মধ্যপলীয় বা মধ্য প্রস্তর যুগ Mesolithic or Middle Stone Age

পুরোপলীয় ও নবোপলীয় যুগের মধ্যবর্তী সময়ে যে অপেক্ষাকৃত স্বল্পকাল স্থায়ী যুগের সূচনা হয় তা মধ্যপলীয় যুগ নামে খ্যাত। অর্থাৎ প্রায় দশ হাজার বছর পূর্বে সর্বশেষ বরফযুগের অবসান হয়, বরফ যুগের অবসানের পর এবং নবোপলীয় যুগের পূর্বে যে যুগের অবতারণা হয় তাই মূলত মধ্যপলীয় যুগ নামে পরিচিত।
মোটামুটি দশ হাজার খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ হতে সাত হাজার খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত ছিল, পুরোপলীয় শিকারি যুগ ও নবোপলীয় কৃষি যুগের মাধবর্তী সময়ের মধ্যপলীয় যুগের সময়কালের ব্যাপ্তি। এযুগকে আবার মেসোলিথিক বা মধ্য প্রস্তর যুগ নামেও আখ্যায়িত করা হয়।
পি.কে. হিট্টি (P. K. Hitti) ১২০০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ হতে পরবর্তী ৬০০ বছরকে মধ্যপ্রস্তর যুগ বলে উল্লেখ করেছেন। মধ্যপলীয় ও পুরোপলীয় যুগের অনেক বৈশিষ্ট্যই মূলত দৃষ্টি গোচরীভূত হয়েছে। যেমন- গুহায় বসবাস করা, মৃতের সৎকার করা, হার্পুন দিয়ে মাছ ধরা ইত্যাদি। এ দু'যুগের মধ্যে যেমন সাদৃশ্য ছিল আবার তেমনি পার্থক্যও ছিল।
বস্তুত, মধ্যপ্রস্তর যুগ হলো প্রাচীন প্রস্তর যুগের উপসংহার স্বরূপ। খাদ্য উৎপাদকের ভূমিকায় এ যুগের মানুষ মূলত তখনও অবতীর্ণ হতে পারেনি। এ সময়কার হাতিয়ারগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকায়, মসৃণ ও সহজে ব্যবহার উপযোগী।
সুতরাং বলা যায় যে, মধ্যপ্রস্তর যুগের প্রাপ্ত নিদর্শনসমূহ যথাক্রমে অন্ন বা খাদ্য, পশু-পালন, বাসস্থান, বিভিন্ন হাতিয়ার, শিল্পকলা ইত্যাদি পর্যালোচনার মাধ্যমেই মূলত সে যুগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় ফুটে ওঠে।
মধ্যপলীয় যুগ বা মধ্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য Characteristics of Mesolithic or Middle Stone Age
এ যুগে প্রাকৃতিক পরিবেশে মৎস্য শিকার, পশু-পালন ও কৃষি উন্নয়ন সম্ভব হয়েছিল। মধ্য প্রস্তর যুগের জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের জীবন যাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। নব্য প্রস্তর যুগের অনেক বৈশিষ্ট্যই মধ্য প্রস্তর যুগে সূচনা হয়েছিল। মধ্য প্রস্তর যুগের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো-
১. খাদ্য (Food) : মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষ ছিল মূলত খাদ্য সংগ্রহকারী। এ যুগের মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল মাছ ও মাংস। এছাড়াও পশু শিকারের পাশাপাশি কিছু লতা-পাতা ও শিকড়-বাকড়কে তারা সুনির্দিষ্টভাবে খাদ্য হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। মাছকে শুঁটকি করে তা দুর্দিনের জন্য রেখে দিত। মাছের মধ্যে শীল মাছ, স্যামন মাছ ও ট্রাউট ছিল পছন্দের তালিকার শীর্ষে। মাছ ছাড়াও তারা বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী আহার করত।
২. পোশাক-পরিচ্ছদ (Clothing) : মধ্য প্রস্তর যুগে মানুষ লজ্জা নিবারণের জন্য পশুর চামড়া ও গাছের বাকল ব্যবহার
করত। আবার শীত নিবারণের জন্য পশুর চামড়া, হাড়ের সুঁচ দ্বারা জোড়া দিয়ে বড় করে পরিধান করত।
৩. বাসস্থান (House) : মধ্যপলীয় যুগের মানুষ ছিল আধা যাযাবর, আধা স্থায়ী। এ যুগের মানুষ মূলত দু'টি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি শাখা নদী ও সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল এবং অপরটি ভূমিতেই মূল অবস্থান সুদৃঢ় করে। ডাল, বাকলের কুঁড়েঘর তৈরি করে বসবাস মূলত এ মধ্য প্রস্তর যুগেই শুরু হয়।
৪. ঘর (Room) : মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষ মূলত ডালপালা, ঘাস ও পাতা দিয়ে ঘর তৈরি করে বসবাস করত। ঘর তৈরির খুঁটি মাটির নিচে কিছু অংশ পুঁতে গাছের লতা দিয়ে এবং বড় বড় পাথর দিয়ে সেগুলোকে খাড়া করে রাখার ব্যবস্থা করা হতো। এছাড়াও ছন জাতীয় উদ্ভিদের সাথে গাছের ডালপালা ও লতা দিয়ে বেঁধে ঘর নির্মাণ করা হতো ।
৫. হাতিয়ার (Tools) : এ যুগের মানুষ তাদের পূর্বের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নব নব পর্যায়ের সূক্ষ্ম প্রস্তরের হাতিয়ার নির্মাণে যত্নবান হয়। এ যুগের নিদর্শন স্বরূপ অনেক হাতিয়ারের সন্ধান মিলেছে। এ যুগে পাথরের হাতিয়ারগুলোকে বলা হতো মেসোলিনিক বা মাইক্রোলিথ বা ক্ষুদ্রাকায় পাথরের হাতিয়ার। পশুর চামড়া ছাড়ানোর জন্য ম্যাগলেমো ফিরান নামক ধারালো পাথর ব্যবহার করা হতো। এ যুগে এ যাবৎকালে প্রাপ্ত হাতিয়ারগুলো হচ্ছে— বাটালি, তীর-ধুনক, প্রস্তর নির্মিত কুঠার, চাচাই, করাত, কাস্তে, ম্যাটক কোদাল (মাইক্রোলিন), ক্ষুদ্রাকৃতির ফলা (পশুর হাড় ও প্রস্তর নির্মিত), কাঠের হাতলযুক্ত বর্শা, কাঠের হাতলযুক্ত চাকু এবং হরিণের শিং-এর গোড়ার খুলি থেকে প্রস্তুত খনন কাজের জন্য কোদাল জাতীয় হাতিয়ার।
৬. মৎস্য শিকার (Fishing) : মধ্য প্রস্তর যুগে মাছ ধরার বড়শি, জাল, ফাঁদ, বর্শা বা ত্রিশুল ব্যবহার করা হতো। তারা গাছকে গোল করে কেটে ‘ক্যানু' তৈরি করে, সেটি দিয়ে মাছ শিকার করত। সুতরাং এযুগে মৎস শিকারের জন্য হাতজাল, বড়শি ও হার্পন ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো।
৭. পশু পালন (Cattlerearing) : মধ্যপ্রস্তর যুগে 'কুকুরই" প্রথম গৃহপালিত পশু ছিল। ক্ষুধা নিবারণ করার জন্য কুকুর বন ছেড়ে মানুষের আস্তানার কাছে এসেছিল। পর্যায়ক্রমে মানুষ এগুলোকে বশে এনে বসতি পাহারা দেওয়ার কাজে ব্যবহার শুরু করে।
৮. শিল্পকলা (Art) : এ যুগের শিল্পকলায় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছিল মৎস্য শিকারের নানা প্রকার হাতিয়ার, হরিণের আকর্ষণীয় শিং সম্বলিত মস্তক এযুগের চিত্রকলায় জ্যামিতিক নকশা লক্ষ করা যায়। এ জন্য প্রাপ্ত চিত্রকলায় তিনকোণ, চারকোণ ও বৃত্তাকার আঙ্গিকের প্রাধান্য বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। পশুর দাঁত ও ঝিনুকের নানা অলংকার সামগ্রীও এ যুগের উল্লেখযোগ্য শিল্প নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
৯. সামাজিক জীবন (Social life) : মধ্যপলীয় যুগের মানুষ পূর্বের মতোই সমাজবদ্ধ ছিল। তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে বসবাস করত। আন্তঃ ও আন্তঃদলীয় সম্পর্ক ভালো ছিল। একে অপরের বিপদে-আপদে সাহায্য সহযোগিতা করত। অস্ত্রশস্ত্র ও প্রাপ্ত খাদ্য সামগ্রী বিনিময়ের রেওয়াজ ছিল।
১০. মৃতদেহ সমাধিস্থকরণ (Dead bodies were buried) : মধ্য পলীয় যুগে মানুষ মৃত দেহকে মাটির নিচে পুঁতে রাখত ।
ধারণা করা হয় যে, পচাগলা মৃতদেহের দুর্গন্ধ ও বিভৎসরূপ হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য মৃতের সমাধিস্থকরণ করা হতো। এ যুগে গণ সমাধিকরণ রীতি প্রচলিত ছিল এবং কোনো কোনো সমাধি হতে একাধিক মাথার খুলি আবিষ্কৃত হয়েছে।
১১. ধর্ম ও জাদু বিদ্যার প্রভাব (Influence of Riligion and Magic) : মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষ ধর্ম ও জাদু বিদ্যায় ব্যাপক বিশ্বাসী ছিল। বস্তুভক্তি, পূর্ব-পুরুষ পূজা, সর্বপ্রাণবাদ ও মহাপ্রাণবাদ ছিল ধর্মীয় মূল দিক। এছাড়াও মধ্যপ্রস্তর যুগের মানুষেরা আগুনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে পোশাক-পরিচ্ছদ ও গহনার ব্যবহার বাড়ায় এবং ব্যক্তি বিশেষের সম্পত্তির ধারণার বিকাশ ঘটায় ।
1
তাই বলা যায় যে, মধ্য পলীয় যুগের ভিত্তির উপর গড়ে ওঠে নব পলীয় যুগের বৈপ্লবিক অগ্রগতির সোপান।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]