সামাজিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক Relations between Social History and Sociology

সামাজিক ইতিহাস এবং সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে মিল-অমিলের সম্পর্ক বিদ্যমান। সামাজিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান উভয়েরই আলোচনার মূল ক্ষেত্র সমাজ। এ কারণে দুটোর সম্পর্ক খুবই নিবিড়। সামাজিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান উভয়ই মানবিক বিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়ন করে সার্বিক সমাজকে নিয়ে আর সামাজিক ইতিহাস অতীতের ঘটে যাওয়া সামাজিক কোনো ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে থাকে। অনেকে সামাজিক ইতিহাস এবং সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে চান না। কেননা সামাজিক ইতিহাসের আলোচ্য বিষয় এবং সমাজবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে একটি চমৎকার মিল লক্ষ করা যায়। তবে একথা নিশ্চিন্তে বলা যায় যে, সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে সামাজিক ইতিহাসের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে একে অপরের তথ্য ভাণ্ডার থেকে উপকৃত হতে পারে এবং উপকৃত হয়েও থাকে ।
ইবনে খালদুন সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করতে গিয়ে তাঁর ‘আল মুকাদ্দিমা' শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, "The past resembles water and hence sociology the study of present, casteslight on history, the study of the past."
.” অর্থাৎ ভবিষ্যতকে সদৃশ করে যেমন পানি পানিকে সদৃশ করে, তেমনি সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়ন করে বর্তমানকে এবং আলোকপাত করে ইতিহাসের ওপর যা অতীতকে নিয়ে অধ্যয়ন করে।
তাই সমাজবিজ্ঞান বর্তমান সমাজের আলোচনায় অতীতের প্রেক্ষাপটকে উপেক্ষা করতে পারে না। বর্তমান বা চলমান সমাজ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ- সামাজিক ইতিহাসের জন্য খুবই জরুরি। কেননা বর্তমান খুব দ্রুতই অতীতে পরিণত হয় । এখন যা বর্তমান ক্ষণিকের মধ্যেই তা অতীত ।
বস্তুত সমাজবিজ্ঞানী যখন বর্তমান সমাজের কাঠামো সম্পর্কে আলোকপাত করেন তখন তাকে বর্তমান সমাজ কাঠামোর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে হয়। কেননা বর্তমান সমাজকাঠামো তথা শ্রেণি সম্পর্ক অতীতের গর্ভেই জন্মলাভ করে। তাই সমাজবিজ্ঞানীকে সামাজিক ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে হয়।
সামাজিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক
Relations between Social History and Sociology
বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকগণ সামাজিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো-
১. বিষয়বস্তুর অভিন্নতা : মানব সমাজে সংঘটিত সকল ঘটনাবলির ইতিহাস হচ্ছে সামাজিক ইতিহাস। অপরদিকে মানব সমাজের যাবতীয় কার্যকলাপ পর্যালোচনা করে সমাজবিজ্ঞানী। পরিবর্তনশীল সমাজের মানুষই হলো সামাজিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান উভয়েরই পঠন-পাঠনের বিষয়। তাই T.B. Bottomore উল্লেখ করেছেন যে, সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকের মূল কর্মকাণ্ডকে পৃথক করার জন্য যতই সংস্কার করা হোক না কেন, সামাজিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। সুতরাং পরিবর্তনশীল সমাজের মানুষই হলো সামাজিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান উভয়েরই পঠন- পাঠনের বিষয়। অর্থাৎ মানুষই হলো উভয়ের পঠন-পাঠনের অভিন্ন বিষয়।
২. পরস্পর পরিপূরক : সামাজিক ইতিহাসের জ্ঞান সমাজবিজ্ঞানের অধ্যয়নকে সহজ ও সমৃদ্ধ করে। তাই সামাজিক ইতিহাস
সম্পর্কে জানতে হলে সমাজবিজ্ঞানের পাঠ অতি প্রয়োজন। অতএব সামাজিক ইতিহাস এবং সমাজবিজ্ঞান পরস্পর পরিপূরক। ৩. মানব সভ্যতার ইতিহাস অনুসন্ধান : সমাজবিজ্ঞান যেমন একদিকে কীভাবে মানুষের সামাজিক সংগঠন গড়ে ওঠে, কীভাবে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, শিল্পকলার পরিবর্তন ঘটে তা নিয়ে বিশ্লেষণ করে। অপরদিকে ইতিহাস হচ্ছে অতীত ঘটনার বিজ্ঞানভিত্তিক বর্ণনা ও বিশ্লেষণ। তাই সামাজিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান উভয়ই মানব সভ্যতার ইতিহাস অনুসন্ধান করার প্রচেষ্টা চালায়। সুতরাং সামাজিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান।
৪. পারস্পরিক সহযোগিতা : যেহেতু সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজের আলোচনায় অতীতের প্রেক্ষাপটকে উপেক্ষা করতে পারে না, সেহেতু চলমান সমাজ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ সমাজ ইতিহাসের জন্য খুবই জরুরি। সুতরাং বহু দেশেই ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা অনেকাংশেই দৃশ্যমান ।
৫. সমাজতাত্ত্বিক পদ্ধতির অনুসরণ : সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায় ও বিশ্লেষণে অনেক সমাজতাত্ত্বিক পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়। সুতরাং সামাজিক ইতিহাসে সমাজের গঠন, বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক আচার-আচরণ, প্রথা প্রভৃতি সমাজতাত্ত্বিক বিষয় সম্পর্কে ব্যাপক পর্যালোচনা করা হয়।
৬. আলোচনার ধারাবাহিকতা : ঐতিহাসিক সমাজতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ধ্যান-ধারণা, সামাজিক
সংগঠনের উদ্ভব, শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্ক, এসবের ধারাবাহিক আলোচনাকে সমৃদ্ধশালী করতে সামাজিক ইতিহাসের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৭. বিষয়বস্তুর নির্ভরশীলতা : সামাজিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান, একটির সাহায্য ছাড়া অন্যটি পরিপূর্ণ হতে পারে না। তাই একে অপরের ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। সকল প্রকার ঐতিহাসিক ঘটনার যথাযথ কারণ অনুসন্ধান করতে হলে একজন সমাজবিজ্ঞানীর মতোই সকল প্রেক্ষাপট পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবগত হতে হয়। সুতরাং একজন সমাজবিজ্ঞানীকে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে অতীতের উপাত্তের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হতে হয়।
৮. মানব কর্মকাণ্ডই মুখ্য আলোচ্য বিষয় : সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকগণ একে অপরের সাথে অনেক তথ্য বিনিময় করে থাকেন। সামাজিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান উভয়ই মানুষের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করে । পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজে সংঘটিত ঘটনা ও সমাজের বিষয়গুলো সমাজবিজ্ঞানের বিষয় এবং এ বিষয়গুলো অতীত হবার পর এগুলো সামাজিক ইতিহাসের বিষয়, তথ্য ও উপাদানে পরিণত হয় । ১.১৫ সামাজিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য Difference between Social History and Sociology সামাজিক ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে বিভিন্ন সম্পর্ক থাকলেও উভয়ের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। যথা-
- ১. সমাজবিজ্ঞান গোটা সমাজ নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু সামাজিক ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ সমাজের চেয়ে সামাজিক ঘটনাবলির ওপর বেশি জোর দিয়ে থাকে
২. সমাজবিজ্ঞান সকল প্রকার সামাজিক সংগঠন ও বিধি ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু সামাজিক ইতিহাস সাধারণত সমাজের রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করে থাকে।
৩. সমাজবিজ্ঞান সমাজের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকে। তাই সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ও পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। অপরদিকে সামাজিক ইতিহাসের পরিধি নির্দিষ্ট বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাই সামাজিক ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ সমাজ বিশ্লেষণের চেয়ে সামাজিক ঘটনাবলির ওপর বেশি জোর দিয়ে থাকে ।
৪. সমাজবিজ্ঞান পারম্পরিক সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। অপরদিকে সামাজিক ইতিহাস পারস্পরিক সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল নয়।
৫. সমাজবিজ্ঞান বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু সামাজিক ইতিহাস বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না ।
৬. সমাজবিজ্ঞান মানুষ ও সমাজের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু সামাজিক ইতিহাস সমাজের বিবর্তন ও ক্রমবিকাশের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে ।
৭. সমাজবিজ্ঞান বর্তমান সমাজের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়সমূহের মধ্যেই তার আলোচনা মূলত সীমাবদ্ধ রাখে। কিন্তু
সামাজিক ইতিহাস কেবলমাত্র অতীত সমাজের সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকে।
৮. সমাজবিজ্ঞানে ধারাবাহিকতা ও সময়ানুক্রমের চেয়ে সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিকই অধিক মূল্যবান বলে বিবেচিত হয়। অপরদিকে সামাজিক ইতিহাসে ধারাবাহিকতা ও সময়ানুক্রমকে ইতিহাসের মূল সূত্র বলে আখ্যায়িত করা হয় ।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সামাজিক ইতিহাসের সাথে সমাজবিজ্ঞানের বেশ কিছু পার্থক্য থাকলেও জ্ঞানের এ দুটি শাখা একে অপরের জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রকে বরাবরই সমৃদ্ধ করে আসছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]