বাংলাদেশে সামাজিক ইতিহাসের উৎস Sources of Social History in Bangladesh

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জন্মলাভ করে। দীর্ঘদিন শাসন, শোষণ ও নির্যাতন এবং অত্যাচারের ফলে দেশটির নিজস্ব ইতিহাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বাধীনতা পাভের পূর্বে এ দেশটি বিভিন্ন দেশের অধীনে শোষণের শিকার হয়েছিল দীর্ঘদিন। সঠিক ইতিহাস সামাজিক ইতিহাস রচনায় গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু বাংলাদেশে সামাজিক ইতিহাস রচনা না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো- বিদেশি শাসকগণ আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির ধারাবাহিক ইতিহাস লেখায় মনোযোগী হয়নি। অতীতকাল থেকেই এদেশের সমাজ হয়েছে বহিঃশোষণের শিকার। বিদেশি লেখকগণ এদেশের সমাজ ইতিহাস সম্পর্কে তেমন আগ্রহও দেখায়নি।
প্রকৃতিগত ভাবেই এ অঞ্চলের মানুষ ইতিহাস সম্পর্কে তেমন সচেতন ছিল না। ধর্ম, দর্শন, কাব্য ইত্যাদি বিষয়ে স্থানীয় জনসাধারণ সামান্য আগ্রহ দেখালেও সমাজ ও তার ইতিহাস সম্পর্কে থেকেছে অনেকটাই উদাসীন।
১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে ইংরেজ শাসনের গোড়া পত্তন হয়েছিল। সে সময় বাংলার মানুষের চক্রান্তের ফলে সহজ, সরল, সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের হাতে পরাজিত হয়। মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার আকাশে দূর্যোগ নেমে আসে। ব্রিটিশ শোষণের ফলে বাঙালি সমাজে নেমে আসে অত্যাচার আর দুঃশাসনের খড়গ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের পরাজয়ের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এসব পট পরিবর্তনে বিভিন্ন ধরনের উৎস সামাজিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছে।
বাংলাদেশে সামাজিক ইতিহাস রচনার প্রধান প্রধান উৎসগুলো নিচে আলোচনা করা হলো--
১. লিপি (Inscription) : ঐতিহাসিকগণ এসব লিপি থেকে বিভিন্ন রাজ্য শাসনের কাল, রাজ্যের বিস্তৃতি এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হয়ে থাকেন। সাধারণত প্রস্তরখণ্ড বা পর্বতগাত্র ও তাম্রপাত্রে খোদিত লিপিগুলোর নাম শিলালিপি ও তাম্র লিপি। এসব লিপিগুলোতে প্রধানত শাসন সংক্রান্ত ঘোষণা, অনুশাসন, দানপত্র, ব্যক্তিগত দানপত্র ও রাজপ্রশক্তির বিবরণ পাওয়া যায়। সুতরাং প্রাচীন বাংলার সামাজিক ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় বিভিন্ন পাথর ও রুপার পাতের ওপর খোদাইকৃত লেখার মধ্যে।
২. মুদ্রা (Coin) : প্রাচীন এবং মুসলিম বাংলার সামাজিক ইতিহাস রচনায় মুদ্রার সাহায্য অপরিহার্য। বস্তুত আবিষ্কৃত মুদ্রার সাহায্যে মুদ্রার সন, শাসকদের নাম, ব্যবসায়-বাণিজ্যের মান এবং ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে অনেক তথ্যাদি পাওয়া যায়, যা সামাজিক ইতিহাস রচনায় বিশেষ গুরুত্ব বহন করে থাকে।
৩. স্মৃতিস্তঃ এবং অট্টালিকা (Monuments and buildings) : স্মৃতিস্তয় এবং অট্টালিকাসমূহ হচ্ছে সমাজ চিত্রের দর্পণ স্বরূপ। কারণ স্মৃতিস্তম্ভের সাহায্যে মানব জীবনের বিভিন্ন চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। স্মৃতিস্তম্ভ এবং অট্টালিকা, সমাজের আর্থ- সামাজিক, ধর্মীয় সাংস্কৃতিক, স্থাপত্য শিল্পের মান ইত্যাদির পরিচয় বহন করে থাকে। প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে
ময়নামতি, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় ও উয়ারি বটেশ্বর থেকে প্রাপ্ত মূল্যবান তথ্যকে সামাজিক ইতিহাস রচনার কাজে লাগানো যায়। বিবিধ কারণেই ইতিহাসবিদগণ ইতিহাসের উৎস হিসেবে স্মৃতিস্তম্ভ ও অট্টালিকার গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন। এছাড়াও এদেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে অসংখ্য মঠ, মন্দির, মসজিদ ইত্যাদি যা সামাজিক ইতিহাসের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। সুতরাং স্মৃতিস্তম্ভ ও অট্টালিকার মাধ্যমেই একটি অঞ্চলে কোন কোন পেশার লোক বাস করতো তার একটি ধারণা লাভ করা যায়।
৪. প্রাচীন সাহিত্য ও ঐতিহাসিক গ্রন্থাবলি (Literary and historical works) : পালি ভাষায় রচিত বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থ ত্রিপিটক থেকে তদানীন্তন সর্বভারতীয় সমাজের আলেখ্য পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতীয় সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির ওপর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য অনেক তথ্যই মজুদ রয়েছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে, কেননা এ গ্রন্থে ভারতীয় সমাজের এক নিখুঁত চিত্র উঠে এসেছে। প্রখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক আল বিরুনির 'কিতাবুল হিন্দ' গ্রন্থে মুসলিম ভারতের সামাজিক ইতিহাসের অনেক উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। আল বিরুনির এ গ্রন্থে সামাজিক রীতিনীতি, সংস্কৃতি এবং মানব আচরণ সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য পাওয়া যায়। সম্রাট আকবরের 'আকবর নামা' এবং আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী' গ্রন্থদ্বয়ে সর্ব ভারতীয় সমাজের ইতিহাস, রাজনীতি এবং প্রশাসন কার্য সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান লাভ করা যায়। সুতরাং বাংলাদেশ তথা ভারতীয় সমাজে সামাজিক ইতিহাসের ব্যাপক উপাদান বা উৎস খুঁজে পাওয়া যায়। ৫. প্রাচীন পুঁথি (Ancient manuscript) : বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করেই প্রাচীনকাল থেকে এদেশের মানুষজন নানা রসাত্মক কাহিনি তৈরি করত। বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনাকে জীবন্ত করে রাখতে কখনো পুঁথি বা কখনো মৌখিক আলোচনার মাধ্যমে করা হতো। এ সকল পুঁথি সাহিত্য, কাগজে, তাল পাতা ও কলা পাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখা হতো। এসকল পুঁথি যাচাই-বাছাই করে সামাজিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অনেক তথ্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়।
৬. লোকাচার ও লোকরীতি (Folk ways and mores) : প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের লোকাচার ও লোকরীতি প্রচলিত হয়ে আসছে। পৌরাণিক ও লোককাহিনির সাহায্যে অনেক উৎস খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন— উপনিষদ, বেদ, মহাকাব্য, হিন্দু পুরাণ, বৌদ্ধ ও জৈনদের ধর্মগ্রন্থ এবং বহুবিধ সাহিত্য ইতিহাসের অনেক উপকরণ যুগিয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের রামায়ণ ও মহাভারত যুগে যুগে মানুষের চিত্ত জয় করে এসেছে। সুতরাং ইতিহাসের উৎস হিসেবে এসবের গুরুত্ব অনেক বেশি।
৭. বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনা (Accounts of the foreign Travelers) : বিদেশি পরিব্রাজকদের ভ্রমণ কাহিনি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সে যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের প্রচ্ছদপট অঙ্কিত রয়েছে। যেমন— পরিব্রাজক হিউয়েন সাং, মেগাস্থিনিস, মার্কো পোলোর ভ্রমণ কাহিনি থেকে ইতিহাসের বহু তথ্য পাওয়া যায়। কেননা বিভিন্ন সময়ে বিদেশি পর্যটকরা এদেশের সমাজ ও মানুষের কথা তাদের বিবরণীতে তুলে ধরেছেন। মেগাস্থিনিসের বর্ণনায় দেখা যায় যে, ভারতীয় সমাজে শাসক ছাড়াও ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ দার্শনিক, অমাত্য, পর্যবেক্ষক, সৈনিক, শিল্পী, ব্যবসায়ী, কৃষক এবং শিকারি মেষপালক শ্রেণিও বসবাস করত। চতুর্দশ শতকে আফ্রিকান, পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনায় মুসলিম শাসনামলের ইতিহাস ও সমাজ সম্পর্কে জানতে পারা যায়। চীনা পর্যটক ফা-হিউয়েন সাং ভারতীয় সমাজের ধর্ম, সমাজ, অর্থনীতি এবং শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যাপক মতামত ব্যক্ত করেছেন। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবস্থা উন্নত ছিল বলে তিনি অভিমত দিয়েছেন। মুঘল আমলে বাংলাদেশসহ ভারতের সমাজ, অর্থনীতি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, প্রশাসন, রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন— ফ্রান্সিস হার্নিয়ার নামক একজন ঐতিহাসিক। সুতরাং ভ্রমণকারী বা বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ সামাজিক ইতিহাসের উৎস হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে থাকে।
পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন উপাদান বা উৎস রয়েছে। বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাস অধ্যয়নে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার, পৌরাণিক ও লোককাহিনি এবং পরিব্রাজকদের ভ্রমণ বিবরণী প্রভৃতি উপকরণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। এসব উপকরণকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের প্রাচীন সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং সমাজ সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। তাই সামাজিক ইতিহাসের উৎস হিসেবে এগুলোর মূল্য অপরিসীম ও অনস্বীকার্য। অতএব আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে এগিয়ে আসলে বাংলাদেশের সমাজ ইতিহাসের ভাণ্ডার পূর্ণ হবে মর্মে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস
চ. অন্যান্য উৎস (Others sources) : বর্ণিত উৎস বা উপাদানসমূহ ছাড়াও সমাজ ইতিহাসের আরোও অনেক উৎসে
করা যায়। এগুলোর মধ্যে দাপ্তরিক প্রতিবেদন, সংবাদপত্র, সাময়িকী, দেশের আইনগত দলিল, আদমশুমারি, শিল্পকলা, গবেষণা প্রতিবেদন, রোজনামচা (ডায়রি), ব্যক্তিগত ও ঐতিহাসিক চিঠিপত্র, লোককাহিনি ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বৃদ্ধ মানুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমেও সামাজিক ইতিহাসের তথ্যাদি সপ্তাহ করা যেতে পারে। পরিশেষে বলা যায় যে, উপরোক্ত উৎস বা উপাদানগুলো সামাজিক ইতিহাস রচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। তবে কোনো দেশ বা অঞ্চল বা কোনো জাতির বস্তুনিষ্ঠ, পূর্ণাঙ্গ ও ধারাবাহিক সমাজ ইতিহাস রচনায় উপর্যুক্ত উ উপাদানগুলোকে অত্যন্ত সতর্কতা, দক্ষতা ও যথাযথভাবে ব্যবহার করা আবশ্যক। মূলত এগুলোর ওপর ভিত্তি করেই আমাদের দেশের সামাজিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয়ে থাকে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]