. শীল কী? শীলপালনের সুফল সর্ম্পকে বিস্তারিত আলোচনা কর

শীলের পরিচয়
বুদ্ধের শিক্ষায় ব্যক্তিজীবন এবং সমাজজীবনকে সুন্দর, নিষ্কলুষ ও পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা
হয়েছে। ব্যক্তি জীবনের নৈতিক উৎকর্ষ ছাড়া জীবনে সফলতা কখনো আসে না । নৈতিক শিক্ষাকে বাদ দিয়ে প্রজ্ঞা এবং সমাধি লাভ হয় না। ত্রিপিটকের বিভিন্ন গ্রন্থে নৈতিক শিক্ষার উপদেশ রয়েছে
এবং সেগুলো মানুষের নীতিবোধকে জাগ্রত করে ও উন্নত সমাজগঠনের পরিকল্পিত চিন্তা-চেতনায় অনুপ্রাণিত করে। বিনয়
পিটকে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। মানুষের ইন্দ্রিয়সমূহকে সংযত করে, দমগুণ অভ্যাস ও অনুশীলনের
মাধ্যমে পরিপূর্ণ মানবসত্তার বিকাশ ঘটানো অন্যতম লক্ষ্য। এখানে অসদাচরণজনিত বিক্ষিপ্ত, দৈহিক, বাচনিক ও মানসিক
অপক্রিয়ার পরিত্যাগের নির্দেশনাও রয়েছে।
শীলপালনের গুরুত্ব
শীল অর্থাৎ নিয়ম-নীতি, নৈতিকতা, শৃঙ্খলাবোধকে ‘শীল’ বলে। ইংরেজীতে যাকে সড়ৎধষরঃু বলা হয়। ‘শীল’ হলো
কতকগুলো নিয়ম-নীতির সমষ্টি। সদাচার এবং সৎ চরিত্রও শীলার্থে ব্যবহৃত হয়। শীলের প্রধান লক্ষণ হলো মহত্ত¡তার দ্বারা
হীনতার অপসারণ করা। বৌদ্ধধমের্র পবিত্র ধর্মীয়গ্রন্থ ত্রিপিটকে উলে খ আ - ছে, ‘বিনয নাম বুদ্ধ আযু। বিনয ঠিতে সাসনং
ঠিতো হোতি’। অর্থাৎ শীল বা বিনয় বুদ্ধ শাসনের আয়ু স্বরূপ। বিনয়ের স্থিতিতেই বুদ্ধ শাসনের স্থিতি নির্ভরশীল। মহামতি
গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের কিছুদিন পরেই বিনয় (শীল) সম্পর্কিত বিষয় অনুধাবন করে প্রথম বৌদ্ধ সংগীতির মাধ্যমে
বিনয় এবং ধর্ম সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এটিই বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থনার মূলভিত্তি।
জগতের সবই নিয়ন্ত্রণাধীন। প্রকৃতিরও নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ নীতি রয়েছে। নিয়ম কিংবা নীতি বিরুদ্ধ হয়ে উচ্ছৃঙ্খলভাবে কোনো
কিছুই টিকে থাকতে পারে না। গ্রহ, নক্ষত্র, ঋতুচক্র নিয়মে আবর্তিত হয়। পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্য, আকাশের সূর্যরশ্মি,
রংধনুর বর্ণের সমারোহ, অঙ্কুরিত তৃণখন্ড পর্যন্ত একটি কার্যকারণ নীতিতে আবদ্ধ। নিয়ম বর্হিভূত কোনো কিছুরই বৃদ্ধি ও
বিনাশ কিংবা স্থায়িত্ব আশা করা যায় না। কেননা প্রত্যেকটি বিষয়ই কার্য-কারণ নিয়মে আবদ্ধ। মানুষের সার্বিক উন্নতি
কিংবা কল্যাণে এ নিয়ম-নীতির প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় এটি উপলব্ধি করা যায়। অসংযমতা,
অনৈতিকতা, অমিতব্যয়িতা, আলস্য পরায়ণতা, উদ্যমহীনতা, উৎসাহীনতা প্রভৃতি উন্নতির পরিপন্থী। অপর দিকে নিয়ম,
শৃঙ্খলা, সংযম, নৈতিকতা, স্থিরতা, ধীরতা , আত্মত্যাগ, চরিত্রবল, শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা, নিয়মানুবর্তিতা, উদ্যম এবং উৎসাহ
ইত্যাদি জীবনে উন্নতির সহায়ক শক্তি। বিনয় বা শীল চলার পথের পাথেয় ও মানবজীবনের মুকুট স্বরূপ। বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশায় এ সত্যকে প্রকৃষ্টরূপে উপলব্ধি করেছেন।
শীলপালনের উদ্দেশ্য
চারিত্রিক কল্যাণ সাধন প্রত্যেক মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। চরিত্রবান ব্যক্তি সর্বক্ষেত্রে যশ, খ্যাতি, প্রশংসা লাভ করে। সুন্দর
এবং পবিত্র জীবনযাপন করাই হচ্ছে শীলপালনের অন্যতম উদ্দেশ্য। শীলপালনের মাধ্যমে সচরাচর চারিত্রিক গুণাবলী অর্জিত হয়। যথা :
১. মানুষের কায়িক, বাচনিক এবং মানসিক সংযমতা আসে।
২. মনের লোভ, দ্বেষ, মোহ, সন্দেহ বিদূরিত হয়ে মন শান্ত ও প্রফুল থাকে। -
৩. সবধরণের অশুভ চিন্তা দূর হয়।
৪. ক্রোধ কিংবা হিংসাভাব দূর হয়।
৫. মানবিক কল্যাণবোধ জাগ্রত হয়।
৬. সকল প্রকার পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা যায়।
৭. আদর্শবান ও ন্যায়পরায়ণ হওয়া যায়।
৮. আধ্যাত্মিক এবং আদর্শ জীবন গঠনে সহায়তা করে।
শীলপালনের নিয়ম বা পদ্ধতি
প্রতিটি বিষয় পালনের কতকগুলো নিয়ম বা পদ্ধতি আছে যা শীলপালনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে শীল পালনকারীদের
নিন্মোক্ত নিয়মগুলো মেনে চলতে হয়। যেমন :
১. উচ্চারিত প্রতিটি শীল উৎসাহ সহকারে পালন করতে হয়।
২. আচরণের ক্ষেত্রে সংযমতা প্রর্দশন করতে হয়।
৩. পবিত্র মনের অধিকারী হতে হয়।
৪. ধর্মের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা রাখতে হয়।
৫. সর্বদা ভালো চিন্তা করতে হয়।
৬. মৈত্রী পরায়ণ হতে হয়।
৭. লোভ-দ্বেষ-মোহের বশীভূত না হওয়ার চেষ্টা করতে হয়।
৮. অন্যের ক্ষতি হয় এমন কাজ না করার অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হয়।
উপরি-উলি খিত শীলপালনের নিয়মগুলো পালন করা সকলেরই কর্তব্য। এগুলো - পরিশুদ্ধ এবং বিশুদ্ধ শীলপালন সহায়তা
করে। সম্যকভাবে শীলপালন করতে না পারলে কখনো শীলের সুফল লাভ হয় না।
শীল আচরণের মূল উপাদান হলো পঞ্চনীতি বা পঞ্চশীল বা গৃহীশীল, অষ্টশীল বা অষ্টনীতি বা উপোসথ শীল, দশশীল বা
দশনীতি, আজীবটাঠম্ক শীল বা সদাচরণ নীতি এবং চতুপরিশুদ্ধ শীল বা পবিত্রতার নীতি শীল।
১. পঞ্চশীল বা পঞ্চনীতিগুলো হলো :
ক. প্রাণি হত্যা হতে বিরত থাকা।
খ. অদত্তবস্তু গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।
গ. অবৈধ যৌন সম্পর্ক হতে বিরত থাকা।
ঘ. মিথ্যাভাষণ হতে বিরত থাকা।
ঙ. সকল প্রকার মাদকজাতীয় দ্রব্য সেবন ও গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।
২. অষ্টশীল বা অষ্টনীতিগুলো হলো :
ক. প্রাণী হত্যা হতে বিরত থাকা।
খ. অদত্তবস্তু গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।
গ. অব্রহ্মচর্য থেকে বিরত থাকা।
ঘ. মিথ্যাভাষণ হতে বিরত থাকা।
ঙ. সকল প্রকার মাদকজাতীয় দ্রব্য সেবন ও গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।
চ. বৈকালিক ভোজন থেকে বিরত থাকা।
ছ. মাল্যগন্ধপুষ্প-এর ব্যবহার এবং দেহ সৌন্দর্য বিধানের জন্য সুগন্ধি তৈল বা চূর্ণ বা প্রসাধনাদির অনুলেপন থেকে বিরত
থাকা।
জ. উচ্চ এবং আরাম শয্যায় উপবেশন বা শয়ন থেকে বিরত থাকা।
৩. দশশীল বা দশ নীতিগুলো হলো :
ক. প্রাণী হত্যা হতে বিরত থাকা।
খ. অদত্তবস্তু গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।
গ. অব্রহ্মচর্য থেকে বিরত থাকা।
ঘ. মিথ্যাভাষণ হতে বিরত থাকা।
ঙ. সকল প্রকার মাদকজাতীয় দ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকা।
চ. বৈকালিক ভোজন থেকে বিরত থাকা।
ছ. নৃত্যগীতি বাদ্য শ্রবণ-দর্শন এবং ব্যবস্থপনা থেকে বিরত থাকা।
জ. মাল্যগন্ধপুষ্প-এর ব্যবহার এবং দেহ সৌন্দর্য বিধানের জন্য সুগন্ধি তৈল বা চূর্ণ বা প্রসাধনাদির অনুলেপন থেকে বিরত থাকা।
ঝ. উচ্চ আরামপ্রদ শয্যায় উবেশন বা শয়ন থেকে বিরত থাকা
ঞ. স্বর্ণ এবং রৌপ্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা।
শীলপালনে সুফল
শীলপালনের সুফল সর্ম্পকে বুদ্ধ তাঁর ধর্ম প্রচারের সময় তদানীন্তন ভারতবর্ষের পাটলীগ্রামে উপস্থিত হয়ে পাঁচটি উপদেশ
প্রদান করেছিলেন। সেই উপদেশগুলো হলো নিম্নরূপ :
১. শীলবান ব্যক্তি উৎসাহ সহকারে শীলপালনে রত থেকে প্রচুর ধন সম্পদ অর্জন করেন।
২. শীলপালনের দ্বারা শীলবান ব্যক্তির সুকীর্তি বাতাসের অনুকূল-প্রতিকূল উভয় দিকে প্রবাহিত হয়।
৩. শীলবান ব্যক্তি ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, গৃহপতি এবং শ্রামণের পরিষদে নির্ভয়ে উপস্থিত হন।
৪. শীলবান ব্যক্তি শীলপালনের দ্বারা সজ্ঞানে মৃত্যু হয়।
৫. শীলবান ব্যক্তি মৃত্যুর পর স্বর্গলোক প্রাপ্ত হন।
এছাড়া এ বিষয়ে তিনি আরো বলেন ; শীলপালনের মাধ্যমে ভোগসম্পত্তি লাভ এবং নির্বাণ লাভ কর যায়।
বৌদ্ধধর্মে শীলকে রক্ষাকবচ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই শীল পরিপালনের মাধ্যমে চরিত্র সংশোধন করা যায়,
পবিত্রতার সাথে জীবনযাপন করা যায়, সর্বোপরি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া যায়। উপরি-উক্ত শীলগুলোর মধ্যে পঞ্চশীল
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একে গৃহীশীলও বলা যায়। প্রত্যেক বৌদ্ধ মাত্রই পঞ্চশীল পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ। পঞ্চশীলের অন্ত
র্নিহিত অর্থে দেখা যায়, এগুলো শুধু বৌদ্ধদের জন্য নয় বরং সমগ্র মানবজাতির নৈতিকজীবন গঠনেও বলিষ্ট ভূমিকা রাখতে
পারে। পঞ্চশীল পরিপূর্ণ আদর্শ জীবনশৈলী এবং সর্বজন কল্যাণপ্রদ আচার-সংস্থান। শীল বা নীতিগুলো পালনের দ্বারা মানুষ
সৎ চরিত্রের অধিকারী হয়। পরিবারে, সমাজে এবং দেশে সুখ-শান্তি সমৃদ্ধি সুরক্ষিত হয়। অন্যান্য শীলগুলো বা নীতিগুলো
সন্ন্যাসধর্ম সম্পর্কিত। বিশেষ করে বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং ভিক্ষুনীদের ক্ষেত্রে এই শীল বিচ্যূতি ‘বিনয়’ বিরোধী বলে বিবেচিত।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন: ১৫.২
এক কথায় উত্তর দিন
১. শীল-এর আভিধানিক অর্থ কী?
২. বৌদ্ধধর্মের মূলভিত্তি কী?
৩. শীলবান কারা?
৪. পঞ্চশীল কী?
৫. অষ্টশীল কী?
৬. মানুষের পরম সম্পদ কী?
৭. শীলপালনের উদ্দেশ্য কী?
৮. পঞ্চশীলের অপর নাম কী?
৯. অষ্টশীলের অপর নাম কী?
১০. চারিত্রিক গুণাবলী কিসের দ্বারা অর্জিত হয়?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. শীলপালনের নিয়মাবলী বর্ণনা করুন।
২. পঞ্চশীলগুলো লিখুন।
৩. অষ্টশীলগুলো লিখুন।
৪. দশশীল কারা পালন করেন লিখুন।
রচনামূলক প্রশ্ন
১. শীল কী? শীলপালনের সুফল সর্ম্পকে বিস্তারিত আলোচনা করুন।
২. শীলপালনের গুরুত্ব নিজের ভাষায় তুলে ধরুন।
৩. শীল সর্ম্পকে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]