বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীর আলোচনার মাধ্যমে সমাজের প্রকারভেদ নির্ণয় কর। Discuss the different classification of society of different sociologists.

সমাজের প্রকারভেদ Types of Societies
মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা, ভালোবাসা, লাভ-ক্ষতি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে মানুষের যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাকেই সমাজ বলা হয়। সমাজের সাথে মানুষের সম্পর্ক সর্বদা গতিশীল ও পরিবর্তনশীল, অর্থাৎ সমাজকে যদি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয় তাহলে সমাজ বলতে বোঝাবে ইচ্ছাকৃত যেকোনো পারস্পরিক সম্পর্ক। (EVERY willed relatioship of man to man).
যাহোক, বিভিন্ন সমাজচিন্তাবিদরা সমাজকে বিভিন্নভাগে ভাগ করেছেন। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো-
৩.৩.ক হার্বার্ট স্পেন্সারের শ্রেণিবিভাজন
Classification of Hearbert Spencer
সমাজবিজ্ঞানী এইচ স্পেন্সার অতীত ও বর্তমান সমাজের বিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে সমাজকে শ্রেণিকরণ করেছেন। Herbert Spencer সমাজকে ব্যাখ্যা করেছেন সহজ থেকে জটিল প্রক্রিয়ায় রূপান্তর হিসেবে। তিনি জীব দেহের প্রেক্ষাপটে সমাজকে সচেতন সত্তা হিসেবে ধরে নিয়ে বিবর্তনের প্রক্রিয়ার সাথে সঙ্গতি রেখে সমাজের বিকাশ দেখিয়েছেন।
স্পেন্সার মূলত সমাজের আকৃতি, জটিলতা, স্থায়িত্ব, নেতৃত্ব, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের মাত্রা প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে সরল সমাজকে যোদ্ধা সমাজ এবং জটিল সমাজকে শিল্প সমাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
হারবার্ট স্পেন্সারের সমাজের শ্রেণি বিভাজন হচ্ছে-
১. যুদ্ধভিত্তিক সমাজ (Military society) : যুদ্ধভিত্তিক সমাজ ছিল প্রথম পর্যায়ে প্রকৃতির বিরুদ্ধে এবং পরবর্তীতে গোষ্ঠী বা সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। মূলত মানব সমাজের সামাজিক জীবনের প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপিত হয় যুদ্ধ-বিগ্রহকে কেন্দ্র করেই। তাই বলা যায়, সমাজ বিকাশের প্রথম পর্বের সমাজ ছিল চরম অর্থে যোদ্ধা সমাজ। কেননা সমাজের প্রধান লক্ষ্য ছিল, সামরিক উৎকর্ষ অর্জন, যার প্রেক্ষিতে জনগণকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিরক্ষামূলক কাজে নিয়োজিত থাকতে বাধ্য করা হতো। অর্থাৎ এ সমাজের নীতি ছিল আক্রমণাত্মক ও আত্মরক্ষামূলক।
মোটকথা যুদ্ধ ভিত্তিক সমাজ শাসিত হতো চূড়ান্ত ক্ষমতাশালী একচ্ছত্র কর্তৃপক্ষ দ্বারা যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা বিলীন হয়ে গড়ত প্রশাসনিক আধিপত্যের নিকট। .

২. শিল্পভিত্তিক সমাজ (Industrial Society) : যুদ্ধকেন্দ্রিক সকল তৎপরতায় গতিরেখা প্রবাহিত হয় শিল্পায়িত খাতে। এ সমাজে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং আইনগত অধিকারের প্রতি রাষ্ট্রীয় অনুমোদন করা হয়। সমাজ হয়ে পড়ে সহযোগিতামূলক ও শক্তিকামী।
বিবর্তনমূলক স্তরের পরিপ্রেক্ষিতে হার্বাট স্পেন্সার চার ধরনের সমাজ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যথা-
ক. সরল সমাজ (Simple society)
খ, যৌগিক সমাজ (Compound society)
গ. দ্বিগুণ যৌগিক সমাজ (Double compound society )
ঘ. ত্রিগুণ যৌগিক সমাজ (Trebly compound society)
যাহোক শিল্পভিত্তিক সমাজে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি প্রশাসনিক এবং মূল্যবোধগত বৈশিষ্ট্যসমূহের পরিবর্তনের ধারা সঞ্চালিত হতে থাকে।
মোটকথা শিল্পভিত্তিক সমাজ হয়ে পড়ে সহযোগিতামূলক ও শান্তিকামী।
খ লুইস হেনরি মর্গানের শ্রেণি বিভাজন
Classification of L.H. Morgan
লুইস হেনরি মর্গান সমাজের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের স্তরকে প্রথমত তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। নিম্নে এগুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো-
ক. বন্যদশা (Savagery) : এল.এইচ. মর্গান বন্যদশাকে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন, তা হলো-
১. নিম্ন বন্যদশা (Lower savagery) : এ যুগেই মূলত ভাষা স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়। মূলত মানব জাতির শৈশব থেকে এর আরম্ভ, আর এর সমাপ্তি ঘটে যখন মানুষ মাছ আহার করা এবং আগুনের ব্যবহার করতে শেখে। এ পর্যায়ে মানুষ তার আদিম প্রবৃত্তির দ্বারাই চালিত হতো এবং বাদাম ও বিভিন্ন ফল খেয়ে জীবন ধারণ করত।
২. মধ্য বন্যদশা (Middle savagery) : মধ্য বন্যদশা পর্যায়ে, মানবজাতি তাদের আদিম অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মূলত মাছকে আহার্য হিসেবে গ্রহণ ও আগুনের ব্যবহার থেকে এই উপবিভাগের আরম্ভ এবং শেষ হয় তীর ধনুক আবিষ্কারের মধ্যদিয়ে। এ যুগে যেসব গোষ্ঠী আবিষ্কৃত হয়েছিল, তাদের মধ্যে অস্ট্রেলীয় ও পলিনেশীয় গোষ্ঠী অন্যতম। এদের বেশির ভাগ গোষ্ঠীই আবিষ্কৃত হয়েছিল আদিম যুগের মধ্য পর্যায়ে।
৩. উচ্চ বন্যদশা (Upper savagery): হার্ডসন উপসাগরীয় অঞ্চলের অ্যাথাপ্যাঙ্কান গোষ্ঠী, কলম্বিয়া উপত্যকার গোষ্ঠীগুলো এবং উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকায় আরও কিছু গোষ্ঠী যখন আবিষ্কৃত হয়েছিল এই পর্যায়েই। মূলত এ পর্যায়ের আরম্ভ তীর ধনুক আবিষ্কারের মাধ্যমে এবং এর সমাপ্তি ঘটে মৃৎ শিল্প আবিষ্কারের মধ্যদিয়ে।
খ. বর্বরদশা (Barbarism) : L. H. Morgan বর্বর দশাকেও ৩টি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
১. নিম্ন বর্বর দশা (Lower Barbarism) : এ দশায় মৃৎ শিল্পকে আদিম ও বর্বর সমাজের সীমারেখা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বর্বর যুগের প্রথম উপবিভাগের শুরু মৃৎশিল্পের আয়ত্তের সঙ্গে। যেসব গোষ্ঠী মৃৎশিল্পের ব্যবহার সম্বন্ধে অজ্ঞ তাদের আদিম সমাজের পর্যায়ে ফেলতে হবে, আবার যারা এ শিল্পকে আয়ত্ত করতে পেরেছে, কিন্তু ধ্বনি সঙ্গত বর্ণমালা ও লেখার ব্যবহার শিখে নি, তাদেরকে ফেলতে হবে বর্বর সমাজে। এ মৃৎ শিল্প কোনো জনগোষ্ঠী নিজেরা উদ্ভাবন করে থাকুক বা অন্য গোষ্ঠীর কাছ থেকে অনুকরণ করেই শিখে থাকুক। এ পর্যায়ের সমাপ্তি এবং মধ্য পর্যায়ের আরম্ভ সম্বন্ধে নির্ণয় করতে গিয়ে দুই গোলার্ধে দুই সমান্তরাল উন্নয়ন দেখতে পাই। পূর্ব গোলার্ধে ঘটে গৃহ পশু পালন এবং পশ্চিম গোলার্ধে ঘটে জল সেচের মাধ্যমে ভুট্টা ও জবের চাষ। এই সাথে দেখা যায় পোড়া ইট ও পাথর দিয়ে গৃহ নির্মাণ। উদাহরণস্বরূপ- মিসৌরী নদীর পূর্ব তীরের যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীসমূহের কথা বলা যেতে পারে। আবার ইউরো এশিয়ার যেসব গোষ্ঠী কোনো প্রকার গৃহপালিত পশু পালন করত না, কিন্তু মৃৎ শিল্পের ব্যবহার করত তাদের কথা বলা যেতে পারে। মূলত এসব কিছুই হচ্ছে নিম্ন পর্যায় থেকে মধ্য পর্যায়ের বর্বর যুগে প্রবেশের ক্রান্তিকাল মাত্র ।
২. মধ্য বর্বরদশা (Middle Barbarism) : পশুকে গৃহপালিত করার মাধ্যমে পূর্ব গোলার্ধে মধ্য বর্বরদশা পর্যায়ের শুরু হয়। অন্যদিকে জলসেচের সাহায্যে কৃষি কাজ ও গৃহ নির্মাণ ক্ষেত্রে রোদে পোড়া ইট ও পাথরের ব্যবহারের মাধ্যমে পশ্চিম গোলার্ধে এ পর্যায়ের শুরু হয়। আবার দেখা যায়, লৌহ-আকর গলানো আবিষ্কার হবার সাথে সাথে এ পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। এ পর্যায়ের মধ্যে পড়ে নিউ মেক্সিকো, মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা ও পেরুর গ্রামীণ ইন্ডিয়ানরা এবং পূর্ব গোলার্ধের গোষ্ঠীসমূহ যাদের গৃহপালিত পশু ছিল। কিন্তু তারা লৌহ-আকর গলাতে জানত না। আবার আদিম ব্রিটিশরা লোহা গলানোর পদ্ধতি জানত বিধায়— তারাও এ পর্যায়ে পড়ে। উল্লেখ্য যে, পার্শ্ববর্তী বহু ইউরোপীয় গোষ্ঠীই কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ভালো অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল।
৩. উচ্চ বর্বরদশা (Upper Barbarism) : উচ্চ বর্বরদশাতেই মূলত সভ্যতার সূচনা ঘটে। এ পর্যায়ের শুরু হয় লৌহ ও হাতিয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে এবং এ পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে ধ্বনি সমৃদ্ধ বর্ণমালা উদ্ভাবন ও সাহিত্যমূলক রচনা সৃষ্টির মাধ্যমে। উচ্চ বর্বর দশায়, হোমারীয় যুগের গ্রিক গোষ্ঠীসমূহ রোম সাম্রাজ্য স্থাপনের পূর্বের ইতালির সব গোষ্ঠীসমূহ এবং জার্মান গোষ্ঠীসমূহও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
গ. সভ্যদশা (Civilization) : ধ্বনি সমৃদ্ধ বর্ণমালা উদ্ভাবন ও সাহিত্য সৃষ্টির সাথে সাথে সভ্যদশার উদ্ভব ঘটে। সভ্যদশার সূচনায়, মানুষ লাঙল দিয়ে চাষ করত এবং চাকাযুক্ত শকট ও পালতোলা নৌকা চালাত । সভ্য যুগকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা প্রাচীন ও আধুনিক। পাথরের গায়ে লিখিত হায়ারোগ্লিফিক পদ্ধতির লেখার চেষ্টা থেকেই সভ্যতার সূচনা ঘটেছিল। যেহেতু প্রাচীন যুগ ছিল মানুষের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিস্তারের যুগ। তাই সভ্যতা মূলত তার পূর্ববর্তী বর্বর যুগের উদ্ভাবন, আবিষ্কার রীতি ও প্রতিষ্ঠান উদ্ভূত। যাহোক আধুনিক যুগ বলতে, বিজ্ঞানের যুগকেই বুঝায়। আর এ যুগের সূচনা হয়েছিল ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে।
গ স্যার হেনরি মেইন ও হাওয়ার্ড-এর শ্রেণি বিভাজন
Classification of Sir Henri Main
স্যার হেনরি মেইন সমাজ গঠনের উপর ভিত্তি করে সমাজকে প্রধানত দু'ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
১. Status বা অবস্থা এবং
২. Contact বা সান্নিধ্য ।
হাওয়ার্ড-এর শ্রেণি বিভাজন : সমাজচিন্তাবিদ হাওয়ার্ড সমাজকে দু'ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
১. পূর্ত (Sacred) সমাজ এবং
২. মৌলিক (Secular) সমাজ
৩.৩.ঘ এন্থনি গিডেন্স-এর শ্রেণি বিভাজন
Classification of Anthony Giddens
সমাজবিজ্ঞানী Anthony Giddens তাঁর A contemporary critique of Historical Materialism' গ্রন্থে সাত ধরনের সমাজের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন-
১. স্থায়ী কৃষি ভিত্তিক সমাজ (Settled agriculture based societies)
২. ক্ষুদ্র সংঘবদ্ধ সমাজ (Bond Societies)
৩. সাম্রাজ্যভিত্তিক সমাজ (Empires based societies)
৪. নগরভিত্তিক সমাজ (City states based societies)
৫. সামন্ত সমাজ (Feudal societies)
৬. পুঁজিবাদী সমাজ (Capitalistic societies) ৭. সমাজতান্ত্রিক সমাজ (Socialistic societies)
৩.৩.৫ রবার্ট র‍্যাডক্লিপ ব্রাউনের শ্রেণি বিভাজন
Classification of Radclip Brown
রবার্ট র‍্যাডক্লিপ ব্রাউন সমাজকে গ্রামভিত্তিক এবং শহরভিত্তিক সমাজ, আবার কার্ল উইট ফোগেল সমাজকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সমাজ হিসেবে ভাগ করেছেন।
কার্ল মার্কস-এর শ্রেণি বিভাজন
Classification of Karl Marx
প্রখ্যাত জার্মান অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী Karl Marx, মানব ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। অর্থনৈতিক উৎপাদনকেই তিনি পরিবর্তনের মৌল উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কেননা, মানব ইতিহাসের সমস্ত ঘটনাবলির পিছনে রয়েছে অর্থনৈতিক কারণ ।
Karl Marx তাঁর ‘A contribution to the critique of Political economy' গ্রন্থে সমাজ বিকাশ সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করেছেন এবং তাঁর Das Capital গ্রন্থে তিনি ‘সমাজ বিকাশ' আলোচনাকে পরিপূর্ণতা দান করেছেন ।
Karl Marx দেখেছেন যে, পাশ্চাত্যের সমাজব্যবস্থা যেভাবে বিকশিত হয়েছে, সে তুলনায় প্রাচ্যের সমাজব্যবস্থা সেভাবে বিকশিত হয়নি। মার্কস সমাজকে শ্রেণিবিভক্ত করণে পাশ্চাত্য সমাজ ও প্রাচ্য সমাজের বিকাশকে ব্যাপক গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তিনি মানব সমাজকে অর্থনৈতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে পাঁচভাগে ভাগ করেছেন। যথা—
১. আদিম সাম্যবাদী সমাজ (Primitive communistic society) - আদিম সাম্যবাদী উৎপাদন প্রণালি ।
২. দাস সমাজ (Slavery society) - দাস নির্ভর উৎপাদন প্রণালি ।
৩. সামন্তবাদী সমাজ (Feudalistic society)— সামন্ত উৎপাদন প্রণালি ।
৪. পুঁজিবাদী সমাজ (Capitalistic society)- পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালি
৫. সমাজতান্ত্রিক সমাজ (Socialistic society) – সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন প্রণালি ৷
৩১২.ছ লেস্কি-এর শ্রেণি বিভাজন/ সমাজের ধরন
Classification of Class of Lenski/ Types of Society
চিন্তাবিদ ও তাত্ত্বিক লেনস্কি এবং লেস্কি (Lenski and Lenski) সমাজের অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করে মূলত সমাজকে পাঁচভাগে ভাগ করেছেন। যেমন-
১. শিকার ও সংগ্রহ সমাজ (Hunting and gathering societies) : শিকার ও সংগ্রহ পর্যায় বলতে মূলত বোঝায় প্রাগৈতিহাসিক কালের জীবনধারণমূলক আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে। নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা আজ হতে দশ হাজার বছর পূর্বে যারা পৃথিবীতে বাস করত তারা আদিম যুগের মানুষ। চতুর্থ হিমযুগ শেষ হলে, আনুমানিক দশ থেকে বারো হাজার বছর পূর্বে মানুষ
বিশ্বের বিভিন্ন অনুকূল ভৌগোলিক স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে আফ্রিকার কেনিয়া, এশিয়ার সিরিয়া, ইসরাইল, প্যলেস্টাইন, লেবানন প্রভৃতি স্থানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ সময় মানুষ প্রথমে অরণ্যচারী। তারা প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল এবং বনজঙ্গলে ঘুরে ফিরে শিকার এবং ফলমূল সংগ্রহ ও আহার করত। তাদের জীবনে বেঁচে থাকার জন্য একমাত্র লক্ষ্য ছিল কিছু খাদ্য সংগ্রহ এবং আহার করা। এ কাজটি তারা ফলমূল সংগ্রহ এবং শিকার করার মাধ্যমে সম্পন্ন করত বলে এ আর্থ- সামাজিক ব্যবস্থাকে শিকার ও খাদ্য সংগ্রহভিত্তিক সমাজ (Hunting and gathering society) বলে অভিহিত করা হয়।
এ প্রসঙ্গে নৃবিজ্ঞানী Beals and Hoijer তাঁদের 'Introduction to Anthropology' শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, “Gathering techniques invoice utilization of the resource of the environment as given without any methods of improving as increase the available supply." এ সময় মানুষ সমাজের ভিত্তি রচনা করে। তারা যূথবদ্ধ হয়ে শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করত। তারা দলবদ্ধ হয়ে বড় কোনো পশুকে তাড়া করে গিরি খাদে ফেলে দিয়ে সহজে শিকার করত। পাথরের ব্যবহার এ সময় পর্যন্ত বেশ বিকশিত হয়েছিল।
পশু শিকারের তীর, মাছ শিকারের হার্পন, হাঁড়ের সুঁচ দ্বারা পোশাক সেলাই, আগুনের ব্যবহার প্রভৃতি এ সময় সভ্যতার ভিত্তিকে মজবুত করে তোলে। মানব জীবনের ৪০ হাজার বছর এরূপ অসহায় অবস্থায় কেটেছে। বর্তমান যুগের এক্সিমো সমাজের আর্থ-সাংস্কৃতিক জীবন পর্যবেক্ষণ করলে শিকার ও সংগ্রহ পর্যায় সম্পর্কে আঁচ করা যায়। এ সমাজব্যবস্থায় মানুষের গৃহকেন্দ্রিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠেছিল। মধ্য ও চূড়ান্ত প্রস্তর যুগ, মর্গানের বন্যদশা, স্পেন্সার, ডুর্খেইমের সরল সমাজ বা আদিম সমাজে শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ ভিত্তিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল।
এ সমাজ ব্যবস্থায় জীবন ছিল "হয় ভূরিভোজ না হয় উপবাস” (Life was either a feast or a fast)। এ সময় মোট খাদ্যের ৪০ শতাংশ পশু ও মৎস্য শিকার হতে এবং ৬০ শতাংশ ফলমূল সংগ্রহ থেকে পূরণ হতো। মোটকথা এ পর্যায়ে শিকারি এবং সংগ্রহকারীদের জীবিকার অবলম্বন ছিল শিকার, মৎস্য শিকার এবং বনের উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত খাবার।
এ সময় থেকে মানুষের গৃহকেন্দ্রিক খাদ্যাভ্যাস (Food habit) গড়ে উঠেছিল। মধ্য ও চূড়ান্ত প্রস্তর যুগ, মর্গানের বন্যদশা (Savagery) স্পেন্সার, ডুর্খেইমের সরল সমাজ বা আদিম সমাজে শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ ভিত্তিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল।
এ সমাজব্যবস্থা প্রসঙ্গে Lenski উল্লেখ করেন, “It is hardly an exaggeration to say that among hunting and gathering peoples, each local community is politically autonomous." অর্থাৎ এটা বললে অতিকথন হবে না যে, শিকার ও সংগ্রহ সমাজের ব্যক্তিবর্গের প্রতিটি স্থানীয় সম্প্রদায় ছিল রাজনৈতিকভাবে স্বশাসিত ।
লেনস্কি আরও বলেন যে, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে সম্পদ অত্যাবশ্যকীয় নয় মূলত সেটুকুই তার উদ্বৃত্ত থাকে। এ থেকে বলা যায় যে, আপেক্ষিক অর্থে হলেও খাদ্য সংগ্রহ ও শিকার সমাজ ছিল সমতাভিত্তিক ।
এখনও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ধরনের সংস্কৃতি লক্ষ করা যায়। যেমন— আফ্রিকায় শুষ্ক অঞ্চল, ব্রাজিলের জঙ্গল এবং নিউগিনিতে বর্তমানে পৃথিবীর ০.০০১ শতাংশ লোক এখনও শিকার ও সংগ্রহ সমাজের অনুসারী।
শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ ভিত্তিক সমাজের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of hunting and gathering society) : এ সমাজব্যবস্থা ছিল উৎপাদন শক্তি বিকাশের সর্বনিম্নস্তর। অর্থাৎ শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ ভিত্তিক সমাজ বলতে মূলত আদিম গোষ্ঠীগত সমাজকেই বুঝায় ।
নিম্নে শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ ভিত্তিক সমাজের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো-
১. সামাজিক সম্পর্ক : এ ধরনের সমাজব্যবস্থায় পণ্ডিতেরা চার ধরনের সামাজিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো— ক. সহযোগিতা, খ. প্রতিযোগিতা, গ. বিনিময় এবং ঘ. দ্বন্দ্ব। তবে শিকার সংগ্রহ পর্যায়ে সহযোগিতা ও বিনিময়ই ছিল অধিক ক্রিয়াশীল ।
২. হাতিয়ার : শিকার সংগ্রহ পর্যায়ের একেবারে গোড়ার দিকে হাত, পা, নখ, দাঁত, শারীরিক শক্তি, গাছের ডালপালা ও আবিষ্কৃত প্রস্তর খণ্ড ছিল জীবিকা ও আত্মরক্ষার উপায়। অবশ্য পরবর্তীতে তারা কিছুটা উন্নত পাথরের হাতিয়ার ব্যবহারে সক্ষমতা অর্জন করে ।
৩. শ্রমবিভাজন : এ পর্যায়ে বয়স ছিল শ্রমবিভাজনের মূলভিত্তি। আবার অনেকের মতে বয়স ও লিঙ্গ উভয়ই ছিল শ্রমবিভাজনের প্রাণ। এ পর্যায়ে শ্রমবিভাজন থাকলেও প্রায় সকল কাজেই নারী ও পুরুষের অংশীদারিত্বমূলক ভূমিকা বিদ্যমান ছিল।
৪. দ্বন্দ্ব-সংঘাত : শিকার সংগ্রহ পর্যায়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রায় অনুপস্থিত ছিল। কদাচিৎ যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দিত তার মূল কারণ ছিল ক্ষমতা ও লিঙ্গ প্রতিযোগিতা।
জীবিকা অর্থনীতি : শিকার সংগ্রহ পর্যায়ের পূর্বে মানুষের জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল জীবিকার সংস্থান। কোনো মতে বেঁচে থাকা বা টিকে থাকাই ছিল তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। অর্থাৎ জীবন ধারণের জন্য শিকার সপ্তাহের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতাই ছিল প্রধান ।
৬. সম্পত্তির মালিকানা: শিকার সংগ্রহের সম্পত্তির মালিকানা ছিল মূলত সামাজিক বা যৌথ। অর্থাৎ এ পর্যায়ে সম্পদ বলতে তেমন কিছু ছিল না।
৭. বাসস্থান পরিবর্তন : এ পর্যায়ের মানুষেরা মূলত খাদ্য প্রাপ্তিতে সংকট সৃষ্টি হলে তারা বাসস্থান পরিবর্তন করে পরবর্তী সুবিধাজনক স্থানে চলে যেত। তাই বলা যায়, এ যুগের মানুষ বৃক্ষ শাখা, বৃক্ষ কোটর, পর্বত গুহা ইত্যাদি স্থানে বসবাস করত এবং নিকটবর্তী স্থানসমূহে শিকার সংগ্রহ চালাত।
৮. বৃদ্ধ লোকের মর্যাদা প্রাপ্তি : শিকার সংগ্রহ সমাজে বৃদ্ধরা অভিজ্ঞতা ও উপদেশ দাতার ভূমিকা পালনের জন্য সম্মানের পাত্র ছিল। বৃদ্ধ জনদের অতি প্রাকৃত শক্তির আশীর্বাদ পুষ্ট বলে মনে করা হতো।
১. সাংস্কৃতিক নমুনা : বস্তুগত সংস্কৃতির পাশাপাশি অর্বাচনিক সংকেত (Non-verbal communication) মৌখিক ভাষার
প্রচলন, শিল্পকলা, জাদু বিদ্যা, ধর্ম ইত্যাদি অবস্তুগত সংস্কৃতি শিকার সংগ্রহ পর্যায়ে বিকশিত হয়েছিল।
১০. যৌথ জীবন : এ পর্যায়ের মানুষ মূলত প্রকৃতি নির্ভর, বিপদসংকুল এবং খাদ্য আহার্য সংগ্রহের অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির পথ হিসেবে গড়ে তুলেছিল যৌথ জীবন ।
পরিশেষে বলা যায় যে, কৃষি অর্থনীতির পূর্বে আদিম মানুষ প্রয়োজন অনুযায়ী হাতিয়ার তৈরি করে শিকার করা, মাছ ধরা এবং ফলমূল সংগ্রহ করে জীবন ধারণের যে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া অবলম্বনের মাধ্যমে যে সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল তাই হচ্ছে মূলত শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ ভিত্তিক সমাজ। তাই বলা হয়ে থাকে যে, সমগ্র মানব জীবনের প্রায় ৪০ হাজার বছর শিকার-সংগ্রহ ভিত্তিক অবস্থায় কেটেছিল।
২. উদ্যান চাষ ভিত্তিক সমাজ (IIorticulture societies) : উদ্যান কৃষি হচ্ছে, কৃষি ব্যবস্থার প্রাথমিক রূপ। পুরুষেরা যখন শিকার, প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য কঠিন কাজে নিয়োজিত থাকত, মেয়েরা তখন ফলমূল, শাক-সবজি, লতা-পাতা ইত্যাদি সংগ্রহ করত। মেয়েরা পুরুষদের তুলনায় কিছুটা স্থিতিশীল ছিল। তাই প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণের সুযোগও তারা বেশি পেয়েছে। মেয়েরা লক্ষ করল যে, ফল খাওয়ার পর বীজটি ফেলে দিলে কীভাবে তা থেকে চারা গজায়। এ চারাই আবার এক সময় ফলবতী বৃক্ষে পরিণত হয় এবং সেখান থেকে তা আহরণ করা যায়। এসব পর্যবেক্ষণ থেকেই মেয়েরা এক সময় উদ্যান কৃষির (Horticulture) সূচনা করে, যা পরবর্তীকালে বিকশিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ কৃষিতে পরিণত হয়। এ জন্যই বলা হয় "Horticulture is going before of agriculture..... agriculture is the invention of women.
সমাজে যখন ক্রমশ মানুষ বৃদ্ধি পেয়েছে, তখনই প্রকৃতিতে ব্যাপকভাবে খাদ্যাভাব অনুভূত হয়েছে। এ জন্য সব সময়ই অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের প্রতি দৃষ্টি দিতে হয়েছে। উদ্যান কৃষিতে মানুষ ব্যাপকভাবে নিয়োজিত হতে সচেষ্ট হয়।
উদ্যান চাষ সমাজকে, কৃষি সমাজে উত্তরণের অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায় বলা হয়ে থাকে। উদ্যান চাষ সমাজকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। সরল উদ্যান চাষ সমাজ এবং উন্নত উদ্যান চাষ সমাজ ।
উদ্যান চাষ সম্পর্কে প্রধানত পণ্ডিত Beals and Hoijer তাঁদের 'An Introduction to Anthropology' গ্রন্থে বলেন, "Horticulture is the term usually applied to cultivation of domesticated plants for food and purposes without the use of plough.” অর্থাৎ সাধারণত খাদ্য সামগ্রির প্রয়োজনে বাড়ির আঙ্গিনায় ও আশপাশে লাঙল ব্যতিরেকে চাষাবাদ উদ্যান কৃষি বলা হয়।
উদ্যান চাষ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় বাড়ির আঙ্গিনা পেরিয়ে আশেপাশের জঙ্গলেও মানুষ আবাদের জন্য হাত বাড়ায়। উদ্যান কৃষি মানুষকে কিছুটা স্থায়ী হওয়ার সুযোগ করে দেয়। ফলে এ সময় পারিবারিক জীবনের ভিত্তি রচিত হয় এবং সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। নৃতাত্ত্বিকদের মতে এ সময় পৃথিবীতে মধ্যপ্রস্তর যুগ চলছিল।
P.K. Hitti তাঁর 'Syria' A Short History' গ্রন্থে ১২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ হতে পরবর্তী ৬০০০ বছরকে মধ্য প্রস্তর যুগ বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৭০০০-৮০০০ বছর পূর্বের সময়কালে উদ্যান কৃষি প্রচলিত ছিল।
আবার অনেক পণ্ডিত মনে করেন, উদ্যান চাষ ভিত্তিক সমাজের (Horticulture Societies) এর অস্তিত্ব লক্ষ করা যায় প্রায় ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্ব মধ্য প্রাচ্যে। পরবর্তীতে এটি বিস্তার লাভ করে চীন ও ইউরোপে, এ সমাজব্যবস্থা এখনও টিকে আছে আফ্রিকার উপসাহরানে।
এল.এইচ. মর্গানের প্রাথমিক বর্বর স্তরের সাথেও এ পর্যায়ের তুলনা করা চলে।
সুতরাং বলা যায়, উদ্যান চাষভিত্তিক সমাজে রোপণ থেকে ফসল আহরণ পর্যন্ত তাদেরকে এক জায়গায় থাকতে হতো, ফলে এ সময় পারিবারিক জীবনের ভিত্তি রচিত হয় এবং সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় ।
~উদ্যান চাষ ভিত্তিক সমাজের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Horticulture Society) : উদ্যান চাষ ভিত্তিক সমাজে মানুষ বৃদ্ধির দরুন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের প্রতি ব্যাপক দৃষ্টি রাখতে হয়েছে। নিম্নে উদ্যান চাষ ভিত্তিক সমাজের বৈশিষ্ট্য আলোচনা
করা হলো-
১. উদ্যান চাষভিত্তিক সমাজে আত্মীয় সম্পর্ক ছিল তাদের খুবই কেন্দ্রীভূত। বিবাহ রীতির ফলে অনেক সময় তারা বহুগোত্রে
বিভক্ত হয়ে পড়ে।
২. জীবিকা নির্বাহের জন্য উদ্যান কৃষি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মানুষ নির্ভর করত হাতওয়ালা কোদাল এবং হস্ত শক্তির উপর। ৩. এ সমাজব্যবস্থায় চারা গাছ রোপণের জন্য যে সব যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় সেসব যন্ত্রপাতি মূলত কাঠের দ্বারা তৈরি। ৪. উদ্যান কৃষিভিত্তিক সমাজে উন্নত ধরনের অর্থনৈতিক জীবন শুরু হয়। কারণ ঐ পর্যায়ে মানুষ অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ত উৎপাদনে
অধিকতর সমর্থ হয়ে ওঠে।
৫. উদ্যান কৃষিমূলক সমাজে মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে অধিকতর খাপ খাইয়ে নেয়ার দক্ষতা অর্জন করে।
এ সমাজের অন্যতম উদ্ভাবন হচ্ছে মৃৎ শিল্প, তাঁত শিল্প ও চর্ম শিল্প। এ পর্যায়ে গৃহ নির্মাণ অধিকতর জটিল রূপ ধারণ করে। 9. এ পর্যায়ে উন্নত ধরনের অর্থনৈতিক জীবন শুরু হয়। কারণ ঐ পর্যায়ে মানুষ অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ত উৎপাদনে অধিকতর সমর্থ হয়ে ওঠে।
৮. উদ্যান চাষ ভিত্তিক সমাজের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রধান দিকসমূহ হলো- নিড়ানি, পশুপালন, মৃৎ শিল্প, চামড়ার কাজ,
ধাতু ও বেতের ব্যবহার ।
এ পর্যায়ে যুদ্ধ-বিগ্রহ একটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের রূপ পরিগ্রহ করে এবং জনসংখ্যা অতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধে পরাজিত জনগোষ্ঠীর গবাদি পশুসহ অন্যান্য ধন সম্পদ বিজয়ী গোষ্ঠীর সম্পত্তিতে পরিণত হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, উদ্যান চাষ ভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ব্যাপক উদ্বৃত্ত উৎপাদন, স্থায়ী বাজার, পূর্ণকালীন পেশা, অর্থনৈতিক অসমতা এবং ব্যাপক মাত্রায় দাস প্রথার সূচনা হয়েছিল। অর্থাৎ এ সমাজের গর্ভ থেকেই জন্মলাভ করে বিপুল খাদ্য উৎপাদনকারী এবং সভ্যতার বীজ বপনকারী কৃষি সমাজ ।
৩. পশু পালন সমাজ (Pastoral societies) : প্রায় বিশ হাজার বছর পূর্বে শিকারি এবং সংগ্রহকারী গোষ্ঠী তাদের গৃহপালিত পশুকে পোষ মানাতে শিখে এবং কৃষি কাজে ব্যবহার করে তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করে
মানব জাতির সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্রমবিকাশের ইতিহাসে পশুপালন একটা গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক পর্যায়। পশুপালন পর্যায়কে খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতির প্রাথমিক স্তর বলা চলে। শিকার সংগ্রহ ও কৃষি অর্থনীতির মধ্যবর্তী পর্যায় হিসেবে এ স্তরটি নানাদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।
কীভাবে পশুপালন শুরু হয় এ নিয়ে বিভিন্ন ধারণার অবতারণা করা হয়েছে। অনেক পণ্ডিত মনে করেন যে, পশু শিকারের সময় পশুর বাচ্চা, শিকারিদের হাতে ধরা পড়ে এবং পোষ মেনে গৃহপালিত হয়। পশু পালন মানুষের জীবন প্রণালিকে অনেক সহজ করে দেয়। পশুর দুধ ও মাংস খাদ্যের অনিশ্চয়তা অনেকটাই দূর করে। চামড়া ও পশম উন্নত মানের পরিধেয় বস্ত্র, থলে, তাবু ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। পশু ভারবাহী জন্তু হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। সর্বশেষে কৃষিকাজে পশুশক্তি ব্যবহারের মাধমে কৃষি বিপ্লব সংঘটিত হয়।
অনেক পণ্ডিতদের ধারণা তিন হাজার খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে মিশর, মেসোপটেমিয়া এবং ভারতে বন্য পশুকে গৃহপালিত করা হয়। মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েই পশুর ওপর প্রভুত্ব করার ক্ষমতা অর্জন করে। এ ক্ষেত্রে মানুষ প্রথমে কুকুরকে গৃহপালিত করতে সক্ষম হয়। গৃহপালিত পশুর সাহায্যে মানুষ বন্য পশুও শিকার করত।
পশু পালন সমাজ সম্পর্কে Haviland তাঁর 'Anthropology' গ্রন্থে বলেছেন, পরিবেশের সাথে মানুষের অভিযোজনের একটি চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে পশু পালনকারী, যিনি বিভিন্ন ধরনের গবাদি পশু-প্রাণীকে গৃহপালিত করার সাথে সম্পৃক্ত। প্রাণীর মধ্যে ভেড়া, ঘোড়া এবং উট উল্লেখযোগ্য।
ধারণা করা হয় ৮০০০ থেকে ৩০০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পশুপালন সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।
নৃবিজ্ঞানী Lowic তাঁর 'An Introduction to Cultural Anthropology' গ্রন্থে বলেছেন, শুধু আর্থিক কারণে পশুপালনকে গৃহপালিত করা হয়নি। পশুর প্রতি অনুগ্রহ এবং ধর্মীয় অনুভূতির কারণে ও পশুবলি দেওয়ার উদ্দেশ্যে পশুপালন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মানুষের যাতায়াত এবং মালপত্র বহনে ঘোড়া গাধা ইত্যাদি ব্যবহৃত হতো ।
পশু পালনকারী শ্রেণি ছিল মূলত যাযাবর, বেদুইন। তারা দুর্ধর্ষ ও শক্তিশালী ছিল। তাই স্থায়ী ও কৃষিভিত্তিক সমাজ প্রায়ই এদের দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হতো। সভ্যতা বিকাশে যাযাবর বেদুইন সম্প্রদায়ের অবদান কম নয়। কালক্রমে অনেক পশু পালক গোষ্ঠী কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে স্থায়ী জীবন গড়ে তোলে এবং মূল জনস্রোতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় ।
-
ইরাক, প্যালেস্টাইন, ওয়াজিয়ান নতুয়া, ইরানের জাগ্রোস পাহাড়ের পাদদেশে পশু পালন সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল বলে নৃবিজ্ঞানী ও প্রত্নতাত্ত্বিকগণ মনে করেন। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ায় পশু পালন সমাজ ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়।
যাইহোক বর্বরদশা ও প্রস্তর যুগের মধ্যভাগে পশু পালন সমাজ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে ১৪00. খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আমেরিকায় এবং ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ভারতের সিন্ধু, খাইবার গিরিপথ প্রভৃতি স্থানে পশুচারণের স্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া গেছে। বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ যেমন— ওল্ডটেস্টামেন্ট, কুরআন শরিফ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থেও পশু পালন অর্থনীতির ব্যাপক উল্লেখ রয়েছে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]