সুমেরীয় সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে ওঠে ব্যাবিলনীয় সভ্যতা। তারা মূলত সুমেরীয়দের কাছে গৃহ নির্মাণ, জলসেচ, লিখন পদ্ধতি প্রভৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করে। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা : হাম্বুরাবি ছিলেন মূলত বেসামরিক, সামরিক, আইন, ধর্ম, রাজনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। হাম্বুরাবি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে খণ্ড-বিখণ্ড নগর রাষ্ট্রগুলোকে একত্রিত করে কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হাম্বুরাবি, রাজনৈতিক ঐক্য, শান্তি এবং শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাবিলন সাম্রাজ্যকে একটি সুশৃঙ্খল দেশে পরিণত করেন। রাজা তার শাসনব্যবস্থাকে গতিশীল রাখার জন্য অর্থ, বাণিজ্য, কৃষি শিল্প ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে একটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেছিলেন। সে সময়ে সামরিক বাহিনীতে যোগ দান ছিল বাধ্যতামূলক ।
২. আইন সম্রাট হাম্বুরাবির রাজত্বকালের শেষের দিকে নির্দেশিত বিধানমালা প্রস্তর খণ্ডে খোদাই করে রাখা হয়, পরবর্তীতে
তা হাম্বুরাবি আইন নামে পরিচিতি লাভ করে। হাম্বুরানি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি একটি সুখমান অধিকার সম্পন্ন বৈষম্য: সত্যনিষ্ঠার ওপর আইনকে প্রতিষ্ঠা করেন। দুইশত বিরাশিটি আইন ব্যাবিলনীয় ভাষায় খোদাই করা হয়। এই আইন মূল নানা রকম আইন ভঙ্গ, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিবাহ, পরিবার, সম্পত্তি বৃত্তিধারী লোকদের পারিশ্রমিক ও দায়িত্ব, কৃষি বিষয় আইনগত সমস্যা এবং ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি সংক্রান্ত সুযোগ্য রাজা হাম্বুরাবিই প্রতিষ্ঠিত করেন।
৩. কৃষি কাজ : ব্যাবিলনীয়রা কৃষি কাজে দক্ষ ছিল। কৃষি কাজে জমি চাষ করার ক্ষেত্রে বলদ ব্যবহৃত হতো। অধিকাংশ অনির মালিক ছিল মন্দির বা পুরোহিত। খাল কেটে বন্যার পানি কৃষি কাজে লাগানো হতো। কৃষি ভূমিতে ব্যাপক ফসল ফলা। প্রধান কৃষি দ্রব্যের মধ্যে গম, যব এবং ধান উল্লেখযোগ্য ছিল। জমিতে হাল, হালের বলদ প্রভৃতি দ্বারা তারা জমিচাষ করে
ফসল বুনত ।
৪. ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যবসা বাণিজ্যে প্রাচীন ব্যাবিলনীয়রা সচ্ছলতার পরিচয় বহন করত। মন্দির ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য লেনদেনের কেন্দ্র। ব্যবসা-বাণিজ্য ও সম্পত্তির বিলি বণ্টন নিয়ে ব্যাবিলনের মানুষ সদা ব্যস্ত ছিল। বর্তমান যুগের মতো তারা একটি মুক্ত হিসাব পদ্ধতির প্রচলনে এগিয়ে আসে। সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল সকল প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ব্যাংক ইত্যাদি ।
৫. তরভিত্তিক সমাজ : বিশ্ব সভ্যতায় ব্যাবিলনীয় সমাজব্যবস্থা ছিল অভিন্ন এক নতুন সংযোজন। ব্যাবিলনীয় সমাজব্যবস্থার
হাম্বুরাবির বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা তিনটি স্তর ছিল। যথা-
ক. আওএলুম বা স্বাধীন অভিজাত শ্রেণি : রাজা, পণ্ডিত, পুরোহিত ও সৈন্যরা এ শ্রেণিভুক্ত ছিল। এরা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-
সুবিধা ও ভোগ বিলাসে মত্ত থাকত ।
খ. মুশকেলুম বা সাধারণ নাগরিক : শিল্পী ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা এ শ্রেণিভুক্ত ছিল। তারা নিজস্ব উদ্যোগে ব্যবসায়িক
কার্য পরিচালনা করত।
গ. ওয়াবদুম বা দাস শ্রেণি : কৃষক, সাধারণ শ্রমিক এ শ্রেণিভুক্ত ছিল। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে তাদেরকে নিপীড়ন,
নির্যাতন সহ্য করতে হতো। তাদের কোনো সামাজিক ও আইনগত অধিকার ছিল না ।
৬. লিখন পদ্ধতি : ব্যাবিলনীয়রা লিখনের কাজে তাদের প্রবর্তিত 'কিউনিফর্ম' লিপি ব্যবহার করত। পণ্ডিতদের মতে,
কিউনিফর্ম লিপিতে অন্যূন ৫০০ অক্ষর স্থান পেয়েছে ।
৭. সাহিত্য ও শিক্ষাব্যবস্থা : প্রাচীন ব্যাবিলনীয়রা শিক্ষা ও সাহিত্যে বেশ এগিয়ে ছিল। ব্যাবিলনীয়রা সুমেরীয়দের অমর সাহিত্য গিলগামেশ উপাখ্যান অধ্যয়ন করে মুগ্ধ হয়। 'Book of job' এর অনুসারে ব্যাবিলনীয় সাহিত্যিকগণ একটি অনবদ্য সাহিত্য রচনা করেন। এ গ্রন্থে প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায় অবস্থা প্রকাশ পায়। তাদের লেখনিতে পৌরাণিক কাহিনি অপূর্ব সাহিত্য রসে সুসমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। মান, বৃত্তকে ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তারা অবদান রাখে। ৮. বিবাহ প্রথা : ব্যাবিলনীয় বিবাহ ছিল চুক্তিভিত্তিক। ছেলের বিয়ে পিতা-মাতাকে ঠিক করতে হতো। ছেলের বাবা কনের বাবাকে যৌতুক দিত। কনেপক্ষ বরপক্ষ বা স্বামী পক্ষকে পরিত্যাগ এই বিষয়ে চুক্তিপত্র থাকত। ক্রীতদাসী ও উপপত্নীর মর্যাদা বিবাহিত স্ত্রীর চেয়ে কম ছিল।
পরিবার ব্যবস্থা : হাম্বুরাবির সংহতির পরিবারের অধিকার ও দায়িত্বের চেয়ে ব্যক্তির অধিকার ও দায়িত্বকে গুরুত্ব দিয়েছিল। স্বামী ছিল পরিবার প্রধান। স্ত্রীর নিজস্ব জমি ছিল এবং সম্পত্তির জন্য তার যথেষ্ট আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতা ছিল। ১০. ভাস্কর্য নির্মাণ : এ সভ্যতায় সুমেরীয়দের কৌশলেই ব্যাবিলনীয়রা বিভিন্ন স্তম্ভ ও ভাস্কর্য নির্মাণ করেছে। এ প্রসঙ্গে সিটন লয়েড উল্লেখ করেছেন, “ব্যাবিলনীয় ভাস্কর্য সুমেরীয় রীতি-কৌশলের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল।" জ্যাকস দ্যা মর্গানের নেতৃত্বে খনন কার্য পরিচালনা করে ৮ ফুট উঁচু একটি সবুজ কালো প্রস্তর স্মৃতিস্তম্ভ আবিষ্কার করেন।
১১. ধর্মীয় ব্যবস্থা : বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন ব্যাবিলনীয় সভ্যতার জনগণ। একেক নগরে একেক দেবতাকে কেন্দ্র করে মন্দির গড়ে উঠেছিল। ব্যাবিলনীয়রা মৃত্যু পরবর্তী কোনো জীবন সম্পর্কে তারা চিন্তা করত না। তারা ইহজগতের ভোগবিলাসী ছিল। তাদের কাছে ছিল ইহজগতের প্রাধান্য। পরকাল সম্পর্কে তারা বিশ্বাস করত না।
১২. বিজ্ঞান চর্চা : ব্যাবিলনীয়দের বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য পরিলক্ষিত হয়। নিচে তা উল্লেখ করা হলো-
ক. জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত শাস্ত্র : উভয় শাস্ত্রের ক্ষেত্রে ব্যাবিলনীয়রা ব্যাপক অবদান রাখে। ব্যাবিলনীয়নরাই সূর্য ঘড়ি, জলঘড়ি, এসব চালু করে। তারা মাস, বছর, দিন ইত্যাদির ক্ষেত্রে সময় নিরূপণ ও বণ্টনের প্রথা চালু রেখে চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে তারা সঠিক ধারণা পেয়েছিল। বারো মাসে বছর, চার সপ্তাহে মাস, বারো ঘণ্টায় দিন এবং এক ঘণ্টাকে ঘাট মিনিটে ভাগ করার কৃতিত্ব ব্যাবিলনীয়দের। গণিত শাস্ত্রের ক্ষেত্রে মৌলিকতাই ব্যাবিলনীয়ানদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তারা সর্বপ্রথম দশমিক গণনার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। এছাড়াও গণিত শাস্ত্রের সকল শাখায় তথ্য পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতির ক্ষেত্রেও প্রভূত সাফল্যের অধিকারী।
খ. চিকিৎসা বিজ্ঞান : ব্যাবিলনীয়নরাই চিকিৎসা বিজ্ঞান চর্চায় এগিয়ে আসে। ঐতিহাসিক জে.ই, সোয়াইন উল্লেখ করেছেন, ব্যাবিলনীয়নরা দাঁতের ব্যথা নিরাময়ে সূর্যমুখী ফুলের বীজ ব্যবহার করত, পেটের পীড়ায় ব্যবহার করত দুধ, কেশহীন মাথায় তেলের স্যাম্পু আর মদ ব্যবহার করত।
গ. বিজ্ঞান : প্রকৃতিতে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তারা বৈজ্ঞানিকভাবে তা রেকর্ডভুক্ত করে রাখত। এভাবেই তারা ব্যাবিলনীয় পঞ্জিকা তৈরি করেছিল। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মাধ্যমে তারা প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করত। তাই বলা যায় যে, প্রকৃতির আবর্তন ও বৈচিত্র্যতা ব্যাখ্যায় ব্যাবিলনীয়রা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল ছিল।
১৩. স্থাপত্য শিল্প : ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় মিশরের পিরামিডের ন্যায়, ধর্ম মন্দির, বিভিন্ন প্রকার সিল, সমাধিকক্ষ, বিচারকক্ষ
ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ছিল। ব্যাবিলনীয়দের স্থাপত্যকলার মধ্যে 'কিউনিফর্ম' লিপিই উল্লেখযোগ্য ছিল। তারা ব্রোঞ্জ, রুপা, সোনার গহনা তৈরিতে ব্যাপক দক্ষতা অর্জন করেছিল। এ সভ্যতায় অমসৃণ ইটের দেয়াল, রঙিন টালি, মোজাইক প্রভৃতি স্থাপত্যের নিদর্শন উল্লেখযোগ্য ছিল।
১৪. অর্থনীতি : ব্যাবিলনীয় সমাজব্যবস্থায় পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু ছিল। সবকিছু নির্দিষ্ট বিধি মোতাবেক পরিচালিত হতো।
কৃষি ছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল চালিকা শক্তি । শ্রমিকদের মজুরি নির্দিষ্ট ছিল তাই নির্ধারিত মজুরি তাদের দিয়ে দেওয়া হতো। ১৫. শিল্প উপকরণের প্রাচুর্যতা : ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় নগরে ছোট বড় বিভিন্ন প্রাসাদ তৈরি হয়েছিল, যার প্রধান উপকরণ ছিল ইট। ইট ছিল মূলত ব্যাবিলনীয়দের অন্যতম শিল্পকর্ম। অন্যান্য তৈরিকৃত দ্রব্যাদির মধ্যে মাটির দ্রব্য, ঝুড়ি এবং বিভিন্ন ধাতব দ্রব্য উল্লেখযোগ্য ছিল। তারা বিনিময় ও ওজনের জন্য মুক্তা ও ধাতুর ব্যবহার করত। সুতরাং তৎকালীন ব্যাবিলনে শিল্প উপকরণের পর্যাপ্ততা ছিল বলে অনুমান করা যায় ।
পরিশেষে বলা যায় যে, শিক্ষা, ধর্ম, শিল্পকলা, পরিবার, বিবাহব্যবস্থা, সামাজিক স্তরবিন্যাস সভ্যতা বিকাশের সকল উপাদানের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল ব্যাবিলনে। পরবর্তীতে নানা বিবর্তনবাদ ও ব্যাপ্তিবাদের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করে।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত