মুখ্য শব্দ কার্ল মার্কস, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, উৎপাদন পদ্ধতি, শ্রেণি সংগ্রাম, উদ্বৃত্ত মূল্য, বিচ্ছিন্নতাবোধ।
কার্ল মাকর্সের জীবন ও কর্ম
কার্ল মার্কস ১৮১৮ সালে জার্মানীর ট্রায়ার শহরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম জীবনে তিনি তাঁর পিতার নিকট থেকে
শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৮৪১ সালে জেনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৪৩ থেকে ১৮৪৫
সাল পর্যন্ত প্যারিসে তিনি সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদগণের সাথে পরিচিত হন। কার্ল মার্কস তাঁর প্রিয় বন্ধু এঙ্গেলস্ এর সাথে
দীর্ঘ ৪০ বছরকাল অতিবাহিত করেন। ১৮৮৩ সালে তিনি মারা যান। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলি হলো The German
Ideology, The Communist Manifesto, A Contribution to the Critique of Political Economy, Das Capita
প্রভৃতি। কার্ল মার্কস হেগেলের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি হেগেলের দ্বা›িদ্বক পদ্ধতি গ্রহণ করলেও ভাববাদের পরিবর্তে
বস্তুবাদের চর্চা করেন। মার্কস ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, উৎপাদন পদ্ধতি, শ্রেণি সংগ্রাম, বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রভৃতি তত্ত¡ প্রদানের
মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছেন।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism)
কার্ল মার্কসের গুরু ছিলেন হেগেল। হেগেল ছিলেন ভাববাদী দার্শনিক ((Idealistic Philosopher)|। ভাববাদে বিশ্বাস করা
হয় যে, বস্তু মূখ্য নয় বরং তার সম্পর্কে যে ভাবধারা সৃষ্টি হয় সেটাই মুখ্য। হেগেলের সঙ্গে মার্কসের এ বিষয়ে মতভেদ
ছিল। কারণ মার্কস ছিলেন বস্তুবাদী। তাঁর কাছে বস্তুই মুখ্য। তিনি মনে করেন বস্তুই প্রথম, বস্তুকে কেন্দ্র করেই ভাবের
সৃষ্টি। বিংশ শতাব্দীতে সমাজ ভাবনা মার্কসীয় চিন্তা-ভাবনা দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত। ঐতিহাসিক দ্বা›িদ্বক বস্তুবাদের
মাধ্যমে সমাজ বিশ্লেষণের নতুন দিগন্ত তৈরি হয়।
কার্ল মার্কস সমাজকে বস্তু হিসেবে গণ্য করে দ্বা›িদ্বক পদ্ধতিতে যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন তাকে দ্বা›িদ্বক বস্তুবাদ
(Dialectical Materialism) e বলে। অন্যদিকে সমাজ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি ঐতিহাসিক বিবর্তনের উপর গুরুত্বারোপ
করেছেন। ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও তিনি দ্বা›িদ্বক পদ্ধতির প্রয়োগ করেছেন। মার্কসের সমাজ বিশ্লেষণের এ
মতবাদকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism) বলে অভিহিত করা হয়। দ্বা›িদ্বক পদ্ধতিতে দুই পক্ষের মধ্যে
আবশ্যিকভাবে সবসময় দ্ব›দ্ব বিরাজ করে। এ দ্ব›দ্ব দুই প্রকারের হতে পারে। যথা: (ক) ইতিবাচক Positive দ্ব›দ্ব এবং
(খ) নেতিবাচক Negative) দ্ব›দ্ব। ইতিবাচক দ্বা›িদ্বক প্রক্রিয়ায় বিশ্লেষণের মাধ্যমে জগৎ সত্ত¡ার যথার্থ স্বরূপ নিরূপণ করা
হয়। আর নেতিবাচক দ্বা›িদ্বক প্রক্রিয়ায় সংশ্লেষের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের মতবাদ খন্ডন করা হয়।
কার্ল মার্কস হেগেলের নিকট থেকে দ্বা›িদ্বক পদ্ধতি তা গ্রহণ করেন। দ্বা›িদ্বক পদ্ধতিতে বিভিন্ন উৎপাদন ব্যবস্থায় বিপরীতমুখী
দু’টি শক্তি থাকে। এর একটি ইতিবাচক (ঞযবংরং) এবং অন্যটি নেতিবাচক (অহঃর-ঃযবংরং) শক্তি। উভয়ের মধ্যে দ্ব›দ্ব হয়ে
একসময় নতুন শক্তি বা ব্যবস্থার (ঝুহঃযবংরং) উদ্ভব ঘটে। এটা থেমে থাকে না বরং অব্যাহত থাকে। এভাবেই নতুন
নতুন সমাজ ও উৎপাদন ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। বিষয়টি নি¤েœর চিত্রের সাহায়্যে দেখানো হলো:
Thesis (Positive) Antithesis (Negative)
Conflict
Synthesis
Thesis (Positive) Antithesis (Negative)
Conflict
Synthesis
চিত্র ৩.২: শ্রেণি-দ্ব›দ্ব ও নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা
কার্ল মার্কসের মতে, সমাজ একটি বস্তু। বস্তুর মধ্যে দ্ব›েদ্বর ফলেই বস্তু বিকশিত হয়। তেমনি সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রেও
বস্তুবাদী দ্ব›দ্ব ক্রিয়াশীল। সমাজের দ্ব›দ্ব-সংঘাত, পরিবর্তন, বিবর্তন এসবের পেছনে কোন কারণ বা সূত্র কাজ করে তা
ঐতিহাসিক বস্তুবাদে জানা সম্ভব। তাই দ্বা›িদ্বক পদ্ধতিতে সমাজ বিকাশের সূত্র আবিষ্কারের প্রক্রিয়াকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ
(Historical Materialism) বলে। বস্তুর কতিপয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা সমাজ বিকাশেও লক্ষ করা যায়। যেমন:
প্রথমত : বস্তু কখনো স্বতন্ত্রভাবে অবস্থান করতে পারে না, এরা পরস্পর নির্ভরশীল;
দ্বিতীয়ত : সব বস্তুই গতিশীল, কোনটা দেখা যায়, কোনটা দেখা যায় না;
তৃতীয়ত : সব বস্তুই উর্ধ্বমুখী এবং ক্রমান্বয়ে বিকাশমান;
চতুর্থত : পরস্পর বিরোধী দ্বিবিধ শক্তি প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই রয়েছে, এ জন্য বস্তু পরিবর্তিত হয়;
পঞ্চমত : বস্তু প্রতিনিয়ত উৎকর্ষের দিকে এবং পরিমাণগত থেকে গুণগত দিকে পরিবর্তিত হয়;
ষষ্ঠত : বস্তুর অস্তিত্ব মনের উপর নির্ভরশীল নয় বরং মনের অস্তিত্ব বস্তুর উপর নির্ভরশীল।
বস্তুর উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ সমাজের ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে, সামাজিক
পরিবর্তন বা রাজনৈতিক বিপ্লব কখনো মানুষের ধীশক্তিপ্রসুত দর্শন দ্বারা সংঘটিত হয় না। সামাজিক পরিবর্তনের মূলে
রয়েছে উৎপাদন পদ্ধতি এবং এর মধ্যকার দ্ব›দ্ব। এ শক্তি দ্বারাই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন, চিন্তা জগৎ সবকিছু
নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত হয়।
উৎপাদন পদ্ধতি
সাধারণভাবে উৎপাদন পদ্ধতি হচ্ছে উৎপাদন সম্পর্ক এবং উৎপাদন শক্তিসমূহের সন্ধিযুক্ত (ধৎঃরপঁষধঃবফ) সম্মিলন, যার
মধ্যে উৎপাদন সম্পর্ক প্রধান। উৎপাদন সম্পর্ক হচ্ছে উদ্বৃত্ত শ্রম সুনির্দিষ্টভাবে উপযোজনের এবং তার সাথে সঙ্গতি রেখে
উৎপাদনের যে সুনির্দিষ্ট বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে তার পতিফলন। মার্কসের মতে উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে সংঘাতের ফলে
বিপ্লবের সৃষ্টি হয় এবং সমাজ পরিবর্তিত হয়। উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে প্রথম দিকে যে ভারসাম্যতা
দেখা যায় পরবর্তীতে তা বজায় থাকে না। ফলে দ্ব›দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। উৎপাদন পদ্ধতি হলো সমাজের মৌল কাঠামো
যা সমাজের উপরি কাঠামোকেপ্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি পাঁচ ধরনের
উৎপাদন পদ্ধতির ধারণা প্রদান করেন:
(১) আদিম সাম্যবাদী উৎপাদন পদ্ধতি
(২) দাস উৎপাদন পদ্ধতি
(৩) সামন্তবাদী উৎপাদন পদ্ধতি (The Feudal Mode of Production)
(৪) পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতি (The CapitalisticMode of Production)
(৫) সমাজতান্ত্রিক ঊৎপাদন পদ্ধতি (The Socialistic Mode of Production)
(১) আদিম সাম্যবাদী উৎপাদন পদ্ধতি : আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার উৎপাদন শক্তি তথা উৎপাদনের উপকরণ ধীর
গতিসম্পন্ন হলেও ক্রমান্বয়ে তার অগ্রগতি সাধিত হয়। হাতিয়ারের উন্নতি সাধিত হয়। উৎপাদনের উপকরণের মধ্যে কাঠ,
পাথরের অস্ত্র, তীর-ধনুক উল্লেখযোগ্য। আর উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে সমতাভিত্তিক ভারসাম্যের প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
কারণ সে সময় জটিল শ্রমবিভাজন ছিল না। সবাই সবাইকে সহযোগিতা করত। পরবর্তীতে জনসংখ্যার বৃদ্ধি, কৃষির
বিকাশ, সমাজে স্তরভেদ তৈরির মাধ্যমে শোষণ প্রক্রিয়া শুরু হতে থাকে। উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন হয়ে নতুন ব্যবস্থার
তথা শ্রেণি শোষণমূলক ব্যবস্থা তথা দাস ও দাসমালিকের উদ্ভব হয়।
(২) দাস উৎপাদন পদ্ধতি : আদিম সমাজের তুলনায় দাস সমাজ ব্যাবস্থায় উৎপাদনের উপকরণ আরো বেশি উন্নত হয়।
উৎপাদন শক্তির উন্নতির ফলে উৎপাদনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এ সময়ে উৎপাদনের উপকরণের মধ্যে কাঠের লাঙ্গল
ব্যবহারে দাসদের দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ। অপর পক্ষে উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে ছিল দাস আর দাসমালিক। দাসভিত্তিক
উৎপাদন পদ্ধতিতে দাসদের কোনো অধিকার ছিল না। তাদের জীবন ধারণের জন্য নূন্যতম যা প্রয়োজন কেবলমাত্র তাই
পেত। দাসরা অন্যের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হতো। তারা শোষণ নির্যাতনের শিকার হতো। অধিকার বঞ্চিত ও
শোষণ নির্যাতনের কারণে উৎপাদন উপকরণ ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে দ্ব›দ্ব দেখা যায়। পরবর্তীতে দাস বিদ্রোহের
মাধ্যমে দাস উৎপাদন ব্যবস্থার পতন হয়; যার ফলে গড়ে ওঠে সামন্ততন্ত্র ব্যবস্থা।
(৩) সামন্তবাদী উৎপাদন পদ্ধতি : সামন্তবাদী উৎপাদন পদ্ধতিতে উৎপাদনের উপকরণ ছিল ভূমি, মানব শ্রম, গরু ঘোড়ার
লাঙ্গল প্রভৃতি। উৎপাদন সম্পর্ক ছিল সামন্ত প্রভু এবং ভূমিদাস। ভূমিদাসগণ দাসদের চেয়ে কিছুটা বেশি অধিকার ভোগ
করত। তারা ভূমির সঙ্গে বাধা ছিল। তবে দাস সমাজের মতো সামন্তসমাজও ছিল প্রভুত্ব ও নির্মম শোষণের যুগ।
পরবর্তীতে শোষণ বঞ্চণার হাত থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় এক নতুন সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হয় যেখানে মুক্ত শ্রম (ঋৎবব
খধনড়ঁৎ) লক্ষ করা যায়।
(৪) পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতি: পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় উৎপাদন হয় ব্যক্তিগত মালিকানায় এবং অধিক মুনাফা লাভের
আশায়। এখানে ভ‚মির পরিবর্তে কল-কারখানায় অধিক উৎপাদন হয়ে থাকে। পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতিতে উৎপাদনের
উপায় হলো শিল্প কলকারখানা, শ্রম প্রযুক্তি, মানবদক্ষতা প্রভৃতি। উৎপাদন সম্পর্ক হলো শিল্প মালিক এবং শ্রমিক শ্রেণির
মধ্যে। কার্ল মার্কস পুঁজিবাদী সমাজে দু’টি শ্রেণির কথা বলেছেন। তা হলো বুর্জোয়া এবং সর্বহারা
। মার্কসের ধারণা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা তথা উৎপাদন পদ্ধতিতে পুঁজিপতি এবং শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে
দ্ব›েদ্বর ফলে পুঁজিবাদের পতন হবে এবং নতুন সমাজ ব্যবস্থার জন্ম হবে যেখানে কোন শ্রেণি শোষণ ও বৈষম্য থাকবে না।
(৫) সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি : এ ধরনের সমাজব্যবস্থা শ্রেণি শোষণ ও বৈষম্যহীন। ফলে কোন রূপ দ্বা›িদ্বক সম্পর্ক
পরিলক্ষিত হয় না। রাষ্ট্র সকল কিছুর দেখভাল করে। ব্যক্তি তার সাধ্য অনুযায়ী পরিশ্রম করে এবং সে অনুযায়ী মূল্য রাষ্ট্র
থেকে লাভ করে থাকে। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণ থাকে কলকারখানা, ভূমি, রেলওয়ে প্রভৃতি।
উৎপাদনের উপকরণের উন্নতি সাধনের মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের লক্ষ্য।
উৎপাদন পদ্ধতির বিভিন্ন পর্যায় বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিভিন্ন সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ সম্ভবপর হয়। তাছাড়া
উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্ক এর তাৎপর্য অনুধাবন সম্ভব যা সমাজবিকাশের পর্যায় সম্পর্কে জ্ঞান লাভে সহায়ক।
শ্রেণি সংগ্রাম
মার্কসীয় তত্তে¡র অন্যতম বিষয় হচ্ছে শ্রেণি সংগ্রাম। ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রেণিগত অবস্থান ও দ্ব›দ্ব
তৈরি হয় যার প্রেক্ষিতে সমাজ পরিবর্তিত হয়। শ্রেণি সম্পর্কে মার্কস সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা প্রদান করেননি। তবে তিনি যে
ধারণা দিয়েছেন তা হলো শ্রেণি বলতে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যারা একই ধরনের কাজে নিয়োজিত তাদের প্রত্যেকেই শ্রেণির
সদস্য। অন্যদিকে সংগ্রাম বলতে অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন করে যাওয়াকে বোঝানো হয়। তাই বলা হয়,
শ্রেণি সচেতন মানুষ তাদের শোষণ নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত যখন আন্দেলন
করতে থাকে তখন তাকে শ্রেণি সংগ্রাম বলে। শ্রেণিসংগ্রাম সম্পর্কে মার্কস বলেন, মানব সমাজের ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামের
ইতহাস (The history of all hitherto existing society is the history of class struggles)| তাঁর মতে প্রতিটি
সমাজেই উৎপাদন যন্ত্রের উপর ভিত্তি করে পরস্পর বিরোধী দুটি শ্রেণি থাকে যারা সংগ্রামে লিপ্ত থাকে। শ্রেণি সংগ্রামের
ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি শিল্প বিপ্লবের পর থেকে আধুনিক সমাজ পর্যন্ত স্পষ্টত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত বলে
জানিয়েছেন। তা হলো (ক) বুর্জোয়া (Bourgeois) এবং (খ) সর্বহারা (Proletariate)|। সহজভাবে বলা হয় যারা
উৎপাদনের উপকরণ নিয়ন্ত্রণ করে তারা বুর্জোয়া আর যাদের কায়িক শ্রম ছাড়া আর কিছুই নাই তারা সর্বহারা। সমাজের যে
পরিবর্তন তথা বিকাশ ঘটেছে তা শ্রেণি সংগ্রামেরই ফল।
কার্ল মার্কস শ্রেণিসংগ্রাম সম্পর্কিত আলোচনায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়ের কথা বলেছেন। তা হলো বাস্তব শ্রেণি এবং সচেতন শ্রেণি . যখন কেবল উৎপাদন সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে যে শ্রেণি গড়ে ওঠে তা
হচ্ছে বাস্তব শ্রেণি। এদের মধ্যে কম সচেতনতা লক্ষ করা যায়। অপর পক্ষে সচেতন শ্রেণি হলো অধিকার আদায় ও
প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সচেতনতা থাকে, প্রয়োজনে আন্দোলন করে। মার্কসের মতে, শ্রমিকরা শোষণের শিকার হলে দাবি আদায়ে
সোচ্চার হয়। তখনই দ্বদ্ব ও সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে পড়ে। এভাবেই মার্কস তার শ্রেণি সংগ্রাম তত্ত¡ দিয়ে মানব সমাজের
বিকাশ ধারাকে বিশ্লেষণ করেছেন।
বিচ্ছিন্নতাবোধ
বিচ্ছিন্নতাবোধ সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। প্রাশ্চাত্যের অনেক দার্শনিকই বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রত্যয় নিয়ে
আলোচনা করেছেন। বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রত্যয়টি হেগেল এবং মার্কসের মাধ্যমে দর্শন হতে সমাজবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয়।
ইতিপূর্বে প্রত্যয়টিকে মানসিক ধারণা হিসেবে গ্রহণ করা হতো। মার্কস বিচ্ছিন্নতাবোধকে মনস্তত্তে¡র পরিবর্তে বস্তুবাদী
দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পান। তাঁর মতে, বিচ্ছিন্নতাবোধ কোনো মনস্তাত্তি¡ক বিষয় নয়। এটা সামাজিক বিষয়।
মার্কস মনে করেন, পুঁজিবাদী সমাজে বিচ্ছিন্নতাবোধ দেখা যায়। পুঁজিবাদ বিকাশের সাথে সাথেই বিচ্ছিন্নতাবোধ বাড়তে
থাকে। সমাজের একটা বিশেষ শ্রেণি এই বিচ্ছিন্তাবোধ দ্বারা আক্রান্ত হয়। বিচ্ছিন্নতাবোধের সঙ্গে শ্রমিক তথা শ্রমের
সস্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় বলে মার্কস এ তত্তে¡র নাম দেন শ্রমের বিচ্ছিন্নতাবাধের তত্ত¡
মূলত পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা থেকেই বিচ্ছিন্নতাবোধ এর সৃষ্টি হয়। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক শ্রেণি উৎপাদন ব্যবস্থা
থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে সমাজ থেকে নিজেকে আলাদা ভাবতে শুরু করে যা বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দেয়।
বিভিন্ন কারণে বিচ্ছিন্নতাবোধ হয়ে থাকে। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক তার নিজের শ্রমের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না।
কারণ উৎপাদন উপকরণসমূহের মধ্যে একমাত্র শ্রম ব্যতীত অন্য কোনো কিছুর উপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই। তাছাড়া জটিল
শ্রমবিভাজন এ বিচ্ছিন্নতাবোধকে আরো প্রকট করছে। শ্রমিক শ্রেণি কর্মহীনতার কারণেও বিচ্ছিন্নতাবোধ করে । শ্রমিক
শ্রেণি ক্ষমতাহীনতার কারণেও বিচ্ছিন্নতাবোধ করে। ফলে তিনটি স্থানে বিচ্ছিন্নতাবোধ করে। প্রথমত: শ্রমিক তার
উৎপাদিত পণ্য হতে বিচ্ছিন্নতাবোধ করে, দ্বিতীয়ত: শ্রমিক তার উৎপাদনের উপকরণ হতে বিচ্ছিন্নতাবোধ করে এবং
তৃতীয়ত: শ্রমিক তার দল বা সমাজ হতে বিচ্ছিন্নতাবোধ করে। ফলস্বরূপ সে তার সমষ্টিবদ্ধতা (ঈড়ষষবপঃরারঃু) হারিয়ে
ফেলে। শ্রমের বিচ্ছিন্নতাবোধ তত্ত¡ দ্বারা আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার ক্রুটিপূর্ণ দিকসমূহ অনুধাবনে সহায়ক।
উদ্বৃত্ত মূল্য
কার্ল মার্কস তার উদ্বৃত্ত মূল্য ধারণার সাহায্যে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় শোষণের প্রকৃতি তুলে ধরেছেন। উৎপাদনে
অবদানের মাধ্যমে শ্রমিক নির্দিষ্ট মজুরির অতিরিক্ত যে মূল্য সৃষ্টি করে তাকে উদ্বৃক্ত মূল্য বলা হয়। একজন শ্রমিকের কাজের
সময় দুইভাগে ভাগ করা হয়। আবশ্যকীয় শ্রম সময় ) এবং উদ্বৃক্ত শ্রম সময় (ঝঁৎঢ়ষঁং
শ্রম শক্তির মূল্য আবশ্যিক শ্রম সময়ে উৎপাদিত মূল্য নির্দেশ করে। তাই মোট শ্রম সময় থেকে
আবশ্যক শ্রম সময় বাদ দিলে উদ্বৃক্ত শ্রম সময় পাওয়া যায়। এই উদ্বৃক্ত শ্রম সময়ে একজন শ্রমিক যে মূল্য সৃষ্টি করে তাই
হলো উদ্বৃক্ত মূল্য। অর্থাৎ শ্রমিক কর্তৃক উৎপাদিত মূল্য এবং তার মজুরীর যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় তাকে মার্কস উদ্বৃক্ত
মূল্য বলেছেন। অনেকে পুঁজিপতির এ মুনাফাকেই উদ্বৃক্ত মূল্য হিসেবে বিবেচনা করেন। একটি
উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার করা যেতে পারে। ধরা যাক একজন শ্রমিক একদিনে মোট ০৮ ঘন্টা কাজ করে।
শ্রমিক ০৮ ঘন্টা কাজ করে যে পণ্য উৎপাদন করে তার মূল্য যদি ধরা যাক ১২০০ (এক হাজার দুইশত) টাকা। এই
১২০০ টাকার পণ্য-মূল্যে শ্রমিকের শ্রম ছাড়াও ব্যবহৃত কাঁচামালের মূল্য, যন্ত্রপাতি বাবদ ব্যয় ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকে।
মনে করি, ১২০০ টাকার পণ্য উৎপাদনে শ্রমিকের শ্রম ব্যতীত আরো ৪০০ টাকা খরচ (বিনিয়োগ) করা হয়। সুতরাং
১২০০ টাকার পণ্য উৎপাদনে শ্রমিকের অবদান (১২০০-৪০০) = ৮০০ টাকা। এখন দৈনিক ০৮ ঘন্টা পরিশ্রম করে
পুঁজিপতি যদি শ্রমিককে ৪০০ টাকা প্রদান করেন, তবে এ ক্ষেত্রে পুঁজিপতির মুনাফা দাড়ায় (৮০০-৪০০) = ৪০০ টাকা।
পুঁজিপতিদের এই মুনাফাই হলো উদ্বৃক্ত মূল্য; যা মূলত শ্রমিকের শ্রম থেকে অর্জিত।
সারসংক্ষেপ
র্কাল মার্কস কেবল যুগ-শ্রেষ্ঠ সমাজতাত্তি¡ক নয়, প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ এবং দার্শনিক। তিনি আধুনিক বৈজ্ঞানিক
সমাজতন্ত্রের জনক। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, শ্রেণি সংগ্রাম তত্ত¡, উৎপাদন পদ্ধতি, উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত¡, পুঁজিবাদী উৎপাদন
ব্যবস্থার বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রভৃতি তাঁর কালোত্তীর্ণ মতবাদ। দ্বা›িদ্বক পদ্ধতিতে তিনি সমাজকে বস্তুর আলোকে অধ্যয়ন করার
প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন তাঁর ঐতিহাসিক বস্তুবাদে। তাঁর মতে উৎপাদন পদ্ধতি সমাজের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ
করে। শ্রেণি সচেনতা সম্পর্কিত ধারণা শ্রেণি সংগ্রাম তত্তে¡ পাওয়া যায়। বিছ্ছিন্নতাবোধের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণির বঞ্চিত
হওয়ার পরও সমাজে অবস্থানের ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর মতে পুঁজিপতি শ্রেণি শ্রমিকের উদ্বৃত্তমূল্য শোষণ করে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৩.৬
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন
১। সামন্তবাদী উৎপাদন পদ্ধতিতে উৎপাদন সম্পর্ক কেমন?
(ক) ভ‚মিদাস-ভূস্বামী (খ) দাস-দাস মালিক
(গ) মালিক-শ্রমিক (ঘ) বুর্জোয়া-প্রলিতারিয়েত
২। বিচ্ছিন্নতাবোধের ফলে শ্রমিকের অবস্থা কী হয়?
(ক) আত্মীয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয় (খ) উৎপাদিত পন্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়
(গ) বন্ধু থেকে বিচ্ছিন্ন হয় (ঘ) রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত