শিল্পোত্তর সমাজ/ উত্তর আধুনিক সমাজ Post Industrial Society/ Post Modern Society

উন্নত শিল্পায়িত সমাজকে এখন শিল্পোত্তর সমাজ (Post Industrial Society) বলে অভিহিত করা হয়। ১৯৬২ সালে D. Bell সর্বপ্রথম শিল্পোত্তর সমাজ প্রত্যয়টি (Concept) ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে (১৯৭৪ সালে) বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন বুঝাতে ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।
বর্তমানের এ আধুনিক ও শিল্প সমাজ থেকে শিল্পোত্তর সমাজকে আলাদা করা কষ্টকর। তবে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উত্থান-পতনে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি আরও স্পষ্ট করে বললে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বের কিছু মৌলিক এবং বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। বৈশিষ্ট্যগত এসব পরিবর্তনের আলোকেই শিল্প সমাজ থেকে শিল্পোত্তর সমাজকে পৃথক করা হয়েছে। শিল্পোত্তর সমাজকে আধুনিকোত্তর সমাজও বলা হয়ে থাকে।
সাধারণভাবে শিল্প সমাজ থেকে শিল্পোত্তর সমাজের পার্থক্য নির্ণয় করা বেশ কঠিন। অর্থনীতিবিদদের মতে,
বিশেষ করে শিল্পোত্তর সমাজের আলোচনা করতে গিয়ে ডানিয়েল বেল (Daniel Bell ) বলেন, “Post industrial society is a society whose economic system is engaged in the processing and control of information.” অর্থাৎ শিল্পোত্তর সমাজ বলতে সেই সমাজকে বুঝায় যার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমাজের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রিত রাখে। শিল্পোত্তর সমাজের প্রাথমিক উৎপাদন হচ্ছে শিল্প কর্তৃক উৎপাদিত দ্রব‍্যাদি। কার্যকারিতার দিকে বেলের ধারণা হচ্ছে শিল্প সমাজ থেকে শিল্পোত্তর সমাজের পরিবর্তন অর্থাৎ ধনাত্মক উন্নয়ন ৷
শিল্পোত্তর সমাজে প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি ঘটে। তথ্য প্রযুক্তিসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে উৎপাদিত পণ্য প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পৌছে যায়। বিদ্যুতের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে এবং মানুষের জীবন যাত্রায়ও আসে ব্যাপক পরিবর্তন। মানুষের চাহিদায় প্রতিনিয়ত নতুন মাত্রা যোগ হতে থাকে। ফলে উৎপাদন এবং বণ্টন প্রক্রিয়ায় আধুনিকীকরণ পরিলক্ষিত হয়। মানুষের ব্যাপক চাহিদাকে সামনে রেখে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করে উৎপাদনে গতি সঞ্চার করে। বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ আর্থ-রাজনৈতিক বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসে।
যেমন— বাংলাদেশে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনে ইউরোপীয় কোম্পানি অগ্রাধিকার পাবে, নাকি মার্কিন কোম্পানি অগ্রাধিকার পাবে, বিষয়টির ক্ষেত্রে মার্কিন রাজনৈতিক চাপকে অস্বীকার করার উপায় নেই ।
শিল্পোত্তর সমাজ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী ব্রানিগান ( Brannigan)-এর মতে, “A post modern society is a technologically sophisticated society that is pre-occupied with consumer goods and media images," afte আধুনিকোত্তর সমাজ বলতে প্রযুক্তভাবে সার্বিক সমৃদ্ধ সমাজকে বুঝায়। এই সকল সমাজে উৎপাদিত দ্রব্যাদি ক্রয়ের জন্য এবং প্রচারের জন্য ব্যাপকভাবে মজুদ থাকে এবং যার সুনাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং অধিক পরিমাণে মানুষ অনুপ্রাণিত হয়। শিল্পোত্তর সমাজে উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো তাদের স্বার্থেই তৈরি করেছে বিশ্বব্যাংক, আই.এম.এফ. জাতিসংঘ প্রভৃতি । অভিন্ন উদ্দেশ্যে তারাই ধুয়া তুলছে বিশ্বায়ন (Globalization) এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির (Pree market economy)
সুতরাং বলা যায় আধুনিক সমাজ পরবর্তী সমাজতত্ত্বটি বিশ্বজনীন যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সকল জাতির সাংস্কৃতিক ধারা। উদাহরণ স্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীরা জামাইকার গান শুনতে পাচ্ছে এবং খাদ্য হিসেবে সুশী (Sushi) এবং অন্যান্য জাপানি খাদ্য গ্রহণ করছে।
৩.৫ শিল্পোত্তর সমাজ/ উত্তর আধুনিক সমাজের বৈশিষ্ট্য
Characteristics of the Post Industrial Society/ Post Modern Society
বৈশিষ্ট্যগত বিভিন্ন পরিবর্তনের আলোকেই শিল্প সমাজ থেকে শিল্পোত্তর সমাজকে পৃথক করা হয়েছে। শিল্পোত্তর সমাজকে আধুনিকোত্তর সমাজও বলা হয়ে থাকে।
নিম্নে শিল্পোত্তর/ উত্তর আধুনিক সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হলো--
১. অঞ্চল : বিভিন্ন অঞ্চলভেদে, এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকাকে প্রাক-শিল্প অঞ্চল, পশ্চিম ইউরোপ, জাপান ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে শিল্পায়িত অঞ্চল এবং যুক্তরাষ্ট্র (United States) কে শিল্পোত্তর অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
২. চাহিদার সম্পসারণ : শিল্পোত্তর সমাজে বস্তুগত দ্রব্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় বা কৃত্রিমভাবে চাহিদার প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মাত্রা যোগ করা হয়।
৩. অর্থনৈতিক ওর : শিল্পোত্তর সমাজের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে তৃতীয় (Tertiary) এবং চতুর্থ (Quaternary) এ দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। টারশিয়ারি পর্যায়ে পরিবহন ও সেবাখাতের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। এ পর্যায়ে সেবা খাতের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে। যথা- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গবেষণা, সরকার ও বিনোদন।
৪. বিশ্ব সংস্থার যথেচ্ছ ব্যবহার : শিল্পোত্তর সমাজে উন্নত ও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তাদের অনুকূলে বিশ্ব সংস্থাসমূহ যেমন জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আই.এম.এফ., ডব্লিউ.টি.ও. প্রভৃতিকে ব্যবহার করছে।
৫. উন্নয়নশীল দেশের উপর খবরদারি বৃদ্ধি : শিল্পোত্তর সমাজের উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো উন্নয়নশীল দেশের উপর নানাভাবে মোড়লগিরি বা খবরদারি চালায়। অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রশাসন, পরিকল্পনা, শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা, আইন শৃঙ্খলা, উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা অর্থাৎ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা পরামর্শক, নির্দেশক বা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বিশ্বব্যাপী আমেরিকার ভূমিকা এর বাস্তব প্রমাণ
৬. তীব্র প্রতিযোগিতা : শিল্পোত্তর বা আধুনিক সমাজে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা। এ সীমাহীন প্রতিযোগিতার সাথে যুক্ত হয়েছে বিশ্বায়ন (Globalization) এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি (Free market economy)-র ধারণা। এ অসম প্রতিযোগিতায় যে উন্নত দেশগুলোর কাছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরাজয় নিশ্চিত তা আজ আর কারো বুঝতে বাকি নেই ।
৭. মূল্যবোধের পরিবর্তন : শিল্পোত্তর সমাজে মানবিক অভিজ্ঞতা বা মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যুক্তিবাদ, পরমত সহিষ্ণুতা, গণতন্ত্র, সমতাবাদ, মানবাধিকার ইত্যাদি মূল্যবোধগুলো শিল্পোত্তর সমাজের দেশগুলো পুনঃপুনঃ উচ্চারণ করলেও বাস্তবে “জোর যার মুল্লুক তার" (Might is right) নীতি বা মূল্যবোধ যেন এখন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কেবল বাজার দখলই নয়, তেল গ্যাস সমৃদ্ধ দেশগুলোর ভূমিও নিলজ্জভাবে মধ্যযুগীয় কায়দায় দখল করা হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানী Bethy Yorburg শিল্পোত্তর সমাজের কয়েকটি প্রলক্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো, Most workers in tertiary industries, new middle class of salaries employees is the majority, widespread employment of women. অর্থাৎ অধিকাংশ শ্রমিক নিয়োজিত থাকে তৃতীয় পর্যায়ের শিল্পে, বেতনভুক্ত নতুন মধ্যবিত্ত কোন শ্রেণির কর্মচারীর সংখ্যাধিক্য, নারীর কর্মসংস্থানের ব্যাপক প্রসার ।
মোটকথা, শিল্পোত্তর ও আধুনিকোত্তর সমাজের মূল লক্ষ হচ্ছে দেশ দখলের পরিবর্তে বাজার দখল করা। ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী নীতির মাধ্যমে প্রান্তিক রাষ্ট্রটি অর্থনৈতিকভাবে শোষণের শিকার হয়। পক্ষান্তরে কেন্দ্রীয় শোষক রাষ্ট্রটি আরও বেশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করে।
পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজ সংস্কৃতি কোনো স্থবির বিষয় নয় বরং সতত পরিবর্তনশীল বিষয়। এ পরিবর্তনের রথে চড়েই মানুষ একেবারে আদিম অবস্থা থেকে হাঁটি হাঁটি পা-পা করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির মাধ্যমে বর্তমান শিল্পোত্তর সমাজে পদার্পণ করেছে। সুদীর্ঘকালের এ পথ পরিক্রমায় মানুষকে ধারাবাহিকভাবে উপযুক্ত ধাপ বা পর্যায়গুলো অতিক্রম করতে হয়েছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]