সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণসমূহ লেখ । Write the causes of fall of Indus-valley civilization.

সিন্ধু সভ্যতার পতন : সিন্ধু সভ্যতা বিলুপ্তির বা পতনের কারণ আজও রহস্যাবৃত। বিভিন্ন পণ্ডিতগণ সিন্ধু সভ্যতার পতনের
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা—
i. অভ্যন্তরীণ অবক্ষয়;
ii. বন্যা ও ভূমিকম্প;
iii. জলবায়ু পরিবর্তন;
iv. সিন্ধু নদের গতি পরিবর্তন :
উপর্যুক্ত কারণগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বিশেষ করে ঘন ঘন বন্যার কারণে সিন্ধুসভ্যতার পতন ঘটে বলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত হয়েছেন। গর্ডন চাইল্ড এ প্রসঙ্গে বলেছেন- কোনো এক অজ্ঞাত দুর্যোগে এ সভ্যতার পতন ঘটে।"
R.S. Sharma-এর মতে, "At the end of this period (about 1200 years) it (Indus valley culture) goes out of history practically unwept and unsung."
উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, সিন্ধু তথা ভারতীয় সভ্যতা সৃষ্টির ইতিহাস যেমন অস্পষ্ট তেমনি তার অবলুপ্তির বিষয়টিও রহস্যাবৃত্ত। প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক দৃশ্যে ভরপুর হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা সিন্ধু সভ্যতাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। নদী তীরবর্তী সভ্যতা হওয়ার সুবাদে সিন্ধু সভ্যতা অত্যন্ত শক্তিশালী কৃষিভিত্তিক আর্থিক বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, সিন্ধু সভ্যতার আলোকেই পরবর্তীতে আর্য সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
সিন্ধু সভ্যতার সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব/ সিন্ধু সভ্যতার অবদান
The social importance of Indus civilization/ Contribution of Indus Civilization
অর্ধ শতাব্দীর কিছুকাল পূর্বে ব্রিটিশ ভারতের বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জোদারোতে এবং পাঞ্জাবের মন্টোগামারী জেলার হরপ্পাতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে যে ধ্বংসস্তূপ আবিষ্কার হয় তাতে জানা যায় যে, মিশর ব্যাবিলনিয় প্রভৃতি সভ্যতার সমসাময়িক বা ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা প্রায় হাজার বছর পূর্বে ভারতবর্ষে গড়ে উঠেছিল।
ঐতিহাসিকদের মতে, নদীর তীরবর্তী সভ্যতা হওয়ার সুবাদে সিন্ধু সভ্যতা অত্যন্ত শক্তিশালী কৃষিভিত্তিক আর্থিক বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সিন্ধু সভ্যতার নাগরিকদের জীবন ছিল সুসংগঠিত ও সুনিয়ন্ত্রিত। এ সভ্যতায় শক্তিশালী প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ভিত্তি রচিত হয়েছিল। এছাড়াও সিন্ধু সভ্যতায় অট্টালিকা, দুর্গ, সুবৃহৎ প্রাসাদ ও শস্য মজুদ রাখার জন্য শস্যাগার ইত্যাদি নিদর্শন থেকে সিন্ধু সভ্যতার জীবনধারা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ।
ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজকাঠামো নির্মাণে সিন্ধু সভ্যতা সুদূর প্রসারী অবদান রেখেছে। নিম্নে সিন্ধু সভ্যতার সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব আলোচনা করা হলো—
১. সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানা : সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত মূল্যবান ব্রোঞ্জ, তামা, স্বর্ণ, রৌপ্য, ধাতু ইত্যাদি দ্রব্য প্রমাণ করে যে, সিন্ধু সভ্যতায় জনসাধারণ বিভিন্ন অর্থনৈতিক পেশায় ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। প্রাপ্ত নিদর্শনসমূহে তাদের কৃষি, বয়নশিল্প, মৃৎপাত্র, ইট তৈরি, স্বর্ণকার, কর্মকার, কুমার প্রভৃতি পেশায় নিয়োজিত থাকার প্রমাণ দেয় ।
সামাজিক শ্রেণি সম্পর্কে জানা : এ সভ্যতায় বিভিন্ন খনন কার্যের ফলে সামাজিক শ্রেণিভেদ সম্পর্কে ব্যাপকভাবে জানা যায়, খনন কার্যের নিদর্শন বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, এখানে বসবাসরত মানুষ ৪টি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা— ক. শিক্ষিত শ্রেণি : এ শ্রেণির মধ্যে ছিল পুরোহিত, জ্যোতিষী, চিকিৎসক এবং জাদুকর গোষ্ঠী। বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদান এবং নিয়ম-কানুন প্রণয়ন এ শ্রেণির দ্বারাই সম্পন্ন হতো। পরবর্তীতে বৈদিক সমাজে ব্রাহ্মণরা সেই কাজ করত। খ. যোদ্ধা শ্রেণি : জনসাধারণকে রক্ষা করাই ছিল যোদ্ধা শ্রেণির প্রধান কাজ। যোদ্ধা শ্রেণির মধ্যে ছিল যুদ্ধের সৈনিকগণ
ও দুর্গের দ্বার রক্ষীগণ। এ যোদ্ধা শ্রেণিই পরবর্তীতে ভারতীয় সমাজে ক্ষত্রিয় নামে পরিচিতি লাভ করে ।
গ. ব্যবসায়ী ও কারিগর শ্রেণি : এ সভ্যতায় ব্যবসায়ী ও কারিগর শ্রেণিতে বিভিন্ন পেশার লোক ছিল। যেমন- লিপিকার, রাজমিস্ত্রি, শাঁখারি, স্বর্ণকার, তাঁতি, ছুতার ইত্যাদি।
ঘ. শ্রমজীবী শ্রেণি : শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষরা পরবর্তীতে বৈদিক যুগে চতুর্থ বা শুদ্রবর্ণে রূপান্তরিত হয়েছিল। শ্রমজীবী শ্রেণির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শ্রমিক, চর্মকার, জেলে, কুটির শিল্পের শ্রমিক, কৃষক এসব শ্রেণির বেশির ভাগই গৃহ কর্মে নিয়োজিত ছিল।
৩. হরপ্পা সভ্যতা : বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকগণ সিন্ধু সভ্যতার নতুন নামকরণ করেন হরপ্পা সভ্যতা। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এ সভ্যতার খননের ফলে প্রায় ২৫০টি হরপ্পার ধ্বংসাবশেষের অনুরূপ নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। হরপ্পার নগরবাসীরা বেশি উন্নত ও পৌর সচেতন ছিল। এ নগরে অভিজাত ও সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিদের সারিবদ্ধ প্রাসাদ যেমনি দেখা গেছে তেমনি আবার নগরীর উপকণ্ঠে শ্রমিকদের বস্তি ঘরের প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই ধারণা করা হয় যে, আধুনিক যুগের পৌর ব্যবস্থা সেখানে বিদ্যমান ছিল।
৪. বৃহৎ অট্টালিকা : হরমায় কেন্দ্রস্থলে ১৬৯ × ১৩৫ ফুট একটা বৃহৎ অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। যেটিকে শস্যাগার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ অট্টালিকা দুটি ব্লকে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে ২৩ ফুট ব্যবধান ছিল। দুটি ব্লকের প্রত্যেকটিতে দুটি করে হলঘর ও পাঁচটি করে বারান্দা ছিল। প্রতিটি হল আবার চারভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে আবার ১০০ ফুট লম্বা ও ১০০ ফুট চওড়া হাম্মামখানা আবিষ্কৃত হয়েছে। মূল সরোবরটি দৈর্ঘ্য ৩৯ ফুট প্রস্থে ২৩ ফুট ও গভীর ৮ ফুট। চারদিকে ছিল ঘেরা বারান্দা ও পানিতে নামার সিঁড়ি।
৫. প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা : সিন্ধু সভ্যতার প্রথম দিকে খননকার্যে কোনো প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা পাওয়া যায়নি। পরবর্তীকালে হরপ্পার
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে যুগের প্রমাণ পাওয়া যায়। মূলত শহর দু'টির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্ভেদ্য।
৬. পোশাক পরিচ্ছদ : হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর লোকদের পরিচ্ছদ ঐতিহাসিক সাক্ষ্যবহন করে। সিন্ধু সভ্যতার এ লীলাভূমি অঞ্চলের লোকজন পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরিতে প্রধানত সুতা ও পশম ব্যবহার করত। এ সভ্যতায় মূলত দুই পার্ট বিশিষ্ট পোশাকের প্রচলনই বেশি ছিল
৭. ভাস্কর্য : সিন্ধু সভ্যতায় ব্রোঞ্জ ও পাথরের তৈরি প্রচুর ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে। তাদের পাথরের ভাস্কর্যগুলো হলো নৃত্যরত
নারী মূর্তি, শ্মশ্রুমণ্ডিত আবক্ষ মূর্তি চূনা পাথরের মূর্তি ইত্যাদি।
৮. খাদ্যাভ্যাস : সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য ছিল গম। মাছ ছিল তাদের সাধারণ খাবার। যব ও খেজুর ছিল তাদের প্রিয় খাবার। তারা বিভিন্ন পশুর মাংসও খেত, যেমন— গরু, ছাগল, শূকর, হাঁস, মুরগি, কচ্ছপ ইত্যাদি। তাই অনুমান করা হয় যে, সিন্ধুবাসীরা বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজি খেত।
৯. ধর্মীয় বিশ্বাস : হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর অধিবাসীদের আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় সাধনা সম্পর্কে কোনো বিস্তারিত বিবরণ না পাওয়ায় তাদের সাধনার স্বরূপ নির্ণয় করা কঠিন। তবুও তাদের অসংখ্য সিল মোহর, মূর্তিগুলিকে বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতীক বলে ঐতিহাসিকগণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন।
পণ্ডিতগণ মনে করেন যে, তারা প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা করত। তাদের মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার বহুল প্রচলন ছিল। শিবের অনুরূপ এক পুরুষ দেবতার পূজারও প্রচলন ছিল। হরপ্পায় শিবলিঙ্গের অনুরূপ একটি কৃষ্ণ প্রস্তরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তাদের মধ্যে সাপ, গাছপালা ইত্যাদি পূজার প্রচলন ছিল। সেই যুগে মৃতদেহের দাহ ও সমাধিস্থ করা উভয়বিধ প্রথার প্রচলন ছিল বলে অনুমান করা হয়।
১০. শিল্পকলা : শিল্প ও চিত্রকর্মে সিন্ধু সভ্যতা বেশ অগ্রসর ছিল। এ সভ্যতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো সিন্ধু সভ্যতার সুরম্য ও কারুকার্য খচিত অট্টালিকা। এ সভ্যতার সময়কালীন বাঘ, হাতি, ষাঁড়, গন্ডার, কুমির, হরিণ ইত্যাদির ছবি সংবলিত সিল মোহর আবিষ্কৃত হয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা সোনা, রুপা, বিভিন্ন অলংকার তৈরিতেও তারা পারদর্শী ছিল। এ সভ্যতায় বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র তৈরি হতো। তাদের মৃৎপাত্রগুলো দু'ধরনের ছিল। যথা— ক. পারিবারিক তৈজসপত্র, খ. সমাধিপত্র।
১১. অর্থনৈতিক অবস্থা : সিন্ধু সভ্যতার মূল বুনিয়াদ গড়ে ওঠে কৃষি ও ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। অধিবাসীদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন ছিল কৃষি কাজ। তারা কৃষি জমিতে গম, যব, বার্লি ইত্যাদি উৎপাদন করত। এছাড়াও তারা মাছ, সবজি, দুধ, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি ইত্যাদির মাংস খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করত। সিন্ধু সভ্যতায় ব্যবসায়ীগণ, পারস্য মিশর প্রভৃতি দেশের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল বলে জানা যায়। তাই বলা যায় যে, প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা জানতে হলে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনসমূহের যথেষ্ট সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব রয়েছে।
v. বহিঃশত্রুর আক্রমণ;
vi. নিবর্ণীকরণ ও মরুকরণ ইত্যাদি।
১২. ব্যবসা-বাণিজ্য : সিন্ধু অধিবাসীরা অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করত। মাপহীন একটা জাহাজের চিত্রসহ সিল আবিষ্কৃত হওয়ায় ধারণা করা হয় যে, তারা হয়তো সমুদ্র পথে নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। সুমেরীয় অঞ্চলে এবং সিন্ধু অববাহিকায় একই ধরনের সিল আবিষ্কৃত হওয়ায় ধারণা করা হয় যে, সুমেরু ও সিন্ধু সভ্যতার অঞ্চলের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক ছিল। সিন্ধু সভ্যতার অঞ্চলে আবিষ্কৃত বিভিন্ন দেশের মুদ্রা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পশ্চিম এশিয়ার সাথে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু বিক্রয়ের ওজন ও পরিমাণের বিভিন্ন একক ব্যবহৃত হতো।
১৩, রাজনৈতিক অবস্থা : হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর বিভিন্ন ঘরবাড়ি ও অট্টালিকা নির্মাণের কৌশলের মধ্যে মিল থাকায় ইতিহাসবেত্তারা মনে করেন উভয় এলাকাই এক শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অধীনে ছিল। রাজাই ছিলেন শাসন ক্ষমতার মূল কেন্দ্রবিন্দু। তাই বলা হয় যে, প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনসমূহের সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব অপরীসীম ।
১৪. বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা : সিন্ধু সভ্যতায় হরপ্পা ও মহোেদারো সভ্যতার প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, তারা পাটিগণিত সম্পর্কে ব্যাপক জানত। নগরীর নগর পরিকল্পনায় তথা নগরের রাস্তা, নর্দমা, দালানকোঠা তৈরির ক্ষেত্রে যে দক্ষতা দেখিয়েছে তাতে তাদের জ্যামিতির জ্ঞান ছিল বলে ধারণা করা হয়। তারা রসায়ন শাস্ত্রেও ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেছিল। তারা তাম্র ও টিন মিশ্রিত করে ব্রোঞ্জ এবং স্বর্ণ ও রৌপ্য মিশ্রিত করে ইলেকট্রাম তৈরির মধ্য দিয়ে সিন্ধু সভ্যতার বিজ্ঞানীগণ ধাতু সম্পর্কিত দক্ষতার পরিচয় দেয় ।
পরিশেষে বলা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতা অল্পদিন আগে আবিষ্কৃত হওয়ায় এ সভ্যতা সম্পর্কে আমরা এর চেয়ে বেশি জানতে পারি না। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত ধারণা করা হতো যে, প্রাচীন ভারতবর্ষ ছিল আর্য সভ্যতার প্রাচীনতম সভ্যতা। কিন্তু সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়ার পর সেই ধারণার পরিবর্তন হয় এবং ইতিহাসের গতি তার সঠিক ধারায় পরিচালিত হয়।
সিন্ধু সভ্যতার পতন Fall of Indus-valley Civilization
সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা কারা বা সে সময় কারা রাজা বা কে সম্রাট ছিলেন এসব তথ্য আমাদের হাতে নেই। এ সভ্যতার ধারক হিসেবে দ্রাবিড়দেরকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তাই অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক সিন্ধু সভ্যতাকে ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা বলে আখ্যায়িত করেছেন ।
এ সভ্যতার পতন কীভাবে হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানান মতভেদ প্রচলিত আছে। আবার অনেকেই মনে করেন সিন্ধু নদীর বন্যার ফলে অথবা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এ সভ্যতার পতন ঘটে। খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত মানুষের কংকাল দ্বারা অনুমান করা হয় বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণে এ সভ্যতার ধ্বংস হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক হুইলার সিন্ধু সভ্যতার পতনকে নিম্নোক্ত ছকে উপস্থাপন করেছেন-
প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বন্যা
জলবায়ু পরিবর্তন
কৃষি উৎপাদন হ্রাসস
→ ক্রমবর্ধমান জনপদের
স্থান পরিবর্তন
সিন্ধু সভ্যতার পতন
মরুময়তা ও ভূমির ক্ষয়তা
নিচে সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণগুলো উল্লেখ করা হলো-
১. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : সাধারণত কোনো অঞ্চলে যদি ভূ-প্রকৃতিগত এবং জলবায়ুগত পরিবর্তন সংগঠিত হয়, তাহলে সে অঞ্চলে স্বাভাবিক কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বেড়ে যায়।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ S.G. Kohli তাঁর Indus valley Civilization গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, সিন্ধু সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারি। সিন্ধু নদে ব্যাপক পলি জমাট হওয়ার কারণে সেখানে প্রায় বন্যা দেখা দিত। আমরা যদি মহেঞ্জোদারো ও চানহুদার শহর দুটির ধ্বংসাবশেষ বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যায় যে, এই শহর দুটি বহুবার নানা কারণে প্লাবিত হয়েছে।
সিন্ধু নদে পলি পড়ে নদী গর্ভ ভরাট হওয়ায় বর্ষার পানি নগরকে প্লাবিত করত। উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সিন্ধুর প্লাবন ঘন ঘন হানা দিত।
২. জলবায়ু পরিবর্তন : ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, সিন্ধু উপত্যকা প্রথমে বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। এ অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে এবং অনুকূল পরিবেশের জন্য এসব অঞ্চলের বনজঙ্গল কেটে মানুষ বসবাস শুরু করে। এভাবেই মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা নামক দুটি নগর রাষ্ট্রের বিকাশ ঘটেছে। এভাবেই সিন্ধু সভ্যতার বনজ সম্পদ কেটে পরিবেশ ধ্বংস করা হয়। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটে এবং জমির স্বল্পতার জন্য সিন্ধু সভ্যতার কৃষিভূমিগুলো মরুভূমিতে পরিণত হয়। তাই বলা হয় যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই অতিদ্রুত গতিতে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের মুখে পতিত হয়।
৩. আবহাওয়ার পরিবর্তন : ভূ-প্রাকৃতির পরিবর্তন ও সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তন, উচ্চতা বৃদ্ধি ও বনবৃক্ষের ধ্বংস ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায়। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত দার্শনিক FR. Khan উল্লেখ করেছেন, “১৮০০ খ্রিঃ পূর্ব অব্দের পর সমগ্র সিন্ধু অঞ্চলে আবহাওয়া পরিবর্তন হতে থাকে।
৪. কৃষি ও অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি : সভ্যতা টিকে থাকার অন্যতম শর্ত হলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। অর্থনৈতিক অবনতি
হলে যেকোনো সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাই বলা হয়ে থাকে, নগর কেন্দ্রিক সভ্যতায় ক্রমে কৃষির গুরুত্ব ও উৎকর্ষ হ্রাস পেতে থাকলে অর্থনৈতিক কারণে এ সভ্যতার অবস্থা খারাপ হয়ে যায় । ৫. বহিঃশত্রুর আক্রমণ : খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০০ সালে সিন্ধু অঞ্চলের জনগণের কাছে পর্যাপ্ত অস্ত্র ছিল না। তাছাড়া এ অঞ্চলের লোকেরা যুদ্ধপ্রিয়ও ছিল না। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, উজ্জ্বল গৌরী বর্ণের উন্নতমান, সুশ্রী ও বলিষ্ঠ আর্য জাতির আক্রমণে খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০০ বা ১৫০০ সালে এ সভ্যতার অবসান হয় ।
৬. অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি : সিন্ধু সভ্যতা আকস্মিকভাবে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে এটা বলা যাবে না। বরং দীর্ঘ সময় ধরে এ সভ্যতার ধ্বংস প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে। এ সভ্যতার ব্যাপকভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বৃহৎ অট্টালিকার জায়গায় বাসস্থানগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। এমনকি জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাসস্থান রাজপথের উপরও চলে আসে। যার ফলে পৌরসভা তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয় বা তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থা শীতলতা পরিলক্ষিত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। মৃৎ শিল্প পূর্বের গর্ব হারিয়ে ফেলে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে হরপ্পা সংস্কৃতিতে বন্ধ্যাত্ব পরিলক্ষিত হয় ।
৭. কেন্দ্রীয় শাসনের শৈথিল্য : প্রখ্যাত ঐতিহাসিক G. Durbar তাঁর History of India গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সিন্ধু ও তার শাখা নদীসমূহের সুশৃঙ্খলিত ও সুরক্ষিত জীবনযাত্রা ব্যাহত হলে কেন্দ্রীয় শাসন শিথিল হয়ে পড়ে এবং এর ফলশ্রুতিতে বৈদেশিক আক্রমণের পথ সুগম হয়। এজন্যই সিন্ধু নদের বন্যা শুধু কৃষি উৎপাদন হ্রাস করেনি বরং খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাই বলা হয়, এভাবেই সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়েছে।
৮. ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর স্থান পরিবর্তন : সিন্ধু সভ্যতা দিন দিন তার বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। যার ফলে জনসংখ্যা তার নাগরিক
উৎকর্ষতা হারিয়ে ফেলে। বিভিন্ন অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর ক্রমাগত স্থান পরিবর্তনের কারণে সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটেছে । ৯. সিন্ধু নদের গতি পরিবর্তন : সিন্ধু নদের গতি পরিবর্তন স্বাভাবিক বিষয়। যেকোনো কারণেই নদী পথের গতি পরিবর্তন হতে পারে। তবে নদী পথের পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট এলাকায় ব্যাপক প্রাকৃতিক পরিবর্তন সংঘটিত করে থাকে। যা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং বলা যায় যে, পৃথিবীতে যতগুলো সভ্যতা সৃষ্টি হয়েছে তার প্রতিটি ধ্বংস প্রাপ্তও অনিবার্য হয়েছে এর ব্যতিক্রম সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রেও দেখা যায় না। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দে আর্যরা উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল দিয়ে হিন্দুকুশ পবর্তমালা অতিক্রম করে পাক ভারতীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ অনেকটা একমত যে, আর্যরা পাক ভারতে হানা দিলে দ্রাবিড়েরা বীরের মতো লড়াই করে পরাজয় বরণ করেছিল।
এ প্রসঙ্গে RC Majumder উল্লেখ করেছেন, "It was not merely a conflict between two nations but a conflict between two types of civilizations."

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]