মধ্যযুগে ইউরোপের সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সামন্তবাদ ও ম্যানর প্রথাকে কেন্দ্র করে। ইউরোপের ন্যায় ভারতেও বিশেষ ধরনের সামন্ত ও ভূমিদাস ছিল। ফলে একে কেন্দ্র করেই গিল্ড ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। মূলত ভারতবর্ষে গিল্ডের বি কাস্ট (Caste) গড়ে উঠেছিল। নিম্নে ইউরোপীয় ও ভারতীয় গিল্ডের তুলনামূলক আলোচনা করা হলো-
১. রাজকীয় আধিপত্য : প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সমাজে যে রাজকীয় আধিপত্য বিদ্যমান ছিল তাতে তুলনামূলক পার্থক্য বিদ্যমান। ইউরোপীয় রাজা ছিলেন রাজ্যের সমস্ত সম্পদের মালিক। ফলে তিনি তার অধীনস্ত ভূমি মালিক তৈরি করে তাদের মধ্যে জমি বণ্টন করতেন। কিন্তু প্রাচ্যে তথা ভারতীয় সমাজে রাজ্যের সমস্ত সম্পদ ও জমির মালিক রাজা বা সম্রাট নিজেই ছিলেন। ফলে রাজা তার শ্রেণি তৈরি করলেও জমি বণ্টন করতেন না ।
২. আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি : প্রাচ্য সমাজের রাজকীয় ক্ষমতা ছিল কেন্দ্রীভূত। রাজার হাতেই সমস্ত ক্ষমতা থেকে যেত। তবে তিনি প্রশাসন পরিচালনার জন্য সেনাপতি থেকে শুরু করে বিশেষ আমলা তৈরি করেন। যারা প্রশাসনিক কাজে সম্রাটকে .....সাহায্য করত। অপরদিকে পাশ্চাত্যে ধীরে ধীরে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে। তাছাড়া প্রাচীন রোমে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল। ইউরোপ তথা পাশ্চাত্যে প্রশাসন চালানোর জন্য সম্রাট অধিকমাত্রায় সামন্ত প্রভুদের উপর নির্ভরশীল ছিল। ৩. পুঁজিবাদের প্রসার : ভারতীয় সমাজে জমির উপর কোনো ব্যক্তিমালিকানা ছিল না। যাবতীয় উৎপাদন হতো সম্রাটের নির্দেশে। রাজস্ব দেবার পর অবশিষ্ট ফসল দিয়ে কৃষক জীবন ধারণ করত। ফলে ভারতীয় সমাজে, ইউরোপের ন্যায় পুঁজিবাদ সম্ভব হয়নি। অপরদিকে ইউরোপীয় সমাজে জমিতে ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠা ও উন্মুক্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের ফলে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটা সম্ভব হয়েছিল।
৪. যুদ্ধ বিগ্রহ : ইউরোপীয় সমাজে জমির উপর কর্তৃত্ব ছিল সামন্ত প্রভুদের। ফলে তারা জমি ও ভূমিদাস বাড়াতে প্রতিনিয়ত পরস্পর যুদ্ধ বিগ্রহে জড়াত। কারণ জমি ও ভূমিদাসের মাধ্যমে ইউরোপীয় সমাজে সামন্ত প্রভুদের ক্ষমতা ও মর্যাদা নির্ধারিত হতো। কিন্তু ভারতীয় সমাজে যে গিল্ড ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তা তুলনামূলকভাবে পার্থক্য বিদ্যমান। কিন্তু বাস্তবতা হলো হাজার তুলনা থাকলেও প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যে কোনো সমাজেই কৃষকেরা ভূমিহীন ভূমিচাষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত ... করতে পারেনি। তাদের কোনো সামাজিক মর্যাদাটুকুও দেওয়া হয়নি। অথচ উভয় সমাজে তারাই ছিল উৎপাদিত অর্থের
একমাত্র উৎস ও শক্তি।
ধর্মযাজক ও পুরোহিত সমাজ : ইউরোপে গির্জার অধীনে বহু সম্পত্তি ছিল। এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ধর্মযাকদের হাতে। সমাজে তাদের মর্যাদা অভিজাত শ্রেণির মতোই। ভারতীয় সমাজেও মৌলভী, ইমাম, হিন্দু, পুরোহিতগণ রাজকীয় সম্মানও পেত। রাজার নির্দেশে তারা অনেক সময় জয়গির পেত। ঐ জায়গিরের অর্থ দিয়ে মাদ্রাসা, সমজিদ ও মক্তব পরিচালনা করা হতো এবং তার নিয়ন্ত্রক ছিলেন মাওলানা, মৌলভী বা ধর্মীয় পুরোহিত।
পারস্পরিক নির্ভরশীলতা : পাশ্চাত্য সমাজে মধ্যযুগে সামন্তবাদ ব্যাপক আকারে বিস্তার লাভ করে। সমস্ত কিছুতে সামন্তবাদের ছোঁয়া বিদ্যমান ছিল। রাজা তার অধিকাংশ প্রশাসনিক কাজে সামন্ত প্রভুর উপর নির্ভর করতেন। এমনকি যুদ্ধের সময় সামন্ত প্রভু রাজাকে পরামর্শসহ অর্থ ও সৈন্য দিয়ে সাহায্য করত। কিন্তু ভারতীয় সমাজে সম্রাট নিজেই ছিলেন সর্বেসর্বা। তাই তিনি কোনো জমিদার, জায়গিরদার, কিংবা আমলা শ্রেণির উপর নির্ভরশীল ছিলেন না।
ক্রীতদাস ব্যবস্থা : ভারতীয় এবং ইউরোপীয় উভয় সমাজেই ক্রীতদাস ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। প্রাচ্য সমাজে যে ক্রীতদাস ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তা ছিল বিশেষ ধরনের। অপরদিকে ইউরোপের সামস্ত প্রভুরা দাস রাখতে পারত। সামন্ত প্রভুর বাইরে কারো দ্বারা কোনো উৎপাদন কাজ করানো হতো। ইউরোপে দাস ছিল জীবন্ত হাতিয়ার। অপরদিকে ভারতের দাস শুধুমাত্র গৃহ কাজে ব্যবহার করা হতো। প্রয়োজনে শুধুমাত্র কৃষি কাজ করানো হতো।
৮. বণিক শ্রেণির উদ্ভব : প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় সমাজেই প্রায় কাছাকাছি সময়ে বণিক শ্রেণির উদ্ভব হয়। সামন্তবাদের সময় ইউরোপের কয়েকটি শহরে বণিকগণ গিল্ড প্রথার ব্যবসা করত। ইউরোপীয় বণিকগণ এ গিল্ডের অধীনে কাজ করত। কিন্তু ভারতে এ রকম কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ভারতে ব্যবসা বাণিজ্য ছিল স্বাধীন। অবশেষে বণিক শ্রেণি দ্বারা একটি শ্রেণি গড়ে উঠে। তবে এ বণিক শ্রেণি ভারতে কৃষকের চেয়ে সুখী জীবন-যাপন করত।
৯. ব্যক্তিগত মালিকানাতে সেচ ব্যবস্থা : প্রাচ্য সামন্তপ্রথা তথা জমিদাররা জমির মালিক ছিলেন। তারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জমি ইজারা পেতেন । তারা ছিলেন মূলত রাজস্ব সংগ্রহকারী। ফলে ভারতের সমাজে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর ভৌগোলিক কারণ ছিল। কারণ ভারতে চাষের জন্য জলসেচ ছিল অপরিহার্য যা সম্রাট কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতো। তাই ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অপরদিকে পাশ্চাত্য সমাজে সামন্ত প্রভুদের ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। তার জন্য কোনো ভৌগোলিক বাধা ছিল না।
১০. শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব : ভারতীয় সামন্তবাদ সমাজে একটি শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল। তবে তারা নাম মাত্র স্বাধীন থাকলেও ইউরোপের রায়ত শ্রেণি থেকে মর্যাদায় বেশি ছিল না। তারা জঙ্গিজাত, জায়গিরদের চাকর ও দোকানদার ছিল। তবে ইউরোপে জমিদার শ্রেণির জন্য যে শ্রমিক ছিল তাদের চাষের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি ছিল। কিন্তু ভারতের শ্রমিকদের ন্যূনতম কোনো নিজস্ব জমি ছিল না ।
পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতীয় সমাজে গিল্ডের সদস্যরা নিজ নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে যেতে বংশানুক্রমিক বিধি-নিষেধ ছিল। কিন্তু ইউরোপীয় গিল্ডের সদস্য পদ জাতিবর্ণের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না। একারণেই ইউরোপীয় গিল্ডগুলো স্বায়ত্তশাসন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে আর ভারতীয়রা তা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত