সমাজ কাঠামোর সংজ্ঞা বল বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর উপাদানসমূহ বর্ণনা কর

মুখ্য শব্দ সমাজ কাঠামো, দল, প্রতিষ্ঠান, উপাদান, উৎপাদন ব্যবস্থা, পরিবার, অর্থনীতি।
সমাজের কাঠামো গঠিত হয় সমাজের মৌলিক উপাদানের সমন¦য়ে, যার উপর ভিত্তি করে সমাজ টিকে থাকে এবং
যেসব উপাদানের মাধ্যমে আমরা সমাজের অস্তিত্ব উপলব্ধি করি সেগুলোর সমন্বিত রূপ হচ্ছে সমাজ কাঠামো।
সমাজবিজ্ঞানে ‘সমাজ কাঠামো’ প্রত্যয়টি প্রথম ব্যবহার করেন প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞান হার্বার্ট স্পেন্সার।
সমাজ কাঠামো সম্পর্কে রেডক্লিফ ব্রাউন (জধফপষরভভব ইৎড়হি, ১৯৫০) বলেছেন, সমাজ কাঠামোর উপাদান হচ্ছে মানব
সম্প্রদায় এবং তাদের মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন সম্পর্ক।
সমাজ কাঠামোর সংজ্ঞায় মরিস জিন্সবার্গ বলেছেন, সমাজ কাঠামোর অধ্যয়ন হচ্ছে সামাজিক সংগঠনসমূহের প্রধান প্রধান
রূপ। সামাজিক সংগঠনের ভিতরে রয়েছে সামাজিক গোষ্ঠী, সংঘ, সমিতি, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। এসবের জটিল রূপই হচ্ছে সমাজ কাঠামো। (
মার্ক্স ও তাঁর অনুসারীরা বলেন, সমাজ কাঠামোর প্রধান দু’টি দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে সমাজের মৌল ভিত্তি) অন্যটি উপরি কাঠামো মৌল কাঠামো হচ্ছে সমাজের অর্থনৈতিক বিষয় বা উৎপাদন
ব্যবস্থা। আর উপরিকাঠামো হচ্ছে সমাজের রাষ্ট্র, আইন, সরকার, প্রথা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি ইত্যাদি। এ মৌল কাঠামো এবং
উপরিকাঠামোর সমন¦য়েই তৈরি হয় সমাজ কাঠামো।
বস্তুত সমাজ কাঠামো হচ্ছে সমাজের মৌল উপাদানের সমষ্টি। সমাজ কাঠামোই মূলত সমাজকে দৃশ্যমান এবং কার্যকর
করে তোলে। সমাজের অর্থনৈতিক ও উৎপাদান ব্যবস্থা, পরিবার ও সামাজিক সম্পর্ক, প্রথা-প্রতিষ্ঠান, বিশ্বাস, মূল্যবোধ,
সাংস্কৃতিক পরিচয়, যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকলা ইত্যাদির সমন্বয়ে সামাজিক কাঠামো তৈরি হয়।
বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো এবং এর উপাদানসমূহ
বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো গ্রামীণ ও নগর সমাজের সমন্বিত রূপ। এখানে কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার পাশাপাশি
আধুনিক শিল্পভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থাও কার্যকর অবদান রাখছে। সেবাখাতের ক্রমবর্ধমান বিকাশও বাংলাদেশের সমাজ
কাঠামোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিবেচনা করে অনেকে বাংলাদেশের সমাজ
কাঠামোকে ‘আধা সামন্ততান্ত্রিক এবং আধা পুঁজিবাদী’ বলে অভিহিত করে থাকেন। এখানে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর
প্রধান প্রধান উপাদান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
১) কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা: বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা।
আবহমান কাল থেকে এদেশের মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষিতে খোরাকি উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে
বাণিজ্যিক উৎপাদন ব্যবস্থায় রূপান্তর ঘটেছে। যদিও জিডিপি’তে কৃষির অবদান এবং কৃষিখাতে শ্রমশক্তির পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, কিন্তু দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে কৃষির অবদান এখনো অপরিসীম।
২) ক্রমবর্ধমান শিল্পোৎপাদন: কৃষির পাশাপাশি দেশের শিল্পোৎপাদন ব্যবস্থা ক্রমশ বিকশিত হচ্ছে। দেশের মোট
শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ শিল্পখাতে নিয়োজিত। জিডিপি’তেও শিল্পের অবদান উত্তরত্তোর বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নয়নশীল
দেশ হিসেবে তাই বাংলাদেশের সমাজ বর্তমান কাঠামোর অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে শিল্পোৎপাদন ব্যবস্থা।
৩) বিকাশমান সেবাখাত: অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, শিল্পায়ন, নগরায়ন এবং আধুনিকায়ন দেশের সেবাখাত বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ
ভ‚মিকা রাখছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক যোগাযোগ, তথ্য প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে
সেবাখাত ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। পেশা, আয়-উপার্জন, দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থা প্রভৃতি সেবাখাত দ্বারা প্রভাবিত।
৪) ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদ ও সম্প্রসারমান পুঁজিবাদ: জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন সামন্তবাদী ব্যবস্থা ও
ধ্যান-ধারণাকে ক্রমশ বিলুপ্তির পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রসারিত হচ্ছে পুঁজিবাদ। ব্যক্তিগত মালিকানা, উৎপাদন ও
বাজার ব্যবস্থা, মানুষের বৈষয়িক চিন্তা-ভাবনা, শ্রেণি শোষণ ও বৈষম্য প্রতিটি ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের প্রভাব লক্ষণীয়।
‘সামন্ত উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে পুঁজিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থায় রূপান্তর’ বাংলাদেশের বর্তমান সমাজ কাঠামোর এক অনিবার্য বাস্তবতা।
৫) সম্প্রসারমান বাজার ব্যবস্থা: পুঁজিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার প্রভাবে বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা ক্রমশ সম্প্রসারিত ও
বিকশিত হচ্ছে। শিল্পের কাঁচামাল, উৎপাদিত দ্রব্য, ভোগ্যপণ্য, সেবা, জনশক্তি সবকিছু এখন বাজারের পণ্য। গ্রাম
থেকে শহর, জাতীয় থেকে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক প্রতিটি পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা
বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো এক এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছে।
৬) প্রভাবশালী মুদ্রা অর্থনীতি: পুঁজিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা এবং বাজার ব্যবস্থার প্রভাবে বাংলাদেশের মুদ্রা অর্থনীতি
অনেক বেশি শক্তিশালী। সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি, সম্মান ও মর্যাদা, সুযোগ-সুবিধা, নেতৃত্ব অধিকারের অন্যতম
উপাদান অর্থবিত্ত বা নগদ টাকা। এমনকি স্বাস্থ্য, শিক্ষার মত মৌলিক অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্রেও মুদ্রা অর্থনীতির
ভ‚মিকা রয়েছে।
৭) ধনী-দরিদ্র বৈষম্য: বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য। দেশের
পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ধনী আরো ধনী হচ্ছে; দরিদ্র হচ্ছে আরো নিঃস্ব। সবার মাথাপিছু গড় আয় বাড়ছে। কিন্তু
ধনীর আয় দরিদ্র মানুষের তুলনায় অনেক গুণ বেশি। ফলে ধনীদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার পাশেই ছিন্নমূল
মানুষের বসবাস পরিলক্ষিত হয়।
৮) অনু পরিবার ব্যবস্থা: বাংলাদেশের ভিত্ হচ্ছে বর্ধিত ও যৌথ পরিবার। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনের অনিবার্য ফল হচ্ছে
অনু পরিবার। গ্রাম কিংবা শহর, শিক্ষিত কিংবা নিরক্ষর, কৃষক, শ্রমিক কিংবা পেশাজীবী সবাই অনু পরিবারের অংশ।
বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো থেকে যৌথ পরিবার ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে এবং স্থান করে নিয়েছে অনু পরিবার।
৯) উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণি: শিক্ষা, শিল্পায়ন ও শহরায়নের ফলে দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকশিত হচ্ছে। নাগরিক
সমাজ, পেশাজীবী এবং শিক্ষিত-সচেতন জনগোষ্ঠী মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সমৃদ্ধ করছে। জনমত গঠন, নীতি নির্ধারণ,
সামাজিক আন্দোলন প্রভৃতি ক্ষেত্রে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছে।
১০) সচেতন রাজনৈতিক শ্রেণি: শিক্ষা ও গণমাধ্যমের বিকাশ দেশে সচেতন রাজনৈতিক শ্রেণি তৈরি করছে। রাজনৈতিক
চেতনা, আদর্শ এবং চর্চা এখন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোয় রাজনৈতিক
দলের সাথে সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়।
১১) কর্মক্ষম যুব সমাজ: দেশের মোট জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশ কর্মক্ষম যুব সমাজ। এরা দেশের উন্নতি, অগ্রগতি ও
সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছে। এই যুব সমাজের কারণেই দেশের ষোল কোটি মানুষ
‘সমস্যা’ না হয়ে আজ ‘সম্পদ’ বলে পরিগণিত। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই
যুব সমাজের ভ‚মিকা অপরিসীম।
১২) অধিকার সচেতন নারী সমাজ: সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশের নারী সমাজ দীর্ঘকাল যাবৎ শিক্ষা
ও সচেতনায় অনগ্রসর ছিল। কিন্তু বর্তমান সামাজিক কাঠামোয় নারী সমাজ শিক্ষিত এবং অধিকার সচেতন।
বাল্যবিবাহ এবং যৌতুক প্রথা রোধ, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সম্পদের মালিকানা এবং ক্ষমতায়ন নারী সমাজকে
বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত করেছে।
১৩) গ্রামীণ ও নগর সমাজের নৈকট্য: বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোয় এখন গ্রামীণ ও নগর সমাজের ব্যবধান অনেক হ্রাস
পেয়েছে। ভৌত ও তথ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা, গণমাধ্যম, শিক্ষা, পেশা ইত্যাদি নগর ও গ্রামীণ সমাজের মধ্যে
সেতুবন্ধ রচনা করছে। গ্রাম ও শহরের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ও সম্পর্ক ক্রমশ নিবিড় থেকে নিবিড়তর হচ্ছে।
বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে এর দৃশ্যমান প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
সারসংক্ষেপ
সমাজকে জানা এবং উপলব্ধি করার মূলসূত্র হচ্ছে এর কাঠামো। সমাজের প্রধান প্রধান দল, প্রথা, প্রতিষ্ঠান, উৎপাদন
ব্যবস্থা, আচরণবিধি ইত্যাদির সমন্বয় হচ্ছে সামাজিক কাঠামো। বাংলাদেশের সামজ কাঠামো বুঝতে হলে এর বিভিন্ন
উপাদানকে জানতে হবে। বস্তুত কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা, ক্রমবর্ধমান শিল্পোৎপাদন, বিকাশমান সেবাখাত, ক্ষয়িষ্ণু
সামন্তবাদ ও সম্প্রসারমান পুঁজিবাদ, বিকাশমান বাজার ব্যবস্থা, প্রভাবশালী মুদ্রা অর্থনীতি, বর্ধিত ও যৌথ পরিবারের
পরিবর্তে অনু পরিবারের সৃষ্টি, উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণি, সচেতন রাজনৈতিক শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশের সমাজ
কাঠামো।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন- ৬.১
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন
১। সমাজ কাঠামো হচ্ছে মৌল কাঠামো এবং উপরি কাঠামোর সমষ্টিÑ কার অভিমত?
(ক) ম্যাকাইভার (খ) কার্ল মার্কস
(গ) অগাস্ট কোঁতে (ঘ) হার্বার্ট স্পেনসার
২। বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর উপাদান হচ্ছেÑ
(র) কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা
(রর) উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণি
(ররর) আমলাতন্ত্র
কোনটি সঠিক?
(ক) র (খ) রর
(গ) র ও রর (ঘ) র, রর ও ররর

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]