মধ্যযুগে ইউরোপের নগর উদ্ভবের কারণগুলো আলোচনা কর । Discuss the causes of the origin of the cities in medieval Europe.

প্রাচীনকাল থেকে ইউরোপে নগরের বিকাশ ঘটলেও সামন্তবাদের যুগে এসে নগরকেন্দ্রের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। নিম্নে মধ্যযুগে ইউরোপে নগরকেন্দ্রের উদ্ভবের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো- ১. ভৌগোলিক কারণ : মানুষ সুপ্রাচীনকাল থেকেই নদীর তীরবর্তী উর্বর অঞ্চলে জনবসতি গড়ে তোলে। নদী তীর ও জনবসতিপূর্ণ স্থানসমূহে যোগাযোগ সুবিধা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়াজনে নগর গড়ে ওঠার জন্য অত্যন্ত অনুকূল ছিল। ভৌগোলিক সুবিধার জন্য আগে থেকেই এসব স্থানে দুর্গ ও উপসনালয় প্রতিষ্ঠিত ছিল। এছাড়া নদী পারাপারের খেয়া বা সেতুর ব্যবস্থা থাকায় এসব জায়গায় দূর-দূরান্তের মানুষের সমাগম স্বাভাবিক ভাবেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভৌগোলিক কারণে এসব স্থানে নগরকেন্দ্রের উদ্ভব ঘটে।
২. জনসংখ্যা বৃদ্ধি : মধ্যযুগে ইউরোপে নগরের উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আর মধ্য
যুগে ইউরোগে সামস্ত উৎপাদন ব্যবস্থার প্রচলন থাকায় জনজীবনে একটি স্থিতিশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থার এটিও ইউরোপে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কৃষি উৎপাদনে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। কৃষিতে উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হলে দশম থেকে এগারো শতকের দিকে কৃষিতে উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার সৃষ্টি হয়। এ উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা কুটির শিল্প, হস্তশিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি অকৃষিজ পেশায় নিয়োজিত হয়।
৩. ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার : মধ্যযুগে ইউরোপে নগরের উত্থানে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এবং অর্থনৈতিক উন্নতিই ছিল প্রধान কারণ। খ্রিষ্টীয় এগারো শতকে বিভিন্ন শিল্প কারখানায় কিছু কিছু কৃষি উপকরণ তৈরি হওয়া শুরু হলে শ্রমিকের কায়িক কিছুটা কমে যায় ৷
৪. ভূমিদাসদের ভূমিকা : মধ্যযুগে ইউরোপে নগর বিকাশে ভূমিদাসদের অবদান ছিল অপরিসীম। সামন্তবাদের পতনের যুগে ম্যানর প্রথা ও ভূমিদাস প্রথার ভাঙনের ফলে ভূমিদাসরা মুক্তিপণের মাধ্যমে বা নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমদানের বিনিময়ে স্বাধীন মানুষে পরিণত হয় এবং স্বাধীন পেশা বেছে নেয়ার সুযোগ লাভ করে। এছাড়া অনেক ভূমিদাস পালিয়ে নগরে চলে আসে। নগর প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের জন্য আনুষঙ্গিক কাজ সম্পাদিত হয় ভূমিদাসের শ্রমে। এভাবে ভূমিদাসেরা নগর সৃষ্টি ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৫. অর্থনৈতিক কারণ : পৃথিবীর যেখানেই জনবসতি গড়ে ওঠে সেখানেই মানুষের জীবনোপকরণ ও জীবন জীবিকার প্রয়োজনে অর্থনৈতিক লেনদেন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সামন্ত প্রভুরা মধ্যযুগে ইউরোপেও তাদের ভোগ বিলাস দ্রব্য ক্রয় এবং নিজেদের উদ্বৃত্ত কৃষি ফসল বিক্রয়ের জন্য বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলে। উপরন্তু বণিক ও ধনিক ও কারিগর শ্রেণি স্ব স্ব প্রয়োজনে এসব স্থানে শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। ফলে যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার কেন্দ্র হিসেবে ইউরোপের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নগরকেন্দ্রের উদ্ভব হয়।
৬. ক্রুসেডের ভূমিকা : ১০৯৪-১২৯১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সংঘটিত ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধে ধর্মীয় উন্মাদনায় উদ্দীপ্ত হয়ে লর্ড ও সামর প্রভুরা অর্থসংগ্রহের আগ্রহে বিভিন্ন জনপদকে বহু অধিকার সংবলিত সনদ দান করে। তাছাড়া ক্রুসেড গমনের পূর্বে অনেক লর্ড জমিজমা বন্ধক রাখে, যা ক্রুসেড থেকে ফিরে অর্থাভাবে আর ফেরত নিতে পারেনি। এ উভয়বিধ প্রক্রিয়ায় ইউরোপের বহু জনপদ ও নগর মুক্ত হয় ।
৭. মুদ্রা অর্থনীতির প্রচলন : মুদ্রা অর্থনীতি মধ্যযুগে ইউরোপীয় নগর বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। এ সময় ইউরোপের নগরগুলোতে টাকশাল স্থাপিত হয়। মুদ্রার প্রচলনে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ, গতিশীল ও নিরাপদ হয়। মুদ্রা প্রচলনের কিছু দিনের মধ্যে গড়ে ওঠে ব্যাংকিং ব্যবস্থা। ফলে নগরের বিকাশ ও সম্প্রসারণ দ্রুততা লাভ করে ।
৮. সামন্ত প্রভুদের পৃষ্ঠপোষকতা : চাষাবাদের ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সমাজে, ম্যানর নামক এক ধরনের বিশেষ পদ্ধতির প্রবর্তন করে। ম্যানরে উৎপাদিত ফসলের উদ্বৃত্ত ফসল বিক্রয়ের প্রয়োজনে ম্যানরের আশপাশে ছোটখাটো বিপণন কেন্দ্ৰ গড়ে ওঠে। এসব বিপণন কেন্দ্রের উপর সামন্ত প্রভুরা শুল্ক আদায়ের জন্য উৎসাহী হয়ে ওঠে। ফলে তারা এসব স্থানে সরাইখানা, ব্যবসায়িক কেন্দ্র, আবাসিক ভবন, দুর্গ, সুরক্ষিত প্রাচীরবেষ্টিত স্থান ইত্যাদি নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ শুরু করে দেয়। সামন্ত প্রভুদের এরূপ পৃষ্ঠপোষকতায় এসব বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোর দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে এবং অতি অল্পকালের মধ্যেই নগরকেন্দ্রের রূপ পরিগ্রহ করে'।
৯. চার্চ কেন্দ্রিক নগর : মধ্যযুগে ইউরোপে চার্চ বা গির্জাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু নতুন নগর গড়ে ওঠে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর চার্চ অনেক স্থানের শাসনকার্য পরিচালনায় ক্ষমতা প্রাপ্ত হয় এবং বিশপগণ শাসনকার্য পরিচালনা করেন। চার্চকে কেন্দ্র করে ব্যাপক জনসমাগম ঘটে, জননিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়। আর্থ-বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বেগবান হয় এবং নগরের বিকাশ ঘটে।
১০. মঠকেন্দ্রিক নগর : মধ্যযুগে ইউরোপে মঠ বা ক্যাথিড্রালকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বিভিন্ন জনপদ। এসব জনপদে কৃষি ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকলার উৎকর্ষ সাধিত হয় যা নগরের রূপ ধারণ করে। ফরে এসব অঞ্চলে মঠ কেন্দ্রিক নগর গড়ে ওঠে। তবে মঠকেন্দ্রিক নগরগুলো মফস্বল নগরের স্তর অতিক্রম করতে পারেনি। এখানে জনসংখ্যা ছিল স্বল্প এবং বণিকাবৃত্তি গ্রহণকারীর সংখ্যাও ছিল সীমিত। লুক্রেটাস, ভেজিল প্রভৃতি নগর মঠকেন্দ্রিক নগরের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ।
বণিক সংঘ : শিল্পীদের করপোরেশন বা সংঘ প্রথম গড়ে ওঠে ইতালিতে খ্রিষ্টীয় দশম শতকে। এখানে শ্রমবিভাগ যতই বাড়তে থাকে, শিল্প ততই বৃদ্ধি পায়। এক একটি শিল্প ও বৃত্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক একটি গিল্ড। ব্যবসায়িক নিরাপত্তা বিধান, বণিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বন্ধকরণ, ব্যবসায়ে সহায়তা দান, বেকারদের কর্মসংস্থান, ট্যাক্স-শু নির্ধারণে বুঝাপড়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে বণিক সংঘ না গিল্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর ফলে নগরগুলোর দ্রুত বিকাশ ঘটে। পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্য যুগের শহর বা নগর কেন্দ্রের উদ্ভবের পিছনে যতগুলো কারণ রয়েছে সবগুলোই ধর্ম ও অর্থনীতির সাথে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত রয়েছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]