খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য Characteristics of Food Producing Economy

কলম্বাসের সময়ের পূর্বে বিশ্বে কয়েক মিলিয়ন জনগোষ্ঠী খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতির পর্যায়ভুক্ত ছিল। এ ছাড়াও মিশর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্য আমেরিকাতে প্রথম খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতি শুরু হয় বলে অনেক নৃবিজ্ঞানী বিশ্বাস করতেন। খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে আলোচনা করা হলো—
১. স্বনির্ভর গ্রাম : খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে মূলত একশত থেকে দু'হাজার লোকসংখ্যা নিয়ে স্বনির্ভর গ্রাম গড়ে ওঠেছিল। ২. জনসংখ্যার ঘনত্ব : "অগ্রসরমান খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতির চেয়ে মূলত খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক
বেশি ছিল।
৩. উৎপাদিত পণ্য ছাড় : এ পর্যায়ের মানুষেরা কেউ কারো উৎপাদিত পণ্য বা খাদ্যে ভাগ বসাতে পারত না। চাহিদা
মেটাতেই অনেক সময় উৎপাদিত পণ্যের কিছু অংশ বিনা মূল্যে ছেড়ে দিত ।
৪. সম্পত্তি : উৎপাদন স্তরে ভূমি, ফলের বাগান ও পশু চারণ ক্ষেত্রগুলো গ্রামীণ সম্প্রদায়ের সাধারণ সম্পত্তি বলে বিবেচিত হতো । গ্রামীণ নেতা বা গোষ্ঠী প্রধান সর্বসম্মতিক্রমে জনগণের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টন করে দিত। মূলত এটিই পরে ব্যক্তিগত সম্পত্তির রূপ পরিগ্রহ করেছিল।
৫. জমি চাষাবাদ : উৎপাদন পর্যায়ে মূলত ব্যক্তিগত পর্যায়ে জমি চাষাবাদ করা হতো, আবার ফসল কাটার সময় গ্রামীণ
সম্প্রদায় একযোগে উৎসাহের সঙ্গে কাজ করত।
৬. শ্রম বিভাগ : খাদ্য উৎপাদন পর্যায়ে আধুনিক অর্থব্যবস্থা ও বাজার ব্যবস্থার সৃষ্টি না হলেও বিনিময় প্রথা ব্যাপকভাবে লক্ষ
করা গেছে। সুতরাং লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমাজে শ্রম বিভাগের ব্যাপক সূত্রপাত হয়েছিল
৭. সংগ্রহ কৌশল : খাদ্য উৎপাদন নির্ভর সমাজে সীমিত পরিসরে হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে খাদ্য সংগ্রহ কৌশল দেখা যায় ৷
যেমন— কৃষি অর্থনীতি সমাজের মানুষও পশুপাখি শিকার এবং পারতপক্ষে ফলমূল, মধু ইত্যাদি সংগ্রহ করে।
৮. খাদ্যের নিশ্চয়তা : খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতি, খাদ্যের কিছুটা হলেও নিশ্চয়তা প্রদান করে থাকে ।
৯. আচার-বিশ্বাস : খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে নানা ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠান কমে আসে। কৃষি সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাস
ও আচরে কিছুটা ভাটা পড়ে। উৎপাদন অর্থনীতিতে একেশ্বরবাদের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয় ।
১০. প্রতিযোগিতা : খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে তখন সমাজে দেখা দেয়
প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব।
পরিশেষে বলা যায় যে, খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে বাঁচার তাগিদে অবশ্য মানুষ প্রথমেই খাদ্য উৎপাদন করতে না পারলেও পরবর্তী পর্যায়ে তারা উদ্ভাবন করেছে নতুন নতুন খাদ্য উৎপাদনের কৌশল। বস্তুত এভাবেই খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতি পুঁজিবাদী অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হয়েছে।
খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতির কৌশল The Strategy of Food Producing
এ পর্যায়ের মানুষেরা খাদ্য সংগ্রহের পাশাপাশি খাদ্য উৎপাদন ও পশু পালন কৌশল উদ্ভাবন করে। 'Neolithik age' এ বিদ্যমান, এই স্তরের মানুষ প্রকৃতি নির্ভর জীবন-যাপন থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি লাভ করতে থাকে। এ পর্যায়ে প্রাকৃতিক শ্রমবিভাগ থাকায় পুরুষেরা শিকার করত এবং মহিলারা শস্যদানা ও ফলমূল সংগ্রহ করত। খাদ্য গ্রহণের বীজগুলো বাসস্থানের পাশে ফেলে রাখত। আর এ বীজ থেকে গাছ জন্মাতে দেখে কৃষি কাজের ধারণা লাভ করে। এ পর্যায়ে সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কৃষি অর্থনীতির আবির্ভাব ঘটে ও গোষ্ঠীগত আবাস ছোট হয়ে আসে। ফলশ্রুতিতে ব্যক্তিগত মালিকানার কারণে সমাজে অসমতা ও বৈষম্য ব্যাপকভাবে সৃষ্টি হয়। খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতির প্রধান কৌশল মূলত ৩টি। যথা-
১. উদ্যান কৃষি;
২. পশু পালন; ও
৩. কৃষি ব্যবস্থা।
নিচে এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
১. উদ্যান কৃষি : এ পর্যায়ে আদিম মানুষ উদ্যানে চাষ পদ্ধতিতে দা, কুঠার, কাঠ এবং বিভিন্ন পশুর হাড় দিয়ে মাটি খুঁড়ে
ফলমূল, শাক-সবজি, তরিতরকারি চাষ করত। এসব আবাদের ইতিহাস খুবই প্রাচীন ছিল। জীবন ছিল প্রতিবন্ধকতাময় ।
২. পশুপালন : শিকার ও সংগ্রহের শেষ পর্যায়ে এসে শুরু হয় পশুপালন। প্রথম দিকে মানুষ পশুদেরকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করত। পরবর্তীতে মানুষ বুঝতে শিখল যে, পশুদেরকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করা যায় এবং তারা দুধ, মাংস এবং পশম দিয়ে থাকে। এ সময়ে তারা শিকারের কিছু কিছু পশুকে জীবিত রেখে গৃহপালিত করতে শুরু করে, প্রজননের মাধ্যমে গৃহপালিত পশু বুদ্ধি করতে লাগল। এভাবে মানুষ বুঝতে পারল যে, এরা হিংস্র নয়, উপকারী।
৩. কৃষি ব্যবস্থা : এ স্তরে কৃষির যথেষ্ট প্রাচুর্য ছিল। ফলে প্রচুর পরিমাণে ফলমূল পাওয়া যেত। তবে ফলমূল আহরণ মূলত ভৌগোলিক অবস্থানের উপরই নির্ভর করত। তাই বলা যায়, কৃষি আবিষ্কারের ফলে মানুষ প্রকৃতি নির্ভর জীবন-যাপন থেকে মুক্ত হয়ে প্রথমবারের মতো উৎপাদনে পৌছায়, তাই কৃষিকে বিপ্লব বলে অভিহিত করা অত্যন্ত ন্যয় সঙ্গত ।
পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজ বিকাশের প্রথম পর্যায়ে মানুষ খাদ্য উৎপাদন করতে না পারলেও পরবর্তী পর্যায়ে খাদ্য সংগ্রহের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা জন্মে। ফলশ্রুতিতে মানুষ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে আজকে এই স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনে পৌঁছেছে ।
খাদ্য সংগ্রহ ও খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতির মধ্যে পার্থক্য Difference between Food Gathring and Food Producing Economy
বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে মানুষ খাদ্য সংগ্রহ ও খাদ্য উৎপাদন পর্যায়ে, যুগ-যুগান্তরের ভিতর দিয়ে নিজেকে সচল রাখতে সচেষ্ট হয়েছে। অনেক প্রতিকূলতা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়েই মানুষ আজকের সভ্যতায় এসে উপনীত হয়েছে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে হাজার বছরের অনেক অজানা ইতিহাসকে পিছনে ফেলে মানুষ শ্রেষ্ঠতম স্থানে নিজেকে সংস্থাপন করতে পেরেছে।
খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতি : আদিম সমাজের প্রথম পর্যায়ের মানুষ খাদ্য কীভাবে উৎপাদন করতে হয় তা তারা জানত না। প্রস্তর যুগের কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত তারা খাদ্য সংগ্রাহক হিসেবে কাটিয়েছে। তারা খাদ্য সংগ্রহের জন্য অর্থাৎ বেঁচে থাকার তাগিদে প্রথমত প্রকৃতির কাছে হাত বাড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত, ফলমূল, শাকসবজি ও পশু শিকারের জন্য তারা এক স্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরে বেড়াত ।
Beals and Hoijer বলেছেন, “মানুষের জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিতের লক্ষ্যে কোনো পদ্ধতি প্রয়োগ ব্যতিরেকে পরিবেশের সম্পদ ব্যবহারের সাথে সম্পৃক্ত কৌশল হচ্ছে খাদ্য সংগ্রহ সমাজ। এ সময় মানুষ সমাজের ভিত্তি রচনা করে।
খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতি : প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার এবং সম্পদের রূপান্তর ও বাড়তি উৎপাদন ছিল খাদ্য উৎপাদন কৌশলের একমাত্র লক্ষ্য। খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে মানুষ গোষ্ঠীগত আবাস ছেড়ে ছোট হয়ে আসে, সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কৃষি অর্থনীতির আবির্ভাব ঘটে। ব্যক্তিগত মালিকানার কারণে সমাজে অসমতা ও বৈষম্য সৃষ্টি হয়। অবশ্য খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি খাদ্য সংগ্রহও চলত। যাহোক, খাদ্য উৎপাদনের ইতিহাস প্রায় আট-দশ হাজার বছরের ইতিহাস। খাদ্য সংগ্রহ ও খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতির মধ্যকার পার্থক্যসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হলো-
১. খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতিতে মানুষ দলবদ্ধভাবে খাদ্য সংগ্রহ করত। তাদের জীবন ছিল যাযাবর প্রকৃতির। কিন্তু খাদ্য উৎপাদন
অর্থনীতিতে মানুষ যাযাবর জীবন পরিহার করে, তারা স্থায়ী বসবাস করতে শুরু করে।
২. খাদ্য সংগ্রহ পর্যায়ে খাদ্য উৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টি হয় না। কিন্তু খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে, উৎপাদনের পাশাপাশি খাদ্য
সংগ্রহের প্রবণতাও লক্ষ করা যায়।
৩. খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতিতে বাড়তি উৎপাদন না থাকলেও এ অর্থনীতি প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রকৃতিতে যা আছে তাই শুধু তারা সংগ্রহ করত। পক্ষান্তরে, খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে প্রকৃতির সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত উৎপাদন করা হতো। ৪. খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতিতে নারী পুরুষ ভেদে কাজ করা হতো। কিন্তু খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দক্ষতা অনুযায়ী কাজ ভাগ করা হতো।
৫. খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক কার্য পরিচালনা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। অর্থাৎ প্রকৃতিতে খাদ্য বা ফলমূল পেলে তাদের পেট চলবে আর না পেলে অনাহারে থাকতে হবে। অপরদিকে খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক কার্য পরিচালনায় অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হয় না ।
৬. খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতিতে প্রযুক্তি থাকে সরল। অপরদিকে খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে প্রযুক্তি থাকে উন্নত।
৭. খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতিতে নারী-পুরুষ ভেদে কাজ ভাগ করা হতো। কিন্তু খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষ দক্ষতা অনুযায়ী কাজ ভাগ করা হতো।
৮. খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতিতে কোনো শ্রেণির উদ্ভব হয়নি। কারণ এখানে কোনো ব্যক্তি মালিকানা ছিল না। তাই এ সমাজে কোনো অসমতা ও বৈষম্যের সৃষ্টি হয়নি। পক্ষান্তরে খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত মালিকানা থাকায় সমাজে সামাজিক বৈষম্য ও অসমতা সৃষ্টি হয় এবং নানা ধরনের সামাজিক শ্রেণির উদ্ভব হয় ।
৯. খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতিতে খুব কম খাদ্যই উদ্বৃত্ত থাকত। অন্যদিকে উৎপাদন অর্থনীতিতে অধিক খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকত। ১০. খাদ্য সংগ্রহ পর্যায়ে বৃহদাকায় শিকারি প্রাণী গড়ে উঠত। অপরদিকে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় উদ্যানচাষ বা কৃষি উৎপাদন কাজে বড় বড় দলের প্রয়োজন হয় না। বস্তুত পরিবার হলো খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতির উৎপাদন ও ভোগের একক । অপরপক্ষে, গোষ্ঠী বা কৌম হলো খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতির একক।
পরিশেষে বলা যায় যে, উভয় অর্থনীতির মধ্যে চূড়ান্ত পার্থক্য নির্দেশ করা না গেলেও এ দুটির আপেক্ষিক গুরুত্ব বিচার্য । আদিম মানুষ প্রকৃতিতে যা যে অবস্থায় পেত তাই তারা আহার করত। সভ্যতার এ পর্যায়ে সম্পদের ঘাটতি পূরণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফলে খাদ্য সংকট দেখা দিত। বনের ফলমূল খেয়ে উজাড় না করে তার বীজ থেকে আরও গাছপালা জন্মানো যেতে পারে এ চিন্তা মানুষকে উদ্ভাবনী শক্তি দান করেছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]