অধিকাংশ ঐতিহাসিক গ্রিসের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ক্রমাগত বৈদেশিক আক্রমণকে গ্রিক সভ্যতার পতনের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করলেও এর পিছনে আরও কতিপয় নিয়ামক ক্রীয়াশীল ছিল। নিম্নে গ্রিক সভ্যতার পতনের প্রধান কারণসমূহ
আলোচনা করা হলো-
১. এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব : খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দের ম্যধভাগ থেকেই এথেন্সের দাস মালিকরা কোরিন্থ ও গ্রিসের অন্য রাষ্ট্রগুলোর জয় করার জন্য উদ্যোগী হয়। পেরিক্লিসের নেতৃত্বে এথেন্সের শাসকরা এ অভিযানের জন্য বহু অর্থ করে। পেরিক্লিস ভেবেছিলেন স্পার্টার দাসদের বিদ্রোহে উস্কানি দিয়ে সেখানে অন্তঃদ্রোহের সৃষ্টি করবেন এবং পার স্পার্ট আক্রমণ করে সহজেই তা দখল করে নিবেন। কিন্তু কোরিন্থবাসী এথেনীয়দের এ কুমতলব বুঝতে পেরে তারাই প্রথম এথেন্সের দিকে অগ্রসর হয় এবং খ্রিঃপূঃ ৪৩১ অব্দে এথেন্স আক্রমণ করে। এটিই বিখ্যাত পিলোপনেশিয়ান যুদ্ধ। এ যুদ্ধ সুদীর্ঘকাল ব্যাপী চলে। এর মাধ্যমেই গ্রিক সভ্যতার ধ্বংসের যাত্রা শুরু হয়।
২. এথেন্স বণিক ও দালাল শ্রেণির উদ্ভব : পেলোপনেশীয় যুদ্ধে পেরিক্লিসের সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। এথেন্সের সেনাবাহিনী পরাজিত হতে থাকে। এ বিপর্যয়ের ফলে এথেন্সে আপসকামী একটি দলের আবির্ভাব ঘটে। এ যুদ্ধে কৃষক ও ভূ-স্বামীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাই তারাই শান্তির জন্য আন্দোলন চালায়। কিন্তু বণিক ও দালালরা যুদ্ধের দরুন যথেষ্ট অন্যায় মুনাফা অর্জন করেছিল। এ শ্রেণির দাস মালিক যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিল। কারণ যুদ্ধ চলতে থাকলে যুদ্ধবন্দী দাস আনার সুযোগ হয়, দাস ব্যবসারও অগ্রগতি সাধিত হয়। সুতরাং এথেন্সবাসীর ক্রমাগত বিপর্যয় সত্ত্বেও তারা শান্তি প্রতিষ্ঠা ও যুদ্ধ বন্ধের বিরোধিতা করতে থাকে ।
৩. এথেন্সের পরাজয় : কোরিন্থিয়ান ও স্পার্টানরা একযোগে এথেন্স আক্রমণ করে। এথেনীয়রা এক পর্যায়ে এ সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। স্পার্টা যেসব শর্ত উত্থাপন করে এথেন্সের পক্ষে তার সব মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। জয়ে আশাবাদী স্পার্টা তখন অন্য রাষ্ট্রগুলোতেও আক্রমণ করে। সমস্ত গ্রিস পদানত করাই স্পার্টার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এসব রাষ্ট্র স্পার্টার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এ যুদ্ধ ৩৫ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। স্পার্টা এ দীর্ঘকালীন যুদ্ধে নিতান্ত দুর্বল হয়ে পড়ে ।
৪. গ্রিসে ক্রমাগত সংঘটিত বিদ্রোহ : গ্রিসে ক্রমাগত সংঘটিত বিভিন্ন বিদ্রোহের কারণে দাস-দাস মালিকরা বুঝতে পারে যে, সমস্ত গ্রিসকে একজন রাজার অধীনে সংঘবদ্ধ করতে না পারলে বিদ্রোহ ও অসন্তোষ দূর করা সম্ভব নয়। সমগ্র গ্রিস একজন রাজার অধীনস্ত হলে বাণিজ্য ও শিল্পের পুনরুদ্ধার সম্ভব। তাছাড়া শক্তিশালী রাজার অধীন বড় সেনাবাহিনী গড়ে উঠলে কৃষকদের তাতে ভর্তি করে অসন্তোষ দূর করা সম্ভব। এসব বিবেচনা করে দাস মালিকরা রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করতে থাকে এরিস্টটলের মতো দার্শনিককেও দাস মালিকরা তাদের সপক্ষে পায়। এরিস্টটল প্রচার করেন, রাজতন্ত্রই উৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা। মেসিডোনিয়ার ফিলিপকেই মনে করা হয় সমগ্র গ্রিসে রাজা হওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি। ফিলিপ একদিকে এক এক করে গ্রিক রাষ্ট্রগুলো দখল করেন, অন্যদিকে রাজতন্ত্রী দলগুলোর সাথে চুক্তিও করেন। এভাবে গ্রিক সভ্যতার পতন ত্বরান্বিত হয়।
৫. বাণিজ্য পথের পরিবর্তন : গ্রিসের অর্থনীতির অন্যতম উৎস ছিল ব্যবসা ও বাণিজ্য। প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সাথে গ্রিসের বাণিজ্য পরিচালিত হতো। কিন্তু এক পর্যায়ে প্রাচ্যে গ্রিকদের বাণিজ্য পথ পরিবর্তিত হয়। পথগুলো ভারতবর্ষ, আরব ও সুদানকে একদিকে গ্রিসের সাথে অন্যদিকে ইতালির সাথে যুক্ত করে। এসব পথে যেসব নতুন বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে ওঠে সেগুলো আগের গ্রিক বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোর গুরুত্ব নষ্ট করে দেয়। খ্রিঃপূঃ তৃতীয় শতকে বাণিজ্য কেন্দ্র রূপে এথেন্সের গৌরব চিরদিনের জন্য ম্লান হয়ে যায়। ৬. শ্রেণিদ্বন্দ্ব : পেলোপনেশীয় যুদ্ধের পরে গ্রিক সমাজে শ্রেণিদ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করে। এ সময় সকল রাষ্ট্রেই নিম্নমধ্যবিত্তরা বেকার হয়ে পড়েছিল, নয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। তারা পরের জমিতে বা পরের কারখানায় যে কাজ করবে তারও উপায় ছিল না। দাস শ্রমিকদের খাটানো হতো বেশি, আবার তাদের জন্য খরচও ছিল কম। ফলে সমাজে দুটি বিরোধী শ্রেণি পরস্পরের মুখোমুখি হয়। একটি শ্রেণি ধনবান মালিকদের এবং অপরটি বেকার সর্বহারাদের। সর্বহারাদের পক্ষে বিদ্রোহের পথ বেছে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না।
দাস বিদ্রোহ : গ্রিসের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সকল কর্মকাণ্ড মূলত দাস নির্ভর ছিল। দাসই ছিল গ্রিক অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু দাস মালিকরা তাদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালাত এবং তাদের জীবন ছিল পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট। তাই গ্রিসের বেকারদের পাশাপাশি দাসরাও এক পর্যায়ে বিদ্রোহ শুরু করে। তারাও মালিকদের অত্যাচার চুপ করে নিতে চায়নি। এ পরিস্থিতিতে দাসদের বসে রাখা মালিকদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। দাসরা দলে দলে মনিবের আশ্রয় ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে এবং পাহাড় থেকে মাঝে মাঝেই তারা শহরের অধিবাসীদের উপর চড়াও হতে থাকে। এভাবে এক পর্যায়ে দাস বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করলে গ্রিক সভ্যতার পতন ঘটে।
৮. অর্থনৈতিক কারণ : গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সংঘটিত ৬০ বছর ব্যাপী যুদ্ধে সমগ্র গ্রিসের অর্থনৈতিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয়। সবার আগে ধ্বংস হয় গ্রিক কৃষক সমাজ। সৈন্যরা অভিযানের সময় চাষের জমি ও ফলের বাগান নষ্ট করে দেয়। বিধস্ত গ্রামগুলো এক প্রকার পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। কৃষক এবং ক্ষুদ্র গৃহস্তরা জীবন ধারণের অন্য কোনো উপায় না পেয়ে সামান্য মূল্যে তাদের ভিটা ও জমি ছেড়ে দেয়। শহরের বড় বড় দাস মালিক তা কিনে নেয়। এরা এসব জমি এক এক করে বড় আকারে কৃষি উৎপাদনের ব্যবস্থা করে। শহরে পরিবর্তন দেখা দেয়। ব্যবসায়ীদের হাতে টাকার পুঁজি বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধে রাষ্ট্র যা খরচ করে অধিকাংশই ব্যবসায়ীদের হাতে এসে পড়ে। ব্যবসায়ীরা তখন শিল্প উৎপাদনে পুঁজি খাটায় ৷
৯. বেকার বিদ্রোহ : গ্রিসে বেকার দলের নির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচি, নীতি এবং রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না। তারা শুধু এতটুকু বুঝত, যে ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় লোক ধনবান এবং অধিকাংশ লোক গরিব, সে ব্যবস্থার বিলোপ হওয়া প্রয়োজন। তারা দাবি করতে থাকে যে, ঋণ বাতিল করতে হবে, জমি ও দাস মালিকদের টাকা সকলের মধ্যে বণ্টন করতে হবে, রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে গরীবদের নিয়মিত ভাতা দিতে হবে। কিন্তু গ্রিসের এ বিপ্লবী জনগণ দাস প্রথার বিলোপ চায়নি । খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭০ অব্দের দিকে বেকার বিদ্রোহ ভিশন আকার ধারণ করে। আর গ্রিসের বিদ্রোহীরা ১২০০ দাস মালিককে হত্যা করে। কোরিন্থের বিদ্রোহের হাতে ১২০ জন ভূ-স্বামী নিহত হয় এবং বহু দাস মালিক অন্য রাষ্ট্রে পালিয়ে যায়। ফলে সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং গ্রিক সভ্যতার পতন ত্বরান্বিত হয়।
১০. ব্যাংক ও বৃহৎ কারখানা প্রতিষ্ঠা : এথেন্সে নতুন একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সমগ্র গ্রিসে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় ব্যাংক। এছাড়া আরও কতগুলো ব্যাংক ছিল। রাষ্ট্র, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সকলেই এসব ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তাছাড়া বড় বড় শিল্পকারখানা গড়ে উঠার কারণে শহরের হস্ত শিল্পীরা বেকার হতে থাকে। কেননা বড় বড় কারখানার সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠা তাদের পক্ষে ছিল খুব কঠিন। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দের পর চতুর্থ শতকে পরিস্থিতি আরও কঠোর হয়ে যায়। কৃষকরা পূর্বে শহরের কারিগরদের জিনিস ব্যবহার করত। এ সময় তাও বন্ধ হয়ে যায়। কেননা কৃষকরা নিজেরাই ছিল সর্বস্বান্ত। অতএব বেকার জীবন ছাড়া তাদের উপায় ছিল না ।
সুতরাং দেখা যায় যে, গ্রিক সভ্যতা ধ্বংসের উপরোক্ত কারণগুলো ছাড়াও এক পর্যায়ে গ্রিক ঔপনিবেশিকদের অনেকেই দলবদ্ধ হয়ে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। শহরে এসব বিদ্রোহ দেখা দিলে অন্যান্য অভাবগ্রস্ত লোকজনও তাতে যোগ দেয়। শুধু ঔপনিবেশিক গ্রিকরাই নয়, বিজিত দেশের নিপিড়িত কৃষকরাও বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়। জনগণের অসন্তোষ ও বিদ্রোহের ফলে প্রাচ্যের গ্রিক সাম্রাজ্য ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। অবশেষে মেসিডোন শক্তি আবির্ভাবের পর গ্রিক রাষ্ট্রগুলো তাদের স্বাধীনতা হারায় ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত