মানব সভ্যতার উত্থান-পতন সম্পর্কিত অসওয়াল্ড স্প্রেংলারের তত্ত্ব আলোচনা কর। Discuss the theory of Oswald Spengler regarding the rise and fall of civilization.

সভ্যতার উত্থান-পতন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে টয়েনবি দেখেছেন যে, কিছু বিভ্যতা উদ্ভবের প্রথম প্রহরেই স্থবির হয়ে পড়ে এবং কিছু কিছু সভ্যতা বিকশিত হয় আবার কিছু সভ্যতার পতন ঘটে। টরেননি বর্তমানের ছাড়াও অতীতের আরও ১৪টি বড় সভ্যতার সন্ধান পেয়েছেন। মোট ২১টি সভ্যতা নিয়ে তিনি তুলনামূলক আলোচনা (Comparative study) করেন। এসকল সভ্যতার জন্ম, বিকাশ, বার্ধক্য ও মৃত্যু সম্বন্ধে সাধারণ সত্য বা নিয়ম আবিষ্কারই ছিল তাঁর মৃ লক্ষ্য।
সভ্যতার উত্থান-পতন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে টয়েনবি অভিমত প্রকাশ করেন যে, সভ্যতার উদ্ভব গো। বা ভৌগোলিক কারণে নয় বরং তা দু'টি সুনির্দিষ্ট পারিপার্শ্বিক অবস্থার সমন্বয়ে সৃষ্ট। যথা- ১. সমাজে উদ্ভাবনী শক্তি সম্পন্ন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি এবং ২. ভারসাম্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ। যে সকল সভ্যতার মধ্যে এ দ্বিবিধ বিষয়ের উপস্থিতি বর্তমান ছিল সে সকল সভ্যতা দৃঢ় ভিত্তি পায়। আর যাদের মাঝে এর অনুপস্থিতি ছিল তাদের সভ্যতা উপসভ্যতার স্তরে রয়ে যায় এবং স্থবির হয়ে পড়ে।
সভ্যতা কীভাব ধ্বংস, বিচ্ছিন্ন ও বিলুপ্ত হয় সে প্রসঙ্গে টয়েনবি 'A Study of History' শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, কোনো মহাজাগতিক বা ভৌগোলিক কারণ বা গোত্রীয় অবক্ষয় বা বহিঃআক্রমণ অথবা কলাকৌশল ও প্রযুক্তির দুর্বলতার জন্য সভ্যতার পতন হয় না। তিনি সভ্যতা পতনের জন্য ৩টি মূল কারণের কথা উল্লেখ করেন। যথা—
১. পরিবেশগত হুমকির মোকাবেলায় সংখ্যালঘু শ্রেণির উদ্ভাবনী শক্তির ব্যর্থতা।
২. প্রভাবশালী সংখ্যালঘু শ্রেণির উপর থেকে সংখ্যাধিক্য শ্রেণির আনুগত্য ও সমর্থন প্রত্যাহার এবং
৩. সামাজিক সংহতি ও ঐক্যের অবসান ।
টয়েনবি সভ্যতার অবক্ষয় পর্যায়কে ধ্বংস প্রাপ্তি, বিচ্ছিন্নতা ও বিলুপ্তি— এ তিনটি উপপর্যায়ে বিভক্ত করেন।
সভ্যতার পতন তত্ত্বের সমালোচনা Criticism of the Theory of Downfall of Civilization
টয়েনবির তত্ত্বটি নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। তিনি যে প্রতিকূলতা ও মোকাবিলার যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তার তীব্রতা সহ্যসীমার চেয়ে বেশি হলে মানুষ তা সহ্য করতে পারে না। অর্থাৎ চ্যালেঞ্জের মাত্রা সহ্য ক্ষমতা অতিক্রম করলে মানুষ তা আর বহন (Bear) করতে পারে না। এমতাবস্থায় উক্ত সভ্যতা স্তিমিত হয়ে পড়ে বা সৃষ্টিশীলতার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় ।
উদাহরণস্বরূপ আর্কটিস ও অ্যান্টার্কটিকের বরফাচ্ছাদিত দুর্গম অঞ্চলের কথা বলা যায়। এখানে জলবায়ু ও প্রতিকূলতা এতই তীব্র যে, সেখানে সভ্যতা গড়ে উঠতে পারেনি। কাজেই চ্যালেঞ্জ যত বড় সাফল্যও ততবেশি। (The greater the challenge the greater the response) ধারণাটি সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
সমালোচনায় আরও বলা হয়েছে যে, টয়েনবির এ গ্রন্থটি আকারে খুবই বিশাল এবং মূল বক্তব্য ও তাত্ত্বিক গুরুত্ব খর্ব না করেই তিনি গ্রন্থটিকে অনেক ছোট করতে পারতেন। বাইবেল, পুরাণ, কবিতা ইত্যাদি থেকে তাঁর দীর্ঘ ও অনেকটা অপ্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি কলেবরের অহেতুক বৃদ্ধি ঘটিয়েছে।
সমালোচকদের মতে, জটিল কারণমালার বিশ্লেষণ না করে সভ্যতা পতনের কারণ ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কাজেই সভ্যতার পতন ও অগ্রগতির কারণ বিশ্লেষণের জন্য একক কোনো কারণ চিন্তা না করে একাধিক কারণ বিশ্লেষণ করাই উত্তম।
পরিশেষে বলা যায় যে, টয়েনবির এই তত্ত্বানুসারে দুঃখ, কষ্ট এবং যাতনার পরিস্থিতি বা দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি হলো প্রকৃত কারণ যা বিভিন্ন উন্নত সংস্কৃতির উত্থান ও বাস্তব রূপ গ্রহণের একমাত্র কারণ। তত্ত্বটি নিঃসন্দেহে বাস্তব সম্মত ও সর্বাধুনিক। এ তত্ত্বটিতে যে সাধারণ সত্যটি উন্মোচিত হয়েছে তা হলো সভ্যতার উদ্ভব ও অগ্রযাত্রায় প্রতিকূলতা বা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও ধ্বংস হবার কারণ বিশ্লেষণে টয়েনবি যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন সে জন্য ইতিহাসে তাঁর নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে ।
সভ্যতার চক্রাকার তত্ত্ব : ওসওয়াল্ড স্পেংলার
Cyclical Theory of Civilization: Oswald Spengler

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী লেখক ওসওয়াল্ড স্প্রেংলার (Oswald Spengler) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Decline of the welt-এ সভ্যতার ইতিহাসের নতুন ব্যাখ্যা দেন।
তিনি সভ্যতার বিকাশ, পরিপূর্ণতা এবং ধ্বংস হওয়ার প্রক্রিয়াটি গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে সভ্যতার উত্থান-পতন সংক্রান্ত মতবাদ প্রদান করেন।
তিনি ভারতীয় গ্রাকো-রোমান, আরব ও পাশ্চাত্য সভ্যতার উত্থান-পতন বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনি সভ্যতাকে ঋতুর সাথে তুলনা করে বলেন, প্রতিটি সভ্যতা চারটি ঋতুর মতোই আবর্তিত হয়। সভ্যতার আবর্তন প্রক্রিয়ায় প্রথম আসে বসন্ত, এরপর গ্রীষ্ম ও শরৎ এবং সবশেষে আসে শীত। শীত আসার অর্থ হলো সভ্যতার পতন তথা ধ্বংস পর্বের আগমন ।
তাঁর মতে পাশ্চাত্য সভ্যতার এখন শীতকাল চলছে এবং সভ্যতার বসন্তকাল বা চূড়ান্ত সমৃদ্ধি ঘটেছিল ১৮০০ সালের দিকে এবং এখন তা দ্রুত অধঃপতনের দিকে ধাবমান ।
স্পেংলার ব্যক্তি স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে জৈবিক প্রয়োজনীয়তার (Biological Necessity) ওপর জোর দিয়েছেন এবং কোনো অদৃশ্য শক্তির ক্রিয়ার ওপর গুরুত্ব দেননি। স্প্রেংলার ঋতুর আবর্তনকালীন আলোচনা করেছেন যেভাবে-
স্পেংলার এর মতে, সভ্যতার আবর্তন প্রক্রিয়ায় প্রথমে আসে বসন্ত। বসন্তকালে প্রকৃতি নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে পূর্ণতা লাভ করে তেমনি সময়ের ধারায় এবং পরিবেশ পরিস্থিতিগত কারণে সভ্যতাও এক সময় উৎপত্তি হয়ে চূড়ান্ত সমৃদ্ধির স্তরে পৌঁছে।
সভ্যতার আবর্তন প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয় স্তর আসে গ্রীষ্মকাল। এ ঋতুর দাবানলে যেমন বসন্তের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বাভাবিকতাকে লণ্ডভণ্ড বা বিনষ্ট করে দেয় তেমনি সময়ের পটপরিবর্তনে সভ্যতার স্বাভাবিকতাকেও লণ্ডভণ্ড করে দেয়। ফলে সভ্যতা চরম বিকাশের পর্যায় থেকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারে না।
সভ্যতার আবর্তন প্রক্রিয়ায় তৃতীয় স্তরে আসে শরৎ। এ ঋতুর আগমনে প্রকৃতিতে যেমন বার্ধক্য নেমে আসে তেমনি সভ্যতার গতিও মন্থর হয়ে পড়ে।
সভ্যতার আবর্তন প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ বা চতুর্থ স্তরে আসে শীত। শীত আসার অর্থ হলো সভ্যতার পতন তথা ধ্বংস পর্বের আগমন। স্প্রেংলারের উপরোক্ত ব্যাখ্যা আরব মনীষী ইবনে খালদুনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। স্পেংলারের কয়েক শতাব্দী পূর্বে খালদুন সভ্যতা বিকাশের ব্যাখ্যা দেন। খালদুন বলেন যে, মানুষের মতো প্রতিটি সভ্যতার জন্মকাল, যৌবনকাল, বার্ধক্য ও মৃত্যু আছে।
স্পেংলারের সভ্যতার তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ড. বুদ্ধ প্রকাশ বলেন, "We feel as it Oswald Spengler was merely recapitulating the theories and concepts of Ibn Khaldun." অর্থাৎ আমাদের মনে হয় ওসওয়াল্ড স্পেংলার যেন ইবনে খালদুনের ধারণা ও গবেষণারই পুনরুক্তি করেছেন। স্প্রেংলার এর মতে, সভ্যতাসমূহ পূর্ণ বিকশিত হয়ে পৃথিবীর বুকে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। অগ্রসরমান সভ্যতার এমন এক পর্যায় আসে যখন তার গতিপথ মন্থর হয়ে পড়ে। সভ্যতা পতনের ঘণ্টা বেজে ওঠে। আর এভাবেই চলতে থাকে সভ্যতার উত্থান, বিকাশ ও পতন।
সভ্যতার চক্রাকার তত্ত্বের সমালোচনা : ওসওয়াল্ড স্পেংলার
Criticism, of Cyclical Theory of Civilization: Oswald Spengler

স্প্রেংলারের সভ্যতার তত্ত্বটিও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়-
১. স্পেংলার সভ্যতার মতবাদে, বিবর্তন ও প্রগতিকে এককভাবে বিবেচনা করেছেন। তাঁর এ ব্যাখ্যাকে সমাজবিজ্ঞানীরা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
২. পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও সমন্বিতভাবে ক্রিয়াশীল অংশ নিয়ে জীব তত্ত্বের উৎপত্তি, বিকাশ ও ধ্বংস হলেও সমাজ ও সংস্কৃতির সেভাবে উৎপত্তি, বিকাশ এবং পতন হয় না।
৩. সমালোচকরা উল্লেখ করেছেন যে, বহুচক্র সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও পতনকে পরিচালিত করতে পারে কিন্তু তা চক্রাকারে পরিবর্তিত হবে এমন কোনো কথা নেই ।
সুতরাং বলা যায়, Spengler-এর সভ্যতার উত্থান ও পতনের ব্যাখ্যা মুসলিম দার্শনিক ইবনে খালদুনের সভ্যতার উত্থানের ব্যাখ্যার সাথে প্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাঁর এ তত্ত্ব, সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে Karober এবং Sorokin নামক গবেষকদ্বয় বলেছেন, “Many great cultural or social systems or civilizations have many cycles, many social intellectual and political ups and downs in their virtually indenfinitely long span of life, instead of just a life cycle, one period of blossming and one of the declien."

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]