সামাজিক ইতিহাসের উৎস Sources of Social History সামাজিক ইতিহাসের ধারণা

সামাজিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এর উৎসসমূহ প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে কাজ করে। সাধারণত যেসব উপাদানের মাধ্যমে অতীত সমাজ সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ করা যায় তাকে সামাজিক ইতিহাসের উৎস বলা হয়। অতীত সমাজ সম্পর্কে জানতে হলে একদিকে যেমন তার বস্ত্রগত সংস্কৃতি সম্পর্কে অবগত হতে হয়, অপরদিকে অ-বস্তুগত সংস্কৃতি সম্পর্কেও জ্ঞান আহরণ করতে হয়। তথ্য যদি সঠিক না হয় তাহলে বাস্তব ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। সমাজ ইতিহাসের মাল-মসলাও তার উৎস থেকেই খুঁজে পাওয়া যায়। সামাজিক ইতিহাস মানুষের জ্ঞান জিজ্ঞাসায় অনেক সমাধান দিয়েছে। মানব জাতির সামাজিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে পণ্ডিত ও গবেষকদেরকে বিভিন্ন উৎস বা উপাদানের ওপর নির্ভর করতে হয়।
'International Encyclopedia of Social Science' গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সামাজিক ইতিহাসের উৎস বহুমুখী । প্রকৃতপক্ষে যেকোনো সমাজের ইতিহাস জানতে হলে সে সমাজের আদিম অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থায় উত্তরণের ধারা জানতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন মানব সংস্কৃতির ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসের তথ্য নির্ণয় করা। মানব সংস্কৃতির এ তথ্যই হচ্ছে ইতিহাসের উৎস। আর এ সব উৎস থেকেই ঐ সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সকল অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। নিম্নে প্রধান প্রধান সামাজিক ইতিহাসের উৎসসমূহ আলোচনা করা হলো-
ক. প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন (Archeological innovation) : মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রতিচ্ছবি পেতে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিশেষ মূল্যবান। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে জন মার্শাল, হ্যামিলটন, প্রিন্সেস ক্যানিংহাম, রাখাল দাস বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ প্রত্নতাত্ত্বিকের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। ময়নামতি, পাহাড়পুর, মহাস্থান গড়, লালবাগ কেল্লা, উয়ারি বটেশ্বর বাংলাদেশ তথা ভারতের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। পুরানো দিনের নগর, রাজধানীর ভগ্নাবশেষের মধ্যে আমরা অতীত মানুষের জীবন প্রণালি সভ্যতা ও সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান, ধর্মবোধ ইত্যাদির পরিচয় পেয়ে থাকি। সুতরাং সামাজিক ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস ও উপাদান হলো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রধান প্রধান নিদর্শনসমূহ নিম্নরূপ-
১. মুদ্রা ও শিলালিপি : সামাজিক ইতিহাস রচনায় মুদ্রা ও শিলালিপি অন্যতম প্রধান উৎস বা উপাদান। প্রাচীন মুদ্রা ও শিলালিপিগুলোর মাধ্যমে শাসন সংক্রান্ত ঘোষণা, অনুশাসন দানপত্র, রাজপ্রশান্তি, রাজ্যের শাসনক 1, রাজ্যের বিস্ত তি, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতকি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রমাণ লাভ করা যায়। আবিষ্কৃত মুদ্রার মাধ্যমে শাসনের সময়কাল, শাসকের গুণাবলি, শাসকের অনুরাগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। সুতরাং মুদ্রা ও শিলালিপি সমকালীন যুগের সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য উৎস।
২. স্মৃতিসৌধ ও অট্টালিকা : সামাজিক ইতিহাসের উৎস হিসেবে স্মৃতিসৌধ ও অট্টালিকার ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এসবের ভগ্নাবশেষ থেকে তৎকালীন সমাজের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের উৎকর্ষতাসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন তথ্য লাভ করা যায়। এসব নিদর্শন থেকে মানুষের শিল্পানুরাগ, রুচিবোধ ও জীবন প্রণালির ধরন সম্পর্কে অনেক ঐতিহাসিক তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। অতএব সামাজিক ইতিহাসের উৎস হিসেবে স্মৃতিসৌধ ও অট্টালিকা ব্যাপক ভূমিকা রাখে ।
৩. হাতিয়ার ও আসবাবপত্র : আসবাবপত্র ও হাতিয়ার দেখে বিভিন্ন যুগকে চিহ্নিত করা যায়। যেমন- প্রস্তর যুগ, লৌহ যুগ; তাম্র যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ ইত্যাদি। এসব যুগের মানুষ যেসব হাতিয়ার ও আসবাবপত্র ব্যবহার করত তা নির্মিত হতো পাথর, কাঠ, জীবজন্তুর হাড়, শিং, দাঁত এবং বিভিন্ন ধাতুর মাধ্যমে। তাই পরিবর্তনশীল সমাজে এসব হাতিয়ার ও আসবাবপত্রের উল্লেখযোগ্য উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
৪. এপিটাফ বা স্মৃতিফলক : এর মাধ্যমে মানব সংস্কৃতির বিভিন্ন দিকের সন্ধান পাওয়া যায়। রেমন্ড ল্যামন্ট ব্রাউন এ
প্রসঙ্গে বলেন, "এপিটাফ জীবনধারার সাক্ষী, সমাজ চিত্রের দর্পণ।" মিশর, গ্রিস, ব্রিটেন প্রভৃতি অঞ্চলে আবিষ্কৃত এপিটাফ সামাজিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরবরাহ করেছে। সুতরাং সামাজিক ইতিহাসের উৎস হিসেবে এপিটাফের গুরুত্ব কম নয় ।
৫. বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি-প্রতিচ্ছবি : বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা থেকে প্রাপ্ত দেব-দেবীর মূর্তি হতে অতীত জীবনের ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা, শিল্পবোধ ও শৈল্পিক নিপুণতা এর ক্রমবিবর্তনের ধারা ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। ৬. ব্যবহৃত দ্রব্যাদি : অতীত সমাজে ব্যবহৃত লোহা, ব্রোঞ্জ, তামা, পাথর ও অন্যান্য ধাতব হাতিয়ার এবং দ্রব্যাদি পুরাতন আসবাবপত্র ও তৈজস পত্রের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক তথ্য উন্মোচিত হয়ে থাকে। যা সামাজিক ইতিহাসের উৎস হিসেবে ব্যাপক অবদান রাখে।
৭. রাজ প্রাসাদ ও মন্দির : বিভিন্ন অঞ্চলে আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহে প্রাচীন রাজ প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ যেমন পাওয়া গেছে, তেমনি তাদের ধর্মবোধ সম্পর্কেও জানা গেছে। যেমন- মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, তক্ষশীলা, পাহাড়পুর, ময়নামতি, মহাস্থান গড় প্রভৃতি ।
ঘ. প্রাচীন পৌরাণিক লোক কাহিনি ( Ancient folklore and myth) : বিভিন্ন জাতি যুগে যুগে তাদের লোককাহিনিকে অবলম্বন করে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি লাভ করেছে। মানবজাতি তথা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ইত্যাদি বৃহৎ জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের মধ্যে কোরআন, রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, ত্রিপিটক, বাইবেল, ইনজিল, তাওরাত, জবুর ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। মুসলিম ভারতের সামাজিক ইতিহাসের উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে সে যুগের নামকরা ঐতিহাসিক আলবিরুনীর 'কিতাবুল হিন্দ' গ্রন্থে। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে আবুল ফজলের 'আইন-ই-আকবরী' এবং আকবরনামায় বাংলাদেশ তথা ভারতীয় সামাজিক ইতিহাসের উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। মধ্যযুগে শাহনামা, আলিফ লায়লা, হাতেমতাই এর গল্প ও সাহিত্য, গ্রিক কবি হোমার এবং তাঁর কাব্য ইলিয়ড ও ওডেসি, দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো ও কনফুসিয়াস এবং তাঁদের তত্ত্বাবলি থেকে সামাজিক ইতিহাসের অনেক উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। গণিতবিদ ইউক্লিড, জ্যোতির্বিদ হিপার্কাস, বৈজ্ঞানিক আর্কিমিডিস ও তাঁদের আবিষ্কারসমূহও সামাজিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অনেক উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে । গ. বিদেশি পরিব্রাজকদের বিবরণী (Accounts of the foreign travelers) : বাংলাদেশসহ ভারতীয় সমাজের প্রাচীন ইতিহাস রচনায় বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে ঐতিহাসিকগণ মত প্রকাশ করেছেন। যুগে যুগে অনেক পর্যটক পৃথিবীকে জানবার জন্য বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন। তাঁরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও তাঁদের ভ্রমণ কাহিনি থেকে সমকালীন সমাজের যে চিত্র পাওয়া যায়, তা ইতিহাস সৃষ্টিতে অনেক খোরাক যোগাতে পারে। হেরোডোটাস, মার্কোপোলো, ইবনে বতুতা, মেগাস্থিনিস, ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাং প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত পর্যটকদের লিখিত বিবরণীতে সামাজিক ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সন্নিবিষ্ট হয়েছে। কাজেই সামাজিক ইতিহাস রচনায় বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে ঐতিহাসিকরা মত প্রকাশ করেছেন।
ঘ. সরকারি দলিলপত্র (Government's record) : বিভিন্ন সময়ে সংরক্ষিত দলিলপত্র থেকে তদানীন্তন সমাজের ঘটনাবহুল জানি অনেক তথ্যই সংগ্রহ করা সম্ভব। যেহেতু সমাজে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাবলির তথ্য সরকারি অফিসে জমা থাকে। তাই এ সকল তথ্য সামাজিক ইতিহাস রচনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
ঙ. সভ্যতার ইতিহাস (Ilistory of world civilization) : আদিম মানুষের জীবন প্রণালি এবং সমাজ ও সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা, গ্রিক সভ্যতা, রোমান সভ্যতা ও সিন্ধু সভ্যতাসহ বিভিন্ন সভ্যতায় খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন মানুষের জীবন প্রণালি। সুতরাং সভ্যতার উত্থান, বিকাশ ও পতনের ইতিহাস থেকে সামাজিক ইতিহাসের অনেক তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]