ভারতীয় ও ইউরোপীয় সামন্তবাদের তুলনামূলক আলোচনা ও পার্থক্য Difference and Comparison between Indian and European Feudalism

ভারতীয় সামন্তবাদ Indian Feudalism

সামন্তবাদ হলো ভূমি বা কৃষিকেন্দ্রিক এক আর্থ-সামাজিক প্রথা। ইউরোপীয় সমাজে খ্রিষ্টীয় নবম শতকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত সামন্ত প্রথার সবল উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। প্রাচ্য সমাজ বলতে সাধারণভাবে পূর্বে অবস্থিত দেশ বা সমাজগুলোে বোঝায়। তবে এক্ষেত্রে গ্রাচ্য প্রত্যয়টি ব্যাখ্যায় Karl wittfogel এর দৃষ্টিভঙ্গি প্রণিধানযোগ্য। উইট ফোগেল প্রাচ্য সমাজ বলতে জলসেচ নির্ভর সমাজ বা সভ্যতাগুলোকে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে নীল, টাইগ্রীস, ইউফেটিস সিন্ধু, হোয়াংহো উপকূল ইত্যাদি অঞ্চলে গড়ে ওঠা সমাজ বা সভ্যতাগুলো প্রাচ্য (Oriental) সমাজ। তিনি জলসেচ নির্ভর অর্থনীতির অনুপস্থিতির জন্য আপন গ্রাচ্যের সমাজ বহির্ভূত মনে করেন। প্রাচীন ভারতীয় সমাজকে প্রাচ্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মূলত আমরা আমাদের আলোচনায় প্রাচ্য সামন্তবাদ বলতে ভারতীয় সামন্তবাদকেই বুঝাব।
প্রফেসর ড. নাজমুল করিম দুটি শর্তে সর্বভারতীয় সমাজকে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ বলে বিবেচনা করেছেন। যথা-
১. সামন্ত প্রথা বলতে যদি এমন একটি সমাজ ও সাংস্কৃতিকে বুঝায় যেখানে ভূমিস্বত্বই হচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক
ক্ষমতার ভিত্তি তাহলে সামগ্রথা শুধু পাশ্চাত্যেই ছিল এমনটি বলার কোনো কারণ নেই। ভারতেও ঐ অর্থে সামন্তপ্রথা ছিল। ২. পাশ্চাত্য সামন্ত প্রথার সব বৈশিষ্ট্যই ভারতীয় সমাজের জন্য প্রযোজ্য হতে হবে এমনটি ভাবাও ঠিক নয়। এই বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য মনে রেখেই শুধু ভারতীয় সমাজে সামন্তবাদ প্রথার প্রকৃতি খুঁজতে হবে। এ প্রসঙ্গে নাজমুল করিম যথার্থই বলেছেন, “If we take feudalism to mean a type of culture and society where and holding is the basis of political and economic power. I see no reason, why the term feudalism be applied to european condition only. However, it must be admitted that we should not except the presence of all the features of european feudalism when we apply this ferm, to Indian conditons."
১৭০৭ সালে প্রবল পরাক্রান্ত মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যু হলে শক্তিশালী কেন্দ্রবিশিষ্ট মুঘল প্রশাসন শক্তিহীন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় রাজস্ব সংগ্রাহক সুবেদারগণ তাঁদের অবস্থা মজবুত করতে শুরু করে এবং এখতিয়ারাধীন অঞ্চলকে অনেকটা নিজের রাজ্য বলে বিবেচনা করতে আরম্ভ করে। যেমন— বাংলার সুবেদার মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার জমিদারি প্রথা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭২২ সালে তিনি সমগ্র বাংলাদেশকে ১৩টি পরগনায় বিভক্ত করেন এবং ২৫ জন জমিদার ও ১৩ জন জায়গিরদার নিযুক্ত করেন। মুর্শিদকুলী খাঁ-এর এরূপ ভূমির বিন্যাস বাংলার জমিদারি ব্যবস্থার ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন যে, এ ভূমি ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করেই। পরবর্তী যুগে ব্রিটিশ শাসকরা সামন্তবাদী কায়দায় ভারতীয় ভূমি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। হিন্দু, বৌদ্ধ বা মুসলিম শাসনামলে তথা প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতীয় সমাজে ভূমিতে কোনো মালিক শ্রেণির অস্তিত্বই দেখা যায়নি। বস্তুত ভারতীয় সামন্ত প্রথার ভূমির ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। সম্পত্তির ধারণা ছিল পাশ্চাত্য সামন্তপ্রথা থেকে আলাদা ।
এ প্রসঙ্গে ভারতীয় সমাজ বিজ্ঞানী এ. আর. দেশাই (A.R. Desai) তাঁর Social Background of Indian Nationalism গ্রন্থে বলেন, “Indian feudalism is distinguished from European feudalism by the striking feature that no class of landed fedalnobility with property rights over land existed under it."
ভারতীয় সামন্ততন্ত্রে মধ্যবর্তী যে শ্রেণিটির অস্তিত্ব ছিল তার নিয়োগ পদ্ধতি ও ভূমিকা, স্থান ও কালভেদে যত ভিন্নই হোক তারা কখনই জমির মালিক ছিল না। খাজনা আদায়কারী শ্রেণি ছিল তারা। বিনিময়ে একটা কমিশন লাভ করতেন। ভারতীয় সমাজে তিন ভাবে খাজনা আদায় করা হতো। যথা- ক. খালিশা জমি, ২. ইজারাদারি জমি ও ৩. জায়গির জমি। প্রাক ব্রিটিশ ভারতে খাজনা আদায়ের ক্ষমতাকেই মূলত ভূমি বন্দোবস্ত বলা হতো। এ সমাজে জমিদার বলে কথিত শ্রেণি ভূস্বামী বা জমির মালিক ছিলেন না। সরকারের রাজস্ব আদায়ের তারা এজেন্ট ছিলেন। খাজনা আদায়কারী এই জমিদার শ্রেণির মাধ্যমে খাজনা সংগ্রহ করা হতো। আবার বিকল্প উপায়েও খাজনা আদায় করা যেত। যেমন-
১. প্রভাবশালী রাজারা নিজ এলাকায় খাজনা সরকারকে দিত।
২. সরকার কর্মচারীদের বেতনের বিনিময়ে কোনো এলাকা থেকে খাজনা আদায় করে নিতেন।
৩. কর্মচারীদের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে কৃষক থেকে খাজনা আদায় করত।
ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অভাব থাকায় ভারতীয় সামস্ত সমাজে তথাকথিত জমিদার শ্রেণি ইজারাদার, ওয়াদ্দারাইজেশন তারা কোনো উৎপাদন ব্যবস্থার কথা ভাবেন নি। তারা শুধু খাজনা আদায় নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। এমন ব্যবস্থাকে External Coercion বা বহিশোষণ বলা হয়। তাই আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব হয় নাই। তাই ভারতীয় সমাজ পুঁজিবাদের জন্ম দিতে পারেনি। তাই নাজমুল করিম বলেন, "European Feudalism Gave Birth to capitalism, while Indian Feudalism of its own accord failed to do so. " ভারতীয় সমাজে যেমন রাজা ও জমিদার ভূমির মালিক নয়, তেমনি কৃষকগণও ব্যক্তিগত পর্যায়ে পুঁজিবাদী সমাজে জমির মালিক নয়। তাই এখানে কোনো ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জন পরিলক্ষিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে এ. আর. দেশাই আবারও বলেছেন, "On the other hand, there did not exist individual peasant proprietorship over land either. This means that there did not exist in pre British-India any form of private ownership of land." ভারতীয় সামন্ত কাঠামোতে নাজমুল করিম তিনটি শ্রেণির কথা উল্লেখ করেছেন। যথা- ১. কৃষক শ্রেণি । গ্রাম সম্প্রদায়ে যারা সংগঠিত ছিল।
খাজনা আদায়কারী শ্রেণি : জমিদার বলে যারা কথিত ছিল ও
৩. যার প্রতিনিধি ছিলেন রাজাই ।
ভারতীয় সামন্ত প্রথার মৌলিক ভিত্তি হলো তিনটি। যথা- ১. স্বনির্ভর গ্রাম সম্প্রদায়;
২. যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ও
৩. বর্ণাশ্রম প্রথা ।
স্বনির্ভর গ্রাম সম্প্রদায়গুলো গ্রাম কমিটি দ্বারা পরিচালিত হতো। গ্রাম কমিটি অথবা স্থানীয় খাজনা আদায়কারীকে খাজনা দেওয়ার বিনিময়ে গ্রাম সম্প্রদায়ের মানুষ বংশ পরম্পরায় ভূমি চাষ করতে পরত। ভারতীয় সমাজে নানা পেশায় নিযুক্ত বিভিন্ন জাতি বর্ণের লোক গ্রামীণ অর্থনীতিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। ভারতীয় সমাজ কাঠামোয় মৌল কাঠামোর উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। উৎপাদন সম্পর্কেও তেমন কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না। তাই সমাজের উপরি কাঠামোর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। পরিশেষে বলা যায়, বিবিধ কারণে সামন্ত প্রথা এক অনন্য বৈশিষ্ট্যতা লাভ করেছে।
ভারতীয় ও ইউরোপীয় সামন্তবাদের তুলনামূলক আলোচনা ও পার্থক্য Difference and Comparison between Indian and European Feudalism
ভারতে (প্রাচ্যে) এক বিশেষ ধরনের সামন্ত প্রথার উদ্ভব ঘটলেও তা যখন পূর্ণ সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি হিসেবে বিকশিত হয়নি। অর্থাৎ ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্র যে বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল, ভারতীয় সামন্ততন্ত্রে তা পুরোপুরি পরিলক্ষিত হয়নি । বরং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় ও ইউরোপীয় (প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য) সামন্তবাদের মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যায়, যা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. ভূমি মালিকানা : সামন্ততন্ত্রের মূল উপকরণ হলো ভূমি। ভারতীয় সামন্ত প্রথার ভূমিতে ব্যক্তিগত কোনো মালিকানা ছিল না, বলে কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, এ. আর. দেশাই, কার্ল উইট ফোগেল, নাজমূল করিম, ম্যাক্সওয়েবার ফ্যান্সিস প্রমুখ পণ্ডিতগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অপরদিকে পাশ্চাত্যের ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার উপস্থিতি ছিল। তাত্ত্বিকভাবে রাজা সকল ভূ-সম্পত্তির মালিক হলেও বাস্তবে প্রত্যেক সামন্ত প্রভু নিজ নিজ এলাকায় ছিলেন স্বাধীন এবং তার ইচ্ছে মতো ভূমি নিয়ন্ত্রণ ও হস্তান্তর করতেন।
২. ভূমি দাস : ভারতীয় সামস্তপ্রথায় ভূমিদাস প্রথার কৃষককুল পাশ্চাত্যের তুলনায় স্বাধীন ছিল। ভূমির সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ততা ছিল না। এরা ভূমি হস্তান্তরের সঙ্গে ভূমি দাস হিসেবে অন্য ভূ-স্বামীর অধীনে কাজ করতে যায়নি। ভারতীয় কৃষকেরা স্থানীয় পঞ্চায়েত, ইজারাদার ইত্যাদিকে খাজনা দিয়ে বংশ পরম্পরায় জমি ভোগ দখল করত মাত্র। অর্থাৎ পাশ্চাত্যের ন্যায় এরা ভূমিদাস ছিল না।
৩. অভিজাত শ্রেণি : ভারতীয় সামন্তবাদে অভিজাত শ্রেণির মর্যাদা ছিল ক্ষণস্থায়ী এবং তারা বংশগতভাবে সমাজ স্বীকৃত ছিল না। কারণ এখানে পদ মর্যাদা এবং ভূমি বা রাজস্ব আদায়ের কর্তৃত্ব সাধারণত অস্থায়ী ভিত্তিতে কোনো বিশেষ দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে প্রদান করা হতো। এ সকল অভিজাতরা মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছামত দায়িত্ব পালন করতেন। মন্ত্রী, উজির, নাজির, জায়গিরদার, জমিদার, সেনাপতি প্রভৃতি ক্ষমতা বলে মানুষেরা ছিলেন অভিজাত শ্রেণিভুক্ত। অপরদিকে ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রে অভিজাত শ্রেণির মর্যাদা ছিল স্থায়ী এবং বংশগত। তাদের আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের অধিকার ছিল। ইউরোপীয় অভিজাত বলতে সামন্ত প্রভুদেরকে বোঝায় ।
৪. বণিক শ্রেণি : ভারতীয় বণিকরা অনেকটা ব্যক্তিগতভাবে বাণিজ্য পরিচালনা করত। তারা গিল্ডের ন্যায় কোনো বাণিজ্যিক
সংগঠন গড়ে তোলেনি। ব্যবসায়ী শ্রেণি সচ্ছল জীবন যাপন করলেও ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্যকে তেমন একটা সম্মানের
চোখে দেখা হতো না। অপরদিকে ইউরোপে ব্যবসা-বাণিজ্য ভারতের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব লাভ করেছিল। বণিক শ্রেণি প্রথম দিকে সামন্ত প্রভুদের দ্বারা করভারে জর্জরিত হলেও ধীরে ধীরে তারা তা থেকে মুক্তি পেতে ইউরোপীয় সামস্তপ্রথা বণিক শ্রেণি ব্যবসায়িক সুবিধার্থে গিল্ড (Guild) বা বাণিজ্য সংগঠন গড়ে তোলে এবং বণিক শ্রেণি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণিতে পরিণত হয় ।
৫. কৃষক শ্রেণি : ভারতীয় সামন্ত প্রথায় কৃষক শ্রেণি ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক স্বাধীন। তারা ছিল না পরাধীন উৎপাদক বা ভূমিদাস। গ্রাম পঞ্চায়েতকে সামান্য খাজনা দিয়ে বংশ পরম্পরায় তারা ভূমি ভোগ দখল রাখতে পারত। অন্যদিকে, ইউরোপীয় সামন্ত প্রথায় কৃষক ছিল লর্ড বা ভূ-স্বামীর অধীনে। তারা ভূ-স্বামীরা বিনা অনুমতিতে তার ভূমি বা বাগান বা ম্যানর ছেড়ে যেতে পারত না। কাজেই বলা যায়, ইউরোপীয় কৃষক ছিল পরাধীন উৎপাদক এবং ভূমিদাস ।
৬. সামাজিক শ্রেণি : ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের প্রধান শ্রেণিগুলো হলো রাজা বা সম্রাট, উচ্চতর সামরিক ও বেসামরিক কর্তা ব্যক্তিবর্গ, খাজনা আদায়কারী এবং কৃষককুল। অপরপক্ষে পাশ্চাত্য সামন্ততন্ত্রে ভূমিভিত্তিক বেশ কয়েকটি উঁচু-নিচু শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছিল। ইউরোপে গড়ে ওঠা প্রধান, সামাজিক শ্রেণিগুলো হলো রাজা, চার্চ, লর্ড, ডিউক, কাউন্ট, ভিস কাউন্ট, জারণ, নাইট, সার্ফ ইত্যাদি। আরও উল্লেখ্য যে, ভারতীয় সামন্ত প্রথার তিনটি শ্রেণি লক্ষণীয় ছিল। যথা—
ক. কৃষক শ্রেণি : গ্রাম সম্প্রদায়ে যারা সংগঠিত ছিল।
খ. খাজনা আদায়কারী শ্রেণি : যারা কথিত জমিদার বলে খ্যাত ছিলেন ও
গ. রাষ্ট্র : যার প্রতিনিধি ছিল রাজা।
অপরদিকে পাশ্চাত্য সামন্তবাদও ৩টি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা—
ক. অভিজাত শ্রেণি : এ শ্রেণিভুক্ত ছিলেন সামন্ত প্রভুরা। রাজা থেকে শুরু করে নাইট পর্যন্ত বিস্তৃত সকল সামন্ত প্রভুই ছিল একটি বিশেষ শ্রেণিভুক্ত।
খ. যাজক শ্রেণি : ধৰ্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা এবং গির্জায় অধীনস্ত সম্পত্তিগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল যাজকদের উপর ।
গ. তৃতীয় শ্রেণি : সমাজের কৃষক, শ্রমিক, বণিক এবং দাসগণই সমাজের তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। ভূমিহীন কৃষকদেরকে বলা হতো সার্ফ বা ভূমিদাস ।
৭. সেচ ব্যবস্থা : প্রাচ্যের বা ভারতীয় ভূমি ব্যবস্থা এমন ছিল যে, ভূমি থেকে কৃষি উৎপাদন পেতে সেচ ব্যবস্থা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন ছিল। এ বিশাল কর্মযজ্ঞটি কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করত। ফলে ভূমিতে কেন্দ্রীয় সরকারেরই প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পক্ষান্তরে, ভৌগোলিক আনুকূল্যের কারণে ইউরোপীয় ভূমিতে প্রাচ্যের মতো বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ ব্যবস্থার তেমন একটা প্রয়োজন পড়ত না। যতটুকু প্রয়োজন ছিল তা স্থানীয়ভাবে সামন্ত প্রভুরাই করতে সক্ষম ছিল। ফলে স্বেচ্ছাচারী কোনো কেন্দ্রীয় শাসকের আগমন ঘটেনি ।
৮. সামন্ত চুক্তি : ভারতীয় সামন্ত প্রথায় 'সেবা ও রক্ষার' ভিত্তিতে কোনো সামন্ত চুক্তি সম্পাদিত হয়নি। এতে জনসাধারণ তুলনামূলকভাবে স্বাধীন থাকতে পেরেছে। আবার এও সত্য, ইউরোপের রাজার ন্যায় ভারতীয় রাজাকে দায়-দায়িত্ব বা জনগণকে রক্ষার আনুষ্ঠানিক চুক্তির আওতায় আবদ্ধ হতে হয়নি। ফলশ্রুতিতে ভারতীয় রাজা বা সম্রাট হতে পেরেছিলেন স্বৈরাচারী ও চরম ক্ষমতাধর। অপরদিকে পাশ্চাত্য সামন্ত প্রথায় লর্ড ও ভ্যাসালের মধ্যে 'সেবা ও রক্ষার' ভিত্তিতে কতগুলো দায়িত্ব কর্তব্য সম্বলিত সামন্ত চুক্তি সম্পাদিত হয়। এটা রাজাকে স্বৈরাচারী হওয়া থেকে বহুলাংশে বিরত রাখে ।
নগরের প্রকৃতি : ভারতীয় সামন্ততন্ত্রে বিকশিত নগরগুলো মূলত ছিল প্রশাসনিক ও সামরিক প্রকৃতির। অপরদিকে, ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের এক পর্যায়ে এসে নগর মূলত গড়ে উঠেছিল আর্থ-বাণিজ্যিক বিষয়াদিকে কেন্দ্র করেই। মানির ব্যবস্থা : ভারতীয় সামস্তপ্রথায় সামন্ত প্রভুরা বিশালায়তনের কোনো স্বনির্ভর খামার বা ম্যানর গড়ে তোলেনি। অপরদিকে ইউরোপীয় সামভতরে সামস্ত প্রভুরা তাদের নিয়াণাধীনে বিশাল এলাকা নিয়ে স্বনির্ভর উৎপাদন ইউনিট গড়ে তুলেছিল। একেই বলা হয় ম্যানর ব্যবস্থা।
উৎপাদন পদ্ধতি : ভারতীয় সামন্ততন্ত্রে উৎপাদন পদ্ধতি পুরোপুরি সামস্ত উৎপাদন কৌশল রূপে বিকশিত হয়নি বা বাস্তব কিছু কারণেই সেটি হতে পারেনি। অন্যদিকে পাশ্চাত্য সামন্ত প্রথায় উৎপাদন পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে সামন্তবাদী উৎপাদন কৌশলের রূপ পরিগ্রহ করে ।
১২. কৃষি ও শিল্পের বন্ধন : ভারতীয় সামন্ততন্ত্রে কৃষি থেকে শিল্পের বিচ্ছিন্নতা লক্ষ করা যায় না। দেখা যায় একই ব্যক্তি বা পরিবার যুগপৎ কৃষি কাজে ও কুটির শিল্পের সাথে যুক্ত। অপরদিকে, ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের এক পর্যায়ে এসে কৃষি থেকে শিল্প বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে কৃষি বহির্ভূত শিল্প শ্রমিক বা শিল্প উৎপাদক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে।
১৩. বর্ণাশ্রম প্রথা : ভারতীয় সামন্তবাদের আরেকটি মৌলিক দিক ছিল বর্ণাশ্রম প্রথা। হিন্দু সমাজের ধর্মীয় জাতপাত এবং জন্মভিত্তিক মর্যাদা ও পেশাকে কেন্দ্র করে (Closed) প্রকৃতির এ প্রথাটি গড়ে ওঠে। অপরদিকে ইউরোপীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজে জাত ধর্মের ভিত্তিতে এরূপ কোনো প্রথা গড়ে ওঠেনি। ইউরোপের গিল্ড, হেনসিয়াটিক লীগ প্রভৃতি আর্থ-বাণিজ্যিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল।
১৪. স্বনির্ভর গ্রাম সম্প্রদায় : ভারতীয় সামন্ত প্রথার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হলো স্বনির্ভর গ্রাম সম্প্রদায়। বলা যায় স্বয়ং সম্পূর্ণ পল্লি সমাজ ছিল। প্রাক ব্রিটিশ ভারতীয় সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য। অস্থায়ী সকল কিছুর মধ্যে উক্ত গ্রাম সম্প্রদায় ছিল দীর্ঘস্থায়ী। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এরূপ কোনো স্বনির্ভর গ্রাম সম্প্রদায় সামন্তবাদী উৎপাদন কৌশলের আওতায় গড়ে ওঠেনি ।
১৫. শোষণের প্রকৃতি : প্রাচ্য বা ভারতীয় সামন্ত সমাজে শাসক ও শোষক প্রায় সর্বদাই বিদেশি হওয়ায় উৎপাদন ব্যবস্থা বহিঃশোষণের রূপ পরিগ্রহ করে। অপরপক্ষে, ইউরোপীয় সামন্ত সমাজে শাসক ও শোষক ছিল স্বদেশি। কাজেই উৎপাদন ব্যবস্থা আন্তঃশোষণের রূপ নেয়।
১৬. ধর্ম যাজক বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান : ভারতে মৌলভী, মাওলানা, পুরোহিত প্রভৃতি ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা বিশেষ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্মান পেলেও তারা তেমন কোনো অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক প্রতিপত্তি লাভ করেনি। অপরদিকে ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রে ধর্মযাজক তথা চার্চ ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি ব্যাপক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করেছিল। চার্চ বা গির্জা পরিণত হয়েছিল সেরা ভূ-স্বামীতে। অনেক সময় চার্চ বনাম রাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতো এবং চার্চের ক্ষমতার কাছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ পরাজিত হতো।
১৭. পুঁজিবাদের বিকাশ : ভারতীয় ও ইউরোপীয় সামন্তবাদের মধ্যকার পার্থক্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ইউরোপীয় সামস্তপ্রথা ক্রমবিকাশের এক পর্যায়ে এসে ধনতন্ত্র প্রথা পুঁজিবাদের জন্ম দেয়। ব্যক্তিগত পুঁজিগঠন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বণিক পুঁজির সৃষ্টি, শিল্প পুঁজির বিকাশ বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি অগ্রগতি প্রভৃতি সামন্ততন্ত্রের গর্ভ হতে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটায়। কিন্তু ভারতের সামন্তপ্রথা পুঁজিবাদের উন্মেষ সাধনে ব্যর্থ হয়। তাই নাজমূল করিম এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "European Feudalism gave birth to capitalism, while Indian feudalism of its own accord failed to do so." পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতীয় ও ইউরোপীয় সামন্তপ্রথায় যদিও ভূমিই ছিল উৎপাদনের মূল উপকরণ (Means of Production) এবং কৃষিই ছিল আর্থ-সামাজিক ভিত্তি, তথাপিও এ দুটি সামন্ত ব্যবস্থার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান বা মৌলিক পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছিল।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]