১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দকে মধ্যযুগের অবসানের সময়কাল হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়। মধ্যযুগের সামন্তবাদের পতন মূলত কতগুলো সুনির্দিষ্ট কারণের প্রেক্ষিতে ঘটে। সামন্তবাদের পতনের জন্য দায়ী কারণগুলো নিচে আলোচনা করা হলো-
১. সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় : সামন্ত প্রথার অবক্ষয় কালের পরিক্রমায় উৎপাদন ব্যবস্থায় নতুন উপাদান যুক্ত হয়। সামন্তযুগে বিদ্যমান বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণির পারস্পরিক বিরোধিতা ও অবক্ষয় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং তৎকালীন যুগের অর্থনৈতিক শ্রেণির বিরোধ সামন্তযুগের সামাজিক বিকাশকে অবরুদ্ধ করে। সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় ও মধ্যযুগের পতন অনেকটা একই সূত্রে গাঁথা।
২. নগরের বিকাশ : ইউরোপের নগরসমূহ ব্যবসা-বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক ও সংগঠন, জনসংখ্যার আধিক্য, মুদ্রা ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা, গিল্ড প্রথা, টাউন, কাউন্সিল, কমিউন গঠন, ক্রুসেড প্রভৃতি কারণে মধ্যযুগে ইউরোপে নগরের বিকাশ ঘটে যার ফলে মধ্যযুগের পতন হয়।
৩. স্বাধীন শ্রমদানের সুযোগ : এখানে বহু সার্ফ সামন্তদের এস্টেট ছেড়ে স্বাধীন শ্রমিকের জীবন গ্রহণ করে। অর্থাৎ না পারিশ্রমিকের বদলে স্বাধীনভাবে শ্রমদান করার সুযোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে। যথা- শ্রমিকের অভাবে সামন্তগণ তাদের
কার্যসম্পাদন করতে পারত না। এভাবেই মূলত সামন্তবাদের পতন ঘটে।
৪. অভিজাতদের হঠকারিতা ও স্বেচ্ছাচারিতা : সামস্ত প্রথার ঘোর বিরোধী ছিল জনগণ। তারা অভিজাতদের হঠকারিতা এবং স্বেচ্ছাচারিতা পছন্দ করতেন না। সাধারণ মানুষ এবং লর্ডের মধ্যে বৈষম্য তাদের পরস্পরের প্রতি ঘৃণা ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছিল। এই বিভেদ শেষ পর্যন্ত ফরাসি বিপ্লবে শেষ হয়ে গিয়েছিল।
৫. যুদ্ধ পদ্ধতির পরিবর্তন : গোলাবারুদের আবিষ্কার ও যুদ্ধ পদ্ধতির পরিবর্তন এবং এর প্রস্তুতকারকদের উপর রাজার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রাজাকে সামন্তদের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী করে তোলে। এরই ফলশ্রুতিতে সামন্ততন্ত্র ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে।
ভূমিদাসদের স্বাধীনতা লাভ : ইউরোপে ভূমিকে কেন্দ্র করে যে সামন্ত প্রথা গড়ে উঠে তাতে দুটি শ্রেণির সৃষ্টি হয়। একটি হলো সামন্ত প্রভু অপরটি হলো ভূমিদাস। সামস্তপ্রভুদের হাতের পুতুল ছিল ভূমিদাসরা। তাদের কোনো স্বাধীনসত্তা ছিল । ভূমিদাসরা সামস্তদের পতনের ফলে স্বাধীন জীবন যাপনের সুযোগ পায়। তারা স্বাধীন জীবন লাভে সৃষ্টি করে নতুন এম ব্যবসা। যার ফলে মধ্যযুগের অবসান ত্বরান্বিত হয়।
বার্গার শ্রেণির ভূমিকা : সামন্ত যুগের শেষের দিকে শহরগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের সাথে সাথে নতুন শ্রেণির উদয় হতে থাকে। এরা হলো ধনী বণিক, ব্যাংকার, সুদখোর মহাজন প্রমুখ। এদেরকে বলা হতো বার্গার। সম্পদশালী এরা। এদের সম্পদের মূল উৎস ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। এ বার্গার শ্রেণির ভূমিকা মধ্য যুগের অবসানের জন্য ছিল। রেনেসাঁর প্রভাব রেনেসাঁ ছিল সমাজ ও সভ্যতার প্রভাবে, মধ্যযুগের পরিবর্তনের জন্য অন্যতম স্রোতধারা। ইউরোপীয় সমাজ কাঠামোতে পনেরো শতকের শেষভাগে যে নতুন আদিকের সৃষ্টি হয় তার পিছনে ছিল রেনেসাঁ। ইউরোপীয় এ পরিবর্তনের ধারা সূচনা করে একটি নতুন যুগের। রেনেসাঁর প্রভাবে সমাজের মানুষের মানসপটে যে নতুন চিন্তাধারার সৃষ্টি হয় তাই পরবর্তীতে জন্ম দেয় একটি নতুন সমাজের। এ কারণেই মধ্যযুগের অবসান হয়।
ভৌগোলিক আবিষ্কার : রেনেসাঁ যুগের জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য মুক্তচিন্তা, দর্শন এবং তীব্র জ্ঞান পিপাসা মানুষের মধ্যে অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা ও অজেয়কে জয় করার ব্যাপক উদ্দীপনা জাগ্রত করে। মূলত এরূপ উদ্দীপনা থেকেই ভৌগোলিক আবিষ্কারের সূত্র এবং একারণেই উত্তমাশা, আমেরিকা, অস্তরীপ, ভারতবর্ষ এবং আরও অনেক দ্বীপ আবিষ্কৃত হয়। মানুষের বাণিজ্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিধিকে এসব ভৌগোলিক আবিষ্কার বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়, যা মানুষকে মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে আধুনিক যুগে প্রবেশের পথ প্রশস্ত করে।
১০. ছাপাখানার আবিষ্কার : ছাপাখানার আবিষ্কার হলো মধ্যযুগের একটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের
পরিসর বৃদ্ধি পায় ছাপাখানা আবিষ্কারের সাথে সাথে। ফলশ্রুতিতে ভবিষ্যৎ বংশধররা মধ্যযুগকে উন্নীত করার কাজে আত্মনিয়োগ করে । এর ফলেই মধ্যযুগের অবসান ঘটে।
11. স্কলাস্টিক দর্শনের বিলুপ্তি : স্কলাস্টিক দর্শন ছিল। মধ্যযুগে জ্ঞান চর্চার বিকাশে অন্যতম প্রতিবন্ধক। বাস্তব পর্যবেক্ষণ জ্ঞান লাভের একটা উপায় তা স্কলাস্টিক দার্শনিকেরা কখনই মনে করতেন না। মধ্যযুগের শেষের দিকে স্কলাস্টিক দর্শনের বিরুদ্ধে নানা প্রকার চিন্তার উদয় হয়।
১২. পুঁজিবাদের উদ্ভব : মধ্যযুগে ব্যক্তিগত মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে তখনই, যখন মানুষের উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। আর ব্যক্তিগত বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে পুঁজিবাদের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে পুঁজিবাদ বিকাশের ফলে, ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন জাতির মধ্যে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা সম্পর্কিত মিথষ্ক্রিয়াসম্পন্ন হয় যা মধ্যযুগের অবসানকে ত্বরান্বিত করে। এছাড়া পুঁজিবাদের ফলে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের জন্মও মধ্যযুগের অবসানকে ত্বরান্বিত করে। ১৩. জাতীয়তাবাদের উন্মেষ : ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে মধ্যযুগে ব্যবসায়ী শ্রেণি একদিকে যেমন উপকৃত হয়, অন্যদিকে তেমনি লুটেরা, ডাকাত এবং হরেক রকমের ট্যাক্সের বোঝায় তাদের জীবন, সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। এরূপ প্রতিকূল অবস্থায় ব্যবসায়ীরা পতিত হয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়। এর ফলে খণ্ড খণ্ড জমিদারি এলাকার ব্যবসায়িরা অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করে এক রাষ্ট্র, এক নিয়ম, একই মুদ্রা এবং একই জাতীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রচলন ঘটাতে সচেষ্ট হয়। ব্যবসায়ীদের মধ্যে এ জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষও শেষ পর্যন্ত মধ্যযুগের অবসান ঘটাতে সাহায্য করে।
১৪. কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন : তুর্কিদের হাতে ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন ইউরোপে নব জাগরণের পথ উন্মুক্ত করে। ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দের এ ঘটনা এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আধুনিক যুগ গণনা করা হয়। কনস্ট্যান্টিনোপল যখন মুসলমানদের অধিকারে চলে যায়, তখন অনেকে ইউরোপ ত্যাগ করে ইতালিতে আশ্রয় গ্রহণ করে। তারা অবশেষে আত্মনিয়োগ করে সেখানে গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা শিক্ষার প্রসার এবং তাদের সংস্পর্শে এসে ইউরোপীয়রা নতুন ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়। এসব পণ্ডিত তাদের ধ্যান-ধারণার মানব মুক্তির পথ নির্দেশ করেন। ফলে ইউরোপে ব্যক্তি চেতনায় উন্মেষ ঘটে, যা মধ্যযুগের অবসান ঘটাতে সাহায্য করে।
১৫. ক্রুসেড। ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সারা ইউরোপকে আলোড়িত করেছি। বহু
এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। এ যুদ্ধে অভিজাতগণ প্রচুর অর্থ দান করেছিলেন। প্রয়োজনে তাঁরা সাজ দিতে এস্টেট বিক্রয় করতেও সুন্ঠাবোধ করেননি। এভাবে শারীরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বহু অভিজ্ঞাত দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই সুযোগে ধনবানরা বা রাজা, তাদের এস্টেট জয় করে নেয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে তাদের পতন হয়।
১৬. গণ্ডিত ব্যক্তিদের অবদান। পণ্ডিত ব্যক্তি ও জ্ঞানী-গুণিদের অবদান মধ্যযুগের ইতিহাসকে অংকৃত করছে। 'গ্যালিলিও, ভেসালিয়াস, হার্ভে, পেত্রাক ও গোপকাচিত্রের সাহিত্য, রাফায়েল, লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি ও মাইকেল শিল্পকথা এবং কোপার্নিকাস প্রমুখ ব্যক্তির আবিষ্কৃত নতুন বিজ্ঞান ইউরোপকে নতুন পদের দিক নির্দে ইউরোপের সমাজজীবন হয় নতুন সূর্যের আলোকে উদ্ভাসিত। ইউরোপের বুকে আধুনিক সমাজের সোনালী স্বপ্ন-শিoy গেড়ে বসে, এভাবেই পতন হয় মধ্যযুগের।
পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগের অবসানে সামন্তবাদের পতনের মধ্যদিয়ে অন্ধত্ব, কুসংস্কার কূপমণ্ডুকতা ও সা এক জগদ্দল পাথর মানব জাতির উপর থেকে সরে গিয়ে পৃথিবীর আধুনিক যুগের নতুন আলোক রশ্মিতে উদ্ভাসিত হয়ে ব
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত