সামন্তবাদে কৃষকের অবস্থা Condition of Peasants in Feudalism


৭.৭ সামন্তবাদে কৃষকের অবস্থা Condition of Peasants in Feudalism
ভূমি ও মানুষের সম্পর্কই সামস্ত সমাজের মূলভিত্তি। অর্থাৎ সামস্ত যুগে কৃষকই ছিল সমাজের মূল উৎপাদক শ্রেণি এবং সামন্ত প্রভু ও যাজকরা ছিল শাসক ও শোষক শ্রেণি। কৃষকরা সমাজে মূল উৎপাদক শ্রেণি হলেও সমাজে তাদের সম্মানজনক কোনো অবস্থান ছিল না। আবার উৎপাদনের কাজে সামন্ত প্রভুদের কোনো ভূমিকা না থাকলেও ফসলের একটি বিরাট অংশ তারা পেত । পক্ষান্তরে পদে পদে কৃষকরা বঞ্চিত হয়। সামন্তবাদের কৃষকরা প্রধানত ৪টি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা- ক. সার্ফ : তাদেরকেই সার্ফ বলা হয়, যারা নিরাপত্তাজনিত অথবা অন্যকোনো বাস্তব কারণে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষক তাদের
নিজেদের ভূমিটুকু ধনী ও বড় কৃষকের নিকট সমর্পণ করে তার আজ্ঞাবহ কৃষকে পরিণত হয়ে জীবন-যাপন করে থাকে। খ. ডিলেইন : ভিলেইনরা নিরাপত্তা বা অন্য কোনো কারণে বড় কৃষকের কাছে নিজের জমি সমর্পণ করে আজ্ঞাবহ কৃষকে
পরিণত হয়ে থাকে।
গ. ক্রফটার : ভূমিহীন কৃষক ছিলেন ক্রাফটরা। এরা নির্ধারিত পরিমাণ কর দিয়ে ভূমি চাষের অনুমতি পেত। এদের অধিকাংশ সময় কাটাতে হতো সামন্ত প্রভুদের ভূমিতে বেগার খাটার বিনিময়ে। কিছু ভূমি বেগার খাটার বিনিময়ে সামন্তপ্রভুরা ক্রাফটদেরকে প্রদান করতেন।
ঘ. কটার : এদের কোনো জমি ছিল না। এরা ছিল সবচেয়ে নীচু শ্রেণির কৃষক এবং এরা করের বিনিময়ে কোনো ভূমি পেতেন না । এরা সামন্ত প্রভু ও ধনী কৃষকদের ভূমিতে বেগার খাটতেন। বেগার খাটার মাধ্যমে সামন্ত প্রভু কিছু ভূমি এদেরকে দান করতেন। সামন্তবাদী কৃষকদের অবস্থার বিবরণসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো—
১. কৃষকদের উপর করারোপ : সামন্ত সমাজে সামন্তপ্রভুর প্রতি ভূমিদাসের বাধ্যবাধকতা ও দায় দায়িত্বের ইয়ত্তা ছিল না। বিভিন্ন উপলক্ষে ভূমিদাস সামন্ত প্রভুকে নজরানা, মাশূল ও কর দিতে বাধ্য ছিল। প্রত্যেক ভূমিদাসকে মাথাপিছু কর দিতে হতো। এ করের পরিমাণ সামন্ত প্রভুর খেয়াল খুশির উপর নির্ভর করত। সামন্ত সমাজে কৃষকদের উপর যেসব করারোপ করা হতো তা ছিল নিম্নরূপ-
ক. ক্যাপিটাশিও : ক্যাপিটাশিও হলো ভূমি দাসের পরিবারে যতজন লোক থাকবে মাথাপিছু ততজনের কর প্রদান করা । এ কর ছিল বাধ্যতামূলক ।
খ. টেইল বা মেটায়েজ : টেইল বা মেটায়েজ কর হলো কৃষকের উৎপাদিত ফসল ও গৃহপালিত পশুর একটি বিশেষ অংশ কর হিসেবে সামন্ত প্রভুকে প্রদান করা। তবে উৎপাদিত ফসল ছাড়াও হাঁস, মুরগি, ডিম, পুকুরের মাছ, গরুর দুধ, মাংস প্রভৃতি এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
গ. বেনালিইটিস : কৃষকরা যখন হাটে ফসল বিক্রি করত তখন সে ফসলের উপরও তাদের কর দিতে হতো। এ কর
সামন্ত প্রভু কর্তৃক নির্ধারিত ছিল। এ জাতীয় করকে বেনালিইটিস কর বলা হয়। এটি হাট কর নামেও পরিচিত ছিল। ঘ. টোল : কৃষকরা যখন তাদের ফসল ম্যানরের ভিতর প্রবাহিত কোনো নদী, খাল বা রাস্তার উপর দিয়ে নিয়ে যেত তখন তাদের ফসলের একটি অংশ কর হিসেবে দিতে হতো। এছাড়া গম বা আঙ্গুর পেষার মেশিনের জন্য একটি কর জমিদারকে দিতে হতো। কারণ এ সময় গম বা আঙ্গুর পেষার মেশিন একমাত্র জমিদারেরই ছিল। এ জাতীয় করকে টোল বলা হতো।
ঙ. প্রেসটেশন : প্রেসটেশন হলো এক ধরনের আপ্যায়ন কর। কৃষকরা যখন সারা বছরের পরিশ্রম শেষে ফসল কেটে ঘরে তুলত তখন জমিদার তার দলবল নিয়ে এক ম্যানর থেকে অন্য ম্যানরে খাজনা আদায়ে বের হতেন। তখন কৃষকের বাড়িতে অবস্থান করার সময় তাদের জমিদারি কায়দায় আপ্যায়ন করতে হতো। জমিদারও তার দলবলের পাশাপাশি কৃষকদের তাদের সাথে থাকা ঘোড়া ও কুকুরদেরও রাজকীয় কায়দায় আপ্যায়ন করতে হতো। একে বলা হতো প্রেসটেশন।
৪. টাইম : টাইম হলো এক ধরনের ধর্ম কর। সামস্ত সমাজের কৃষকরা চার্চের যাজক দ্বারা শোষিত ও অত্যাচারিত হতো। চার্চকে তারা কর দিতে বাধা থাকত। এ করকে বলা হতো টাইল। সুতরাং পর্ডের ন্যায় চার্চের যাজক দ্বারাও কৃষকরা শোষিত হতো। ৪. কর্তি : কৃষকদের মাঝে মাঝে জমিদার ও চার্চের প্রয়োজন অনুযায়ী বেগার খাটতে হতো। কতদিন বেগার খাটতে হবে তা ঠিক করত সামঞ্জগ্রভু ও যাজক। এরূপ বেগার খাটা কর্তি নামে পরিচিত। প্রভুর জমি চাষাবাদ ও ফসল কাটা, রাস্তা তৈরি সেতু বা গুল তৈরি ও মেরামত প্রভৃতি কাজে কৃষকদের বেগার বা বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিতে হতো। এমনকি শিকার করতো প্রভু। কিন্তু শিকার যাওয়া করে নিয়ে যেতে হতো বেগার খাটা কৃষকদের। এতে কৃষকরা অধিকাংশ সময় তাদের নিজের ক্ষেতে কাজ করতে পারত না। কিন্তু ফসল ফলুক বা না ফলুক জমিদারের খাজনা থেকে তাদের রেহাই ছিল না।
B. অন্যান্যদের কর : প্রভুর ছেলে মেয়ের বিবাহ বা নাইট উপাধি পাওয়া উপলক্ষে কৃষকরা জমিদারকে খাজনা দিতে বাধ্য থাকত। এ ছাড়াও সামন্ত প্রভুকে পথ কর, ভ্রমণ কর, শিকারের জন্য কর, বিবাহ কর, যুদ্ধ কর এবং অন্যান্য স্থানীয়
ও রাজকীয় কর কৃষকরা দিতে বাধ্য থাকত। এছাড়া জমিদাররা অনেক অবৈধ কর কৃষকদের উপর চাপিয়ে দিত। 2. কৃষকদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ : কৃষকরা ছিল বঞ্চিত ও শোষিত শ্রেণি, আর লর্ডরা ছিল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তারা ছিল লর্ডদের নির্দেশ ও আদেশ মান্যকারী এবং তাদের কোনো অধিকার ছিল না। বিনা বাক্যে লর্ডদের নির্দেশ মান্য করা ও আনুগত্য প্রকাশ করাই ছিল কৃষকদের ব্যক্তিগত দায়িত্ব ও কর্তব্য। এতে করে প্রতিটি কৃষকের ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হতো। নিম্নোক্ত বিষয়গুলির জন্য কৃষককে মূলত লর্ডদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করতে হতো। যেমন-
ক. কৃষককে প্রতি সপ্তাহে ২/৩ দিন কর্তি দেওয়া ছাড়াও সামন্ত প্রভুর ফসল কাটার সময় সপ্তাহে ৫ দিন কর্তি দিতে হতো । খ. কৃষককে নিয়মিত ও সন্তোষজনক রাজস্ব দেওয়াসহ কর্তি প্রদান ছিল বাধ্যতামূলক
গ. সেবা করার বিনিময়ে কৃষকরা জমি ভোগ দখল করতে পারত। এই জমি প্রদানে লর্ডদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ঘ. কৃষকদের ছেলে বা মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলেও লর্ডের বিনা অনুমতিতে বিয়ে দেওয়া যেত না। অনুমতি নিয়েই বিয়ে দিতে হতো ।
ঙ. উৎপাদিত ফসল, পুকুরের মাছ, গরু, ঘোড়া, ভেড়া বা অন্যান্য পশু বিক্রি করতে হলেও লর্ডের অনুমতি নিতে হতো। চ. সামন্ত প্রভুর অনুষ্ঠানে কৃষককে উপহার উপঢৌকন এর পাশাপাশি অর্থ সাহায্য দিতে হতো। যেকোনো উৎসবে মুরগি সরবরাহের বিষয়টিও বাধ্যতামূলক ছিল।
৩. নিম্নমানের জীবন যাপন ব্যবস্থা : উৎপাদনের হাতিয়ার চালিকা শক্তি হিসেবে সামন্তবাদের কৃষকরা যদিও ব্যাপক ভূমিকা রাখত তথাপিও তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন সে সময় হয়নি। তাদেরকে উৎপাদিত ফসলের প্রায় ৮০ ভাগেরও বেশি প্রভুরা ভোগ করত আর ২০ ভাগ ফসল দিয়ে খুবই কষ্টে নিম্নমানের আহার পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করতে হতো। অনেক সময় অর্ধাহারে ও অনাহারেও থাকতে হতো। জরাজীর্ণ, নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাদেরকে বসবাস করতে হতো। ৪. শারীরিক নির্যাতন ভোগ : কৃষকগণ যেসব শর্ত ও চুক্তির মাধমে সামন্ত প্রভুর সাথে সম্পর্কিত ছিল এবং যেসব কর ও কর্ভি প্রদানের কথা থাকত তার কোনোটি পালনে যদি ব্যর্থ হতো তবে তাকে লর্ড অমানবিক ও পৈশাচিক নির্যাতন করত। যদিও অধীনস্ত কৃষককে আঘাত করা, আহত করা বা হত্যা করা বা শারীরিক নির্যাতন সম্পূর্ণভাবে বেআইনি ছিল, কিন্তু এগুলোর কোনোটি লর্ড না মেনে নিলে সে ক্ষেত্র বিশেষে চাষিকে বন্দী করে চুনের গুদামে রাখত এবং কখনো কখনো মৃত্যুদণ্ডও `দিত। কর পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়ে যদি কোনো কৃষক মারা যেত তবে তার পরিবারকে তার ঋণ পরিশোধে বাধ্য করা হতো। ঋণ পরিশোধের পরই মৃতদেহের সৎকার করার অনুমতি পাওয়া যেত
৫. কর্ডি : লর্ডের নির্দেশ মতো, কৃষককে কর প্রদান ছাড়াও বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিতে বাধ্য ছিল। কর্ডি বলা হতো মূলত বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দেওয়ার রীতিকে, খাল কাটা, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, পুল নির্মাণ, সাঁকো তৈরি, ফসল লাগানো ও কাটা, ভূমি চাষাবাদ, শিকার ধরা প্রভৃতি কাজগুলো সামন্ত প্রভুরা কর্তির মাধ্যমে করত। এসব কাজগুলো করতে গিয়ে কৃষকরা মাঝে মাঝেই তাদের নিজের জমিতে সঠিক সময়ে বীজ বপন করত এবং ফসল কাটতে ব্যর্থ হতো, এমনকি শিকার সংগ্রহের সময় শিকারটিকে ধাওয়া করলে কৃষকদের ফসলের যে ক্ষতি হতো তাতেও তাদের বলার কিছু থাকত না । উভয় প্রক্রিয়ায় কৃষকের যে ক্ষতি হতো তাতে মাঝে মাঝেই খাজনা প্রদানসহ অন্যান্য পাওনা ঠিকমতো পরিশোধ করতে ব্যর্থ হতো।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]