নদী তীরবর্তী সভ্যতার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
Discuss the Features of River Valley Civilization.

নদীর তীরবর্তী সভ্যতা
River Valley Civilization
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে মানুষ প্রতিকূল বিশ্ব প্রকৃতির সাথে অবিরাম সংগ্রামের মাধ্যমে টিকে আছে এখনও পর্যন্ত। মানুষ বিভিন্ন সময়ে
পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে গড়ে তুলেছে অনেক সমৃদ্ধ সভ্যতা ও জনপদ। মানুষের অক্লান্ত শ্রম ও চিন্তার ফসল হলো এ সভ্যতাসমূহ। এসব সভ্যতার প্রায় সকল অংশই নদীর সাথে অভিমাত্রায় সম্পৃক্ত।
ঐতিহাসিকদের মতে, প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের অদম্য স্পৃহা ও প্রচেষ্টা সর্বপ্রথম নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। যেমন- নীল নদকে কেন্দ্র করে মিশরীয় সভ্যতা, হোয়াংহো নদীকে কেন্দ্র করে চীন সভ্যতা, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে মেসোপটেমিয়া সভ্যতা এবং সিন্ধু নদের অববাহিকায় সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
এ নদীগুলোর প্রকৃতির নিয়মে দুই কূল ছাপিয়ে রেখে যেত উর্বর মাটি। এতে প্রচুর ফসল ফলত। নদীগুলোকে কেন্দ্র করে জনবসতি বেড়ে চলল। গ্রাম ও নগর গড়ে উঠল। নদী উপত্যকায় গড়ে ওঠে মানবসভ্যতার ভিত। কৃত্রিম খাল, বাঁধ দেওয়া ইত্যাদি সম্প্রদায়গত উন্নয়ন কাজকর্ম শুরু হলো। এ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব ও আইনের সৃষ্টি হয়।
মিশরে নীলনদ মেসোপটেমিয়ায় টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী, ভারতের সিন্ধু নদ এবং চীনে হোয়াংহো ও ইয়াংজেকিয়াং নদী তাদের উপত্যকায় উর্বর ভূ-খণ্ড গড়ে তুলেছিল। আর সেখানেই গড়ে উঠেছিল ঐশ্বর্যশালী নগর সভ্যতা। আর এভাবেই গড়ে ওঠে প্রাচীন সভ্যতাসমূহ ।
এ সভ্যতায় উদ্বৃত্ত ফসল ব্যবসা-বাণিজ্যের সূচনা করল। নদীপথে শুরু হয় পণ্য সামগ্রী আনা-নেওয়ার পালা। ব্যবসা- বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জনপদের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান শুরু হয়। উদ্বৃত্ত ফসল ব্যবসা-বাণিজ্যের সূচনা করল। তখন যাতায়াতের জন্য একমাত্র উপায় ছিল নদীপথ ।
নীলনদ, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস, সিন্ধু, হোয়াংহো, ইয়াংজেকিয়াং নদী অঞ্চলসমূহেই সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে ওঠে। শিল্প সাহিত্যের বিকাশ ও ব্যবসার প্রসার ঘটে। আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা এগিয়ে চলে। অক্ষর ও দিনপঞ্জি আবিষ্কৃত হয় । মানবিক আত্মিক চাহিদা মেটাতে ধর্ম ও দর্শনের সূত্রপাত হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত সভ্যতার দিকে তাকালে দেখা যায় এসব সভ্যতার চরম উৎকর্ষের পিছনে নদীর ভূমিকা সর্বজনবিদিত। কেননা মানব সভ্যতার উৎপত্তিই হয়েছিল মূলত বিশেষ বিশেষ নদীকে কেন্দ্র করে। মানুষ যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে প্রকৃতির সাথে লড়াই করে অগ্রসর হচ্ছিল ঠিক তখনই নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলো আকর্ষণ করছিল পৃথিবীর মানুষকে তাদের উর্বর পলি মাটির প্রতি। যে মাটি মানুষকে তাদের যাযাবর বৃত্তি ত্যাগ করে তারই কোলে স্থায়ী আবাস গড়বার জন্য উদ্বুদ্ধ করল, একদিন তারাই গড়ে তুলল নগর সভ্যতা। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠল সভ্যতা। নদীই ছিল সভ্যতাসমূহের প্রধান উৎস। তাই এসকল সভ্যতাকে নদী মাতৃক সভ্যতা বলা হয়। বিভিন্ন সভ্যতাসমূহের মধ্যে সিন্ধু, চৈনিক, মিশরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতা গড়ে ওঠেছে এবং চরম উৎকর্ষ লাভ করেছে নদীগুলোর কারণে। আর এ জন্যেই এ সভ্যতাগুলোকে নদীর তীরবর্তী সভ্যতা বলা হয়ে থাকে।
নদীর তীরবর্তী সভ্যতার বৈশিষ্ট্য Characteristics of river valley Civilizationplus this blej
নদীর তীরবর্তী সভ্যতাগুলো কতগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এসমস্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ এ সভ্যতাগুলোকে অন্যান্য সভ্যতা থেকে কিছুটা হলেও আলাদা করে রেখেছে। নিচে নদীর তীরবর্তী সভ্যতার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো-
১. কৃষি : কৃষি উৎপাদন দ্বারা এ সভ্যতাগুলোর সব কিছুই পরিচালিত হতো। প্রকৃতপক্ষে কৃষির প্রয়োজনে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে সভ্যতার চরম বিকাশ ঘটেছিল। কারণ কৃষির জন্য চাই সেচ এবং পর্যাপ্ত পানির যোগান
২. জল সেচ ব্যবস্থা কৃষিকাজ এবং বেঁচে থাকার জন্য পানির প্রয়োজন অপরিসীম। সব সময় পানির সরবরাহের পত লভ্যতা ও কৃষির প্রয়োজনে সেচব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। অর্থাৎ কৃষি কাজের জন্য নদীগুলো থেকে সেচের প্রবর্তন কর হয়। সুবিন্যস্ত জলসেচ পদ্ধতি নদীর তীরবর্তী সভ্যতাগুলোর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
৩. আমলাতন্ত্রের বিকাশ : নদীর তীরবর্তী সভ্যতাগুলোতে আমলাতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছিল অতিদ্রুততার সাথে। সংগঠি আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শোষক শ্রেণি বা রাষ্ট্রশক্তি জলসেচ ব্যবস্থা বলবৎ রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তাই ঐতিহাসিক Wittfogel তখনকার রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে জলসেচ নির্ভর সমাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
৪. ধর্ম ধর্ম হলো নদী তীরবর্তী সভ্যতার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। ধর্মীয় অনুশাসন টোটেম, ট্যাবু এবং পুরোহিতদের নিয়ন্ত্রণ, সভ্যতার বিকাশকে আরও গতিশীল করেছে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মীয় প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেক সময় রাজাই পুরোহিতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতো।
৫. ভাষা : নদী তীরবর্তী সভ্যতাগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এসব সভ্যতার মানুষ তাদের নিজস্ব ভাষা রীতিতে কথা বলত এবং তাদের লেখার জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি ব্যবহার করত। সুতরাং বলা যায়, নদীর তীরবর্তী প্রতিটি সভ্যতারই নিজস্ব ভাষা ও লিখন পদ্ধতি ছিল ।
৬. নদ-নদীর চ্যালেঞ্জ : অভাব আবিষ্কারের জননী, আর প্রতিবন্ধকতাই মুক্তির পথ দেখায়। উক্তিগুলো নদী তীরবর্তী স সৃষ্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যেমন- মিশরীয় সভ্যতা; চৈনিক সভ্যতা ইত্যাদি।
৭. যুদ্ধ-বিগ্রহ : অধিকাংশ সভ্যতাগুলোই শান্ত ছিল না। এসব সভ্যতার আওতাভুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য দল, উপদলগুলোর মধ্যে বিরামহীন রক্তপাত ও যুদ্ধ-বিগ্রহ বিরাজমান ছিল। তারা সবসময়ই একে অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চেষ্টা করত। ফলে সেসব ক্ষেত্রে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। তাই বলা যায়, সভ্যতাগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে পড়েছিল। ৮. সামাজিক শ্রেণির বিকাশ : নদীর তীরবর্তী সভ্যতাগুলোতে ব্যক্তিমালিকানা এবং সামাজিক শ্রেণির বিন্যাসের সূত্রপাত হয়েছিল। নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে এ ধরনের বিন্যাস ব্যবস্থা বিকাশ লাভ করে। আর এ কারণেই সভ্যতাগুলো থেকে আমরা সামাজিক স্তরবিন্যাস, শোষণ ও উঁচু-নিচু শ্রেণি দেখতে পাই ।
১. ব্যবসা-বাণিজ্য : নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার ব্যবসা-বাণিজ্যকে প্রসারিত করেছে। নদীপথে সহজ ও নিরাপদ যাতায়াত ও যোগাযোগ, পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে ব্যবসায়-বাণিজ্যের উন্নতি ঘটায় এবং এর মধ্য দিয়ে নদীর তীরবর্তী সভ্যতাসমূহের বিকাশ ঘটেছে।
১০. যোগাযোগ ও যাতায়াত : নদী পথের সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে ওঠার ফলে একদিকে যেমন বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যকার দূরত্ব হ্রাস পেয়েছে, তেমনি মতাদর্শ, ভাব বিনিময় সম্ভব হয়েছে। ফলে নদী তীরবর্তী অনুকূল পরিবেশে সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে। তাই বলা যায়, সভ্যতা শুরুর প্রথম দিকে মানুষের যোগাযোগ ও যাতায়াতের সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল নদী ।
১১. রাজ শক্তির উদ্ভব : যেহেতু কৃষির উৎপাদনের জন্য জলসেচ ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল সেহেতু এ জলসেচ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে এবং ব্যবহার করতে কেন্দ্রীয় ক্ষমতাশালী রাজশক্তির উত্থান ঘটেছিল। আর এভাবেই নদী তীরবর্তী সভ্যতাগুলোতে বিশাল বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল।
১২. পরিপূর্ণ বিকাশ : সভ্যতাগুলোর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল নব্য প্রস্তর যুগে এবং ধাতুর প্রবর্তনের ফলে সভ্যতাগুলো পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করেছিল। সভ্যতাগুলো বিকাশে নদ-নদী এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যা সভ্যতাগুলোকে দিয়েছে গতিময়তা এবং উন্নয়নের ছোঁয়া।
১৩, সুষ্ঠু আবাসন ব্যবস্থা : বসবাসের জন্য ও স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী এলাকা হচ্ছে নদীর তীরবর্তী এলাকাসমূহ। তাই নদীর তীরবর্তী স্থানেই মানুষ আবাসন ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। আর এ সব এলাকার মানুষের বসবাসের ব্যাপক সুযোগ থাকায় নদী তীরে গড়ে উঠেছে সভ্যতার লীলাভূমি।
, যা এসব নদীগুলো থেকে পাওয়া যেত আর এ কারণে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছে।
১৪. সম্পদ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি : নদী তীরবর্তী সভ্যতায় বনজ ও খনিজ সম্পদ আনা-নেওয়ার জন্য নদীপথই উত্তম। নদীকে মানব জীবনের প্রয়োজনে ব্যবহার উপযোগী করার মাধ্যমেই অধিক ভূমিকে কৃষির আওতায় আনা সম্ভব হয়। ফলে এ অঞ্চলে জনসংখ্যা ও সম্পদ দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায় ।
পরিশেষে বলা যায় যে, নদীসমূহের আশীর্বাদ এসব সভ্যতাগুলোকে দিয়েছে প্রাণ বা জীবনী শক্তি। ফলে নদীর কল্যাণে এসব সভ্যতাসমূহ হয়েছে সমৃদ্ধ, উন্নত ও ইতিহাস বিখ্যাত। তাই বলা যায়, টিকে থাকা বা বেঁচে থাকার জন্য নদ-নদীর পানির গুরুত্
অপরিসীম। নদীর বহুমাত্রিকতা ব্যবহারই সত্যতা উদ্যেগে দৃঢ় ভূমিকা পালন করেছে। তাই ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন, “সত্যতা হচ্ছে নদীর অপরিসীম দান।"

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]