'মিশরীয় সভ্যতা নীলনদের দান'- উক্তিটি ব্যাখ্যা কর। “Egyptian civilization is gift of Nill' - Explain the statement.

মিশরীয় সভ্যতায় নীলনদের অবদান Contribution to Nile in Egyptian Civilization
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সভ্যতাই নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা এবং এ নদীটি সভ্যতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তাই নদীতে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে মিশরীয় সভ্যতা যা গড়ে ওঠে নীলনদকে কেন্দ্র করে। নীলনদ হয়েছে প্রকৃতির অপরূপ দান যা মিশরের জন্য আর্শিবাদস্বরূপ। তাই বলা হয় যে, মিশরীয় সভ্যতা বিনির্মাণে নীলনদের ভূমিকা অপরিসীম। মিশরীয় সভ্যতা সম্পর্কে ইতিহাসের জনক হেরোডেটাস খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪৩ অব্দে মিশর পরিভ্রমণ করে বলেন, মিশর হচ্ছে নীলনদের দান 'Egypt is the gift of Nile, '
প্রাচীন মিশরের সমাজ ও সভ্যতা সম্পর্কে সিরিল আলড্রড বলেন, আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর পূর্বে নীল নদের অববাহিকায় মিশরীয় সভ্যতার অংকুর উদ্ভব হয়। এ অঞ্চলের মানুষেরা উর্বর জমিতে বসবাস শুরু করে। যাযাবর, শিকারীরা নীলনদ অঞ্চলেই কৃষি কাজের সূচনা করে, বন্য জীবজন্তুকে পোষ মানায়, ঘরবাড়ি নির্মাণ করে এবং নদীর পানি দিয়ে অপচে করে সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বীজ বপন করে ।
নীলনদ মিশরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। তাই বলা যায় যে, নীল নদকে কেন্দ্র করেই মূলত মিশরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। নিম্নে মিশরীয় সভ্যতা বিকাশে নীল নদের অবদান বা প্রভাব আলোচনা করা হলো-
:
১. বন্যা বা প্লাবন নীলনদের বার্ষিক বন্যা বা প্লাবনই ছিল মিশরীয় সভ্যতার গোপন রহস্য। আফ্রিকার মধ্য অঞ্চলে গ্রীষ্মকালের শুরুতে (জুন মাসে) প্রচুর বৃষ্টিপাত হতো। এ বৃষ্টিপাতের ফলে প্রচুর পানি নীলনদে নেমে আসে। ফলে নীল নদের পানি ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর উপর ইথিওপিয়ার মালভূমির বরফগলা পানি পাহাড়ি মাটি ক্ষয় করে নীলনদে গিয়ে মিশে। এ কারণে নীল নদের পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে যে, দুকূল ছাপিয়ে যায় তার জলধারা এবং তখন দেখা দেয় নীল নদের ভয়ানক বন্যা। এভাবে প্রতিবছর জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নীল নদের পানি বেড়ে বন্যার সৃষ্টি হতো এবং বন্যার পানি ২০ থেকে ৪০ ফুট উঁচু হয়ে নীল নদের দু'কূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হতো। ঐতিহাসিকদের মতে, এ বার্ষিক বন্যা বা প্লাবনের উপরই মিশরের অস্তিত্ব ও সমৃদ্ধি নির্ভরশীল ছিল।
২. বন্যা নিয়ন্ত্রণ : যদিও বলা হয় মিশর নীল নদের দান, তথাপিও বন্যার সময় অনেক ক্ষতি হতো। তাই বন্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলে জনগণ ও সকারের ঐক্য প্রচেষ্টার দ্বারা। রাজ বংশ পূর্ব শাসনের পূর্বে মিশরে বহুকাল ধরে বহু সংখ্যক মানুষ পরিশ্রম করে নীলনদ বাঁধ নির্মাণ করেছে। অসংখ্য নালা কেটেছে এবং নীলনদের পানির সর্বাত্মক ব্যবহারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ৩. কৃষি কাজ : প্রাচীন মিশর মূলত কৃষি প্রধান দেশ ছিল। নীল নদের উর্বর অববাহিকায় কৃষির উৎপাদন ছিল সর্বাধিক। প্লাবনেও কৃষির বিশেষ ক্ষতি হতো না। কারণ মিশরীয়রা জলসেচের ব্যবস্থা করে কৃষি ব্যবস্থাকে তাদের আয়ত্তের মধ্যে আনতে পেরেছিল। মূলত মিশরের কৃষি ভিত্তিক সমাজের ত্রাণ বলা হতো নীলনদকে। নীলনদকে কেন্দ্র করেই জমিতে গম, বার্লি, জোয়ার, শন, তুলাসহ বিভিন্ন তরকারী ও ফসলের চাষ হতো। খাল খনন ও সেচের মাধমে মিশরে প্রচুর খাদ্য শস্য উৎপাদিত হতো। bir প্রতিবছর জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের বন্যায় ১২,৫০০ বর্গ মাইল এলাকায় পলিমাটি পড়ে উর্বর ভূমির সৃষ্টি হতো। এ
উর্বর পলিযুক্ত সরস ভূমিতে প্রচুর ফসল উৎপাদিত হতো। ফলশ্রুতিতে মিশর ব্যাপক সমৃদ্ধি ও স্বনির্ভরতা অর্জন করেছিল। ৪. খাল খনন ও জলসেচ ব্যবস্থা : নীল নদের অববাহিকায় কৃষি কাজের বিশেষ অগ্রগতি তেমন না হলেও মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই সেখানে বসতি স্থাপন করেছিল। বাঁধ দিয়ে জলাভূমি থেকে জমি উদ্ধার কিংবা খাল কেটে সেচের ব্যবস্থা না করলে এখানে লাভজনকভাবে চাষাবাদ করা সম্ভব হতো না। নীলনদের অববাহিকায় বড় কাজ করা সম্ভব হতো না কোনো পরিবার বা গ্রামের বা গ্রামের লোকের পক্ষে। আবার অল্প জমিতে বড় ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনাও নেয়া হতো না। তাই এ নীল অববাহিকায় ক্রমশ অনেক গোত্র বা গ্রামের মানুষ দলবদ্ধ হয়ে এক একটি এলাকায় বাঁধ দিয়ে ও খাল খননের মাধ্যমে জলসেচ করে জমি চাষের ব্যবস্থা করে। এভাবে খাল খনন ও সেচের মাধ্যমে মিশরে প্রচুর পরিমাণে শস্য উৎপাদিত হতো। ৫. শস্য পঞ্জিকা নীল নদের অবস্থার উপর ভিত্তি করে মিশরীয়গণ আবিষ্কার করে শস্য পঞ্জিকা। শস্য পঞ্জিকা কৃষি কাজ পরিচালনায় সহায়তা করতো। এছাড়াও সরকারিভাবে কৃষি কাজকে সহায়তা দানের জন্য ছিল সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত পরিদর্শক, যিনি শস্য পঞ্জিকার মাধ্যমে মিশরীয় কৃষি ব্যবস্থাকে ৬. ঋতু আবিষ্কার : নীল নদকে কেন্দ্র করে মিশরীয়রা তিনটি ঋতু আবিষ্কার করেছিলেন। এগুলো হচ্ছে-
ক. প্লাবন কাল: জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নীল অববাহিকায় প্লাবন বা বন্যা হতো। বন্যায় প্রচুর পলি নীলনদের ভূমিতে সঞ্চিত হতো। যাকে মিশরীয়রা বলত 'কালো পলি'।
খ. প্লাবনোত্তর কাল : ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে বন্যার পানি সরে যেত এবং জমিতে ফসল বপনের উপযুক্ত
সময় হতো। এ সময়েই জমিতে চাষাবাদ করা হতো।
গ. শুষ্ক মৌসুম : মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়কে বলা হতো শুষ্ক মৌসুম। এ সময় চলত ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ। তাই বলা হয় যে, ঋতু বিভাগ ও কর্ম বিভাজন মূলত নীলনদের অবস্থার উপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছিল।
৭. ব্যবসা-বাণিজ্য : প্রাচীন মিশরে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারতা লাভ করে। নীল নদের উত্তর দক্ষিণে বাণিজ্যতরী গুলো সব সময় আসা যাওয়া করত। নীল নদ থেকে খাল কেটে লোহিত সাগরের সাথে যোগ করেছিল। এতে নৌকা চলাচল করত। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ছাড়াও মিশরীয়রা জল পথে ভূমধ্য সাগরের পূর্ব তীরে ফিনিশীয়, গ্রিস, ক্রিট ও অন্যান্য স্থানের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করত। মিশর হতে বিদেশে গম, মোম, বস্তু ও সুন্দর সুন্দর মাটির পাত্র চালান দেওয়া হতো। ৮. লেখার উপকরণ : নীলনদের দু'ধারে এবং বিশেষ করে নীল বদ্বীপের জলাভূমিতে জন্মাত লম্বা নলখাগড়ার মতো ঝাড়। আসলে এগুলো ছিল প্যাপিরাস গাছ। মিশরীয়গণ এ প্যাপিরাসের মাধ্যমে পেত লেখার কাগজ তুল্য উপকরণ। এ প্যাপিরাস মিশরের জন্য কেবল অর্থনৈতিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, সাংস্কৃতিকভাবেও এর গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট অর্থবহ। সেই সাথে প্যাপিরাস মিশরীয়দের জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও সম্প্রসারণের সুযোগ এনে দেয়।
৯. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি : নীলনদের প্লাবন, নাব্যতা ও সৌরজগতের সাথে জোয়ার ভাটার সম্পর্ক সম্বন্ধে প্রাচীন মিশরীয়দের সম্যক ধারণা ছিল। মূলত প্রাচীন মিশরে জ্যোতির্বিদ্যা বিশেষভাবে সমাদৃত ছিল। নীলনদের প্লাবনের সাথে জ্যোতির্বিদ্যা ও অঙ্ক শাস্ত্রের গভীর সম্পর্ক ছিল। এ দু'টি গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান শাখায় চর্চা প্রাচীন মিশরে পিরামিড নির্মাণ ও প্লাবন নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অবদান রাখে।
১০. যোগাযোগ ব্যবস্থা : নদী পথই ছিল মিশরীয়দের যোগাযোগের প্রধান উপায়। আর এ ক্ষেত্রে নীলনদই ছিল প্রধান জলপথ।
নীল নদের নৌকার সাহায্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য চলত ।
১১. ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য ও কেন্দ্রীয় শাসন: নীলনদ প্রায় চার হাজার মাইল লম্বা আবিসিনিয়ার পর্বতমালা থেকে নেমে এসে উত্তরে প্রবাহিত হয়ে ভূমধ্যসাগরে পড়েছে। নীলনদের গতিপথে রয়েছে দুটি বড় জলপ্রপাত। এসব জলপ্রপাতকে বাঁধ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত করতে না পারলে মোহনার কাছাকাছি অঞ্চল চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়ত। তাই স্বাভাবিক প্রয়োজনেই নীলনদকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে প্রাচীনকালে মিশর ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীকালে নীলনদকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনে মিশরে সর্বদা একচ্ছত্র কেন্দ্রীয় শাসন বজায় রাখার দরকার হয়েছে ।
১২. ধর্মীয় বিশ্বাস ; নীলনদের বার্ষিক গতিবিধি মিশরীয়দের ধর্ম বিশ্বাসে নতুন উপাদান সংযোগ করে। মৃত্যুই জীবনের সব নয়। মৃত্যু জীবনের সাময়িক বিরতি। নীলনদের প্লাবন শেষ হয়ে গেলে নীলনদ হয়ে যায় মৃতপ্রায় ও নিষ্প্রাণ। আবার প্লাবন ফিরে এলে নীলনদ ফিরে পেত প্রাণ। সম্ভবত পরলোক সম্পর্কিত মিশরীয়দের বিশ্বাসের মূল উৎপত্তি ছিল নীলনদ ও নীলনদ সৃষ্ট কিংবদন্তী। ফলে মৃতদেহের মমিকরণের ব্যবস্থা প্রচলিত হয় প্রাচীনকালে। ১৩০০ খ্রিষ্টপূর্বে রচিত 'Book of Proverb' এ নীলনদের মহাত্মা চিত্রিত রয়েছে। ক্রমে নীলনদ স্থান পায় মিশরীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান ও কিংবদন্তিতে। উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মিশরীয় সভ্যতায় যা কিছু গড়ে উঠেছে, সবকিছুই নীলনদকে কেন্দ্ৰ করেই গড়ে উঠেছে। তাই মিশরীয় ইতিহাসে কৃষি থেকে শুরু করে অন্য সব কর্মকাণ্ডে নীলনদের প্রভাব ছিল অপরীসীম। নীলনদ ছাড়া মিশরীয় সভ্যতার অস্তিত্ব কল্পনার অবকাশ নেই। মিশরের ভৌগোলিক অবস্থা তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে নীলনদ প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। তাই হেরোডেটাসের উক্তির যথার্থ হচ্ছে মিশর নীলনদের দান। হেরোডেটাস প্রায় ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আরও যথার্থই বলেছেন যে, “যে ব্যক্তি মিশর দেখেছে, সে অবশ্যই উপলব্ধি করেছে যে, এটি একটি স্বোপার্জিত দেশ, নীলনদের দান । নিয়মিত পরিচালিত করত।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]