পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আর্থ-সামাজিক বৈষম্যকে ব্যাখ্যা কর

মুখ্য শব্দ পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান, বৈষম্য, শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি, চাকরি।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগোলিক দূরত্ব যেমন অনেক বেশি ছিল, তেমনি আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও ছিল
ব্যাপক বৈষম্য। বৈষম্যের শুরু হয় মাতৃভাষার উপর আঘাতের মধ্য দিয়ে। যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের শতকরা
৫৬ ভাগ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা, সেখানে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার নীলনকশা করা হয়।
এছাড়া বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। বৈষম্যের ক্ষেত্রগুলো নিচে আলোচনা করা হলো:
(০১) সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্য: সামাজিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানে বড় ধরনের বৈষম্য
সৃষ্টি করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের চারটি ভিন্ন ভাষা প্রচলিত ছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে
প্রচলিত ছিল বাংলা ভাষা যা সমগ্র পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মুখের ভাষা। কিন্তু ক্ষমতাসীন পাকিস্তানি
শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়। এটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক
বৈষম্যের অন্যতম উদাহরণ। পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের প্রতিও পশ্চিম পাকিস্তানীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব খুব
ইতিবাচক ছিল না। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা অপমান, অসম্মান ও বৈষম্যের স্বীকার হতো।
(০২) শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য: শিক্ষাক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান চরম বৈষম্যের স্বীকার হয়। একটি বাজেটে শিক্ষা খাতে করাচীর
জন্য ৪০ লক্ষ ১৪ হাজার, সিন্ধুর জন্য ১০ লক্ষ, সীমান্ত প্রদেশে ১১ লক্ষ এবং পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ৭১ হাজার টাকা
বরাদ্ধ দেওয়া হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে উচ্চ শিক্ষার জন্য অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানে
হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বিদেশে পড়ালেখা এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিকদের
যে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের তা দেওয়া হতো না।
(০৩) অর্থনৈতিক বৈষম্য: পাকিস্তানের মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতো কেন্দ্রীয় সরকার। আর কেন্দ্রীয় সরকার ছিলো পশ্চিম
পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে। দেশের সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত ছিল। পাট,
চা, চমড়াজাত দ্রব্য সবকিছু রপ্তানি হতো করাচি বন্দর থেকে। অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে দৃশ্যমান বৈষম্য বিরাজমান
ছিল। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ৬১.৪ শতাংশ রপ্তানী আয়ের বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তানের রপ্তানী
আয় ছিল ৩৮.৬ শতাংশ। কিন্তু মোট জাতীয় বাজেটের ৭৫ শতাংশ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে, পূর্ব পাকিস্তানে
ব্যয় হতো মাত্র ২৫ শতাংশ১
। সড়ক, রেল যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নে পশ্চিম পাকিস্তানকে অগ্রাধিকার দেয়া
হতো। এমনকি বহিবিশ্বের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগকেও গুরুত্ব দেয়া হতো না।
(০৪) রাজনৈতিক বৈষম্য: পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে সবসময় উদাসীন ছিল।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয় লাভ করে সরকার গঠন করলেও কিছুদিনের মধ্যে তা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভেঙ্গে
দেয়া হয়। এদেশের মানুষের অধিকারের কথা বলার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বার বার জেল-জুলুমের
শিকার হতে হয়। ছয়দফা ঘোষণার পর ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হয়রানি করা হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনরা নানা
. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ঢাকা, প্রতীতি, ঢাকা, ২০০৭, পৃ. ২।
টালবাহানা শুরু করে। ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে এবং নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে
হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে।
(০৫) চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য: সামরিক বাহিনীর (বিমান, নৌ ও সেনা) সদর দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। মন্ত্রণালয়,
সচিবালয়, মহাপরিচালকের কার্যালয় সবকিছু ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের
কেন্দ্রীয় বাজেটের প্রায় ৫৬ শতাংশ ব্যয় হতো সামরিক খাতে, যার মাত্র ১০ শতাংশ ব্যয় হতো পূর্ব পাকিস্তানে।
নিয়োগের ক্ষেত্রেও পশ্চিম পাকিস্তানিদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। পশ্চিম পাকিস্তানের ৮৯৪ জন সেনাকর্মকর্তার
বিপরীতে বাঙালি সেনাকর্মকতা ছিলেন মাত্র ১৪ জন। নৌ এবং বিমান বাহিনীতে এ সংখ্যা যথাক্রমে ৫৯৩ এবং
৬৪০ জনের বিপরীতে ০৭ জন এবং ৬০ জন। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে মোট ৫১২ জন কর্মকর্তার মধ্যে বাঙালি
ছিলেন ১৮৬ জন। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা এবং কর প্রদানের পরিমাণ পশ্চিম পাকিস্তান অপেক্ষা অনেক
বেশি ছিল।
উপরের আলোচনা থেকে এটি প্রমাণিত যে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এদেশের মানুষের সাথে চরম
বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে। আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি সর্বত্র পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ শোষণ, বঞ্চনার ও বৈসম্যের শিকার হয়েছে।
সারসংক্ষেপ
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগোলিক দূরত্ব যেমন অনেকটা বেশি ছিল তেমনি আর্থ-সামাজিক দিকেও ব্যাপক বৈষম্য
বিদ্যমান ছিল। সামাজিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের সাথে বড় ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি
করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের চারটি ভিন্ন ভাষা প্রচলিত ছিল অথচ পূর্ব পাকিস্তানের বাংললা
ভাষাভাষীদেরকে টার্গেট করে তাদের মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়।। পাকিস্তানের মুদ্রা ব্যবস্থা
নিয়ন্ত্রণ করতো কেন্দ্রীয় সরকার। আর কেন্দ্রীয় সরকার ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে। পশ্চিম পাকিস্তানি
শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে সবসময় উদাসীন ছিল।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৫.৩
সঠিক উত্তরের পাশে টিক চিহ্ন (√) দিন।
১। পাকিস্তানের সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনীর দপ্তর কোথায় ছিল Ñ
(ক) পূর্ব পাকিস্তানে (খ) পশ্চিম পাকিস্তানে
(গ) ভারতে (ঘ) আফগানিস্তানে
২। বাংলা ভাষায় পাকিস্তানের কত শতাংশ মানুষ কথা বলতো?
(ক) ৬৬ শতাংশ (খ) ২৫ শতংশ
(গ) ৫৬ শতাংশ (ঘ) ৫২ শতাংশ
৩। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় বাজেটের ব্যয়ের হার কেমন ছিল?
(ক) ৫০ : ৫০ শতাংশ (খ) ৪০ : ৬০ শতাংশ
(গ) ৬০ : ৪০ শতাংশ (ঘ) ৭৫ : ২৫ শতাংশ

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]