হাম্বুরাবি আইনের বৈশিষ্ট্য Features of Humburabi Law

সম্রাট হাম্বুরাবির মৃত্যুর পর ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য নামে টিকে ছিল মাত্র। হাম্বুরাবির পাঁচজন উত্তরাধিকারী দেশ শাসন করেন। তাঁর পুত্র সামসু ইলুনার এর রাজত্বকালে ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য সংকুচিত হয়ে পড়ে। তার রাজত্বকালেই উত্থান ঘটে ক্যাপাইটিদের।
পরবর্তী উত্তরাধিকারী আবিয়েগুর, আম্মিদিতানা, আম্মি-মাদুক এবং সামসু-দিতানা ছিলেন দুর্বল শাসক। তাঁদের দুর্বলতার সুযোগে ব্যাবিলন ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সুমেরীয় রাজা ডুঙ্গির মৃত্যুর পর অ্যামোরাইটরা ব্যাবিলনীয় সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেন। এ বংশের সর্বশেষ নরপতি হাম্বুরাবি (২১২৩-২০৮১ খ্রিঃপূঃ) সুদক্ষ আইনবিদ ও বিজ্ঞ শাসক হিসেবে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার উন্মেষ ও ক্রমবিকাশে অপরিসীম অবদান রেখে বিশ্বের ইতিহাসে অম্লান স্বাক্ষর রেখেছেন। অনেক ইতিহাসবেত্তাদের মতে, মূলত, রাজনৈতিক পতনের মধ্য দিয়েই ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পতন ঘটে।
খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তদশ শতাব্দীতে বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার মতো সামরিক শক্তি ব্যাবিলনীয় সরকারের না থাকায় তাঁরা বহিঃশত্রুর আক্রমণেও পরাভূত হয়ে পড়তে থাকে। ফলে তাদের পতন ঘটতে থাকে।

হাম্বুরাবি আইন Humburabi Law

ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল হাম্বুরাবির শাসনামলে। ব্যাবিলনের বিখ্যাত রাজা হাম্বুরাবি দেশবাসীকে কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য একটি আইন প্রণয়ন করেন যা 'The Code of Humburabi' নামে পরিচিত। বস্তুত ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে ২৮২টি ধারা বিশিষ্ট 'The Code of Humburabi'। তাই বলা হয় যে, ব্যাবিলনীয় বিখ্যাত শাসক হাম্বুরাবি দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, প্রভাবশালী শাসক ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন।
হাম্বুরাবি আইনের উদ্দেশ্য জ্যাকস দ্য মর্গানের নেতৃত্বে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক মিশন ১৯০১-১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে পারস্যে খনন কার্য পরিচালনা করেন। এমিশনের মাধ্যমে সিপার দুর্গে আবিষ্কৃত হয় কালা সবুজ প্রস্তরের স্মৃতিস্তম্ভ। এখানেই সংকলিত হয়েছে হাম্বুরাবি আইন। আর এ আইন সংকলনের ভূমিকাতেই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। হাম্বুরাবি আইনের বহুবিধ উদ্দেশ্যসমূহ নিচে তুলে ধরা হলো-
প্রথমত : হাম্বুরাবির শাসন আমলে অনেক নগর রাষ্ট্রের দুর্বল শাসনে জনগণের অধিকার খর্ব হতে ছিল এবং জনগণ চরম অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতায় দিনাতিপাত করত। তাই এসব পরিস্থিতি থেকে হাম্বুরাবি জনগণের অধিকার সমুন্নত ও নিরাপত্ত প্রদানসহ আইনি সহায়তা দানের উদ্দেশ্যেই আইনের সংকলন করেছেন।
দ্বিতীয়ত : ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় মারদুক ছিলেন দায়িত্ব বণ্টনের দেবতা। দেবতা মারদুক জনগণকে ন্যায্য পদে স্থায়িত্ব প্রদান করার সময় মেসোপটেমিয়া রাষ্ট্রটি বহুনগর রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল এবং এসব নগর রাষ্ট্রের সংঘাত ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। ফলে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও নিরাপত্তা ছিল অস্থিতিশীল ও অরাজকতাময়। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনাই ছিল হাম্বুরাবি আইনের প্রধান উদ্দেশ্য ।
তৃতীয়ত : মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনকল্যাণ ও জনসেবা নিশ্চিত করা ছিল হাম্বুরাবি আইনের আরেক মূল উদ্দেশ্য। হাম্বুরাবি নিজেকে শাসক মনে না করে 'King of Righteousness' ও 'Builder of the Land' মনে করতেন। জনকল্যাণ ও জনসেবা করার উদ্দেশ্যেই তিনি নিজেকে দেবতাদের প্রতিনিধি মনে করেছেন।
চতুর্থত : পুরোহিত সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিলেন হাম্বুরাবি শাসনের প্রথমদিকের বিচারক। এরা তাদের ইচ্ছামত ও সুবিধামত আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করতেন এবং মনগড়া ও ধর্মীয় আইনের বিচার কাজ পরিচালানা করতেন। এতে শুধু জনগণের অমঙ্গলই সাধিত হতো। অর্থের বিনিময়ে অনেক সময়ে এ বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হতো। এসবকে রহিতকরণ ও পুরোহিতদের আধিপত্যের অবসান করাই ছিল হাম্বুরাবি আইনের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ।

হাম্বুরাবি আইনের বৈশিষ্ট্য Features of Humburabi Law

হাম্বুরাবি আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্বরূপ :
১. মিথ্যা সাক্ষ্য ও মিথ্যা মামলা: হাম্মুরাবি আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মিথ্যা মামলা ও মিথ্যা সাক্ষীকে বড় অপরাধ হিসেবে মনে করা হতো। কোনো ব্যক্তি কারো বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনলে এবং তা প্রমাণ করতে না পারলে তবে অভিযুক্ত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড হতো। আর মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারীর শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড ।
২. কঠোর অনুশাসনের প্রতি একাত্ম : যেহেতু হাম্বুরাবি আইনের মূল লক্ষ্য ছিল জনকল্যাণ ও জনসেবা, জনগণের অধিকার সমুন্নত রাখা ও নিরাপত্তা প্রদান করা। আর এসব উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের জন্য শক্তির বিধান ছিল কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক। যেমন- দাঁতের বদলে দাঁত ও চোখের বদলে চোখ ।
৩. শ্রেণি বিভক্ত আইন : হাম্বুরাবি আইনে শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থা, বিভিন্ন শ্রেণির সুযোগ সুবিধা এবং ভিন্ন শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। রাজা একক মাত্র এক শ্রেণি, অন্যসব প্রজা আর এক শ্রেণি অভিজাত ও ধনীদের ক্ষেত্রে অন্য ধরনের আইন প্রচলিত ছিল। বিচারের ক্ষেত্রে নিচু শ্রেণির জন্য আইন ছিল ভিন্ন।
৪. শ্রম আইন : কোনো চাষিকে যদি জমি চাষের জন্য নিয়োগ করা হতো তবে উষ্ণ শখি প্রতি বছর আটগুণ খাদ্যশস্য মজুরি হিসেবে পেত। চাষের জন্য কোনো গরু ভাড়া করা হলে গরুর মালিক প্রতিদিন ১২ শিলা খাদ্যশস্য ভাড়া হিসেবে পেত। নারীদের প্রতি উদার আচরণ : এ আইনে মূলত নারীদের প্রতি উদার আচরণ করা হতো। যদি কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে ন্যায্য হিস্সা থেকে বঞ্চিত করত, তবে স্ত্রী আদালতের সহায়তা নিতে পারত। নারীরা পর্দার মধ্যে থেকে সকল কাজে অংশগ্রহণ করার বিধানও ছিল হাম্বুরাবি আইনে। তারা জন্মসূত্রে ভূ-সম্পত্তির অধিকার পেত।
৬. ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণ : হাম্বুরাবি আইনের প্রথমদিকে তেমন ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল না। এ আইন সংকলনের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যকে অবাধ ও উদার করা হতো। যেমন- ক্রেতা দ্রব্যাদি ক্রয় করার পর একটি ক্রয় রশিদ পেত এবং ক্রেতা ঐসব দ্রব্যাদি প্রাপ্তির পর একটা প্রাপ্তি রশিদ প্রদান করত ।
৭. পারিবারিক ও বিবাহ আইন : এ আইনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হাম্বুরাবি আইনে পারিবারিক নিয়ম-কানুন বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। বিয়ে চুক্তির মাধ্যমে সম্পাদিত হতো। ছেলে-মেয়ের বিয়ে স্থির করার দায়িত্ব ছিল পিতা-মাতার। আইনের ১২৯ নং ধারায় বলা হয়েছে, কারো স্ত্রী যদি অন্য পুরুষের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তবে তাদের পানিতে ডুবিয়ে মারা হতো।
৫.২২ হাম্বুরাবি আইনের গুরুত্ব
Importance of Humburabi Law
সম্রাট হাম্বুরাবি এ আইন সংকলন করে ইতিহাসে খ্যাতি লাভ করেছেন। হাম্বুরাবি আইনে প্রাচীন ব্যাবিলনের সমাজ অর্থনীতি সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যায়। মূলত এটাই হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম সুসংবদ্ধ আইন কাঠামো। নিচে এর গুরুত্ব তুলে ধরা হলো- ১. আইনের শাসন : হাম্বুরাবি আইনে সকল শ্রেণির মানুষের জন্য সমান অধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ।
পরবর্তীতে সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন সম্রাট ও শাসকগণ এ আইনকে অনুসরণ করে শাসন কার্য পরিচালনা করেছিল।
২. জনগণের জন্য ন্যায় বিচার : অসহায় ও দুর্বল শ্রেণিকে প্রভাবশালীরা যাতে কোনোরূপ অত্যাচার না করতে পারে সে জন্য
এ আইনে ব্যাপক কঠোরতা ও নিরপেক্ষতা ছিল। এভাবেই এ আইনের মাধ্যমে জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছিল। ৩. ব্যক্তি মর্যাদা রক্ষা : নারীদের প্রতি সহানুভূতি ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা হয়েছে এ আইনের মাধ্যমে। অত্যাচারিত আর পিছিয়ে পড়া নারী জাতিকে সমান অধিকার প্রদান করেছিল এই হাম্বুরাবি আইন। যার ফলে নারীর অধিকার সম্পর্কে মানুষ ব্যাপক সচেতন হতে শুরু করে। তাই এ আইনের গুরুত্ব অপরিসীম।
৪. আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি : হাম্বুরাবি আইন ব্যাবস্থায় মূলত মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক জীবনের এক পূর্ণাঙ্গ দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় বিভিন্ন দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর হাম্বুরাবি আইনের ছায়া লক্ষ করা যায় ৷
৫. অনুসরণীয় ও আদর্শ : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব শাসকের কাছেই হাম্বুরাবি আইন আদর্শ ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। বিভিন্ন প্রকার শাস্তির বিধান সম্পর্কে মানুষ এ আইনের মাধ্যমেই জানতে পেরেছিল। কোন অপরাধে কোন শাস্তি তা এই আইনের মাধ্যমেই জানা গিয়েছিল বলেই এটি যেকোনো সরকার ব্যবস্থার জন্য আদর্শস্বরূপ ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]