চতুরার্য সত্য কি আর্যসত্যের সংজ্ঞা আর্যসত্যের শ্রেণী বিভাজন আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্পর্কে বলতে

বৌদ্ধধর্ম
‘বুদ্ধ’ শব্দের অর্থ জ্ঞানী। এ জ্ঞান অর্জন করতে হয়। প্রাচীন ভারতবর্ষের শাক্য রাজবংশের যুবরাজ সিদ্ধার্থ এই জ্ঞানালঙ্কারে
অভিষিক্ত হয়েই জগতে বুদ্ধ হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন।
তিনি তাঁর পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন ‘হি ভিশুগণ! তোমরা বহুজনের হিতের জন্য, বহু জনের কল্যাণের
জন্য বঙ্গজনে মুখের জন্য, শান্তির জন্য, চতুর্দিকে বিচরণ করো। আমরা এমনধর্ম প্রচার করো যার কাদিতে কল্যাণ, মধ্যে
কল্যাণ এবং অন্তে কল্যাণ। তার মনে ছিল মানব প্রেম, যা সকলের জন্য মানবিক অবদান পরিপূর্ণ ও সর্বাঙ্গীন কল্যাণকর।
কুমার সিদ্ধার্থ আজই হাজার বছরেরও পূর্বে নেপালের লুম্বিনী উদ্যানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজা শুদ্ধোদন
এবং মাতার নাম রানী মহামায়া। নামকরণ দিবসে তাঁর নাম রাখা হলো সিদ্ধার্থ। জন্মের সপ্তাহকাল পরেই তাঁর মাতার মৃত্যু
হয়। তখন তাঁর লালন-পালনের দায়িত্ব নেন তাঁর মাসী (মায়ের বোন) মহাপ্রজাপ্রতি গৌতমী। গৌতমীর লালনকৃত সন্তান
বলে তাঁকে গৌতমও বলা হয়। শাক্যবংশ জন্ম বলে শাক্য সিংহ নামেও তিনি পরিচিত। জন্মের পর জ্যোতিষীগণ ভবিষ্যদ্বাণী
করেছিলেন যে, ভবিষ্যতে এই সন্তান গৃহত্যাগী হয়ে বুদ্ধ হবেন অথবা সংসারী হয়ে রাজচক্রবর্তী রাজা হয়ে রাজ্যশাসন
করবেন। কিন্তু সংসার ত্যাগের সম্ভাব্য বিষয়ে রাজা চিন্তিত হয়ে পড়েন। এ জন্য রাজা শুদ্ধোদন কুমার সিদ্ধার্থকে যথাসময়ে
পরমা সুন্দরী রাজকন্যা যশোধরা’র সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করালেন। কুমার সিদ্ধার্থের পুত্র সন্তান রাহুল জন্মগ্রহণ
করলে তাঁকে ভাবিয়ে তোলেন। এ সময় মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-স্বজন অন্যান্য পরিজন এবং ভোগ বিলাসের অফুরন্ত
উপাদানকে তুচ্ছ মনে করে তাঁর হৃদয়-মন উদ্বেলিত হয় এক অনন্য চেতনায়। এ নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি সংসার ত্যাগ
করে বৈরাগ্য বছর বয়সে জীবনকে প্রধানব্রত হিসেবে গ্রহণ করে। তারপর ছয় বছর কঠোর সার্ধনা করে বোধজ্ঞান লাভ
করেন এবং আশি বছর বয়সে মহাপরিনির্বা লাভ করেন। তাঁর জীবন-দর্শন মানববিদ্যার পঠন-পাঠনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চতুরার্য সত্যের পরিচয়
জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং দুঃখময়। প্রতি নিয়ত মানুষ অতৃপ্ত বাসনা, শোক, বিলাপ প্রভৃতি নিয়ে মৃত্যু মুখে পতিত হয়। বৌদ্ধ
মতে, তৃষ্ণা হেতু মানুষ জন্ম গ্রহণ করে। পুনঃপুন জন্মগ্রহণ করা খুবই দুঃখকর। এ দুঃখ থেকে মুক্তি পাবার জন্য বুদ্ধ বুদ্ধত্ব
লাভের পূর্বে বোধিসত্ত¡ অবস্থায় জন্ম-জন্মান্তরে পারশী পূরণ করেন। অবশেষে তিনি তৃষ্ণা মুক্তির পরমসত্য জ্ঞাত হয়ে
বুদ্ধত্বে উন্নীত হন। অন্যতম পথ হিসেবে অষ্টাঙ্গিক মার্গের সন্ধান লাভ করেন। এটি চার ভাগে বিভক্ত যা চারি আর্যসত্য নামে
পরিচিত। এ চারি আর্যসত্যকে বৌদ্ধধর্ম কিংবা বৌদ্ধদর্শনের উপক্রমণিকা বলা হয়। এগুলোই হলো বুদ্ধের ধর্মদর্শনের মূল
চাবিকাটি। মানুষকে চারটি সত্য সম্বন্ধে অবহিতকরণ করাই হলো বুদ্ধের মহান শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য।
আর্যসত্যের সংজ্ঞা
আর্যসত্যের শব্দগত অর্থ হলো শ্রেষ্ঠ সত্য। আর্যগণের জ্ঞানচক্ষু দ্বারা দৃষ্ট যে সত্য তার নাম আর্যসত্য। যিনি ক্ষমাশীল,
শত্রুহীন ও নির্ভীক তিনিই আর্য। যিনি সকল প্রাণীর প্রতি মৈত্রীভাব পোষণ করেন তিনিই আর্য। কিন্তু এখানে ‘আর্য’ বলতে
বুদ্ধ ও প্রত্যেক বুদ্ধগণকে বোঝায়। কারণ তাঁরা জ্ঞানযোগে আর্যসত্যকে দর্শন করে জন্ম-মৃত্যুর অতীত হয়েছেন। অর্থাৎ
তারা নির্বাণ অধিগত হয়েছেন। এখানে বিশেষ অর্থে বুদ্ধ যে শ্রেষ্ঠসত্য দেশনা করেছেন তাকে আর্যসত্য বলা হয়।
আর্যসত্যের শ্রেণী বিভাজন
জগৎ সংসারে নিত্য বলতে কিছুই নেই। লোভ দ্বেত্ত মোহে আসক্ত মানুষ অবিদ্যায় আচ্ছন্ন হয়ে দুঃখকে সুখ মনে করে
প্রতিনিয়ত কষ্ট পায়। আর প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে জন্মচক্রে আবর্তিত হচ্ছে বারবার। অন্যদিকে যাঁরা প্রজ্ঞাবান তাঁরা দুঃখকে
দুঃখ মনে করে নত্যের সন্ধান করে। তাই এই সত্যজ্ঞানের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এ চারটি আর্যসত্যগুলো হলো যথাক্রমে :
ক . দুঃখ আর্যসত্য
খ. দুঃখ সমুদয় আর্যসত্য
গ. দুঃখ নিরোধ আর্যসত্য
ঘ. দুঃখ নিরোধের উপায় আর্যসত্য।
ক. দুঃখ আর্যসত্য : জীবন মাত্রই দুঃখময়। এতে রোগ আছে, ব্যাধি, জরা, শোক, মৃত্যু আছে। কর্মফলের বন্ধন হেতু
সবাইকে জন্ম জন্মান্তরে তার নিদারুণ নারকীয় যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। বলতে গেলে দুঃখ জন্মে, দুঃখ শৈশবে, দুঃখ
বার্ধ্যকে, দুঃখ মরণে। এমনকি দুঃখ প্রিয় বিয়োগে ও অপ্রিয় সংযোগে। এখানে প্রতিনিয়ত মানুষ দুঃখের সাথে সংগ্রাম
করে চলছে। সুখ একটি স্বপ্নমাত্র। সুতরাং সংসার জীবনে আবদ্ধ হওয়াই দুঃখের মূল কারণ যা দেহ ও মনের ক্ষণিক্ষতা
বিচার করলে বোঝা যায়।
খ. দুঃখ সমুদয় আর্যসত্য : এখানে দুঃখ সমুদয় মানে দুঃখের কারণ বা হেতুকে বোঝায়। দুঃখের মূল কারণ তৃষ্ণা। অগ্নির
উপাদান যেমন কাষ্ঠ বা কাঠ তেমনি জন্ম ও জন্ম পরবর্তী দুঃখের উপাদান হলো তৃষ্ণা। কাম তৃষ্ণা, ভব তৃষ্ণা, এবং
বিভব তৃষ্ণা এ ত্রিধাবিভক্ত তৃষ্ণাই সকল প্রকার দুঃখের মূল কারণ। ইন্দ্রিয় ও বিষয় বাসনার প্রতি আসক্তিই কাম। কাম
তৃষ্ণা প্রাণিগণকে সংসার ও জাগতিক ভোগের প্রতি প্রলুব্ধ করে রাখে। ভব তৃষ্ণায় আচ্ছন্ন ব্যক্তি অনিত্য সংসারকে
আরাম বলে মনে করে। এখানে মিথ্যা ধারণাই ভব উৎপত্তির সহায়ক। জন্ম-মৃত্যুর প্রতি বিশ্বাস না রেখে জীবনকে
ভোগ করার ইচ্ছাই হলো বিভব তৃষ্ণা। যাঁরা সকল প্রকার তৃষ্ণা ধ্বংস করতে পারেন, তারাই প্রকৃত সুখের অধিকারী হন। তাঁরা আর পুর্ণবার জন্ম গ্রহণ করেন না।
গ. দুঃখ নিরোধ আর্যসত্য : দুঃখ এবং দুঃখ সমুদয়ের নিবৃত্তিই হলো দুঃখ নিরোধ। তৃষ্ণা এবং অবিদ্যা এ দুটি বিষয়
প্রাণিকে অবিরত দুঃখ প্রদান করে। তৃষ্ণার কারণে উপাদান, উপাদানের কারণে ভব, ভবের কারণে জন্ম-মরণ-শোক-
রোদন, মানসিক দুশ্চিন্তা সর্বোপরি সব অশান্তির সৃষ্টি হয়। তৃষ্ণা ধ্বংস হলে একে একে উপাদান, ভব, দুঃখের
পরিসমপ্তি হয়। নির্বাণ প্রত্যক্ষ হয়। দুঃখ নিরোধই নির্বাণ। দুঃখ নিরোধই হলো বৌদ্ধদর্শনের মূল লক্ষ্য।
বৃক্ষের মূলোচ্ছেদ না করলে যেমন পুনরায় অঙ্কুরিত হয়, তেমনি তৃষ্ণার মূলোৎচ্ছেদ না হলে দুঃখ লাভ অবশ্যম্ভাবী। তৃষ্ণা
জন্ম-জন্মান্তরে দুঃখ বৃদ্ধি ঘটায়। তৃতীয় আর্যসত্য পরিপালন কিংবা অনুশীলনের মাধ্যমে তৃষ্ণাকে ধ্বংস করা যায়।
ঘ. দুঃখ নিরোধের উপায় আর্যসত্য : দুঃখ নিরোধের উপায় একটি আচরণ সমন্বিত মার্গ যাকে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়।
এর অপর নাম মধ্যমপন্থা। কৃচ্ছতা সাধন এবং ভোগস্পৃহা এই দুটির মধ্যবর্তী অবস্থান হয় বলেই এটি মধ্যপন্থা নামে
পরিচিত। আর্য অষ্টাঙ্গিক মর্গে অনুশীলনকারীরাই এই অবস্থানে থাকতে পারে। সুতরাং আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের
কার্যকারিতা সম্বন্ধে বিশ্বাস বা প্রত্যয় স্থাপনই হলো চতুর্থ আর্যসত্য।
আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গেরঅঙ্গগুলো হলো যথাক্রমে ;
ক. সম্যক দৃষ্টি, খ, সম্যক সংকল্প, গ. সম্যক বাক্য,
ঘ. সম্যক কর্ম, ঙ. সম্যক জীবিকা, চ. সম্যক ব্যায়ম প্রচেষ্টা,
ছ. সম্যক স্মৃতি এবং জ. সম্যক সমাধি।
উপরি-উলি খিত মার্গগুলো দুঃখের বিনাশক ও প্রজ্ঞার বিকাশক দুঃখ মুক্তি এবং - নির্বাণ লাভের একমাত্র পথ। দুঃখকে
প্রকৃষ্টরূপে জেনে তা থেকে মুক্ত হওয়াই মহামতি বুদ্ধের ধর্ম দর্শনের মূলভিত্তি এবং এই মার্গই বিমুক্তি লাভের উত্তম পন্থা।
আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ-এর পরিচয়
গৌতম বুদ্ধের অভিনব আবিষ্কার হলো আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। তিনি ছিলেন মধ্যপথের অনুসারী। তাঁর শিক্ষা, জীবন-দর্শন
সর্বত্রেই যেন এ মধ্যমপন্থার উপস্থিতি রয়েছে। মধ্যপথ হলো কঠোর কৃচ্ছতা এবং অতিমাত্রায় ভোগ-বিলাসের মধ্যস্তর।
এটা শুধু ব্যক্তির চারিত্রিক উন্নয়ন ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনই করে না বরং এর সাথে আর্থিক কল্যাণ ও পারস্পরিক
সামাজিক সর্ম্পক উন্নয়নের অবদান অতুলনীয়। মধ্যপথ অনুশীলনের দুটি ধারা। একটি হলো আধ্যাত্মিক উন্নয়ন এবং
অপরটি হলো সুন্দরসমাজ বিনির্মাণ। এটাকে নৈতিক আচরণ মার্গও বলা যায়। নির্বাণ লাভ এবং আধ্যাত্মিক জীবনাচারে
আদর্শ সোপান এটি। জীবনের প্রতিটি স্তরে কিংবা অধ্যায়ে এ মধ্যপথের গুরুত্ব রয়েছে। সাধারণ অর্থে আর্য অষ্টাঙ্গিক
মার্গ বলতে বিশুদ্ধ আটটি মার্গ বা পথকে বোঝায়। এগুলোর একটি সাথে অপরটির নিবিড় এবং গভীর সর্ম্পক রয়েছে।
বিশুদ্ধ জীবনগঠনে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ
বিশুদ্ধ জীবনচর্চা কিংবা আদর্শজীবন গঠনের অন্যতম পথ হলো অষ্টাঙ্গিকো মার্গ। তাছাড়া এটাকে আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভের
পথ বলা হয়। বুদ্ধ এটাকে দুঃখ মুক্তির সোপান হিসেবে অভিহিত করছেন। এটি অনুসরণ করলে ইহ এবং পারলৌকিক
জীবন সৎ, সুন্দর ও এবং মনোময় হয় এবং সকল প্রকার দুঃখের অবসান ঘটে।
আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ জীবন সাধনায় ‘মধ্যম পন্থা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কারণ এখানে দুটি বিষয় বিসর্জনের কথা
বলা হয়েছে। এ দুটি বিষয় হলো Ñ
ক. শারীরিক কঠোর কৃচ্ছতা সাধন বর্জন করা।
খ. তীব্র ভোগ-বাসনা পরিত্যাগ করা।
উপরি-উক্ত কোনটিই আদর্শ জীবনগঠনের ক্ষেত্রে উপযোগী নয়। এ জন্য মধ্যম সাধন পদ্ধতিতে এ দুটি বিষয়কে বর্জনের
কথা বলা হচ্ছে। যে বা যাঁরা নৈর্বাণিক ধর্ম আচরণ করেন তাঁরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এ দুটি বিষয়কে পরিত্যাগ করেন।
বলা যায়, এগুলো উন্নত এবং বিশুদ্ধ জীবনগঠনের পরিপন্থী।
আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের স্বরূপ বিশ্লেষণ
এ গুলো হলো যথাক্রমে : ক .সম্যক দৃষ্টি, খ. সম্যক সংকল্প, গ. সম্যক বাক্য, ঘ. সম্যক কর্ম, ঙ. সম্যক আজীব, চ. সম্যক
ব্যায়াম বা প্রচেষ্টা, ছ. সম্যক স্মৃতি এবং জ. সম্যক সমাধি।
সম্যক দৃষ্টি : সৎ দৃষ্টি বা যথাযথ দৃষ্টি। এখানে ‘সম্যক দৃষ্টি’ মানে এমন দৃষ্টিকে বোঝায় যা জগত এবং জীবন সম্বন্ধে একটি
সত্য এবং অভ্রান্ত ধারণা দেয়। অর্থাৎ প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি, অনিত্য, দুঃখ, অনাত্ম, লোভ, দ্বেষ, মোহ, অকুশল কর্ম ইত্যাদি
বিষয়ে একটি স্বচ্ছ ধারণা লাভ করা এবং পরিণাম সম্পর্কে সচেতন কিংবা অবহিত হওয়াই সম্যক দৃষ্টি। বিশুদ্ধ জ্ঞানার্জন কিংবা দুঃখমুক্তির ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন অপরিহার্য।
সম্যক দৃষ্টিকে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা :
ক. লৌকিক সম্যক দৃষ্টি : এখানে লৌকিক শব্দের অর্থ হলো জাগতিক। সাধারণ জ্ঞান বা জাগতিক জ্ঞানদৃষ্টিকে লৌকিক সম্যক দৃষ্টি বলে।
খ. লোকোত্তর সম্যক দৃষ্টি : লোকোত্তর শব্দের অর্থ হলো পরমার্থিক। মার্গ ও তার ফল সম্পর্ক যুক্ত জ্ঞানই হলো
লোকোত্তর সম্যক দৃষ্টি।
আবার শৈক্ষ্য ও অশৈক্ষভেদে সম্যক দৃষ্টি তিন প্রকার। যেমন :
ক. লৌকিক সম্যক দৃষ্টি : কর্ম ও কর্মফলের বিশ্বাসই লৌকিক সম্যক দৃষ্টি।
খ. শৈক্ষ্য সম্যক দৃষ্টি : স্রোতাপত্তি, সকৃদাগামি ও অনাগামি এ তিন মার্গ সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জনই হলো শৈক্ষ্য সম্যক দৃষ্টি।
গ. অশৈক্ষ্য সম্যক দৃষ্টি : অরহতগণের জ্ঞানকে অশৈক্ষ্য সম্যক দৃষ্টি বলে।
সম্যক সংকল্প : প্রকৃত জ্ঞান লাভের জন্য যে দৃঢ় প্রত্যয় বা প্রতিজ্ঞা সেটা হলো ‘সম্যক সংকল্প’। এখনে সম্যক সংকল্প
বলতে বিষয়ের প্রতি আসক্তি ও হিংসা-দ্বেষ পরিহার এবং ঐহিক সঙ্গতির পথ ত্যাগ করা বোঝায়। সম্যক সংকল্প বলতে
আমরা বুঝি উত্তম সংকল্প। বিদ্যা অর্জনে, ধন সম্পদ অর্জনে, নানাবিধ সাধনায় এবং পরম মুক্তির জন্য সম্যক সংকল্পের
প্রয়োজন রয়েছে। এ রকম সংকল্পের ফলে জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে সফল হওয়া যায়। এ সম্যক সংকল্প তিন প্রকার। যথা :
ক. নৈষ্ক্রম্য সংকল্প : ভোগ-বাসনা ত্যাগ করে বৈরাগ্য অবলম্বনের মাধ্যমে যে সংকল্প তাকে বলা হয় নৈষ্ক্রম্য সংকল্প।
খ. অব্যাপাদ সংকল্প : মন বা চিত্তের অকুশলভাব ত্যাগ করে কুশল চিন্তায় মনোনিবেশ করার নামই হলো অব্যাপাদ সংকল্প।
গ. অবিহিংসা সংকল্প : হিংসা বৈরিতাভাব ত্যাগ করে সর্ব প্রাণীর প্রতি মৈত্রী এবং করুণা প্রর্দশন করাই হলো অবিহিংসা
সংকল্প।
সম্যক বাক্য : অর্থাৎ সৎ বা সুভাষিত বাক্য। যেখানে কোনো রকম মিথ্যা আশ্রয় থাকে না। ‘সম্যক বাক্যে’-এর অর্থ হলো
বাক্যে সংযম কিংবা সৎ বাক্যের অনুশীলন। অর্থাৎ সত্যভাষণ অন্যের আচরণে যা প্রশংসাযোগ্য তার প্রশংসা করা,
ভদ্রপ্রীতিপূর্ণ ভাষণ এবং আলাপ-আলোচনায় নিজের বাক্য সীমাবদ্ধ রাখা। মিথ্যা, কর্কশ, স¤প্রলাপ, বৃথাবাক্য ভাষণ
পরিত্যাগ করা। কারো বিরুদ্ধে কুৎসা রচনা এবং বিরূদ্ধাচরণ উচ্চারণ না করা। সম্যক বাক্যের ফলে ইহকাল এবং পরকাল
উভয় কালেই সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
সম্যক কর্ম : তার অর্থ হলো সুন্দর এবং নান্দনিক কর্ম সম্পাদন করা। অহিংস চিত্তে সাধুজনোচিত কর্ম সম্পাদনই সম্যক
কর্ম । অন্যভাবে বলা যায়, যে কর্মে কোনরকম পাপের ছোঁয়া বা ষ্পর্শ থাকে না তাকে সম্যক কর্ম বলা হয়। মিথ্যাভাষণ,
চুরি, ডাকাতি, মাদকজাতীয় দ্রব্য সেবন, সামাজিক ব্যভিচার সম্যক কর্ম অনুসারে গর্হিত অপরাধ। এ রকম পাপময় বিষয়কে
পরিহার করে নির্দোষ এবং নিষ্কুলষ জীবন ও কর্ম পরিচালনা করাই হলো সম্যক কর্ম। তিনটি দ্বার দিয়েই এ কর্ম সংঘঠিত
হয়। যথা ১. কায় দ্বার বা কায়িক ২. বাক্য দ্বার বা বাচনিক, এবং ৩. মনো দ্বার বা মানসিক। আমাদের সম্পাদিত সকল
কর্মই এ তিন দ্বারের যে কোন একটি দ্বারের মাধ্যমে সম্পাদন করা হয়।
সম্যক আজীব বা জীবিকা : ‘সম্যক আজীব বা জীবিকা’ বলতে আমরা বুঝি সৎ বা পবিত্র জীবিকা। এটাকে আবার নির্দোষ
জীবিকাও বলা যায়। এখানে সম্যক জীবিকা বলতে এমন জীবিকাকে বোঝানো হয়েছে যাতে বুদ্ধের অনুজ্ঞা লঙ্ঘিত না
হয়। বুদ্ধ নির্দেশিত এবং প্রদর্শিত পঞ্চনীতিতে যেগুলো বর্জন করার উপদেশ রয়েছে সেগুলো বর্জন করে জীবিকা অবলম্বন
করা বাঞ্চনীয়। সুন্দর এবং মনোময় জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে বৌদ্ধধর্মে পাঁচ প্রকার বাণিজ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এগুলো হলো যথাক্রমেÑক. মৎস ব্যবসা খ. মাংস ব্যবসা গ. অস্ত্র ব্যবসা ঘ. বিষ ব্যবসা এবং ঙ মাদকজাতীয় দ্রব্য ব্যবসা।
চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী, প্রতারক, শঠক, প্রবঞ্চক, উৎকোচ গ্রহণকারীকে সবাই ঘৃণা করে। কারণ এগুলো সুন্দর এবং
আদর্শ জীবিকা নয়। সৎ এবং জ্ঞানী ব্যক্তিরা সবসময় সম্যক জীবিকার মাধমে জীবনযাপনে উৎসাহবোধ করেন। এ রকম
জীবিকা নির্বাহ করাই বৌদ্ধধর্মে প্রশংসিত।
সম্যক ব্যায়াম বা প্রচেষ্টা : মন হতে সকলপ্রকার খারাপ চিন্তা-চেতনা প্রকৃষ্টরূপে বিদূরিত করার সচেতনাই হলো ‘সম্যক
ব্যায়াম বা প্রচেষ্টা’ । এটার প্রধান উদ্দেশ্য হলো মনে কুচিন্তা-চেতনা প্রবেশ করতে না দেওয়া। সম্যক ব্যায়াম বা প্রচেষ্টা চার
প্রকার। সেগুলো হলো :
ক. অনুৎপন্ন অকুশল বিষয় মনে উৎপন্ন হতে না দেওয়া।
খ. উৎপন্ন অকুশল চিন্তা মন থেকে পরিহার করা ।
গ. অনুৎপন্ন কুশল চিন্তা মনে উৎপন্ন করা।
ঘ. উৎপন্ন কুশল চিন্তা সর্বদা সংরক্ষণ করা।
মানুষ সম্যক প্রচেষ্ট ছাড়া কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে কখনো পৌঁছাতে পারে না। সম্যক প্রচেষ্টা অনুযায়ী সবাই কাক্সিক্ষত বস্তু লাভ
করতে পারে। বিদ্যা, ধন, জ্ঞান এবং ধ্যানের জন্য সম্যক প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে। প্রচেষ্টার মাধ্যমে বুদ্ধত্ব লাভ করতে
সক্ষম হয়েছিলেন।
সম্যক স্মৃতি : স্মৃতি অর্থাৎ স্মরণ বা ধারণ করা। দৈহিক এবং মানসিক সকল প্রকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষণ করে
স্মরণ রাখাকে বৌদ্ধ পরিভাষায় স্মৃতি বলে। অন্যভাবে বলা যায়, কুশল অবলম্বন পুনঃপুন স্মরণ করার নামই স্মৃতি। দেহ
অনিত্য, আত্মীয়-স্বজন অনিত্য, বন্ধু-বান্ধব অনিত্য, জাগতিক বিষয়বস্তু অনিত্য, ধন সম্পদ অনিত্য। বলা যায়, নিজের
অস্তিত্ব এবং বিশ্বপ্রবাহ অনিত্য। এগুলোর নিজস্ব কোনো সত্তা নেই তা মনে রাখাই হলো ‘সম্যক স্মৃতি’।
সম্যক স্মৃতি চার প্রকার। যথা
১. কায়ানুদর্শন : শরীরের ভিতরে এবং বাইরে দর্শন করাই হলো কায়ানুদর্শন।
২. বেদনানুদর্শন : দেহের সুখ এবং দুঃখানুভূতি অনুভব করাই হলো বেদনানুদর্শন।
৩. চিত্তানুদর্শন : মন বা চিত্তের সকল অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়াই হলো চিত্তানুদর্শন।
৪. ধর্মানদর্শন : সেবনীয় ধর্ম, অসেবনীয় ধর্ম, বর্জনীয়, অবর্জনীয়, কল্যাণ, অকল্যাণ ইত্যাদি সর্ম্পকে দর্শনই হলো
ধর্মানুদর্শন।
সম্যক সমাধি : চিত্তের একাগ্রতাই হলো সম্যক সমাধি। ব্যাপক অর্থে সর্বদা, সকল বিষয়ে চিত্তের সচেতন একাগ্রতাই
‘সম্যক সমাধি’। অর্থাৎ একটি বিশেষ বিষয়ের উপর মনকে নিবিষ্ট করা। অর্থাৎ তীব্র কামনা-বাসনা, লোভ-দ্বেষ-মোহ, হিংসা
প্রভৃতি মনোভাব হতে মুক্ত হয়ে একটি নিরাসক্ত দৃষ্টিভঙ্গীতে উন্নীত হওয়া এবং ঐ অবস্থায় নিজের আপনচিত্তকে সংযত
করার মহান সাধন প্রক্রিয়াই হলো সম্যক সমাধি। মিলিন্দ প্রশ্ন নামক গ্রন্থে সমাধির লক্ষণ বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে ;
‘সকল কুশল কর্মই সমাধি মুখ, সমাধি নিম্ন’। অর্থাৎ রণক্ষেত্রে যেমন হাতী, ঘোড়া, রথ, পদাতিক বাহিনী প্রভৃতি যুদ্ধের
সাজ-সজ্জা রাজাকে অনুসরণ করে, রাজাকে রক্ষার জন্য নিয়োজিত থাকে ঠিক তেমনি সমাধিও। সমাধিস্থ ব্যক্তিই একমাত্র
যথাযথ জ্ঞান লাভ করতে পারে।
আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গে অঙ্গসমূহকে প্রজ্ঞা, শীল এবং সমাধি ভেদে তিনভাগে বিভাজন করে দেখানো হয়েছে। সম্যক দৃষ্টি
ক. প্রজ্ঞা - সম্যক সংকল্প
সম্যক বাক্য
খ. শীল - সম্যক কর্ম
সম্যক জীবিকা
সম্যক ব্যায়াম বা প্রচেষ্টা
গ. সমাধি- সম্যক স্মৃতি
সম্যক সমাধি
আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ হলো একটি প্রস্তুতির পথ। প্রত্যক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বাহিরে থেকেও শুধু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা
যে কোন মানুষ পুত-পবিত্র, শান্তিময় জীবনযাপন করতে পারে তার একটি বিশুদ্ধ পদ্ধতি কিংবা নির্দেশনা এখানে রয়েছে।
এগুলো নাগরিক জীবনে অনুশীলিত হলে স্থিতিশীল পরিবার, সমাজ সর্বোপরি রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন: ১৮.১
এক কথায় উত্তর দিন
১. আর্যসত্যের শব্দগত অর্থ কী?
২. চারি আর্যসত্য কী কী?
৩. মানুষ কিসে আচ্ছন্ন?
৪. প্রকৃত সুখের অধিকারী কারা?
৫. আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ শব্দের আভিধানিক অর্থ কী?
৬. আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের কয়টি অঙ্গ?
৭. সম্যক দৃষ্টি কয়ভাগে বিভাজিত?
৮. সম্যক ব্যায়াম বা প্রচেষ্টা কয় প্রকার?
৯. সম্যক স্মৃতি কয় প্রকার?
১০. আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের অঙ্গসমূহকে কয়ভাগে ভাগ করে দেখানো হয়েছে?
সংক্ষিপ্ত উত্তর দিন
১. আর্যসত্য বলতে কী বুঝায়?
২. দুঃখ আর্যসত্য কী?
৩. দুঃখ সমুদয় আর্যসত্য কী?
৪. দুঃখ নিরোধ আর্যসত্য কী?
৫. চারি আর্যসত্যকে বৌদ্ধদর্শনে কী বলা হয়?
৬ আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ কাকে বলে?
৭ সম্যক জীবিকা বলতে কী বোঝেন?
৮. সম্যক প্রচেষ্টা বলতে কী বোঝেন?
৯. সম্যক স্মৃতি বলতে কী বোঝেন?
রচনামূলক প্রশ্ন
১. চারি আর্যসত্য বলতে কী বোঝ? চারি আর্যসত্য সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা লিখুন।
২. আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলতে কী বুঝ? সমাজজীবনে আর্য অষ্টাঙ্গিকের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিনা-লিখুন।
৩. সম্যক স্মৃতি এবং সম্যক সমাধি সম্পর্কে আপনি যা জানেন আলোচনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]