নব্যপ্রস্তর/ নবোপলীয় যুগের সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা কর । Discuss the social and cultural characteristics of Neolithic age.

নব পলীয় বা নব্য প্রস্তর যুগ Neolithic Age
নব্যপ্রস্তর যুগের ইংরেজি প্রতিশব্দ Neolithic । শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ থেকে। গ্রিক শব্দ Neo (নব্য নতুন) এবং Lithas (পাথর) এর সমন্বয়ে Neolithic শব্দটির সৃষ্টি। বিখ্যাত ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিক Sir John Lubbock ১৮৬৫ সালে প্রথম Neolithic শব্দটি ব্যবহার করেন। প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতির শেষ ধাপ হিসেবে নব্য প্রস্তর যুগ মানব সভ্যতার ভিত রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মধ্য প্রস্তর যুগের অবসানের পর এ যুগের সূচনা হয় ।
পণ্ডিতদের মতে খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে তামার ব্যবহার মানুষের মধ্যে লক্ষ করা যায়। সে হিসেবে এ সময়কালকে প্রাচীন মানব সভ্যতার ইতিহাসে তাম্রযুগ বলে অভিহিত করা হয়। আনুমানিক ৮০০০-৩৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব অব্দের মধ্যে নিকট প্রাচ্যে নব্য প্রস্তর যুগের প্রথম বিকাশ ঘটে। অতঃপর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং অবশেষে খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে ইংল্যাণ্ডে এ যুগের সূচনা হয়। এ যুগের প্রধান কৃতিত্ব হলো মসৃণ, হালকা কিন্তু অধিক কার্যক্ষম যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার, কৃষি আবিষ্কার ও স্থায়ী গ্রামীণ জীবনের সূত্রপাত, পশু পাখি গার্হস্থ্যকরণ এবং মৃৎ শিল্পের উৎপাদন। এ যুগে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে আসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বস্তুত প্রাগৈতিহাসিক যুগে কৃষি আবিষ্কারই ছিল মানব জাতির সর্বাপেক্ষা বড় সাফল্য।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নব্য প্রস্তর যুগের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। তন্মধ্যে মেসোপটেমিয়ার টেলহাসুনা, প্যালেস্টাইনের জেরিকো, উত্তর ইরান, পাকিস্তানের বেলুচিস্থান, তুরস্কের কাভাল হুইউক, ককেশাস অঞ্চল, মিশর, গ্রিসের আর্গিসা মাধুলা, দানিয়ুব উপকূল, সার্বিয়া চীনের পীত নদী তীরবর্তী ইয়াংশাও ও লুংশনে ইত্যাদি নামগুলো উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের সীতাকুণ্ডেও নব্য প্রস্তর যুগের একখানি পাথর আবিষ্কৃত হয়েছে। বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক Gordon Child খাদ্য আহরণ পর্যায় থেকে কৃষি কাজ বা খাদ্য উৎপাদনের পর্যায়কে নব্য প্রস্তর যুগের বিপ্লব (Neolithic Revolution) হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তাই বলা যায়, সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসে নব্য প্রস্তর যুগ একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়।
বগলীয় বা নব্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য Characteristics of Neolithic Age
নবা প্রপ্তর যুগে খাদ্য উৎপাদনকারী মানুষ হিসেবে তাদের জীবনে এক মৌলিক রূপান্তর ঘটে। নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ শত বছরের তুলনায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিভিন্ন দিক দিয়ে অভাবনীয় উন্নতি সাধন করে। নব্য প্রস্তর যুগের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের জন্য প্রত্নতত্ত্ববিদ গর্ডন চাইন্ড (Gordon V. Child) এ যুগকে मন পণীয় বিপ্লব নামে অভিহিত ক
সভ্যতার অগ্রগতিতে নবপলীয় যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ-
১. পৃথি (Agriculture) । নব্য পাঘনের যুগের সর্বাপেক্ষা যুগান্তকারী ঘটনা হলো কৃষি কাজ। অরণ্যচারী শিকারি জীবন ও ফলমূল আহরণে ব্যস্তজীবনকে দূরে সরিয়ে রেখে এ যুগের মানুষেরা কৃষি কাজে আত্মনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, গম ও বানিই হচ্ছে প্রাচীনতম কৃষিজাত ফসল। কালক্রমে অন্যান্য ফসলের চাষ করতেও তারা এগিয়ে আসে। কৃষির সূচনা নারীর হাতে হলেও এর উৎকর্ষে নিয়োজিত হয় পুরুষ। গম, বার্লি ছাড়াও এ যুগে উৎপাদিত ফস হলো- মটরশুঁটি, ডাল, কাউন, জোয়ার, মিষ্টি আলু, ভুট্টা, সীম, বরবটি, লাউ, নারকেল, বেঙ্গুর, জলপাই, ডুমুর, আঙ্গুর এবং অসংখ্য লতাপাতা, শাক-সবজি ইত্যাদি। তাই বলা যায়, এ যুগে কৃষির আবিষ্কার মানুষের খাদ্যের অনিশ্চয়তা দূর করে এবং এক শ্রেণির মানুষ অবকাশ পায়। অবকাশকালীন সময়ে তারা বিভিন্ন সৃষ্টিধর্মী কাজে এগিয়ে আসে এবং সভ্যতার সূর্য উদিত হয়। এ প্রসঙ্গে ফিলিপ নীরাফল যথার্থই বলেছেন, “When villages began evolving into cities. civilization was born."
২. শত পালন (Pastoral) : পশু পাখিকে বশ মানানো নব পলীয় যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ যুগে কুকুর সর্বপ্রথম গৃহপালিত পশুতে পরিণত হয়। অভিজ্ঞ জনদের মতে, শিকার যুগে ধৃত পশুর বাচ্চা হত্যা না করে, পোষ মানানো হতো। এ থেকেই পরবর্তীকাল পশু পালনের সূত্রপাত হয়। এ যুগে পশুর দুধ, মাংস এবং পাখির ডিম বহুলাংশে তাদের খাদ্যের অনিশ্চয়তা দূর করে এবং চামড়া বস্ত্রের চাহিদা মেটায়। তদুপরি পরিবহন, ভূমি কর্ষণ, পত সংগ্ৰহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে পশুর ব্যবহার ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ যুগে গৃহপালিত পশুর মধ্যে ছাগল, ভেড়া, শুকর, গরু, ঘোড়া, গাধা, মহিষ ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় হাতিকেও গৃহপালিত করা হয়েছিল বলে প্রমাণ মেলে ।
৩. বাসস্থান (Ilouse) : পুরোপলীয়, মধ্যপলীয় এবং নব পলীয় যুগের প্রথম দিকেও মানুষ বৃক্ষচারী ও গুহাবাসী ছিল। তাই তারা অরণ্য প্রকৃতির গুহাবাস ত্যাগ করে উন্মুক্ত স্থানে বাকল, বৃক্ষ শাখা, পত্র, পল্লব, লতাগুল্ম ইত্যাদি দিয়ে কুটির রচনা করার কৌশল উদ্ভাবন করে।
৪. উন্নত হাতিয়ার উদ্ভাবন (Development of tools) : নব্য প্রস্তর যুগের হাতিয়ার অধিক মসৃণ, ধারালো, হালকা ও কার্যকরী করে তৈরি করা হতো। নব পলীয় যুগের মানুষরা ধারালো ও মসৃণ হাতিয়ার তৈরি করতে থাকে। নব পলীয় যুগের পাথর দ্বারা পাথর ভেঙে সহজে ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ার তৈরি করতে থাকে। এ যুগে পাথর দ্বারা পাথর ভেঙে সহজে ব্যবহারযোগ্য উন্নত হাতিয়ার তৈরি করা হয়। নব্য প্রস্তর যুগের হাতিয়ার ও উপকরণাদির মধ্যে- পাথরের কুড়াল, কোদাল, মাটির পাত্র, সুতা কাটা চরকা, তাঁত, বাঁশ ও বেতের ঝুড়ি, গম ভাঙার যাতা, রুটি, উন্নত ধরনের নৌকা, চাকু, কাস্তে, গাঁইতি, বর্ণা, তীর ধনুক, সুচ, বাটালি, ছেনি, নিড়ানি, লাঙল ইত্যাদির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৫. শিল্পকলা (Art); নব্য প্রস্তর যুগে চিত্র লিপি সৃষ্টিরও প্রচেষ্টা হয়েছিল বলে অনেক পণ্ডিত মনে করেন। নব্য প্রস্তর যুগের স্থাপত্যকে মেগালিথ (Megalith) বলা হয়। আবিষ্কৃত ডলমেনকে (Dolmen) সভ্যতার প্রাথমিক স্তরের স্থাপত্য বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। সুতরাং নব পলীয় যুগের শিল্পীরা স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, অংকন প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাপক দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষী রেখেছেন।
তামার আবিষ্কার (Invention of Copper) : নব্যপ্রস্তর যুগের শেষার্ধে তামা আবিষ্কৃত হয়। এতে হাতিয়ার নির্মাণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। প্রাচীন মিশরীয়, সুমেরীয় ও সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীরা তামার হাতিয়ার ও অন্যান্য দ্রবাদি ব্যবহার করত। এভাবেই সূত্রপাত ঘটে ধাতু সভ্যতার।
৭. ভাষার উদ্ভব (Innovation of Language) : নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ মনের ভাব প্রকাশের জন্য কথা বা ভাষার ব্যবহার শুরু করে। এ যুগে কথা ভাষার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিল। এ ছাড়াও এ সময় জীবিকা বিষয়ক ও শিক্ষামূলক লোক সাহিত্যেরও (গীত, গাথা, বচন, গল্প-গুজব) প্রচলন হয় ।
৮. চাকার আবিষ্কার (Invention of Wheel) : এ যুগের চাকার আবিষ্কার কাজের গতিকে বৃদ্ধি করে দিয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে মেসোপটেমিয়া ও সিরিয়ায় ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তুরস্ক ২০০০ খ্রিষ্টপূর্ব অব্দে ক্রিট ও এশিয়া মাইনরে এবং ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্ব অব্দে মিশরে চাকার ব্যবহার শুরু হয় বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। চাকার আবিষ্কারের ফলে মৃৎপাত্র তৈরি, মৃৎপাত্রের ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি, উৎপাদন বৃদ্ধি, পণ্য মালামাল ও যাতায়াত সহজতর হয়েছিল। যুদ্ধরণে, রণকৌশলে ও শিল্পের বিকাশে ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বস্তুত চাকা যে সকল সভ্যতার অন্যতম ভিত্তি তা সহজেই অনুমেয় ৷
৯. মৃৎ শিল্পের বিকাশ (Development of Pottery) : নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র তৈরি করে উদ্বৃত্ত ফসল সংরক্ষণ, রন্ধন কার্য, খাদ্য ও পানীয় সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজে ব্যাপক ব্যবহার করে। এসব মৃৎপাত্র বিভিন্ন রঙের ও ডিজাইনের মৃৎপাত্র এবং এগুলোর গায়ে অংকিত নারীমূর্তি, জীবজন্তুর ছবি, আলপনা ইত্যাদি নব্য প্রস্তর যুগের মৃৎ শিল্পের পরিণত বিকাশের সাক্ষ্য বহন করে। নব্যপ্রস্তর যুগের মৃৎপাত্র দেখে Graham Clarke বলেন, “তাদের মাটির পাত্রের গঠন প্রকৃতি, পোড়ার ধরন, রং ব্যবহার এবং কারুকার্য নিঃসন্দেহে একটি নতুন যুগের সূচনা করে।
১০. আগুনের ব্যবহার (Use of fire) : বজ্রপাত, দাবানল ইত্যাদি ভাবে সৃষ্ট আগুন মানুষ প্রাচীন ও মধ্য প্রস্তর যুগেই কাজে লাগায় । কিন্তু কৃত্রিম পদ্ধতিতে আগুন জ্বালানোর কৌশল আয়ত্ত এবং এর ব্যাপক ব্যবহার নব্য প্রস্তর যুগের অর্জন। এ যুগে মানুষ পাথর দ্বারা পাথর ঘসে বা কাঠে কাঠ ঘষে আগুন জ্বালাবার কৌশল উদ্ভাবন করে। আগুন আবিষ্কারের ফলে মানুষের খাদ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। কাঁচা মাংসের পরিবর্তে মাংস ঝলসে খাওয়া শুরু হয়। এতে তার দৈহিক পরিবর্তন ছাড়াও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। মৃৎপাত্র তৈরি। খাদ্যসিদ্ধ বা ঝলসান, শীত নিবারণ, বন্য জীবজন্তু তাড়ানো, অস্ত্র তৈরি ইত্যাদি কাজে তৎকালীন মানুষ আগুনের সফল ব্যবহারে সক্ষমতা অর্জন করে। ফলশ্রুতিতে মানব সমাজ আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে।
১১. বয়ন শিল্পের উন্নয়ন (Development of weaving industry ) : নব্যপ্রস্তর যুগে তাঁত বা বয়ন শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। মিশর ও পশ্চিম এশিয়ায় বয়ন শিল্পের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। নবপলীয় যুগে ফাইয়ম হ্রদের উভয় তীরে প্রচুর শনের চাষ হতো এবং এই শনের সুতা দিয়ে লিনেন কাপড় তৈরি হতো। পরবর্তীতে মেসোপটেমিয়ায় ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ভেড়ার লোম থেকে পশমি সুতা তৈরি করা হতো এবং উলের কাপড় বানাত। এই উলের কাপড় শীত নিবারণের জন্য প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার হতো ।
১২. প্রযুক্তির উদ্ভাবন (Invention of technology) : নবপলীয় যুগে সেচ ব্যবস্থা, পানি নিষ্কাশন, নদীর পানির গতি পরিবর্তন,
জমিতে সার প্রয়োগ, খাল খনন ইত্যাদি বিষয়ক কৃষি প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটে।
১৩. শ্রম বিভাজন (Division of labour) : নব পলীয় যুগে ব্যাপক শ্রমবিভাজনের বিস্তৃতি ঘটে। এ যুগে সকল গৃহস্থ পরিবারই সংসারের যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করত। তবে পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে কাজের বিভাজন ছিল বলে জানা যায়। এ যুগে পুরুষরা হাতিয়ার তৈরি, পশুপালন, শিকার, ঘরবাড়ি তৈরি ও কৃষি কাজ করত। নারীরা ফসল সংরক্ষণ, বস্ত্র, বয়ন, মৃৎপাত্র তৈরি, সন্তান প্রতিপালন ও ঘর কন্যার কাজে ব্যস্ত থাকত ।
১৪. যাদুবিদ্যা ও ধর্ম (Magic and Religion) : নবপলীয় বা নব্য প্রস্তর যুগে রোগ-শোক, মৃত্যু, মৃত্যু পরবর্তী জীবন। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় কীট-পতঙ্গ ও জীবজন্তুর হাত থেকে নিজেদের জীবন ও ফসল রক্ষা, শিকার, যুদ্ধ জয়, শুভ-অশুভ ধারণা, আত্মা-প্রেতাত্মায় বিশ্বাস ইত্যাদি বিষয় থেকে যাদুবিদ্যা ও ধর্ম বিশ্বাস প্রবল হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে অনুসন্ধানকারী Knud Rasmussen বলেছেন, “We do not believe, we fair." নবপলীয় যুগের দলপতি, রাজা ও ধর্মগুরুরা তাঁদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য, এ যুগের সহজ ও সরল মানুষের মনে, নানা ধরনের ধর্মীয় কুসংস্কার ও বিভ্রান্তির জন্ম দেয়।
১৫. সামাজিক স্তরভেদ (Social stratification) : নবপলীয় যুগে দাস ব্যবস্থায় গোড়াপত্তন ঘটেছিল। এযুগে দলপতির আবির্ভাব, যুদ্ধে পরাজিতদের দাসে পরিণতকরণ, ধর্মগুরু ও অভিজাত শ্রেণি সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে সমাজে শোষক-শোষিত বা প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। ক্ষমতা (Power), ধন-সম্পত্তি (Property) এবং মর্যাদা (Prestige Co কেন্দ্র করেও সামাজিক স্তরভেদ প্রকট হয়ে ওঠে।
১৬. অলংকার ও প্রসাধনী দ্রব্য (Ornaments and Cosmetics) : নবপলীয় যুগের মানুষ অবসর ও বিনোদনে ব্যাপক সময় গেত। তাই নারী-পুরুষ উভয়ই সাজ-সজ্জার দিকে বেশি সময় দিত। নব্য প্রস্তর যুগে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই পাথর, পুঁতি ও হাঁড়ের তৈরি গহনা পরত। মেয়েরা হাতে, পায়ে, গলায় পুঁতির তৈরি মালা পড়ত আবার কখনো কখনো হাতে বালা পড়ত, সাথে লকেটও পড়ত। মেয়েরা চুলের বেনি, নানা রকম কেশ বিন্যাস করে কখনো-বা খোপাত্ত করত। পশু পাখির দাঁত ও হাঁড় দিয়ে অলংকার বানাত। এ যুগে গুড়া সুরমা ও কাজলের ব্যবহার ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেছেন। ১৭. ব্যবসা-বাণিজ্যিক তৎপরতা (Commercial activities) : নবপলীয় যুগে, নিকট ও দূরবর্তী স্থানের সাথে ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ যুগে, তামার অস্ত্র-শস্ত্র ও যন্ত্রপাতি, পশু, নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য, উদ্বৃত্ত খাদ্য শস্য ইত্যাদি সংগ্রহ ও বিনিময় করা হতো। এভাবেই তৎকালীন মানুষের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
১৮. পালতোলা নৌকার ব্যবহার (Use of Boats under Sail) : খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৩০০০ অব্দে মিশরে পালতোলা নৌকার ব্যবহার ছিল। এ সময় ভূমধ্য ও আরব সাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরে বৃহৎ আকৃতির পালযুক্ত নৌকা চলাচল করত। পালযুক্ত নৌকার ব্যবহার ছিল নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠকীর্তি। তাই বলা যায়, নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ নৌযানের উন্নতি ঘটায় এবং নৌকায় পালের ব্যবহার শুরু করেছিল।
১৯. পরিবারের উৎপত্তি (Origin of Family) : নবপলীয় যুগে 'ক্ল্যান' ছিল সমস্ত সম্পত্তির মালিক। আর এ ক্ল্যান প্রথা ভাঙনের মধ্য দিয়ে পরিবার প্রথার উদ্ভব ও বিকাশ সাধিত হয়েছিল। ক্ল্যান সর্দার অধিবাসীদের মধ্যে ফসল উৎপাদন করার জন্য জমি বণ্টন করে দিত। ফলে যৌথ শ্রম ব্যবহার বিলুপ্তি হয়ে পারিবারিক শ্রমব্যবস্থার প্রচলন হলো। এভাবেই ক্ল্যান ব্যবস্থা ভেঙে পরিবারের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে ।
২০. বিবাহ ব্যবস্থার উদ্ভব (Origin of Marriage) : নবপলীয় যুগে বিবাহ ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে। এ যুগে প্রধানত দু'ধরনের যথা— বহুগামিতা ও এক গামিতা বিবাহের প্রচলন ছিল। বহুগামিতায় স্ত্রীর সংখ্যা একাধিক অথবা পুরুষের সংখ্যাও একাধিক হতে পারে। বহুগামিতার জন্যই নবপলীয় যুগে জনসংখ্যা দ্রুত বেড়েছে বলে ঐতিহাসিকগণ মন্তব্য করেছেন। অতিমাত্রায় যৌন জীবনের নিয়ন্ত্রণের জন্য একগামিতা চালু হয়। সুতরাং মধ্যপ্রস্তর যুগই হচ্ছে বিবাহ ব্যবস্থা উদ্ভবের চূড়ান্ত পর্যায় । সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন (Social and Political Organization) : নবপলীয় যুগে স্থায়ী দলপতি নির্বাচনের জন্যই রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। এছাড়া নদী দ্বারা সৃষ্ট নতুন চরের ভূমি দখল, জমির মালিকানা, অন্যান্য বণ্টন নীতিমালা ও নিয়ম-কানুনের প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় রাজনৈতিক সংগঠনের গোড়া পত্তন হয়েছে বলে অনেক তাত্ত্বিক মনে করেন। এ প্রসঙ্গে গর্ডন চাইল্ড যথার্থই বলেছেন, রাষ্ট্র উদ্ভবের পেছনে কৃষির ভূমিকাই প্রধান।
২১ পরিশেষে বলা যায় যে, নব্যপ্রস্তর যুগ হলো, প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতির শেষ ধাপ। সভ্যতা ও সংস্কৃতির অগ্রযাত্রায় নব্যপ্রস্তর যুগ নিঃসন্দেহে মানব জাতির জন্য অন্যতম মাইলফলক। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, প্রায় ৩৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তাম্র যুগের অবসান ঘটে । বস্তুত, এ সকল বৈশিষ্ট্যই এ যুগকে ক্রমশ প্রায়-ইতিহাসিক যুগে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
২.১১ প্রাচীন প্রস্তর যুগ ও নব্য প্রস্তর যুগের মধ্যে পার্থক্য
Differences between Palaeolithic Age and Neolithic Age
বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী, সমাজ ঐতিহাসিক এবং নৃবিজ্ঞানীগণ আদিম স্তরের মানুষ ও তাদের সমাজের নানা অজানা তথ্য উদ্ঘাটনে সচেষ্ট রয়েছেন। প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শনসমূহ তাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যেসব মতামত দিয়েছেন সেগুলোর আলোকে আদিম সমাজকে প্রধানত দুটো স্তরে বিশ্লেষণ করা যায়। যেমন-
১. প্রাচীন প্রস্তর যুগ এবং
২. নব্যপ্রস্তর যুগ ।
প্রত্নতাত্ত্বিক এ যুগ বিভাগ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াবলির ওপর ব্যাপক কৌশল আবিষ্কার করে। কারণ হাতিয়ার তৈরি উপকরণ ও কৌশলের পরিবর্তনের সাথে সাথে উৎপাদন কৌশল পরিবর্তিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও বদলে গেছে। এর প্রেক্ষিতে সমাজব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। যাহোক, নিম্নে প্রাচীন প্রস্তর যুগ ও নব্যপ্রস্তর যুগের মধ্যে পার্থক্যসমূহ উল্লেখ করা হলো-
১. প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ ছিল যাযাবর প্রকৃতির অর্থাৎ তাদের কোনো স্থায়ী বাসস্থান ছিল না। অন্যদিকে নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ যাযাবর জীবন ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিল। কারণ তাদের স্থায়ী বাসস্থান ছিল।
২. প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রহকারী, অপরদিকে নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ ছিল খাদ্য উৎপাদনকারী।
৩. প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই বজ্রপাত, দাবানল ইত্যাদিভাবে সৃষ্ট আগুন সিমিতভাবে ব্যবহার করত। কিন্তু নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ কৃত্রিম পদ্ধতিতে আগুন জালানোর কৌশল আয়ত্ত করেছিল।
৪. প্রাচীন প্রস্তর যুগে রাষ্ট্র নামক সংগঠনের উদ্ভব হয়নি। কিন্তু নব্যপ্রস্তর যুগের শেষ পর্যায়ে ট্রাইব সংগঠন আরও সুদৃঢ় ও সম্প্রসারিত হয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থার গোড়া পত্তন হয়।
৫. প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ কোনোভাবেই প্রযুক্তির উদ্ভাবন করতে পারেনি। অন্যদিকে নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছিল। যেমন- কৃষি প্রযুক্তি, খাল-খনন, সেচ ব্যবস্থা ইত্যাদি ।
৬. প্রাচীন প্রস্তর যুগে নারীদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। কিন্তু নব্যপ্রস্তর যুগে নারীদের পরিবর্তে পুরুষদের কঠোর পরিশ্রম করতে হতো ।
৭. প্রাচীন প্রস্তর যুগে সামাজিক শ্রেণি ভেদাভেদ শুরু হয়নি। অন্যদিকে নব্যপ্রস্তর যুগে সামাজিক শ্রেণিভেদ ছিল।
৮. প্রাচীন প্রস্তর যুগে মানুষ রক্ত সম্পর্কভিত্তিক যূথবদ্ধ জীবন-যাপন করত। অন্যদিকে নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ গোত্র, কেটি, জেন, পরিবার ও ট্রাইবভিত্তিক জীবন-যাপন শুরু করে ।
৯. প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষের মনে অতিপ্রাকৃতিক ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে তারা পূর্বপুরুষ পূজা ও প্রকৃতি পূজা করত। অন্যদিকে নব্যপ্রস্তর যুগে সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ধর্মের আবির্ভাব ঘটে এবং ধর্ম যাজক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল।
১০. প্রাচীন প্রস্তর যুগে মানুষ শব্দ ও আকার ইঙ্গিতের মাধ্যমে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করত। কিন্তু নব্যপ্রস্তর যুগে কথ্যভাষার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে, কেননা এযুগে মনের ভাব প্রকাশের জন্য মানুষ ভাষার ব্যবহার শুরু করে।
১১. প্রাচীন প্রস্তর যুগে তেমন শ্রমবিভাগ সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু নব্যপ্রস্তর যুগে কর্মের ওপর ভিত্তি করে শ্রমবিভাগের সৃষ্টি হয়েছিল। ১২. প্রাচীন প্রস্তরযুগের মানুষ অধিকাংশ সময় গাছের কোটরে ও গুহায় বসবাস করত। কিন্তু নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ এসবের পরিবর্তে কৃত্রিম আবাসস্থল গড়ে তুলে বসবাস করত।
১৩. প্রাচীন প্রস্তর যুগে জনসংখ্যা স্বল্প ছিল এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও কম ছিল। কিন্তু নব্যপ্রস্তর যুগে জনসংখ্যা ছিল বেশি এবং তা বৃদ্ধির হারও ছিল দ্রুত।
১৪. প্রাচীন প্রস্তর যুগে পরিবারের উদ্ভব না হওয়ায় মানুষের মাঝে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়নি। অন্যদিকে নব্যপ্রস্তর যুগে পরিবারের উদ্ভব ঘটে এবং মানুষের মাঝে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়।
১৫. প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আন্তঃগোষ্ঠীর মধ্যে বিনিময় করত। অন্যদিকে নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ এসবের পরিবর্তে ব্যবসায়িক লেনদেন শুরু করে ।
১৬. প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ পাথরের অমসৃণ ভোঁতা, অনুন্নত হাতিয়ার ব্যবহার করত। কিন্তু নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ পাথরের মসৃণ ধারালো এবং উন্নত হাতিয়ার ব্যবহার করত।
১৭. প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষ প্রথমদিকে উলঙ্গ থাকত। পরবর্তীতে তারা গাছের পাতা, ছাল-বাকল, পশুর চামড়া প্রভৃতি লজ্জা নিবারণের জন্য ব্যবহার করত। অন্যদিকে নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ শন, তুলা, ভেড়া ও ছাগলের পশম দিয়ে কাপড় তৈরি করে তা পরিধান করত।
১৮. প্রাচীন প্রস্তরযুগে উত্তরাধিকার প্রথা চালু হয়নি, কারণ এ যুগে সম্পত্তির যৌথ মালিকানা ছিল। অন্যদিকে নব্যপ্রস্তর
যুগে সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্ভব ঘটে এবং উত্তরাধিকার প্রথা চালু হয়।
অতএব বলা যায়, প্রাচীন প্রস্তর যুগে আবিষ্কৃত, অমসৃণ ও স্থল পাথরের অস্ত্র ব্যবহৃত হতো। অন্যদিকে নব্যপ্রস্তর যুগ মানৰ সভ্যতার ভিত রচনাকারী যুগ হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ নব্যপ্রস্তর যুগ হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক কালের মধ্যে অবস্থানকারী যুগ। নব্য প্রস্তর যুগে কৃষির ব্যাপক বিকাশ লাভ হয়েছে। এজন্য এ যুগকে Gordon child নবপলীয় বিপ্লব নামে অবহিত করেছেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুগ হলো প্রাচীন প্রস্তর যুগ। প্রায় ১০ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ হতে ৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কাল প্রাচীন প্রস্তর যুগ বিস্তৃত ছিল। আবার অপর দিকে নব্যপ্রস্তর যুগ ৮০০০-৩০০০ অথবা ৮০০০-৩৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এ যুগ স্থায়ী ছিল। সুতরাং উভয় যুগই ছিল মানব জাতির জন্য আশির্বাদ স্বরূপ ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]