সভ্যতার উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে ইবনে খালদুনের তত্ত্ব আলোচনা Discuss/ critically discuss Ibn Khaldun's theory regarding the rise and fall of civilization.

চতুর্দশ শতকের বিখ্যাত আরব মনীষী ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) সভ্যতার উত্থান-পতন ব্যাখ্যায় একটি মতবাদ বা তত্ত্ব প্রদান করেন। তিনি সভ্যতার উত্থান-পতনকে মানব দেহের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন যে, মানব দেহের যেমন জন্মকাল, যৌবনকাল, বার্ধক্য ও মৃত্যু আছে, তেমনি প্রতিটি সভ্যতারও জন্মকাল, যৌবনকাল, বার্ধক্য ও মৃত্যু অবধারিত । ইবনে খালদুন তাঁর সভ্যতার তত্ত্বে উল্লেখ করেছেন, মানুষের গোষ্ঠী সচেতনতা থেকে জন্ম হয়েছে সমাজের যার শুরু হয়েছে যাযাবর জীবন থেকে। আর সমাজ ধীরে ধীরে উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে জন্মলাভ করেছে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের ।
১৩৭৭ সালে ইবনে খালদুন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'কিতাবুল ইবর' বা বিশ্ব ইতিহাস রচনা করেন। এটি তিন খণ্ডে বিভক্ত ছিল । প্রথম খণ্ডটি ছিল 'আলমুকাদ্দিমা'। ইবনে খালদুন আল মুকাদ্দিমায় প্রথম খণ্ডে সমাজ, রাষ্ট্র, তথা সভ্যতার উত্থান-পতন সংক্রান্ত মতবাদ প্রদান করেন। এ মতবাদই হলো আসাবিয়া। আল মুকাদ্দিমায় ৬টি বিষয় রয়েছে। যথা-
ক. মানব সমাজের বিভিন্ন দিক,
খ. যাযাবর সমাজের বর্বর গোষ্ঠীসমূহের জীবন
গ. শহর, নগর ও প্রদেশ বিষয়ক,
ঘ. অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কিত, ৩. রাষ্ট্র বিষয়ক,
চ. জ্ঞান আহরণের বিভিন্ন পদ্ধতি ও তার প্রকৃত রূপ সম্পর্কে আলোচনা।
খালদুনের মতে, সমাজ জীবন শুরু হয় যাযাবর জীবন থেকে। পরবর্তী এক পর্যায়ে তাঁরা শুরু করে সমাজবদ্ধ জীবন। সমাজবদ্ধ জীবনে দেখা দেয় সেই সমাজকে পরিচালিত করার জন্য একজন শাসকের প্রয়োজনীয়তা। খালদুন আরও উল্লেখ করেন যে, নগর জীবন গড়ে উঠলে সম্পদ উৎপাদনের লক্ষ্যে মানুষ বোধ করতে শুরু করে শ্রমবিভাজন ও পারস্পরিক সাহায্য- সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা। পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে প্রারম্ভিক পর্যায়ে সমাজের উন্নতি ও সমৃদ্ধি সাধিত হয় ঠিকই কিন্তু সভ্যতার উচ্চতম পর্যায়ে সমাজের উচ্চতর শ্রেণির ব্যক্তিরা সম্পদ উৎপাদন না করে চেষ্টা করে অপরের শ্রমের ওপর বেঁচে থাকার। এমতাবস্থায় বৃদ্ধি পায় শ্রেণি শোষণ এবং ধনিক শ্রেণির দ্বারা গরিব শ্রেণির এ শোষণ ও নির্যাতন সমাজের ধ্বংস ডেকে আনে। তাই তিনি বলেছেন, সমাজ ও সভ্যতার পতনের শক্তি ও কারণসমূহ ক্রিয়াশীল থাকে সমাজেরই অভ্যস্তরে।
ইবনে খালদুনের মতে, সমাজ ও সভ্যতার উৎপত্তি হতে অবনতি পর্যন্ত পাঁচটি পর্যায় অতিক্রম করে থাকে।
যথা— ক. প্রাথমিক পর্যায় বা সংহতিকরণ পর্ব : এ পর্বের মূলভিত্তি হলো আসাবিয়া বা Social Solidarity। সমাজ ও সভ্যতার এ পর্যায়ে গোষ্ঠী সংহতি খুব জোরালো থাকে। গোষ্ঠী প্রধান তার ইচ্ছানুযায়ী কর্মে লিপ্ত না থেকে গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করেন।
খ. দ্বিতীয় পর্যায় বা স্বৈরতান্ত্রিক পর্ব : এ পর্যায়ে মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে ব্যক্তির কল্যাণ বড় হয়ে দেখা দেয়। এসব শাসক অধিক স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। এ পর্যায়ে সমাজে শাসকদের অত্যাচার ও নির্যাতনে শৃঙ্খলা ও সংহতি নষ্ট হতে থাকে খালদুনের মতে, স্বৈরতান্ত্রিক পর্বেই সভ্যতার পতনের সূত্রপাত ঘটে ।
গ. তৃতীয় পর্যায় বা শোষণের পর্ব : স্বৈরতান্ত্রিক পর্বের স্বেচ্ছাচারিতাই শাসকদেরকে কল্পনাবিলাস ও আরামপ্রিয় করে তোলে। এ পর্যায়ে আরাম-আয়েশ ও সম্ভোগের দিকে ঝোঁক বেশি দেখা দেয়। ফলে সামাজিক অসমতার সৃষ্টি হয় এবং পতনের
পথ প্রশস্ত হয় ।
ঘ. চতুর্থ পর্যায় বা শাস্তি সংস্থান পর্ব : এ পর্যায়ে শাসক জনগণের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। অধিক মাত্রায় আরাম-আয়েশ ও ভোগ প্রবণতায় শাসককে আভিজাত্য ও দত্ত প্রকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ফলে শাসক তার স্থিতিশীলতা ও ক্ষমতার প্রাধান্যের কারণে সর্বশক্তি নিয়োগ করে থাকে। এজন্য সামাজিক শৃঙ্খলা ও সংহতি নষ্ট হয়ে সাধারণ
জনগণের মধ্যে অসন্তোষ ছড়াতে শুরু করে।
গু. পঞ্চম পর্যায় বা ধ্বংস ও পতন পর্ব : এ পর্বে রাজ্য জুড়ে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার সৃষ্টি হয় এবং গোষ্ঠী সংহতি পুরোপুরি বিনষ্ট হয়ে পড়ে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, শোষণ ও শান্তি সংস্থান পর্বে অধিক মাত্রায় আরাম-আয়ে ভোগ প্রবণতা এবং আভিজাত্য ও দম্ভ প্রকাশের মাধ্যমে শাসক জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলে শাসকগণ দুশ্চরিত্র, লম্পট ও অমিতব্যয়ী হয়ে পড়ে। রাজকোষ শূন্যের কোঠায় দাঁড়ায়, এসব সুযোগেই শত্রুপক্ষ আক্রমণ করে রাষ্ট্র দখ করে নেয়। পরিবর্তনের চক্রপূর্ণ হয়। সভ্যতার পতন প্রান্তসীমায় গিয়ে পৌঁছে ।
ইবনে খালদুন মনে করেন যে, মানুষের ঐক্যবোধ যত সুসংহত, প্রবল ও শক্তিশালী হবে, রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটি ততবেশি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও আয়তনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। তিনি রাষ্ট্রের/ সভ্যতার জীবনকালকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন—
রাষ্ট্রের আয়ুষ্কাল
১ম প্রথম জীবনকাল বা স্থায়িত্ব ৪০ বছর
হয় দ্বিতীয় জীবনকাল বা স্থায়িত্ব ৮০ বছর
৩য় তৃতীয় জীবনকাল বা স্থায়িত্ব ১২০ বছর
অর্থাৎ কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থাই ১২০ বছরের বেশি তার সকল গৌরব নিয়ে টিকে থাকতে পারে না।
ইবনে খালদুন আরও বলেছেন যে, "আসানিয়া হচ্ছে এক ধরনের আদর্শভিত্তিক অনুভূতি, যে অনুভূতিতে সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকে। সমাজস্থ মানুষের সংঘবদ্ধ জীবন টিকিয়ে রাখতে হলে পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি প্রয়োজন।" তিনি তাঁর সমাজ ও রাষ্ট্র চিভায় সম্প্রীতির বন্ধনের উৎস খুঁজে পেয়েছেন উপজাতির গোজনীতি ও রক্ত সম্পর্ক, ধর্মীয় চেতনা এবং নৈকট্যজনিত বন্ধুত্ব ও সহধর্মী জীবনযাত্রার মধ্যে।
তিনি মূলত একটি গোষ্ঠীর সমন্বিত মানসের অভিব্যক্তি জাপন করার জন্য আসাবিয়া প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Corporate of group' অর্থাৎ একই গোষ্ঠী চেতনায় সকলের একাত্ববোধ বা সংহতি ।
সভ্যতার চক্রাকার তত্ত্বের সমালোচনা : ইবনে খালদুন Criticism of Cyclical Theory of Civilization: Ibn Khaldun
মানব সভ্যতার উত্থান-পতনে ইবনে খালদুনের তত্ত্বটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। নিম্নে সমালোচনাগুলো আলোচনা করা হলো-
১. সমালোচকদের মতে, ইবনে খালদুন সমাজ সভ্যতার ইতিহাসের খণ্ডিত অংশের বিশ্লেষণ করেছেন মাত্র।
2 তিনি রাষ্ট্রের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল সম্পর্কে বলেছেন যে, এর স্থায়িত্বকাল চার পুরুষ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের স্থায়িত্বকাল কম-বেশি হতে পারে।
৩. ইবনে খালদুন সমাজ ও সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও পতনের পর্বসমূহকে জীবদেহের সাথে তুলনা করেছেন। কিন্তু > জীবতত্ত্বে যে অর্থে Organism প্রত্যয়টিকে ব্যবহার করা হয় সে অর্থে সমাজ ও সভ্যতায় ব্যবহার করা যায় না।
৪. ইবনে খালদুন সমাজ ও সভ্যতার তত্ত্বটিতে সমাজ ও পরিবর্তনের জন্য জাতি বা গোষ্ঠীর সাথে সমাজের সম্পর্ককে প্রাধান্য > দিয়েছেন। গোষ্ঠীর সাথে সমাজের সম্পর্কের সাথে সাথে উৎপাদন পদ্ধতির ভূমিকাকে বিবেচনা করা হয়নি।
৫. তিনি সভ্যতার উদ্ভব-বিকাশকে জীবন্ত জীবদেহের (Living organism) সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণযোগ্য নয় । সমালোচনা সত্ত্বেও বলা যায় যে, মানব সভ্যতার উত্থান-পতন সম্পর্কিত ইবনে খালদুনের তত্ত্বটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ । সুতরাং বলা যায় যে, রাষ্ট্র, সমাজ ও সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ, আয়ুষ্কাল ও পতন সম্পর্কিত ধারণা বিশ্লেষণে ইবনে খালদুনের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে অসাধারণ করেছে, দিয়েছে অমরত্ব। তাই ঐতিহাসিক ডি বোয়েস উল্লেখ করেছেন যে, কতিপয় কারণ ও পরিস্থিতির আলোকে সমাজের অগ্রগতি ও উত্তরণের ব্যাখ্যায় ইবনে খালদুন নিঃসন্দেহে প্রথম ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]