ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচি বল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা কর

মুখ্য শব্দ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ১১ দফা কর্মসূচি, সত্তরের নির্বাচন।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচনের ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বস্তুত যেসব কর্মসূচির সিঁড়ি বেয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় চ‚ড়ান্ত রূপ লাভ করেছিল তার মধ্যে ঊনসত্তরের
গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচন বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। বস্তুত এ দু’টি ঘটনাই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত
করেছিল। স্বাধীনতার যৌক্তিক ভিত্তি, আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে ঊনসত্তরের
গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচনের ভ‚মিকা সবথেকে বেশি। এখানে পর্যায়ক্রমে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের
নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করা হলো।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আদায়ের স্বার্থে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ কর্মসূচি পাকিস্তানি
শাসকগোষ্ঠীকে বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ করেছিল। তারা বঙ্গবন্ধুর দাবিগুলোকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে প্রচারণা চালায়। ছয় দফা ছিল
মূলত বাঙালির মুক্তির সনদ, স্বায়ত্তশাসনের দলিল। এ কর্মসূচি ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুর উপর পাকিস্তানের অখÐতা বিনষ্ট
করার অভিযোগ এনে নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত করে দ্রæত বিচার
ট্রাইবুনালে তাঁর বিচার শুরু হয়। কিন্তু জনগণের প্রবল দাবির মুখে ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে
মুক্তি দেওয়া হলেও জেলগেট থেকে আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। একের পর এক তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হতে থাকে।
১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে
সাধারণ মানুষ এ আন্দোলনে সাড়া দেয়। আন্দোলন গণআন্দোলন রূপান্তরিত হয়। বিরোধী সব রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র
সংগঠন আইয়ুব বিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা এবং পরিচালনা করতে থাকে।
১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একাংশ ‘সর্বদলীয় ছাত্র
সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। পরিষদের পক্ষ থেকে ১৯৬৯ সালের ১৮ জানুয়ারি ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ছাত্র
সংগ্রাম পরিষদ আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচিকেও তাদের কর্মসুচির অন্তর্ভুক্ত করে। এগারো দফা কর্মসূচি ছিল নি¤œরূপ:
১। (ক) সচ্ছল কলেজসমূহকে প্রাদেশিকীকরণের নীতি পরিত্যাগ করিতে হইবে এবং জগন্নাথ কলেজসহ
প্রাদেশিকীকরণকৃত কলেজসমূহকে পূর্বাবস্থায় ফিরাইয়া দিতে হইবে।
(খ) শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য প্রদেশের সর্বত্র বিশেষ করিয়া গ্রামাঞ্চলে স্কুল-কলেজ স্থাপন করিতে হইবে এবং
বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজসমূহকে সত্বর অনুমোদন দিতে হইবে। কারিগরী শিক্ষা প্রসারের জন্য
পর্যাপ্ত সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক, টেকনিক্যাল ও কমার্সিয়াল ইনস্টিটিউট স্থাপন করিতে হইবে।
(গ) প্রদেশের কলেজসমূহে দ্বিতীয় শিফটে নৈশ আই.এ, আই.এস-সি, আই.কম ও বি.এ, বিএস-সি, বি.কম এবং প্রতিষ্ঠিত কলেজসমূহে নৈশ এম.এ ও এম.কম ক্লাস চালু করিতে হইবে।
(ঘ) ছাত্র বেতন শতকরা ৫০ ভাগ হ্রাস করিতে হইবে। স্কলারশিপ ও স্টাইপেন্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং
ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে স্কলারশিপ ও স্টাইপেন্ড কাড়িয়া লওয়া চলিবে না।
(ঙ) হল, হোস্টেলের ডাইনিং ও কেন্টিন খরচের ৫০ শতাংশ সরকার কর্তৃক ‘সাবসিডি’ হিসাবে প্রদান করিতে হইবে।
(চ) হল ও হোস্টেল সমস্যার সমাধান করিতে হইবে।
(ছ) মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে। অফিস আদালতে বাংলা ভাষা চালু করিতে হইবে।
সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত সংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষকের ব্যবস্থা করিতে হইবে। শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি করিতে
হইবে এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার দিতে হইবে।
(জ) অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করিতে হইবে। নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার করিতে হইবে।
(ঝ) মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে এবং অটোমেশন প্রথা বিলোপ, নমিনেশনে ভর্তি প্রথা বন্ধ,
মেডিকেল কাউন্সিল অর্ডিনেন্স বাতিল, ডেন্টাল কলেজকে পূর্ণাঙ্গ কলেজে পরিণত করা প্রভৃতি মেডিকেল ছাত্রদের
দাবি মানিয়া লইতে হইবে। নার্স ছাত্রীদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।
(ঞ) প্রকৌশল শিক্ষার অটোমেশন প্রথা বিলোপ, ১০% ও ৭৫% রুল বাতিল, সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সুব্যবস্থা,
প্রকৌশল ছাত্রদের শেষবর্ষের ক্লাশ দেওয়ার ব্যবস্থাসহ সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।
(ট) পলিটেকনিক ছাত্রদের ‘কনডেন্সড কোর্সের’ সুযোগ দিতে হইবে এবং বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষা বাতিল করিয়া
একমাত্র সেমিস্টার পরীক্ষার ভিত্তিতেই ডিপ্লোমা দিতে হইবে।
(ঠ) টেক্সটাইল, সিরামিক, লেদার টেকনোলজি এবং আর্ট কলেজ ছাত্রদের সকল দাবি অবিলম্বে মানিয়া লইতে
হইবে। আই.ই.আর ছাত্রদের দশ-দফা; সমাজ কল্যাণ কলেজ ছাত্রদের, এম.বি.এ ছাত্রদের ও আইনের ছাত্রদের
সমস্ত দাবি মানিয়া লইতে হইবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগকে আলাদা ‘ফ্যাকাল্টি’ করিতে হইবে।
(ড) কৃষি বিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মানিয়া লইতে হইবে। কৃষি ডিপ্লোমা ছাত্রদের কনডেন্সড কোর্সের
দাবিসহ কৃষি ছাত্রদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।
(ঢ) ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের ‘আইডেন্টিটি কার্ড’ দেখাইয়া শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ‘কন্সেসনে’ টিকিট দেওয়ার
ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটেও ‘কন্সেসন’ দিতে হইবে। পশ্চিম পাকিস্তানের মত বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায়
শহরের যে কোনো স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলে বাস যাতায়াতেও শতকরা ৫০ ভাগ
‘কন্সেসন’ দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সরকারি ও
আধাসরকারি উদ্যোগে আয়োজিত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের শতকরা ৫০ ভাগ ‘কন্সেসন’ দিতে হইবে।
(ণ) চাকুরির নিশ্চয়তা বিধান করিতে হইবে।
(ত) কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স সম্পূর্ণ বাতিল করিতে হইবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের
পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হইবে।
(থ) শাসকগোষ্ঠীর শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রামাণ্য দলিল জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও হামুদুর রহমান কমিশন
রিপোর্ট সম্পূর্ণ বাতিল করিতে এবং ছাত্রসমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে গণমুখী ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করিতে হইবে।
২। প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তি
স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হইবে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিতে হইবে।
৩। নিম্নলিখিত দাবিসমূহ মানিয়া লইবার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হইবে:
(ক) দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হইবে ফেডারেশন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসংঘ এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা হইবে
সার্বভৌম।
(খ) ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা এই কয়টি বিষযয় সীমাবদ্ধ থাকিবে। অপরাপর সকল বিষয় অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা হইবে নিরঙ্কুশ।
(গ) দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকিবে। এই ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এই অবস্থায়
শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যে, যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে
না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে। দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক অর্থনীতি প্রবর্তন করিতে হইবে।
(ঘ) সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের সকল ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল
সরকারের কোনো কর ধার্য করিবার ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউর নির্ধারিত অংশ
আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে জমা হইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান
শাসনতন্ত্রে থাকিবে।
(ঙ) ফেডারেশনের প্রতিটি রাষ্ট্র বহিঃবাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করিবে এবং বহিঃবাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত মুদ্রা
অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির এক্তিয়ারাধীন থাকিবে। ফেডারেল সরকারের প্রয়োজনীয় বিদেশি মুদ্রা অঙ্গ রাষ্ট্রগুলি সমানভাবে অথবা
শাসনতন্ত্রের নির্ধারিত ধারা অনুযায়ী প্রদান করিবে। দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির মধ্যেআমদানিরপ্তানি চলিবে। এবং ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশি রাষ্ট্রগুলির সাথে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের
এবং আমদানি-রপ্তানি করিবার অধিকার অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতন্ত্রে বিধান করিতে হইবে।
(চ) পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারি রক্ষী বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র
কারখানা নির্মাণ ও নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থাপন করিতে হইবে।
৪। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধুসহ সকল প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতঃ সাব- ফেডারেশন গঠন করিতে হইবে।
৫। ব্যাংক-বীমা, পাট ব্যবসা ও বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ করিতে হইবে।
৬। কৃষকের উপর হইতে খাজনা ও ট্যাক্সের হার হ্রাস করিতে হইবে এবং বকেয়া খাজনা ও ঋণ মওকুফ করিতে হইবে।
সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল ও তহশিলদারদের অত্যাচার বন্ধ করিতে হইবে। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য মণ প্রতি ৪০ টাকা নির্ধারণ এবং আখের ন্যায্য মূল্য দিতে হইবে।
৭। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী বোনাস দিতে হইবে এবং শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থা করিতে হইবে। শ্রমিক
স্বার্থ বিরোধী কালাকানুন প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং ধর্মঘটের অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান করিতে হইবে।
৮। পূর্ব-পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জল সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
৯। জরুরি আইন প্রত্যাহার, নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য নিবর্তনমূলক আইন প্রত্যাহার করিতে হইবে।
১০। সিয়াটো, সেন্টো, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করিয়া জোট বহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কায়েম করিতে হইবে।
১১। দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক সকল ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তি,
গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহার এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক কারণে রুজুকৃত
মামলা প্রত্যাহার করিতে হইবে।
এসব দাবি আদায়ে ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধ হয়। বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্দোলন ক্রমশ বেগবান হতে থাকে। আন্দোলন
প্রতিহত করতে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় নামে। পুলিশের গুলিতে নিহন হয়
কিশোর মতিউর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান। এতে আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়। আন্দোলন দমাতে
সরকার সেনাবাহিনী তলব করে। কিন্তু আন্দোলন ততদিনে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়ে গিয়েছে। সেনাবাহিনী গুলি চালিয়েও
আন্দোলন দমন করতে পারছিল না। সরকার বিরোধী আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ক্রমশ পশ্চিম পাকিস্তানে ছড়িয়ে
পড়ে। এসময় আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক আহŸান করেন। কিন্তু সে সময় ঐতিহাসিক আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধু
কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। দুর্বার আন্দোলনের মুখে সরকার বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়। এতে
বিক্ষুব্ধ জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। তারা ঢাকায় প্রধান বিচারপতি এবং কয়েকজন মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা চালায়,
অগ্নিসংযোগ করে। ১৬ ফেব্রæয়ারি পুলিশের গুলিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা শহীদ হন। এ সংবাদ
ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। আন্দোলনের চাপে আইয়ুব খান ২২ ফেব্রæয়ারি আগরতলা মামলা
তুলে নিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রæয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা মামলার আসামিদেরকে
সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এ সভা থেকেই শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভ‚ষিত করা হয়। এ সভা থেকে বঙ্গবন্ধু ছয়
দফা ও এগারো দফার ভিত্তিতে দেশ পরিচালান আহŸান জানান। তিনি আরো বলেন, দফা ও এগারো দফা দাবি আদায় না
হওয়া পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি লাভ করেছিল।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন:
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয়যুক্ত
করে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ টি আসনের মধ্যে ২৮৮ টিতে এবং জাতীয়
পরিষদের পূর্ব পাকিস্তান অংশের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসনে জয় লাভ করে। এ বিজয়ের মূলে ছিল বঙ্গবন্ধুর
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ, পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ ও বৈষম্যমূলক আচরণ, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার বিষয়ে
জনসচেতনতা সৃষ্টি। নির্বাচনে জয়লাভের পরও বঙ্গবন্ধুকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হয়নি। একাধিকবার জাতীয়
পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তিনি
ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। বস্তুত তাঁর ঘোষণার
মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু হয়। শাসকগোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারিতা ও অন্যায্যতার প্রতিবাদে আপামর বাঙালির
সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর মাধ্যমে পাকবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে (২৬ মার্চ) বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সত্তরের নির্বাচনের ম্যান্ডেট এবং পাকবাহিনীর
নৃশংসতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছিল। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
সারসংক্ষেপ
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পরিমÐলে গ্রহণযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে এ দু’টি ঘটনা
গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ এর নির্বাচন বাংলাদেশের
স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কার্যকর অবদান রেখেছে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৫.৫
সঠিক উত্তরের পাশে টিক চিহ্ন (√) দিন।
১। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কত দফা দাবি ছিল?
(ক) ১০ দফা (খ) ১১ দফা
(গ) ৬ দফা (ঘ) ২১ দফা
২। শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভ‚ষিত করা হয় কবে?
(ক) ২১ ফেব্রæয়ারি ১৯৫২ (খ) ১৬ ডিসেম্বর ১৯৬৬
(গ) ১৫ ফেব্রæয়ারি ১৯৬৯ (ঘ) ২৩ ফেব্রæয়ারি ১৯৬৯

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]