যা সৃষ্টি হয় তা প্রাকৃতিক নিয়মেই ধ্বংস হয়। সভ্যতার উদ্ভব, ক্রমবিকাশ এবং পতনও যেন কালের এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলতে থাকে। রোমান সাম্রাজ্যও এর ব্যতিক্রম নয়। এ সত্য সবাইকে মেনে নিতে হয়। রোমান সাম্রাজ্যের ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে চূড়ান্ত পতন ঘটে। রোমান সাম্রাজ্য পতনে নিম্ন বর্ণিত কারণসমূহ বিশেষজ্ঞরা তুলে ধরেছেন।
১. সামাজিক কারণ রোমান সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায় তৎকালে এ সমাজে শ্রেণি বিভক্তির ফলে মানুষদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল। দূরত্বটা পেশাগত না হয়ে মান মর্যাদার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল যেমন- রোমান সমাজের প্রধান তিনটি প্রচলিত শ্রেণিবিভাগ ছিল তা হচ্ছে যথাক্রমে- ক. অভিজাত শ্রেণি, খ, কিউরিয়ালেস, গ. সাধারণ মানুষ স্বাধীন নাগরিক, ii. দাস ।
রোমান সমাজ
অভিজাত শ্রেণি
কিউরিয়ালেস
স্বাধীন নাগরিক
সাধারণ মানুষ
দাস
এ তিন শ্রেণির মধ্যে অভিজাত শ্রেণি সর্বোচ্চ পদ সিনেট সদস্য হতে পারতেন। এ উপাধি প্রাপ্তরা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হয়ে সরকারি দ্বায়িত্ব বা সামাজিক দায়িত্ব পালন ব্যতিরেকে ভোগ বিলাসে দিন যাপন করতেন। কিউরিয়ালেস শ্রেণির স্থান ছিল অভিজাত শ্রেণির নীচের স্তরে। এ উপাধি প্রাপ্তরা অবৈতনিক ছিলেন এবং প্রচুর সুযোগসুবিধা ভোগ করতেন। তৃতীয় শ্রেণিতে ছিল স্বাধীন মানুষ বা দাস শ্রেণির মানুষ। এ উপাধি প্রাপ্তরা স্বাধীন নাগরিকরা খাজনা দিয়ে জমিদারদের কাছ থেকে ছোট ছোট জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করত। আর দাসরা করত মূলত সবার দাসত্ব। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ এক অসহনীয় জীবন যাপনে তারা বাধ্য ছিল। মোটকথা বিত্তশালী ব্যক্তিরাই যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত, বঞ্চিত সাধারণ মানুষ রোমান সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার কোনো চেষ্টা করেনি। তাই এ সভ্যতার পতন ত্বরান্বিত হয়।
২. দাস প্রথা : রোমান সভ্যতার শেষ দিকে দাসের সংকট সৃষ্টি হয়। দাস ব্যবস্থা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল রোমান সাম্রাজ্যে। দাসদের প্রচুর শ্রম প্রদান করতে হতো। এতে করে একজন সুস্থ সবল মানুষ অতি শ্রীঘ্রই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। তাছাড়া অর্থ ব্যবস্থা পরিবর্তন হতে থাকলে দাস ব্যবস্থা ক্রমেই সংকটপূর্ণ হতে থাকে। আর এ সংকট প্রবল আকারে দেখা দিলেই মূলত রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
৩. বিচ্ছিন্নতাবাদ : রোম সাম্রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নতুন শাসক নির্বাচনের সময় প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই রোম ১টি শাসনতান্ত্রিক সংকটের মুখে পড়ে। ২৩৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২৮৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রোমে চরম অরাজকতা পরিলক্ষিত হয়। এ সময় ২৬ জন শাসকের মধ্যে ২৫ জনই ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারান। সুতরাং বিচ্ছিন্নতাবাদ রোম সাম্রাজ্যের পতনের আরেকটি কারণ।
৪. কেন্দ্রীয় প্রশাসনের দুর্বলতা : রোমানরা সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতি মনোনিবেশ করে। কিন্তু বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে গিয়ে তারা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে নি। বর্বর জার্মানরা এ সুযোগ গ্রহণ করতে থাকে। আবার সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তারের মধ্য দিয়ে শ্রেণি দ্বন্দ্বও অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হওয়ার ফলে রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়।
৫. উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিবর্গের উত্থান : রোমান সভ্যতা পতনের অন্যতম কারণ হচ্ছে রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে
উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিবর্গের উত্থান ঘটায় রোমের সংহতি বিনষ্ট হয় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।
৬. নৈতিক অবক্ষয় রোমান সাম্রাজ্যের শেষের দিকে সমাজে অনাচার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, সমাজের উচ্চবিত্তরা বহু বিবাহ
করত। বিবাহ বিচ্ছেদ ও সমকামিতার হার বহুকামিতার হার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে যায়। সমাজে অপরাধ প্রবণতা, দুর্নীি উৎপীড়ন, ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। B.M. Burns এ সময়ের সমাজ ও রাষ্ট্রের কতগুলো বিবরণ প্রদান করেছেন। যথা- ক, অসামস্যপূর্ণ করনীতি, খ. নতুন উৎপাদিকা শক্তির উত্থান, শাসন ব্যবস্থায় সাধারণ জনগণের অনুপস্থিতি, ১৬৬ থেকে
২৫২ সাল পর্যন্ত রোমে মহামারি আকারে প্লেগ রোগের আক্রমণ ।
৭. অর্থনৈতিক অবক্ষয় রোমে দাসপ্রথা চরমরূপ ধারণ করেছিল। দাসদের উৎপাদনের সকল ক্ষেত্রে ব্যবহারের ফলে স্বাধীন
শ্রমিক ও কৃষকদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। ব্যাপক বেকারত্ব রোমের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে রেখেছিল।
৮. খ্রিষ্টান ধর্মের প্রসার : রোমান সাম্রাজ্যের শাসনের শেষের দিকে খ্রিষ্টান ধর্ম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। সাধারণ মানুষকে শোষণের জন্য গড়ে ওঠে পোপতা। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী শাসকরা সাধারণ মানুষের উপর অন্যায় অত্যাচার চালাতে
থাকে। সাধারণ মানুষ অতিষ্ট হয়ে ওঠে। তারা রোমান সাম্রাজ্যের পতনকে প্রত্যাশা করে ।
সম্রাটদের বিলাসিতা : সুবিশাল রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাটদের সম্পদ ও প্রতিপত্তির অভাব ছিল না। তারা অনেক সময় ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে পড়ে। সাম্রাজ্যের পতনের জন্য সম্রাটদের বিলাসিতা অনেকাংশে দায়ী ছিল।
১০. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাব : রোমানরা যেভাবে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, আইনের ক্ষেত্রে সফলতা দেখাতে পারেনি।
উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবে রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়ে থাকে ।
১১. সামরিক বাহিনীর ভূমিকা : সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে সামরিক ব্যয় বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। কেন্দ্র থেকে দূরবর্তী স্থানে
সামরিক অফিসাররা সেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। এর ফলে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের সৃষ্টি হয়।
১২. উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের উত্থান : রোমান সাম্রাজ্য শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও শাসনভার গ্রহণে সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকার নীতি ছিল না। উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে বহু অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও প্রশাসনে জনগণের অংশগ্রহণ না থাকায় প্রশাসন ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে থাকে।
১৩. বহিঃশত্রুর আক্রমণ : বার বার বৈদেশিক আক্রমণেও রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তদুপরি
আভ্যন্তরীণ বিরোধ ও এ সবের মধ্যে জড়িয়ে যায়। বৈদেশিক আক্রণের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা হলো-
ক. ২য় খ্রিষ্টাব্দের বৈদেশিক আক্রমণ
খ. খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর বৈদেশিক আক্রমণ
গ. ৪২৫ খ্রিষ্টাব্দের গথ উপজাতির আক্রমণ
ঘ. ৪৩৩-৪৪ খ্রিষ্টাব্দের হুন জাতির আক্রমণ
ঙ. খ্রিষ্টীয় পাঁচশো শতকে জার্মাণ জাতি গোষ্ঠীর আক্রমণ
এসব আক্রমণে রোমান জাতির পতন ঘটে এবং এসব আক্রমণে সাম্রাজ্যের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয় ।
১৪. উত্তরাধিকার নীতির অভাব : রোমান সাম্রাজ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তরাধিকার নীতি ছিল না। ফলে ক্ষমতা দখলের খেলায় লিপ্ত হতো সামরিক বাহিনীসহ শক্তিশালী ব্যক্তিবর্গ ও শাসক পরিবারের লোকজন। এসময় বাহুবলই ছিল ক্ষমতা দখলের নিয়ামক শক্তি। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিবর্গের উত্থান ঘটিয়ে রোমের সংহতি বিনষ্ট হয়। ফলশ্রুতিতে রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে I
পরিশেষে বলা যায় যে, মনুষত্ব যেখানে উপেক্ষিত মানবতা যেখানে লাঞ্ছিত সে সমাজ ও সভ্যতার পতন অনিবার্য। রোমান সাম্রাজ্যের পতনও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। তেমনিভাবেই প্রায় ১,৩০০ বছরের প্রবল পরাক্রান্ত রোমান সাম্রাজ্য এক পর্যায়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। এক সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে পতনের দিকে ধাবিত হয়। ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দের বর্বর জার্মান উপজাতি ঘুনেধরা রোমান সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত অবসান ঘটায়। তাদের এ পতনের মধ্য দিয়ে ইউরোপে মধ্যযুগের সূচনা হয়।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত