সামন্তবাদের বৈশিষ্ট্য/ প্রকৃতি Features/ Nature of Feudalism

মধ্যযুগের ইউরোপীয় ইতিহাসে সামস্তা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাজব্যবস্থা। সামন্ততন্ত্র বলতে এক প্রকার ভূমিব্যবস্থাকেই বুঝায়। যা মূলত ভূমি মালিকানার উপর ভিত্তি করে বিকশিত হয়েছিল। সামন্তবাদের মূল লক্ষ্য হলো সমাজের শক্তিশালী মানুষ দুবল মানুষকে সাহায্য করবে। অর্থাৎ সামন্তবাদের মূল বৈশিষ্ট্যের ভিত্তি হলো সেবা ও রক্ষার চুক্তি। নিচের আলোচনায় সামন্তবাদের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো-
১. জমির মালিকানা : সামন্ততন্ত্রের রাজা বা লর্ডই মালিক। লর্ড কতিপয় শর্তের বিনিময়ে তার অধীনস্ত সামস্তপ্রভুদের মধ্যে
অধিকাংশ ভূমি বন্দোবস্ত করতেন। রাজার কাছে জমি পেতেন ডিউক, কাউন্ট, আর্থ, মারগ্রেভ প্রভৃতিরা। এদেরকে বলা হতো টেনান্টসইনসিফ। তারা আবার তাদের জমির সিংহভাগ বণ্টন করে দিতেন ব্যারণ, ডিসকাউন্ট প্রভৃতির মধ্যে। এভাবে সর্বনিম্ন পর্যায়ে যিনি ভূমি পেতেন তাকে বলা হতো নাইট ।
ভূমির উপর লর্ডদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা : সামন্ততন্ত্রে ভ্যাসলগণ লর্ডদের নিকট থেকে যে ভূমি গ্রহণ করত সে ভূমির উপর তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। তারা ইচ্ছামতো ভূমি ব্যবহার করার যাবতীয় অধিকার ভোগ করত। ৩. লর্ড ভ্যাসাল ব্যবস্থা : সামন্ততন্ত্রের ভূমি বিতরণ কার্যে যিনি ভূমি দিতেন তিনি হলেন লর্ড এবং যিনি ভূমি পেতেন তাকে
বলা হতো ভ্যাসাল, ভ্যাসালকে বাংলায় সামন্ত বলা হতো। সামন্ততন্ত্রে লর্ড ব্যতীত সকল সামন্ত প্রভুই কারও না কারো ভ্যাসাল এবং নাইট ছাড়া সকল প্রভুই কারো না কারো লর্ড। এ ব্যবস্থাকে ইউরোপের সর্বত্র যে একক বা সুনির্দিষ্ট রীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তা নয় ৷
:
৪. বংশ পরম্পরায় জায়গির স্বত্ব ভোগ : ফিউড বা শর্তাধীনে জায়গির প্রদানকে কেন্দ্র করে সামন্ত যুগের শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ফিউডের বিনিময়ে জায়গিরদার তার প্রভুর ভ্যাসাল বা অনুগত সামন্তে পরিণত হতো। এ সামন্তরা তাদের প্রভুর প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিত এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চলা পর্যন্ত বংশানুক্রমে জায়গীর স্বত্ব ভোগ করতে পারত ।
৫. লর্ডের কর্তব্য : সামন্ততন্ত্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার ব্যবহার করত ভূমির মালিক তথা লর্ড। লর্ডের অধীনে সকল শ্রেণিই তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করত তবে এ সবের পরও লর্ডের প্রধান কর্তব্য ছিল বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে তার ভাসালকে রক্ষা করা এবং কোনো ভ্যাসালের মৃত্যু হলে তার নাবালক সন্তানদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ ও তাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন । ৬. ভ্যাসালের কর্তব্য : সামন্ততন্ত্রে ক্ষমতা ব্যবহারের দিকে প্রায় সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান হলো ভ্যাসালের। এ সমাজব্যবস্থায় ভ্যাসালের প্রধান কর্তব্যসমূহ হলো অস্ত্র ও সজ্জিত অশ্বারোহী সামরিক বাহিনী লর্ডকে সরবরাহ করা, যুদ্ধে লর্ডকে অনুসরণ করা ও লর্ড বন্দী হলে মুক্তিপণ দিয়ে তাকে মুক্ত করা, শত্রুর গোপন ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা উৎঘাটন করা ।
৭. ম্যানির প্রথা : সামন্ততন্ত্রের জমিদারের খাস-খামারকেই ম্যানর বলে অভিহিত করা হয়। মূলত সামন্ত উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদনের একক ছিল এ ম্যানর। সাধারণত ম্যানর বলতে সামন্ত কৃষি ব্যবস্থা কিছু খাস জমির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা স্বনির্ভর আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে বুঝায়। ম্যানরকে উৎপাদন ব্যবস্থার মৌল একক বলা হয়েছে, যেখানে ম্যানর প্রধান চারিদিকে কৃষক প্রজা পরিবেষ্টিত হয়ে স্বনির্ভর এক সমাজের পত্তন করে ৷
৮. এস্টেট প্রথা : সামন্ততন্ত্র তিন ধরনের এস্টেটে বিভক্ত ছিল। প্রথমে এস্টেট বলতে জমিদারি বুঝালেও পরবর্তীতে এক
ধরনের স্তরবিন্যাস বুঝাতে এ এস্টেট শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সামন্ততন্ত্রের তিন ধরনের এস্টেট হলো-
* প্রথম এস্টেট : যাজক সম্প্রদায়;
* দ্বিতীয় এস্টেট : অভিজাত সম্প্রদায়;
* তৃতীয় এস্টেট : জনসাধারণ ।
৯. মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবস্থা : সামন্ততন্ত্রে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। রাজার কাছ থেকে প্রাপ্ত ভূমি ডিউক, কাউন্ট, আর্ল, মারগ্রেভ, নাইট প্রভৃতির মধ্যে স্তরে স্তরে বণ্টন করা হতো এবং রাজা ও নাইটের মধ্যবর্তী সকল সামন্ত প্রভুই ছিল মধ্যস্বত্বভোগী । তবে সব সময় এ ধারাবাহিকতা এক রকম থাকত না।
১০. শাস্তিমূলক ব্যবস্থা : সামন্ততন্ত্রে অপরাধের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। ভেসাল যদি জমির ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে পরে সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করত বা কর্তব্য সম্পাদনে অবহেলা করত, তা হলে লর্ড ভেসালের প্রতি ইচ্ছানুযায়ী শাস্তির ব্য গ্রহণ করতে পারতেন।
১১. সামাজিক স্তরবিন্যাস : সামন্তবাদ ছিল নিঃসন্দেহে স্তবায়িত সমাজ। লর্ড থেকে নাইট পর্যন্ত ছিল শাসক ও শোষক শ্রেণি । এদের বিপরীত দিকে ছিল একদল বিত্তহীন কৃষককুল- যারা চিরকালের জন্য সামন্ত প্রভুর জমিতে বাঁধা ছিল। এদেরকে বলা হতো ভূমিদাস। সামন্ত সমাজে স্তরবিন্যাসের চিত্র ছিল রাজা টেনান্ট ⇒ ইন কাউন্ট ⇒ অর্থ মারমেও
→ নাইট → সার্ক ।
১২. চার্চের প্রভাব : সামন্ত যুগে যেমন ছিল ভূমিভিত্তিক তেমনি আবার ছিল ধর্মীয় সমাজ। তখন সমাজে চার্চের প্রভাব ছিল খুবই বেশি। ধর্মীয় ব্যাপক কর্তৃত্ব ছাড়াও চার্চ ছিল সকলের সেরা ভূ-স্বামী। চার্চ প্রভূত রাজনৈতিক ক্ষমতারও অধিকারী হয়েছিল এবং সে ক্ষমতা বহু ক্ষেত্রে রাজার ক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। চার্চ সামন্ত যুগের সর্বাপেক্ষা বড় শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।
১৩. ভ্যাসালের স্বাধীনতা : হোমেজ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জমি পাওয়ার সাথে সাথে ভ্যাসাল প্রভুর কাছ থেকে কতকগুলো স্বাধীনতা লাভ করত। নিজের ভূ-খণ্ডে ভ্যাসাল ইচ্ছামতো সৈন্য মোতায়েন রাখা, প্রয়োজনের উপর কর ধার্য করা, জরিমানা আদায়, নিজস্ব আদালত স্থাপন করে প্রজাদের বিচার প্রভৃতি স্বাধীনতাগুলো ভ্যাসাল প্রাপ্ত হয়েছিল।
১৪. কার্ডি ব্যবস্থা : সামন্ত সমাজে কৃষকরা সর্বদাই সামন্ত প্রভুর জন্য বাধ্যতামূলকভাবে কাজ করত। ফসল উৎপাদনের জন্য যেমন কৃষকদের খাটতে হতো তেমনি সামন্ত প্রভুর জন্য বাড়তি শ্রমও দিতে হতো। সপ্তাহে দুই তিন দিন অতিরিক্ত শ্রম দিতে কৃষক বাধ্য থাকত। এ অতিরিক্ত বা বৈগার শ্রমকে কার্ভ বলা হয় ।
১৫. কর ও নজরানা আদায় : সামন্ত সমাজে কৃষকদের থেকে বিভিন্ন ধরনের কর আদায় করা হতো। যেমন- বিক্রয় কর বেনালিটিস, সাফ পরিবারের সদস্যদের জন্য ক্যাপিটাটিও, চার্চের জন্য টাইথ, সামন্ত প্রভুর পশুর জন্য প্রেসটেনশন প্রভৃতি কর এবং বিভিন্ন ধরনের নজরানা দিতে কৃষকরা বাধ্য থাকত ।
১৬. বিনাশ্রমে ফসল লাভ : সামন্ত প্রথায় সামন্ত প্রভুরা শুধু মালিকানার জোরে বিনা শ্রমেই ফসল লাভ করত। সামন্তবাদের কৃষক ছিল মূলত ভূমিদাস। ভূমিতে সামন্ত প্রভুর কোনো শ্রম ছিল না। উৎপাদনে শ্রম বলতে যা বুঝায় তা আসত ভূমিদাসের নিকট থেকে। অর্থাৎ সামন্ত উৎপাদন প্রণালিতে উৎপাদনের জৈবিক উপাদান ছিল ভূমিদাস ।
১৭. ভূমি দাসের স্থানান্তর গমন : ভূমিদাস সামন্ত প্রভুর অনুমতি ব্যতীত তার বাসস্থান ত্যাগ বা ম্যানর ছেড়ে অন্যত্র কোথাও যেতে পারত না। কোনো সামন্ত প্রভু অন্য কোনো সামন্তের সকল ভূমি হস্তান্তর করলে তখন ভূমির সাথে ভূমিদাসও
হস্তান্তর হয়ে যেত ।
পরিশেষে বলা যায় যে, উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই ইউরোপীয় সামন্ত প্রথার সামাজিক দিক ফুটে উঠেছে। তবে সামন্ততন্ত্রের এসব বৈশিষ্ট্য যে ইউরোপের সর্বত্র পরিপূর্ণ রূপে প্রচলিত ছিল তা নয় ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]