যাযাবর মতবাদ Nomad Theory

মানুষের প্রাথমিক জীবন ছিল যাযাবর প্রকৃতির। খাদ্য সংগ্রহ ও শিকারের অভিপ্রায়ে এরা বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। এ আদিম যাযাবর জনগোষ্ঠীই এক সময় পশু পালন সমাজ ও পরবর্তীতে কৃষি সমাজের সূচনা করে। এ বিষয়গুলোর প্রেক্ষিতে ইতিহাসের কয়েকজন প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও দার্শনিকের মতে, স্থান ও ঐতিহাসিক স্থানসমূহ যাযাবরদেরই সৃষ্টি। এ মতবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন ফ্রাঞ্জ ওপেন হেইমার, তিনি তাঁর বিখ্যাত "The State : Its History and Development Viewed Sociologically' শীর্ষক গ্রন্থে সভ্যতা সৃষ্টিতে যাযাবরদের অসামান্য অবদানের বিষয়টি যুক্তিযুক্তভাবে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন যে, রণলিপ্সু ও রণপটু যাযাবর জনগোষ্ঠী অন্য জনগোষ্ঠী বা উপজাতিদের পরাস্ত করে অভিজাত মর্যাদা সম্পন্ন ও পরাক্রান্ত হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে যা পরবর্তী সময়ে সমাজ, নগর ও রাষ্ট্র গঠনের সহায়ক হয়েছে ।
এ প্রসঙ্গে বলা হয়, “Nomad were the orginal conquerors of primitive cultures and the founders of the state and of complex society.” অর্থাৎ যাযাবর জনগোষ্ঠীই হচ্ছে আদিম সংস্কৃতির উদ্ভাবক এবং এরাই রাষ্ট্র ও জটিল সমাজ তৈরি করে। তাঁর মতে খাদ্য সংগ্রহ ও শিকারের অভিপ্রায়ে আদিম জনগোষ্ঠী বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। অসভ্য ও বর্বর জাতিরা তাদের উট, গরু, মেষ ও ছাগল চরানোর জন্য দূর-দূরান্তে ঘুরে বেড়াত। তারা মরুভূমির এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে ভ্রমণ করত। কৃষি কার্যের ও স্থায়ী অধিবাসীদের তারা পরাজিত করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
ওপেনহেইমার উদাহরণ দিয়ে বলেন যে, ব্যবিলনীয়, অ্যাসেরীয়, আরবীয়, পারসীয়, মেসিডোনীয়, কার্থেজীয়, মঙ্গোল, রোমান, নরম্যান, স্যাক্সন প্রভৃতি সভ্যতার বিকাশ পর্যালোচনা করলে যাযাবর তত্ত্বের ধারণা শক্তিশালী হয়।
তিনি বলেন যে, যাযাবররাই প্রথম শোষণমূলক দাস ব্যবস্থার প্রচলন ঘটিয়েছিল- যা রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "The nomad is the inventor or slavery and thereby has created the seedling of the state, the first economic exploitation of man by man." রাষ্ট্র গঠনে ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশুপালক এমনকি কৃষিজীবীদের চেয়েও যাযাবরেরা অগ্রগণ্য ছিল বলে ওপেনহেইমার ও র‍্যাটজেল (Ratzel) মনে করেন। যাযাবর সম্প্রদায় কর্তৃক কৃষক সমাজ পরাজিত হয়ে রাষ্ট্র কাঠামোয় রূপান্তরিত হবার ক্ষেত্রে ওপেন হেইমার নিম্নোক্ত ছয়টি ধাপের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা-
১ . কৃষিজীবী-যাযাবর যুদ্ধ এবং যুদ্ধে যাযাবরদের বিজয় অর্জন ।
২. কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের পুনঃপ্রতিরোধ ব্যর্থতা এবং শেষ পর্যন্ত যাযাবরদের নিকট বশ্যতা স্বীকার ।
৩. কৃষকদের উদ্বৃত্ত উৎপাদন বিজয়ী যাযাবরদেরকে কর হিসেবে প্রদান ।
৪. বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সম্মিলন।
৫. কর্তৃত্ব বা ক্ষমতার ক্রমবিবর্তন এবং
৬. জাতীয় চেতনার বিকাশ ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি ।
মধ্য এশিয়ায় যাযাবরদের সম্পর্কে র‍্যাটজেল বলেন, "The nomad is as herdsman, an economic, as warrior, a political concept." যাযাবর সম্প্রদায়ের অধিকৃত জনগোষ্ঠীর সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি ধ্বংস করে এরূপ বক্তব্যের বিরোধিতা করে র্যাটজেল আবারও বলেন, "It must be remembered that nomads do not always destroy the opposing civilization of the settled folk, " ওপেন হেইমারের মতে, যাযাবররা বিভিন্নভাবে সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে। নিচে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. যাযাবর জনগোষ্ঠী যখন ক্রমশ খাদ্য উৎপাদন ও পশুপালনে অভ্যস্ত হয় তখন খাদ্য সংকট কাটে। ফলে এরা স্থায়ীরূপে বসতি স্থাপন পূর্বক স্থিতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
২. যাযবর জনগোষ্ঠী শিকার ও পশুপালনে অভ্যস্ত ছিল। খাদ্য সংকট ছিল তাদের মধ্যে প্রকট। কিন্তু বীজ থেকে বৃক্ষের ধারণা প্রথম যাযাবরদের মধ্য থেকেই উদ্ভব হয়। পরবর্তীতে কৃষি যুগে পদার্পণের মাধ্যমে সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠায় এরা ছিল সক্রিয়।
৩. যাযাবররা যুদ্ধে পারদর্শী হওয়ায় এরা নতুন নতুন জনগোষ্ঠীকে পরাজিত করে সেখানে নিজস্ব চেতনার সমাজ প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে জাতীয় চেতনা ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়ও এরা সহায়ক অবদান রাখে।
৪. যাযাবর জনগোষ্ঠী কোনো স্থানে স্থায়ী ছিল না। এরা প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াত। ফলে বিভিন্ন স্বাস যাযাবররা স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তাদেরকে পরাস্ত করে সে এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। সাথে ঐ অঞ্চলে তাদের আদলে উন্নত জীবনধারার প্রচলন ঘটায় ।
অনেক ঐতিহাসিক এ মতবাদের উদাহরণ হিসেবে আর্কাডীয় সভ্যতা, হিব্রু সভ্যতা, এশিয়া মাইনরের সভ্যতা, মেসোপটেমিয়া সভ্যতার কথা উল্লেখ করেছেন। তাই বলা যায়, যাযাবররা এভাবেই সভ্যতার দিক-বিদিক ছড়িয়ে দিয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন ৷
যাযাবর মতবাদের সমালোচনা Criticism of Nomad Theory
সভ্যতার বিকাশ সম্পর্কিত যাযাবর তত্ত্বটি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। সমালোচনায় বলা হয়েছে যে, উন্নততর সংস্কৃতি বা সভ্যতা সৃষ্টি সম্পর্কে এ মতবাদটি কোনো তথ্য প্রদান করে না বা দিক নির্দেশনা দেয় না। সমালোচকদের ভাষ্য হচ্ছে- সভ্যতার অগ্রগতির জন্য যাযাবর জাতি নয় বরং কৃষিজীবীদের অবদান সর্বাপেক্ষা বেশি। কারণ সেচ ব্যবস্থার প্রচলন, শস্য পঞ্জিকা তৈরি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে কৃষিজীবিরা বেশি অবদান রেখেছিল। অনেকেই সমালোচনা করে বলেছেন যে, যাযাবররা নিজস্ব সংস্কৃতি সৃষ্টি করলেও তা স্থায়ীরূপ দিতে পারেনি। যাযাবর তত্ত্বের প্রতিকূল অবস্থান নিয়ে আমেরিকান পণ্ডিত Thorstein Veblin উল্লেখ করেছেন যে, "Nomads peoples made no significant contributions whatever, with the expectations of the poetry and religious creeds and cults." যাযাবর জাতি খাদ্য উৎপাদন ও পশু পালনে অভ্যস্ত হলেও তা দীর্ঘরূপ লাভ করতে পারেনি।
পরিশেষে বলা যায় যে, সমালোচনা সত্ত্বেও পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম সভ্যতাসমূহ বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, যাযাবর জনগোষ্ঠী সভ্যতা নির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। কেননা প্রাচীন ব্যাবিলনীয়, আরবীয়, এসেরীয়, গ্রিক, পারসীয়, রোমান, স্যাক্সন প্রভৃতি সভ্যতা বিকাশে দাস ও যাযাবর জনগোষ্ঠীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]