আদিম অর্থনীতি আদিম অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য Characteristics of Primitive Economy

আদিম অর্থনীতিকে জীবিকা নির্বাহের অর্থনীতি (Subsistance economy) বলা হয়। অর্থনীতি হচ্ছে সামাজিক বিজ্ঞানের সেই শাখা যেখানে উৎপাদন, বণ্টন, ভোগ, বিনিময়, চাহিদা, যোগান, কেনা-বেচা ইত্যাদি অর্থনৈতিক কার্যকলাপের আলোচনা- পর্যালোচনা হয়ে থাকে। পৃথিবীর সকল সমাজের মানুষই কোনো না কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিল। বস্তুত জীবন-জীবিকার অপর নামই ছিল অর্থনীতি
যাইহোক, আদিম অর্থনীতিতে মানুষ কেবল বেঁচে থাকা বা টিকে থাকার জন্যই সংগ্রাম করত। তখন মানুষের অর্থনৈতিক জীবন ছিল প্রকৃতি নির্ভর। জীবন ও জীবিকার প্রধান উপায় ছিল লতাপাতা, শাক-সবজি, ফল-ফলাদি, শিকড়-বাকড় সংগ্রহ, পশু-পাখি শিকার, পশু পালন, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণি ধরা ইত্যাদি।
আদিম অবস্থায় কোনো রকম সুস্পষ্ট শ্রমবিভাগ ছিল না। যা ছিল তা হলো স্ত্রী পুরুষের মধ্যে অতিসাধারণ রকমের শ্রমবিভাগ। আদিম সমাজে প্রথম অবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্যও প্রবর্তিত হয়নি। তখনও মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়নি। স্বভাবতই জিনিসপত্রের মূল্য বলে কোনো কিছু ছিল না। আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে যে সমস্ত ধারণা ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত দেখা যায়, তখন সেগুলোর সৃষ্টি হয়নি। যেমন— মজুরি, খাজনা, সুদ, মুনাফা প্রভৃতি ধারণা ছিল অজ্ঞাত।
বস্তুত সামগ্রিকভাবে আদিম অর্থনীতিকে খাদ্য আহরণ অর্থনীতি (Food Gathering Eocnomy) বলা হয়ে থাকে । একেবারে প্রাথমিক অবস্থা থেকে শুরু করে কৃষি আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত আদিম অর্থনীতির সময়কাল ছিল। এ বিচারে সমগ্র পুরোপলীয় ও মধ্যপলীয় যুগ আদিম অর্থনীতির পর্যায়ভুক্ত ছিল।
আদিম অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক কাজকর্ম বলতে বুঝাত ফলমূল আহরণ বা পশু শিকারকে। এই সময়ে উৎপাদিত খাদ্য সামগ্রি ও যৌথ মালিকানা সমভাবে ভোগ করত। এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী মিনুমাসানী বলেন যে, “Life was either a feast or a fast” অর্থাৎ “আদিম সমাজে জীবন ছিল ভুরিভোজ না হয় উপবাস।”
কারী আদিম অর্থনীতিতেই মানুষ পশুপালন ও কৃষি কার্য সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করেছে।
সুতরাং বলা যায় যে, আদিম সমাজের জীবিকা নির্বাহের পদ্ধতি আদিম অর্থনীতি। আদিম সমাজে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল কর্ম, খাদ্য, আশ্রয় ও বস্ত্র। এসব উপকরণ আদিম মানুষের অর্থনীতির মূল লক্ষ্য ছিল। কারণ এগুলো দ্বারাই তারা কোনো রকমে তাদের জীবনকে টিকিয়ে রাখত ।
আদিম অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য
Characteristics of Primitive Economy
আদিম অর্থনীতিতে ব্যক্তি মালিকানার ধারণা তাদের মাথায় আসেনি। মূলত আদিম মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপায় ছিল শিকার ও পশু পালন। এ অর্থনীতিতে সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন তাদের স্বীকৃত প্রথা অনুযায়ীই নির্ধারিত হতো এবং বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ছিল দ্রব্য। কোনো কিছু জমা করে রাখার মতো উৎপাদন কৌশল তাদের জানা ছিল না। তাই তাদের জীবনের প্রবাহ ছিল— 'দিন আনা দিন খাওয়া' এ রকমের। আদিম অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো— ১. জীবন ধারণ অর্থনীতি (Subsistence economy) : ভরণ-পোষণের উপায় বের করা ছিল আদিম অর্থনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কোনো রকমে তাদের খাদ্য যোগাড় করতে পারলেই তাদের কর্তব্য শেষ হয়েছে মনে করত। জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয় লাভই ছিল তাদের একমাত্র কাম্য। এ যুগের মানুষ উৎপাদিত কোনো খাদ্যদ্রব্য মজুত করত না, তারা তা জীবন ধারণের প্রয়োজনেই সবটুকু শেষ করত। সে জন্য কোনো জিনিসের অতিরিক্ত উৎপাদনের প্রয়োজন মনে করত না। তাই অনেকেই আদিম অর্থনীতিকে ভরণ-পোষণের অর্থনীতি বা খাদ্য সংগ্রহের অর্থনীতি বলে মনে করেন। ২. সম্পত্তি (Property) : এ অর্থনীতিতে পশুপাখি শিকারের জন্য ব্যবহৃত অস্ত্রই ছিল মূল সম্পত্তি। এগুলো ছিল আবার যৌথ বা গোষ্ঠী মালিকানায়। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে কোনো ধারণাই তখন মানুষের মনে স্থান পায়নি। প্রাপ্ত সকল খাদ্যদ্রব্যে সকলের সমান অধিকার স্বীকৃত ছিল এবং সমষ্টিগত প্রচেষ্টা ছিল খাদ্য সংগ্রহের ভিত্তি।
৩. অর্থনৈতিক সম্পর্ক ( Economic Relation) : আদিম অর্থনীতিতে মানুষের মাঝে পারস্পরিক একটা অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা ছিল। আদিম মানুষ একত্রিত হয়ে নিজেদের বাঁচার তাগিদেই কাজ করত। এ অর্থনীতিতে, সামাজিক, প্রয়োজনেই যৌথ উৎপাদন ও ভোগ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। সুতরাং অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক নির্ধারিত করেনি। বরং সামাজিক সম্পর্কই, অর্থনৈতিক সম্পর্ককে নির্ধারিত করেছিল (Social Determinism)। তাই বলা হয়, আদিম বা অনক্ষর সমাজের অর্থনৈতিক সম্পর্ক কোনোক্রমেই সামাজিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না।
৪. প্রাকৃতিক শ্রমবিভাগ (Natural division of labour) : আদিম অর্থনীতিতে পুরুষেরা শিকার ও পশু পালন কাছে
নিয়োজিত থাকত, আর মহিলারা ফলমূল, শাকপাতা সংগ্রহ, রান্না, শিশুপালন, উদ্যানচাষ ইত্যাদি কাজে রত থাকত। অর্থাৎ আদিম অর্থনীতিতে মূলত বয়স (Age) ও লিঙ্গভেদে (Sex) শ্রমবিভাগ প্রচলিত ছিল।
৫. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা (Economic planing) : এ অর্থনীতিতে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ছিল অসুবিধাজনক। যার কারণে দীর্ঘমেয়াদি তো দূরের কথা, স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণও ছিল অসম্ভব। আদিম অর্থনীতিতে খাদ্য সংগ্ৰহ কার্যক্রম খুব অল্প সময়ের জন্য ভবিষ্যৎ চাহিদা নির্ধারণ করতে পারত ।
৬. বসতির ঘনত্ব (Density of Population) : আদিম অর্থনীতিতে জনবসতির ঘনত্ব ছিল কম। তবে সর্বত্র জনসংখ্যার ঘনত্ব একই রকম ছিল না। সাধারণত ২০ থেকে ১০০ জনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে মানুষ দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করত। এ অর্থনীতিতে জনসংখ্যা বেড়ে গেলে শিকার সংগ্রহের ওপর চাপ বেড়ে যেত এবং কিছু মানুষ তখন অন্যত্র স্থানাস্তর গমন করত। সুতরাং আদিম অর্থনীতিতে মূলত জনবসতির ঘনত্ব ছিল কম তবে সর্বত্র জনসংখ্যার ঘনত্ব একই রকম ছিল না।
৭. পারস্পরিক বিনিময় পদ্ধতি (Reciprocity) : পারস্পরিক বিনিময় (Reciprocal exchange) বা যৌতুক দান প্রথা আদিম অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এ প্রথার মাধ্যমে দ্রব্য ও কাজের পারস্পরিক আদান-প্রদান চলত। এতে সামাজিক সংহতি দৃঢ় হতো এবং পারস্পরিক অর্থনৈতিক চাহিদা মিটত। এ অর্থনীতিতে অবশ্য আদান-প্রদান ও সামাজিক সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়া হতো, অর্থনৈতিক পুনর্বণ্টনের দিকে নয়। এ যৌতুক প্রথার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সামাজিকতার মাধ্যমে অপরের অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানো। এ প্রথার একদিকে যেমন অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ হতো অপরদিকে সামাজিকতার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক দৃঢ় হতো।
৮. দ্বন্দ্ব সংঘাত (Conflict) : আদিম অর্থনীতিতে সমাজে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্রগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত ছিল মূলত সাধারণ ঘটনা। বস্তুত আদিম অর্থনীতিতে সম্পদকে কুক্ষিগত করতে পারেনি ।
৯. খাদ্যের অনিশ্চয়তা (Food uncertainity) : আদিম অর্থনীতির প্রকৃতিতে নানা ধরনের খাদ্যে ভরপুর থাকলেও খুবই নিম্নমানের উৎপাদন কৌশলের জন্য তাদের প্রায়শই খাদ্যের অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হতো। মূলত আদিম অর্থনীতিতে খাদ্যের ব্যাপক অনিশ্চয়তা ছিল। এ অর্থনীতিতে কখনো মিলত প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার্য বস্তু, আবার কখনো ন্যূনতম খাদ্য সামগ্রীও পাওয়া যেত না। এজন্য বলা হয়, খাদ্য অনিশ্চয়তা সর্বদাই তাদেরকে তাড়া করে ফিরত। এ অর্থনীতির মানুষরা বলতে গেলে সর্বদাই নিরাপত্তাহীন ছিলেন।
১০. শ্রেণি বৈষম্যের অনুপস্থিতি (Absence of class ) : সমতার দর্শনভিত্তিক এ সমাজকে মার্কসবাদীরা আদিম সাম্যবাদ (Primitive communism) নামে আখ্যায়িত করেছেন। এ অর্থনীতিতে সমাজে তেমন কোনো শ্রেণি বৈষম্য না থাকলেও ভোগ, বণ্টন, বিনিময় ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমতার নীতি প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে শ্রেণি বৈষম্য সৃষ্টির তেমন কোনো সুযোগ ছিল না বললেই চলে ।
পরিশেষে বলা যায়, আদিম অর্থনীতিতে রাজনৈতিক সংগঠন না থাকলেও আত্মীয়তার সম্পর্কে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল এ সমাজব্যবস্থা। কেননা, সামাজিক প্রথা, আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ সর্বদাই নিয়ন্ত্রিত হতো। যাহোক এ অর্থনীতিতেই মূলত পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনে একদলের সাথে অন্য দলের সংহতি ও সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কেননা এ অর্থনৈতিক বিধি ব্যবস্থার প্রভাবে তাদের মধ্যে স্বার্থ ও দ্বন্দ্ব তেমন দানা বেঁধে উঠেনি।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]