সমাজের ধরন মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি Types of Society: Marxist Viwe

কার্ল মার্কস অর্থনৈতিক উৎপাদনকেই সামাজিক পরিবর্তনের মূল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে মানব ইতিহাসের সমস্ত ঘটনাবলির পশ্চাতে রয়েছে অর্থনৈতিক কারণ। অর্থনৈতিক উৎপাদনকেই তিনি সমাজ পরিবর্তনের মৌল উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি সর্বদাই মানব ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করে। সমাজের শ্রেণি বিভাজনের ক্ষেত্রে সমাজ কাঠামোকে বিশ্লেষণ করে সমাজ কাঠামোর দুটি ভিত্তির কথা উল্লেখ করেছেন। যথা- ক. মৌল
কাঠামো (Basic structure) ও খ, উপরি কাঠামো (Super structure)। মৌল কাঠামোকে তিনি জার্মান শব্দ 'Struktur' দ্বারা অভিহিত করেন। যার অর্থ Basic of Economic Foundation of Society'. এটাকে Relation of Production-ও বর্গী হয়। উৎপাদন প্রণালি হচ্ছে সমাজের সকল কর্মকাণ্ডের মূল চালিকা শক্তি। এটি মূলত গড়ে ওঠে সমাজের অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্কের সমন্বয়ে। Karl Marx মূলত তাঁর 'A Contribution to the Critique of Political Economy' গ্রন্থে সমাজের অর্থনৈতিক বিকাশ সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করেছেন এবং Das Capital গ্রন্থে এ আলোচনায় পরিপূর্ণতা দান করেছেন। সুতরাং মার্কসীয় দৃষ্টি ভঙ্গির পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, Karl Marx মূলত সবসময়ই মানব ইতিহাসের সমস্ত ঘটনাবলির পিছনে অর্থনৈতিক কারণকে দায়ী করেছেন। তিনি শ্রেণি বিভক্তকরণে পাশ্চাত্য সমাজ ও প্রাচ্য সমাজের বিকাশকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করে বলেছেন- পাশ্চাত্যের সমাজ যেভাবে বিকশিত হয়েছে, প্রাচ্য সমাজ সেভাবে বিকশিত হয়নি।
পরিশেষে Marx দৃঢ় কণ্ঠে ব্যক্ত করেছেন যে, সমাজ কাঠামোর মৌল অংশের কোনো রকম পরিবর্তন সূচিত হলে তার প্রভাব উপরিকাঠামোতে পড়বে। Karl Marx উপরি কাঠামোকে আবার অপর জার্মান শব্দ 'Uberbau' দ্বারা অভিহিত করেছেন, যার অর্থ হলো- Formen. এটা উৎপাদন প্রণালির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। এতে সমাজের প্রচলিত বিশ্বাস, আচার- অনুষ্ঠান, ধর্ম, দর্শন, মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণা, শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
Karl Marx মানব সমাজের অর্থনৈতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে এটিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
১. আদিম সাম্যবাদী সমাজ- এ সমাজের মূলভিত্তি আদিম সাম্যবাদী উৎপাদন প্রণালি
২ দাস সমাজ- দাস নির্ভর উৎপাদন প্রণালি
৩. সামন্তবাদী সমাজ- সামন্ত উৎপাদন প্রণালি
৪. পুঁজিবাদী সমাজ- পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালি
৫. সমাজতান্ত্রিক সমাজ সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন প্রণালি ।
নিচে এগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
১. আদিম সাম্যবাদী সমাজ (Primitive Communism) : Karl Marx-এর মতে আদিম সাম্যবাদী সমাজ ছিল শোষণহীন সমাজ। এ সময় মানুষ প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। মূলত মানব সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে আদিম অবস্থায়। তারা পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে শিকার ও সংগ্রহের ওপর নির্ভর করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করত। এ. সমাজের অর্থনৈতিক দর্শন ছিল From hand to mouth' তাই শোষণের কোনো অবকাশ ছিল না এবং সুবিধাভোগী শ্রেণিরও বিকাশ হয়নি। আদিম সাম্যবাদী সমাজে মানুষ তার শ্রমশক্তি দ্বারা প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়েছে এবং প্রকৃতিকে বশে আনার চেষ্টায় লিপ্ত থাকার চেষ্টা করেছে।
আদিম মানুষের প্রথম হাতিয়ার হলো অমসৃণ পাথরের টুকরো ও গাছের ডালপালায় তৈরি লাঠি। তারা দলবদ্ধভাবে পশু পাখি ও মৎস্য শিকার করত এবং Life was either feast or a fast নীতিতে ভোগ করত। Karl Marx আদিম সাম্যবাদী সমাজের উৎপাদনের কথা বলতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন, The basic type of production relation in primitive society was simple co-operation. .... explanation that is systematic appropriation of the fruits of other people's labour. was impossible. এ পর্যায় ক্রমে ক্রমে আদিম মানুষ তীর ধনুক, মুগুর, বল্লম, পাথরের আকৃতিগত পরিবর্তন সাধিত, বড়শি, আংটা ইত্যাদি তৈরি শিখল। পাথরে পাথরে ঘর্ষণের ফলে আগুনের আবিষ্কার হলো।
এ সময়ে মেয়েরা রান্নাবান্না ও বাচ্চাদের লালন-পালন করত। পুরুষরা শিকারে বের হলে মহিলা ও শিশুরা যৎসামান্য মালামাল বহন করে পিছু ছুটত। উৎপাদন শক্তি ক্রমে বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে প্রকৃতির দমনমূলক প্রভাব থেকে আদিম মানুষ নিজেদেরকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হলো। এভাবেই মূলত স্ত্রী-পুরুষভেদে প্রাকৃতিক শ্রমবিভাগ দেখা দিল। আর শ্রম বিভাজনের প্রসারণ ঘটায় বিনিময় প্রথার আবির্ভাব ঘটল। শিকার ও সংগ্রহ অর্থনীতিতে শিকার ও সংগ্রহকারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা হলো। আবার পরবর্তীতে শিকার ও সংগ্রহের উপকরণের মালিকানার স্বীকৃতির মাধ্যমে ব্যক্তিগত মালিকনার সৃষ্টি হলো।
Karl Marx আদিম সমাজের এই ব্যক্তিগত মালিকানাকে দু'ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- Have ও Have not শ্রেণি। তিনি এ দু'ভাগে বিভক্ত করে বলেছেন যে, এই দু-পক্ষের দ্বন্দ্বের ফলেই পরবর্তী সমাজের সৃষ্টি হয়েছে। যার নাম দেওয়া হয়েছে দাস সমাজ।
আদিম সাম্যবাদী সমাজের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Primitive Communism) : কার্ল মার্কস আদিম সাম্যবাদী সমাজকে দু'ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- শ্রেণিহীন সমাজ ও শোষণহীন সমাজ। তিনি নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা বলেছেন-
১. আদিম সমাজে ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকার ফলে সমাজব্যবস্থা ছিল শ্রেণিহীন। আদিম সাম্যবাদে শ্রেণি বৈষম্য বা শ্রেণিষর ছিল না।
২. আদিম সাম্যবাদী সমাজ ছিল মূলত সহযোগিতামূলক। সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সংহতিবোধ ছিল সে সমাজের ভিত্তি ।
যেখানে সমাজ ছাড়া ব্যক্তির আলাদা কোনো অস্তিত্ব ছিল না।
৩. এ সমাজে সবাই মিলে খাদ্য সংগ্রহ করত এবং নিজেদের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করে ভোগ করত।
৪. আদিম সমাজে পারস্পরিক আদান-প্রদান ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। সে সমাজে কোনো দ্রব্য বা সামগ্রী পেলে কিংবা উদ্বৃত্ত থাকলে তা প্রতিবেশী বা জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে উপহার, উপঢৌকন হিসেবে বিলিয়ে দেওয়া হতো।
৫. আদিম সাম্যবাদী সমাজে যৌথ মালিকানায় পাশাপাশি দলগত বিবাহভিত্তিক যৌথ পরিবার ব্যবস্থা বজায় ছিল। সেখানে
হ্যক্তিগত, পারিবারিক জীবন যা এক বিবাহভিত্তিক পরিবার ব্যবস্থা ছিল না।
৬. আদিম সমাজে সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না, ছিল গোষ্ঠীগত বা যৌথ মালিকানা। কার্ল মার্কস সমাজজীবনের এ সমাজকে ভিত্তি ভূমিরূপে চিহ্নিত করেছেন। আদিম সাম্যবাদী সমাজের স্তরটি ছিল শুধুমাত্র প্রকৃতির বৈরি অবস্থা ও প্রতিকূলতা থেকে বাঁচার জন্য কিছু মানুষের একত্রে বসবাস। এ সমবেত জনসমষ্টির মধ্যে সাম্যের নীতি ছিল বিরাজমান। সুতরাং সভ্য সমাজজীবন ব্যবস্থায় প্রথম সূচনাকাল হচ্ছে আদিম সাম্যবাদী স্তর।
২. দাস সমাজ (Slevery) : প্রাচীন সমাজব্যবস্থা থেকেই দাসব্যবস্থা বিকাশ লাভ করেছে। শিকার ও খাদ্য সংগ্রহভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার পরে যখন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কৃষিব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়, তখন থেকেই সম্পত্তিতে ব্যক্তির মালিকানার ভিত্তিতে দাস ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
আদিম সাম্যবাদী সমাজের শেষ পর্যায়ে উৎপাদন শক্তি বৃদ্ধি পাওয়া, ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব, উৎপাদন সম্পর্কে মৌল পরিবর্তনের মাধ্যমেই পরস্পর স্বার্থ বিরোধী 'দাস ও মনিব' শ্রেণির সৃষ্টি হয়।
Karl Marx এর মতে পৃথিবীর ইতিহাসে দাস প্রথাই প্রথম শ্রেণি নির্ভর শোষণমূলক সমাজ। দাসদের কোনো অধিকার ছিল না। এরা মনিবের সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দাসেরা কাজে আনন্দ পেত না। অপর পক্ষে মনিবেরা বিলাসবহুল জীবন- যাপন ভোগ করত। বিক্রয় তথা বিনিময়ের জন্য উৎপাদন শুরুকে Karl Marx পণ্য উৎপাদন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
Karl Marx মনে করেন, অর্থনীতিকে সচল ও সবল রাখার জন্য দাসদের নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালনা ইত্যাদির প্রয়োজনেই রাষ্ট্র নামক শোষণ যন্ত্রের সৃষ্টি হয়। তাই পণ্যের ন্যায় দাস ক্রয়-বিক্রয় করা হতো।
পরিশেষে Karl Marx যথার্থই বলেছেন যে, দাস সমাজেই মুদ্রার প্রচলন ও সুদের কারবার দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের উপর ভিত্তি করে দাস ও মনিবের মধ্যে স্বার্থ দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং দাস সমাজ ভেঙে পরবর্তী সমাজের বিকাশ ঘটে। তাই এ সমাজকেই সামন্তবাদী সমাজ বলা হয় ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]