ভূ-প্রাকৃতিক/ ভূ-সংস্থানিক মতবাদ Topographical Theory

সভ্যতা বিকাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হলো ভূ-প্রাকৃতিক মতবাদ বা Topographical Theory। এ মতবাদে বলা হয়েছে যে, সভ্যতার উত্থানের জন্য মানব বসবাসরত ভূ-খণ্ডের গুণাগুণ বিবেচনা করতে হবে। পৃথিবীর উপরিভাগে বিদ্যমান অবস্থা সভ্যতা অভ্যুদয়ের অপরিহার্য বা মৌলিক শর্ত ।
বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, শুধু অনুকূল আবহাওয়া নয় বরং সভ্যতার উত্থান, বিকাশ ও টিকে থাকার জন্য দরকার পৃথিবীর উপরিভাগের ভূ-প্রাকৃতিক বিচিত্রতা। সমভূমি, পর্বতমালা, বনভূমি, নদী, সাগর ইত্যাদির সহাবস্থান সভ্যতার উত্থান, বিকাশ ও টিকে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান ।
ভূ-প্রাকৃতিক মতবাদের প্রধান প্রবক্তারা হলেন জার্মান পণ্ডিত কার্ল রিটার (Karl Ritter) ও ইংলিশ ঐতিহাসিক টমাস বাকল (Thomas Bucl) |
কার্ল রিটার (Karl Ritter) : ভূ-প্রাকৃতিক মতবাদ প্রসঙ্গে কার্ল রিটার বলেন, “The form and shape of continents are of great importance in providing adventages for cultural growth." অর্থাৎ সভ্যতার বা সংস্কৃতির অগ্রগতির জন্য ভূ- প্রাকৃতিক বিচিত্রতা দরকার। Karl Ritter-এর মতে, অধিকতর ঘন সন্নিবেশিত ও সমরূপ সভ্যতার মানুষ সাধারণত বেশি পিছিয়ে থাকে এবং একঘেয়ে বা অভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম দেয়। ইউরোপে উন্নত সভ্যতা বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে কার্ল রিটারের তত্ত্বের সখ্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। কার্ল রিটার ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য কয়েকটি উপাদানের প্রভাবকে অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেছেন। যথা-
১. সমভূমি, ২. বনভূমি, ৩, পর্বত, ৪, পোতাশ্রয়, ৫. গণ বিন্যস্ত ভৌগোলিক পরিবেশ, ৬. নদীনালা এবং ৭. ব্যবসা- বাণিজ্যের সম্ভাবনা। এসব উপাদান এক সঙ্গে কোথাও উপস্থিত থাকলে বহুমুখী সংস্কৃতির জন্ম দেয়। আবার এসব উপাদানের খণ্ড খণ্ড উপস্থিতি একপেশে সংস্কৃতির জন্ম দেয় ।
কার্ল রিটার বলেন, মানুষ কী ধরনের সভ্যতা গড়ে তুলতে পারবে প্রাকৃতিক পরিবেশ তার রূপরেখা নির্ধারণ করে। কোনো সভ্যতা গড়ে ওঠার জন্য তার ভূ-প্রকৃতির মধ্যে বৈচিত্র্য থাকতে হবে। সমুদ্রতীর যত ভগ্ন হবে ততই সমুদ্রগামী মানুষের সংখ্যা ঘাড়বে ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা দেখা দেবে। কার্ল রিটার ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য বলতে একই সাথে সমভূমি, পর্বত, মালভূমি এবং বনভূমির অবস্থানকে বুঝিয়েছেন। পার্বত্য অঞ্চল সাধারণত বন্ধুর, করেময় ও বনভূমিতে সমাচ্ছন্ন। এজন্য এখানে যাতায়াত ও কৃষিকার্য অসুবিধাজনক। জনবিরল এবং প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সংগ্রাম করে চলতে হয় বলে উক্ত অঞ্চলের বাসিন্দাগণ কষ্টসহিষ্ণু, বলিষ্ঠ ও সাহসী। কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূল নয়।
কার্ল রিটার আরও বলেন যে, অধিকতর ঘনবিন্যস্ত প্রকৃতির ভৌগোলিক পরিবেশের মানুষ সাধারণত বেশি পিছিয়ে থাকে এবং একঘেয়ে বা অভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম দেয়। পিটার মনে করেন, পোতাশ্রয়ের (Port) অভাবে বহির্জগতের সাথে তাদের যোগাযোগ ক্ষীণ হয়। ফলশ্রুতিতে সেই অঞ্চলের মানুষ নিশ্চল বা স্থির হয়ে পড়ে এবং সভ্যতার অগ্রগতি হয় ব্যাহত। কার্ল রিটার বলেন, সমভূমি সাধারণত উর্বর ও পরিবহনযোগ্য। পৃথিবীর মোট আয়তনের প্রায় অধিকাংশ সমভূমির অন্তর্গত। তাই বলা যায়, সমভূমি অঞ্চলে পৃথিবীর অধিকাংশ শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো এবং অধিকাংশ বৃহৎ নগরগুলো অবস্থিত। সুতরাং শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি পরিবহন প্রভৃতির দিক থেকে সমভূমি অঞ্চল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তাই সমভূমি অঞ্চলের বাসিন্দাগণ পার্বত্য অঞ্চল ও মালভূমির বাসিন্দা অপেক্ষা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বহুগুণে সমৃদ্ধ ও উন্নত। অন্যদিকে বক্র, অসম উপকূল বিশিষ্ট মহাদেশেও সভ্যতা বিকাশের পরিবেশ লক্ষ করা যায়। পরিশেষে বলা যায় যে, ভৌগোলিক অবস্থার বৈচিত্র্য জাতিসমূহের অগ্রগতি সাধনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের সমাবেশ ঘটিয়েছে।
থমাস বাকল (Thomas Buckle) (১৮২১-১৮৬৮) : ভূ-প্রাকৃতিক মতবাদের অন্যতম আরেকজন প্রবক্তা হলেন হেনরি থমাস বাকল। তিনি জলবায়ু, খাদ্য ও মৃত্তিকার সাথে প্রকৃতিগত সম্পর্ক আবিষ্কার করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর মানুষের অধিকতর নিয়ন্ত্রণ সভ্যতা বিকাশে একান্ত আবশ্যক এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রকৃতি ও প্রাপ্তি বহুলাংশে সে স্থানের ভূ-প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ তিনি এশিয়া মহাদেশের পলল মৃত্তিকার কথা বলেন- যা সভ্যতা বিকাশে প্রভূত সহায়তা করে ।
টমাস বাকেল আরও বলেন যে, ভূ-প্রকৃতি মানুষের মন ও মানসিকতাকেও প্রভাবিত করে। তিনি মানুষের ওপর পরিবেশের বিবিধ প্রভাব সৃষ্টির বিষয়ে আলোকপাত করেন। যথা-
১১. ভূ-সংস্থান মানুষের অনুভূতিকে উদ্দীপিত করে এবং or siso b
২. ইহা মানুষের চেতনাকে তীক্ষ্ণ করে।
এ দুটি বিষয়ের আলোচনায় উদাহরণস্বরূপ বাকেল বলেন যে, ইতালি, স্পেন ও পর্তুগিজ উপদ্বীপে সংহার মূর্তিতে নিয়মিত ভূমিকম্পের উপস্থিতির কারণে এসব অঞ্চলে এতদসংক্রান্ত কুসংস্কারের প্রাধান্য লক্ষণীয় এবং ভূ-প্রকৃতি ইতালি ও স্পেনের অধিবাসীদের অনুভূতিকে উদ্দীপিত করা এবং কাব্য সত্তা জাগ্রত করণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাকেল বিভিন্ন জাতির মানসিক বিকাশ ধারার এবং সংস্কৃতির পার্থক্যও তুলনার মাধ্যমে তার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। বিশেষ করে ভারত ও গ্রিসের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য বিবেচনা করে বলেন, তারা নানাবিধ অলৌকিক শক্তির প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। ধর্ম চিন্তা এ মনোভাবের ওপর প্রভাব ফেলেছে। ফলে অলৌকিক শক্তির ওপর বিশ্বাস, ভারতীয়দের ধর্ম চেতনায় প্রভাব ফেলেছে। এজন্য বলা হয় ভূ-প্রকৃতি ভারতবাসীকে করেছে ধর্মকর্মের অনুরাগী। অপরদিকে গ্রিসের ভূ-প্রকৃতিতে স্বাভাবিক গুণাবলি বিদ্যমান থাকায় সেখানকার মানুষ হয়েছে আত্মপ্রত্যয়ী, সাহসী ও বাস্তববাদী।
এজন্যই বাকল যথার্থই বলেছেন যে, ভূ-প্রকৃতিই শিল্প সাহিত্য, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে গ্রিসকে করেছে উন্নত এবং বিখ্যাত দার্শনিক, সমালোচক ও চিন্তাবিদদের জন্ম দিতে পেরেছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, ভূ-প্রকৃতি কেবল মানুষের অনুভূতিকেই উদ্দীপিত করে না, মানুষের জ্ঞানকেও সুতীক্ষ্ণ ও যৌকি (Rational) করে তোলে ।
ভূ-প্রাকৃতিক/ ভূ-সংস্থানিক মতবাদের সমালোচনা Criticism of Topographical Theory
সমালোচকদের মতে, গ্রিসের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থা সুদৃঢ় প্রাচীনকাল থেকে একই অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও গ্রিক সভ্যতার ধ্বংস হয়েছে কেন? ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থা এক সময় মানুষকে আত্মপ্রত্যয়ী, উদ্যমী, সাহসী করলেও
বর্তমানে সে অবস্থা আর নেই। প্রতিকূল পরিবেশে মানুষকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকে ধাবিত করছে। ফলে সভ্যতার এ মতবাদের গুরুত্ব দিন দিন কমে যাচ্ছে। সমালোচকরা আরও মনে করেন যে, দীর্ঘ ও ভগ্ন সমুদ্র উপকূলভাগ জ্ঞান ও বাণিজ্য প্রসারের সহায়ক এটিও প্রমাণ করা যায় না। তদুপরি নৌপথ ও পোতাশ্রয়ের ভালো সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও রেনেসাঁ পূর্ব সময়েই সুইজারল্যান্ডে সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশকে এ তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করা যায় না। এ সভ্যতার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে একথাটি সত্য নয়। কার্ল পিটারের সব বক্তব্য বাস্তবতার সাথে কোনো মিল নেই ।
গরিশেষে বলা যায় যে, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক টমাস বাকেল ও কার্ল রিটার সভ্যতার উত্থান, বিকাশ ও পতন সম্পর্কে যে ভূ-প্রাকৃতিক আনুকূল্যতার কথা বলেছেন তা হচ্ছে ভূ-প্রাকৃতিক বিচিত্রতা। আর এ বিচিত্রতা না থাকলে সভ্যতার অগ্রগতি সম্ভব নয় ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]