সনাতন ধর্ম
সনাতন ধর্ম একটি ধর্মমতের নাম। সারা পৃথিবীতে বিপুল সংখ্যক মানুষ সনাতন ধর্মের অনুসারী।
জীব ও জগতের উদ্ভব ও বিকাশের আদি কারণ হিসেবে, স্রষ্টা হিসেবে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরে বিশ্বাস, ঈশ্বর এক, অদ্বিতীয় ও
সর্বশক্তিমান Ñ এ ধারণা, জীবনের উদ্দেশ্য ও করণীয় প্রভৃতি বিষয়ে অতিপ্রাচীন কালে উদ্ভূত একটি বিশেষ ধর্মমতকে বলা
হয় সনাতন ধর্ম।
এ ধর্মের অনুসরণে স্রষ্টার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপিত হয়, জাগ্রত হয় তাঁর প্রতি অবিচল ভক্তি। জীবের মধ্যে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর
আত্মা রূপে অবস্থান করেন জেনে সকল জীবের প্রতি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভালোবাসা জন্মে। সনাতন ধর্ম সকল ধর্মকেই
সত্য বলে মানে। পার্থক্য যা তা হলো উপাসনার পদ্ধতিসহ জীবন-যাপন প্রণালীর কিছু কিছু ধারা। সনাতন ধর্ম অহিংসা,
পরমত সহিষ্ণুতা ও জীবসেবার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এতে করে মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে ধর্মমতসহ মত ও
পথের বিভিন্নতা থাকলেও মানুষ হিসেবে দেখার বোধ জন্মে। জীবে ঈশ্বরবোধ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সংহতির চেতনা
জাগ্রত করে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সংহতির প্রতি উদ্বুদ্ধ করে এবং সা¤প্রদায়িক ও সংকীর্ণ ভেদবুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠতে
সহায়তা করে।
সনাতন ধর্ম ও হিন্দুধর্ম
‘সনাতন’ শব্দটির অর্থ ‘চিরন্তন’Ñ যা পূর্বে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। সুতরাং সনাতন ধর্ম বলতে
বোঝায়, যে ধর্ম পূর্বে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এ কথার মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মের চিরন্তনতা প্রকাশ
পায়। তবে তার মানে এই নয় যে সনাতন ধর্ম অবিকল পূর্বের মতোই আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এ কথার তাৎপর্য
এই যে সনাতন ধর্ম যুগ যুগ ধরে যুগাগত বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে এগিয়ে চলেছে ভবিষ্যতের পথে। সনাতন ধর্মের মূলীভূত
বৈশিষ্ট্য অবিকৃত রয়েছে, তার প্রকাশরূপে ঘটেছে নানা পরিবর্তন, যুগাগত প্রয়োজনের দিকে লক্ষ রেখে পরিমার্জন ও
সংযোজনের মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্ম এগিয়ে চলছে ।
সনাতন ধর্মকে তার এগিয়ে চলার পথে নানা মত ও পথের মধ্যে সমন্বয় ও সংহতি ঘটাতে হয়েছে। সনাতন ধর্ম তাই প্রাচীন
হয়েও নবীন। আবার নবীন হয়েও তা বহু যুগাগত ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। এ গতিশীলতা ও চিরসজীবতার জন্যই এ
ধর্মটিকে বলা হয়েছে সনাতন ধর্ম।
সনাতন ধর্ম হিন্দু ধর্ম নামেও বহুল পরিচিত। ‘হিন্দু’ নামটি মূলত পারস্যবাদীদের (বর্তমান ইরান) দেওয়া। পারস্যবাসীরা
‘স’ স্থানে ‘হ’ উচ্চারণ করেন। তাই তাঁদের উচ্চারণে ‘সিন্ধু’ হয়েছে ‘হিন্দু’। আর সিন্ধু নদের অববাহিকায় যাঁরা বসবাস
করতেন তাঁরাও হিন্দু নামে অভিহিত হন। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও তাঁদের কাছে ‘হিন্দু’ বলে বিবেচিত। এ হিন্দুদের
> সনাতন ধর্মকে তাঁরা হিন্দুধর্ম বলেছেন।
সুতরাং সনাতন ধর্ম ও হিন্দুধর্ম একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আমরা পরিষ্কারভাবে বোঝাবার জন্য বলতে পারি : এ
উপমহাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী স¤প্রদায়ের নাম হিন্দু স¤প্রদায়। এ হিন্দু স¤প্রদায়ের ধর্ম হচ্ছে সনাতন ধর্ম। প্রসারিত
অর্থে যিনি সনাতন ধর্মে বিশ্বাস করেন তিনিই সনাতন ধর্মী। প্রচলিত অর্থে হিন্দুধর্ম বললে সনাতন ধর্মকেই বোঝায়।
সনাতন ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ
অতি প্রাচীন কালে সনাতন ধর্মের উদ্ভব। ঠিক কখন সনাতন ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে, তার পূর্ণ ইতিহাস আজও অজ্ঞাত। বহু
ঋষির, মুনির ও মনীষীর ধ্যানে, মননে, সাধনায় সনাতন ধর্মদর্শন, ধর্মকৃত্য ও ধর্মাদর্শ উদ্ভূত ও বিকশিত হয়ে এসেছে। তাই
সনাতন ধর্মের কোনো একক প্রবর্তকের নাম উল্লেখ করা হয় নি। প্রাচীন যুগ থেকে আরম্ভ করে আধুনিক কাল পর্যন্ত নানা
মত ও পথের সমন্বয় সাধন করে সনাতন ধর্ম বিকশিত হয়ে চলেছে।
সনাতন ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থাবলি
বহুকাল ধরে বহু মনীষীর সমন্বিত প্রচেষ্টায় সনাতন ধর্মের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ। তাই সনাতন ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থাবলির সংখ্যাও
অনেক। কালের ধারায় সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান যে ধর্মগ্রন্থগুলোর উদ্ভব ঘটেছে, তার নাম বেদ। বেদ চারটি : ঋক্, সাম, যজুঃ
ও অথর্ব। এগুলোর একেকটিকে বলা হয় সংহিতা। যথাÑ ঋগ্বেদসংহিতা, সামবেদসংহিতা, যজুর্বেদসংহিতা এবং
অথর্ববেদসংহিতা।
এ চার বেদের পরবর্তী কালের ধর্মগ্রন্থগুলোর নাম ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ গ্রন্থের সংখ্যাও অনেক। যেমনÑ কৌষীতকী ব্রাহ্মণ,
শতপথ ব্রাহ্মণ, তান্ড্য ব্রাহ্মণ, গোপথ ব্রাহ্মণ ইত্যাদি।
ব্রাহ্মণের সঙ্গেই জড়িত আরও দুরকমের ধর্মগ্রন্থ : আরণ্যক ও উপনিষদ। আরণ্যকও অনেকগুলো। যেমনÑ ঐতরেয়
আরণ্যক, তৈত্তিরীয় আরণ্যক ইত্যাদি। উপনিষদও অনেকগুলো। যেমনÑ ঈশ উপনিষদ, কঠ উপনিষদ, মন্ডূক উপনিষদ,
মান্ডূক্য উপনিষদ, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ইত্যাদি।
অতঃপর রচিত হয়েছে ছয়টি বেদাঙ্গ : শিক্ষা (উচ্চারণ তত্ত¡ ও প্রয়োগ), কল্প, নিরুক্ত, ব্যাকরণ, ছন্দ ও জ্যোতিষ। এগুলো
বেদ পাঠের সহায়ক। এরপর সূত্র গ্রন্থাবলি রচিত হয়েছে। যেমনÑ কল্পসূত্র, গৃহ্যসূত্র ইত্যাদি।
তারপরের ধর্মগ্রন্থগুলো হচ্ছে রামায়ণ ও মহাভারত। এ ধর্মগুলোর মধ্যে কাব্য ও ইতিহাসের সংমিশ্রণ ঘটেছে। মহাভারতের
একটি অংশ হয়েও পৃথক ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ
সংকলিত Ñ যা জীবনে চলার পথে সহায়ক। এ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা নামক ধর্মগ্রন্থটি সনাতনধর্মাবলম্বীদের নিত্যপাঠ্য গ্রন্থ।
অনেককাল ধরে রচিত হয়েছে ‘পুরাণ’ নামক একগুচ্ছ ধর্মগ্রন্থ। আঠারোটি পুরাণ, আঠারোটি উপপুরাণ এবং আঠারোটি উপউপপুরাণ রয়েছে। আঠারোটি পুরাণের মধ্যে রয়েছে ব্রহ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, শিবপুরাণ, মার্কন্ডেয় পুরাণ, অগ্নিপুরাণ,
শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ ইত্যাদি। মার্কন্ডেয় পুরাণের অংশ হয়েও পৃথক ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে শ্রীশ্রীচন্ডী। দুর্গাপূজাসহ বেশ
কিছু ধর্মানুষ্ঠানে শ্রীশ্রীচন্ডী পাঠ করা হয়। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণও নিয়মিত পাঠ করা হয়।
আরও একগুচ্ছ ধর্মগ্রন্থ রয়েছে যেগুলোর নাম ‘তন্ত্র’।
শ্রীচৈতন্যদেবের মাহাত্ম্য প্রকাশক একটি ধর্মগ্রন্থের নাম শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত।
এ সকল ধর্মগ্রন্থ ছাড়াও রয়েছে কিছু স্মৃতিগ্রন্থ। এগুলোও ধর্ম পালন ও জীবনাচরণের সহায়ক। মনুসংহিতা, পরাশরসংহিতা
প্রভৃতি স্মৃতিগ্রন্থ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অনুসরণ করেন।
সনাতন ধর্মদর্শন
সনাতন ধর্ম গ্রন্থ বহু হলেও এগুলোর মধ্যে দর্শনগত সমন্বয় ঘটেছে। বিশ্বব্রহ্মান্ডের আদি স্রষ্টা রূপে যাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন
করা হয়, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাকে ‘ব্রহ্ম’ বলেন। ব্রহ্ম নিরাকার, ব্রহ্ম অদ্বিতীয়। তাই উপনিষদে বলা হয়েছে
একমেবাদ্বিতীয়ম্। ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়।
এই ব্রহ্মের স্বরূপও বিশে ষণ করা হয়েছে। ব্রহ্ম বিশ্বব্রহ্মান্ডের ওপর প্রভুত্ব করেন। তাই ব্রহ্মকে বলা হ - য়েছে ঈশ্বর। ‘ঈশ্বর’
মানে প্রভু।
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ঈশ্বরের বিচিত্র রূপ ও স্বরূপের মাহাত্ম্য কীর্তন করে নানাভাবে তাঁর উপাসনা করেন। নানা রূপে নানা
পথে উপাসনা করলেও ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। এটা সনাতন ধর্মের ভিত্তি এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একেশ্বরবাদী।
এক ঈশ্বরই বহুরূপে প্রতিভাত হয়েছেন। ঈশ্বর যখন জীব তথা ভক্তকে কৃপা করেন তখন তাকে ভগবান বলা হয়।
পৃথিবীতে অনেক সময় অশান্তির দেখা দেয়। দেখা দেয় অরাজকতা। দুর্বৃত্তেরা দেখায় শক্তিদম্ভ। সজ্জনেরা উৎপীড়িত হন।
ধর্ম তথা ন্যায় বিচার বিঘিœত হয়। তখন দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন এবং ধর্ম তথা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ঈশ্বর জীবরূপে
পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। অবতীর্ণ হন বলে তখন ঈশ্বরকে অবতার বলা হয়। যেমনÑ নৃসিংহ, বামন, রাম। তবে ভগবান
সরাসরি শ্রীকৃষ্ণ রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাই বলা হয় ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ং’। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান। তাই শ্রীকৃষ্ণকে
কেবল অবতার না বলে বলা হয় মহা-অবতারী।
আবার ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের কোনো একটি বিশেষ গুণ বা শক্তিকে বলা হয় দেবতা বা দেব-দেবী। যেমনÑ যে রূপে ঈশ্বর সৃষ্টি
করেন, তাঁর নাম ব্রহ্মা। সুতরাং ব্রহ্ম আর ব্রহ্মা এক কথা নয়। ব্রহ্ম নিরাকার মূল সত্তা। আর ব্রহ্মা তার সৃষ্টি শক্তির
রূপধারী। ব্রহ্ম পূর্ণ। ব্রহ্মা তার অংশ।
ঈশ্বর যে রূপে জীবজগতকে পালন করেন তাঁকে বলা হয় বিষ্ণু। বিষ্ণু ব্রহ্মের পালন শক্তি। আবার ব্রহ্ম যে রূপে ধ্বংস করে
সৃষ্টির মধ্যে লয় বা ভারসাম্য রক্ষা করেন, তখন তাঁকে বলা হয় শিব।
ব্রহ্মের বা ঈশ্বরের শক্তি বা প্রকৃতির নাম আদ্যাশক্তি বা মহামায়া। এ মহামায়ারও অনেক রূপ। যেমনÑ দুর্গা, কালী,
অন্নপূর্ণা, জগদ্ধাত্রী প্রভৃতি।
ঈশ্বর যে রূপে বিদ্যা দান করেন, তিনি দেবী সরস্বতী। ব্রহ্মের ধন-সম্পদ প্রদানের শক্তি বা গুণের নাম ল²ী।
এ রকম অনেক দেব-দেবী আছেন। দেব-দেবীরা পূর্ণ ঈশ্বর নন। তাঁরা ঈশ্বরের কোনো বিশেষ গুণ বা শক্তি।
আবার জীবের মধ্যে আত্মা রূপেও ব্রহ্ম বা ঈশ্বরই বিরাজ করেন। তাই জীবের সেবা করলে ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের সেবা করা হয়।
ব্রহ্মই জগতের সর্বত্র বিরাজিত। তাই একজন কবি ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলেছেন:
আছ অনল-অনিলে চির নভোনীলে
ভূধর-সলিল-গহনে,
আছ বিটপি-লতায় জলদের গায়
শশী তারকায় তপনে।
(রজনীকান্ত সেন)
স্বামী বিবেকানন্দ চমৎকার করে বলেছেন : ব্রহ্ম হতে কীট-পরমাণু সর্বভূতে সেই প্রেমময়।
সুতরাং ব্রহ্ম বা ঈশ্বর থেকে শুরু করে অবতার, দেব-দেবী, জীব ও জগৎ মিলিয়ে এক পরম ব্রহ্ম, এক পরমসত্তা। অদ্বিতীয়
ঈশ্বর। ‘এক’ থেকে ‘বহু’ আবার বহুকে মিলিয়ে এক অনাদি অনন্ত পরম ব্রহ্ম।
সনাতন ধর্মের এ ব্রহ্মতত্ত¡ তথা একেশ্বরবাদটি না বুঝলে মনে হবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বহু ঈশ্বরবাদী। এ চিন্তা থেকে জাত
সিদ্ধান্ত হবে বিভ্রান্তিকর এবং সনাতন ধর্মদর্শনের ভুল ব্যাখ্যা। তাই সনাতন ধর্মের এ ব্রহ্মতত্ত¡মূলক ধর্মদর্শনটিকে আমরা
সহজভাবে বুঝে নিলাম। এখন আর বিভ্রান্ত হব না। প্রকৃত সত্য আমাদের চিন্তায় উদ্ভাসিত থাকবে। সনাতন ধর্মদর্শনে
জন্মান্তরবাদ কর্মফল, পাপপুণ্য, স্বর্গ-নরক প্রভৃতি বিষয়ে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সনাতন ধর্মকৃত্য
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ব্রহ্ম বা ঈশ্বর, অবতার ও দেব-দেবীদের উপাসনা করেন। সেই স্রষ্টার কাছে তাঁরই সৃষ্টি রূপে কৃতজ্ঞতা
জানানোর, প্রার্থনা জানানোর উপায় হচ্ছে উপাসনা।
সনাতন ধর্ম অনুসারে উপাসনা দু প্রকার: নিরাকার উপাসনা ও সাকার উপাসনা।
নিরাকার উপাসনা
নিরাকার ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে স্তব-স্ততি উচ্চারণ করে, তাঁর নাম জপ করে, তাঁর নাম সরবে কীর্তন করে যে উপাসনা তা
নিরাকার উপাসনা।
সাকার উপাসনা
অবতার ও দেব-দেবীর প্রতিমা নির্মাণ করে, পুষ্প, পত্র, ধূপ, দীপ ও ভোজ্য নৈবেদ্য দিয়ে, প্রতিমার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের শক্তি
বিশেষের যে উপাসনা তাকে বলা হয় সাকার উপাসনা। এভাবে সাকার উপাসনার নাম পূজা। নিজ গৃহে পূজা করা যায়।
আবার সকলে মিলে পূজা করার জন্য দেবতার মন্দির নির্মাণ করে বিগ্রহ বা প্রতিমাকে সেখানে স্থাপন করা হয়। আয়োজন
করা হয় ধর্মোৎসবের। নির্মিত প্রতিমার মধ্য দিয়ে ব্রহ্মের শক্তি বিশেষের পূজা করে সেই শক্তি অর্জনের যে প্রার্থনা তারই
নাম সাকার উপাসনা।
নিরাকার ও সাকার দুভাবেই ঈশ্বরের বা তাঁর কোনো শক্তিকে (দেব/দেবীকে) উপাসনা করা যায়।
উপাসনা ছাড়াও জন্ম থেকে শুরু করে, শিক্ষা ও মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত জীবনে ধর্মকৃত্য রূপে কিছু কৃত্য পালন করতে হয়।
সেগুলিও ধর্মের অঙ্গ। গঙ্গা বা পবিত্র নদীতে স্নান, তীর্থভ্রমণ প্রভৃতিও সনাতন ধর্মকৃত্যের অন্তর্গত। ধর্মকৃত্যসমূহের মধ্য
দিয়ে প্রকাশ পায় ধর্মাচার। ধর্মাচার ধর্মের প্রকাশরূপ।
সনাতন ধর্মাদর্শ
সনাতন ধর্মাদর্শ বলতে বোঝায় ধর্ম পালন করলে কী ফল লাভ করা যায়। ঈশ্বরে বিশ্বাস, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে
ধর্ম পালন ধর্ম নির্দিষ্ট কর্তব্য। এ কর্তব্য পালন করলে ব্রহ্ম কর্তৃক সৃষ্ট জীব যে আত্মা রূপে ব্রহ্মকে ধারণ করে আছে, সেই
জীবাত্মা ব্রহ্মের সঙ্গে মিলিত হয়ে ব্রহ্মে লীন হয়ে যেতে পারে। একে বলে মোক্ষ। ধর্মপালন করা আমাদের কর্তব্য কেন?
সনাতন ধর্মদর্শনে বলা হয়েছে, ধর্মপালন করা হয়, ‘আত্মমোক্ষায় জগদ্ধিতায় চ’। অর্থাৎ ধর্ম পালন করা হয় নিজের মোক্ষ
বা চিরমুক্তি এবং জীব-জগতের কল্যাণের জন্য। কেবল নিজের মোক্ষের কথা ভাবলেই ধর্ম পালন করা হবে না। তার সঙ্গে
জীব-জগতের হিত বা মঙ্গলের জন্য সেবামূলক কর্মে লিপ্ত হতে হবে। এই হলো সনাতন ধর্মাদর্শ।
যেহেতু জীবের মধ্যে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর জীবাত্মা রূপে বিরাজ করছেন, তাই ব্রহ্মজ্ঞানে জীবের সেবা করতে হবে। তাহলে ঈশ্বরের
সেবা করা হবে। বহু জীবের মধ্যে বহু রূপে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর আমাদের সম্মুখেই আছেন। সেই জীবব্রহ্মের সেবা করতেই হবে।
এ নৈতিক শিক্ষা সনাতন ধর্মাদর্শের একটি মৌলিক বিশ্বাস। স্বামী বিবেকানন্দ চমৎকার করে বুঝিয়েছেন:
বহু রূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।
এ সনাতন ধর্মাদর্শ অনুসরণ করলে সমাজে হিংসা, স্বার্থপরতা কিছুই থাকবে না, সমাজ হবে শান্তিময় আনন্দময়।
পাঠ সংক্ষেপ
‘সনাতন ধর্ম’ একটি ধর্মমতের নাম। পৃথিবীতে বিপুল সংখ্যক মানুষ সনাতন ধর্মের অনুসারী। সনাতন ধর্মের অপর নাম
হিন্দুধর্ম। সনাতন ধর্ম অতি প্রাচীন কালে উদ্ভূত। বহু মত ও পথ সনাতন ধর্মে সমন্বিত। তাই সনাতন ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে
কোনো একক প্রবর্তকের নাম উল্লেখ করা হয় না। সুদূর অতীত কালে উদ্ভূত হয়ে সনাতন ধর্ম বিকশিত হয়ে চলেছে। তবে
মূল চিন্তা থেকে তা দূরে সরে যায় নি। বেদ, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ, রামায়ণ মহাভারত, পুরাণ, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা,
শ্রীশ্রীচন্ডী প্রভৃতি সনাতন ধর্মের গ্রন্থাবলির অন্তর্গত। এ সকল ধর্মগ্রন্থে সনাতন ধর্মদর্শন, ধর্মকৃত্য ও ধর্মাদর্শ বর্ণিত হয়েছে।
সনাতন ধর্মের ভিত্তি একেশ্বরবাদ। একই ব্রহ্ম ঈশ্বর, ভগবান ও অবতার রূপে উপাসিত। দেব-দেবীরাও ব্রহ্মের অংশ।
আবার আত্মা রূপে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর জীবের মধ্যে অবস্থান করেন। সব মিলিয়ে এক ব্রহ্ম বা ঈশ্বর। জন্মান্তরবাদ ও কর্মফল
সনাতন ধর্মের অন্যতম বিশ্বাস।
নিরাকার ও সাকার উপাসনার মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মকৃত্য প্রকাশিত হয়। আত্মমোক্ষ ও জীবজগতের
হিতসাধন হচ্ছে সনাতন ধর্মের আদর্শ। জীবকে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর জ্ঞানে সেবা করা সনাতন ধর্মের অন্যতম ধর্মাদর্শ ও শিক্ষা।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন: ১৬.১
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন:
১. সনাতন ধর্মের অপর নাম কী
ক. হিন্দুধর্ম খ. সিন্ধু ধর্ম
গ. আর্যধর্ম ঘ. শৈব ধর্ম
২. ‘সনাতন’ শব্দটির অর্থ কী?
ক. সত্য খ. চিরন্তন
গ. অনন্ত ঘ. অনাদি
৩. সনাতন ধর্মের প্রবর্তক কে?
ক. ব্রহ্মা খ. শিব
গ. শ্রীচৈতন্য ঘ. একক কোনো ব্যক্তি নন
৪. বেদ কয়টি?
ক. একটি খ. দুটি
গ. তিনটি ঘ. চারটি
৫. ‘ঈশ’ কোন শ্রেণির ধর্মগ্রন্থ?
ক. বেদ খ. ব্রাহ্মণ
গ. উপনিষদ ঘ. আরণ্যক
৬. একটি ধর্মগ্রন্থের অংশ হয়েও পৃথক ধর্ম গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে কোন ধর্ম গ্রন্থটি?
ক. কঠ উপনিষদ খ. শ্রীমদ্ভাগবত
গ. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ঘ. শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত
৭. নিচের কোনটি অবতারের নাম?
ক. দুর্গা খ. ইন্দ্র
গ. নৃসিংহ ঘ. চন্দ্র
সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্ন
১. টীকা লিখুন:
(ক) বেদ (খ) ব্রাহ্মণ (গ) উপনিষদ
২. ব্রহ্ম ও ব্রহ্মার মধ্যে পার্থক্য কী?
রচনামূলক প্রশ্ন
১. সনাতন ধর্ম বলতে কী বোঝেন? সনাতন ধর্ম ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কী? বুঝিয়ে লিখুন।
২. সনাতন ধর্ম গ্রন্থাবলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিন।
৩. সংক্ষেপে সনাতন ধর্মদর্শনের পরিচয় তুলে ধরুন।
৪. সনাতন ধর্মাদর্শের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত