কর্ম কাকে বলে জান কর্মের উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে জানতে পারবে বৌদ্ধ কর্মবাদ

কর্মের ধারণা
কর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বৌদ্ধধর্মের মূলতত্ত¡ই হলো কর্মবাদ। বৌদ্ধ পরিভাষায় ‘কর্ম’ বলতে কুশল-অকুশল বা ভালোমন্দ ইচ্ছা বা প্রবৃত্তিকেই কর্ম বলা হয়। অর্থাৎ চেতনায় জাগ্রত হলেই তাকে কর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয়। অন্যকথায় বলা
যায়, চিত্ত ও চৈতসিকের কায়িক, বাচনিক এবং মানসিক অভিব্যক্তিই কর্ম। সকলপ্রকার কর্ম আগে চিত্তে উৎপন্ন হয়। তারপর
কায় সহযোগে তা সংগঠিত হয়। বৌদ্ধধর্মে কর্মকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন করা হয়েছে। বৌদ্ধধর্ম মতে, শুধু কোনো
কিছু করাই কর্ম নয়, মন বা চিত্তের চেতনা বা ইচ্ছাকেও কর্ম বলা হয়।
কর্মের উপত্তিস্থল
সাধারণত মানুষের মন বা চিত্ত অস্থির কিংবা চঞ্চল। অস্থির কিংবা চঞ্চল চিত্তে ভাল-মন্দ, কুশল-অকুশল বিভিন্ন চেতনা বা
ইচ্ছা জাগ্রত হয়। এ রকম ভাল-মন্দ, কুশল-অকুশল চেতনা বা ইচ্ছা সমূহ কর্ম নামে অভিহিত করা হয়। সুতরাং চিত্ত বা
মনকে সকল কর্মের মূল উৎপত্তিস্থল বলা হয়। বৌদ্ধধর্ম মতে, যে যেমন কর্ম করবে তাকে তার সম্পাদিত স্ব-স্ব কর্মের ফল
ভোগ করতে হবে। বুদ্ধ ত্রিপিটকের অর্ন্তগত অঙ্গুত্তর নিকায় নামক গ্রন্থে বলেছেনÑ ‘চেতনাহং ভিক্খবে কম্মং বদামি’।
অর্থাৎ হে ভিক্ষুগণ! আমি চেতনা বা ইচ্ছাকে কর্ম বলি।
সুতরাং নিজ ইচ্ছায় কিংবা স্বেচ্ছা প্রণোদিত কর্মই বৌদ্ধ মতে কর্ম। যে কর্মে কর্তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংযুক্তি নাই। অর্থাৎ
কর্তার ইচ্ছায় বা জ্ঞাতনুসারে সম্পাদিত হয় না তা কর্ম বলে অভিহিত হতে পারে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আমার
মনের অজ্ঞাতসারে যদি আমার কর্তৃক মিথ্যাভাষিত হয় এবং বায়ুমণ্ডলস্থ অসংখ্য ক্ষুদ্রানুক্ষুদ্র জীব আমার অজ্ঞাতসারে শ্বাসপ্রশ্বাসের দ্বারা হত হয়। এমতাবস্থায় সেই মিথ্যাভাষণ এবং প্রাণিহত্যা আমার দ্বারা কৃতকর্ম বলে স্বীকৃতি পাবে না এবং তার
জন্য কোনোরকম ফলভোগ করতে হবে না। এখানে বৌদ্ধ মতে কর্মই ধর্ম। কর্মই জীবনের নিয়ন্তা অর্থাৎ জীবন কর্মময়।
কর্মক্ষয়ে মানুষ পরম মুক্তি লাভ করতে পারে। বৌদ্ধ ধর্মে এ পরম মুক্তিকে নির্বাণ বলা হয়।
বৌদ্ধ কর্মবাদ
পৃথিবীর সকল মানুষের স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ একই রকম নয়। ‘মিলিন্দ প্রশ্ন’ নামক গ্রন্থে মানুষে মানুষে ভিন্নতা
প্রসঙ্গের রাজা মিলিন্দ-এর প্রশ্নোত্তরে ভিক্ষু নাগসেন বলেছিলেন ; এগুলো নিজের কর্মের কারণে হয়। কেউ অল্পায়ু, কেউ
দীর্ঘায়ু, কেউ রোগী, কেউ নিরোগী, কেউ সুশ্রী, কেউ বিশ্রী, কেউ দুর্বল, কেউ সবল, কেউ ধনী, কেউ ধনহীন, কেউ নীচ,
কেউ কুলীন, কেউ জ্ঞানী, কেউ অজ্ঞানী, ইত্যাদি নিজেরই কর্মফল দ্বারা সৃষ্ট। তিনি আরো বলেন ; সকল বৃক্ষের ফল সমান
হয় না। কিছু অমবল, কিছু লবণাক্ত, কিছু কটু, কিছু কুলুষযুক্ত, কিছু মধুর রসযুক্ত। এগুলো বীজের নানাত্ব হেতু বা
কারণেই হয়। এভাবে কর্মের নানাত্বহেতু সকল মানুষ সমান হয় না। কারণ প্রাণী মাত্রই কর্মের অধীন। বুদ্ধের মতে, এ
বিভিন্নতার অন্যতম কারণ হলো কর্ম। বৌদ্ধধর্মে এটি-ই কর্মতত্ত¡ কিংবা কর্মবাদ নামে অভিহিত।
কর্মই প্রাণিগণকে হীন-শ্রেষ্ঠ, উচুঁ-নীচু নানাবিধভাবে বিভাজন করে। জীবের সুখ এবং দুঃখের দাতাও কেউ নয়। এগুলো
কর্মেরই প্রতিক্রিয়া । বুদ্ধ ‘সুত্ত নিপাত’ নামক গ্রন্থ বলেছেনÑ
ন জচ্চা ব্রাহ্মণো হোতি, ন জচ্চা হোতি অব্রাহ্মণো
কম্মুনা ব্রাহ্মণো হোতি, কম্মুনা হোতি অব্রাহ্মণো
অর্থাৎ-জন্ম দ্বারা কেউ ব্রাহ্মণ হয় না, জন্ম দ্বারা কেউ অব্রাহ্মণও হয় না; কর্ম দ্বারাই ব্রাহ্মণ হয়, কর্ম দ্বারাই অব্রাহ্মণ হয়।
কস্সকো কম্মুনা হোতি, সিপ্পিকো হোতি কম্মুনা ;
বাণিজো কম্মুনা হোতি, পেস্সিকো হোতি কম্মুনা।
অর্থাৎ কর্ম দ্বারা কেউ চাষী হয়, কর্ম দ্বারা কেউ কারিগর (শিল্পী) হয়, কর্ম দ্বারা মানুষ বণিক এবং কর্ম দ্বারা চাকর হয়।
কম্মুনা বত্ততি লোকো, কম্মুণা বত্ততি পজা
কম্ম নিন্ধনা সত্তা, রথস্সানীব যাযতো।
অর্থাৎ কর্মের মাধ্যমে সমগ্র জগৎ সচল। কর্মের মাধ্যমে মানব জন্মের সৃষ্টি। চাকার আলোর উপর নির্ভর করে যেমন রথ চলে
তেমনি সকল প্রাণী নিজ নিজ কর্মের উপর নির্ভরশীল।
কর্মফল জীবকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। কর্ম ও কর্মফলের মধ্যে এক অদৃশ্য যোগসূত্র রয়েছে। সেই কারণে প্রত্যেককে
যে কোনো রকমের কাজ সম্পন্ন করার আগে ভাল-মন্দ, কুশল-অকুশল, শুভ-অশুভ এবং তার পরিণতি সম্বন্ধে চিন্তা করা একান্তই প্রয়োজন রয়েছে।
কর্মের দ্বার
কর্মের দ্বার তিনটি। যথা : ক. কায় দ্বার, খ. বাক্য দ্বার, এবং গ. মন দ্বার। এ তিন দ্বারের মাধ্যমে জীবগণ নিরবিচ্ছিন্ন
কর্মপ্রবাহে নিয়োজিত। তাতে এক মুহূর্তের কোনোরকম বিশ্রাম নেই। কোনো কোনো কর্মে তিনটি দ্বার, কোনোটি কর্মে দুটি
দ্বারা আবার কোনো কোনা কর্মে কেবল মাত্র একটি দ্বার একত্রে নিয়োজিত। এ তিন দ্বার দিয়ে সম্পাদিত কর্মের কোনটি শুভ,
কোনটি অশুভ আবার কোনটি নিরপেক্ষ। শুভ-অশুভ, ভাল-মন্দ এবং নিরপেক্ষ যে কোনো কর্মই সম্পাদিত হোক না কেন স্ব
-স্ব কৃত কর্মের ফল অবশ্যই প্রত্যেককে ভোগ করতে হবে। শুভ বা ভাল কর্ম শুভফল, অশুভ বা মন্দ কর্ম অশুভ ফল এবং
নিরপেক্ষ কর্ম নিরপেক্ষ ফল প্রদান করে। শুভ বা ভালকর্মের ফল সুগতিসম্পন্ন এবং অশুভ বা মন্দকর্মের ফল দূর্গতিকারক।
কর্মের শ্রেণী বিভাজন
কর্ম প্রধানত চার প্রকার। যেমন : ক. জনক কর্ম, খ. উপস্তম্ভক কর্ম, গ. উপপীড়ক কর্ম এবং ঘ. উপঘাতক কর্ম।
ক. জনক কর্ম : ইহ জন্মে ও পূর্ববর্তী জন্মে সম্পাদিত কর্মে যে কোনো বিষয় মানুষের মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে স্মরণে আসা
স্বাভাবিক। বস্তুত বেশী অভ্যস্থ কর্ম সমূহই এ সময় চিত্তের অবলম্বন হয়। এ অবলম্বন বা অবলম্বন কুশল এবং অকুশল
যা-ই হোক না কেন এটি পরবর্তী জন্মের মধ্যে প্রভাব ফেলে। এটিই হলো জনক কর্ম।
খ. উপস্তম্ভক কর্ম : জনক কর্মের প্রায় কাছাকাছি একটি কর্ম পর্যায় এটি। ‘উপস্তম্ভক’ শব্দের অর্থ হলো উপকারী বা
সহায়তাকারী। সুতরাং পস্তম্ভক কর্ম’ বলতে জীবের জীবিতাবস্থায় উৎপন্ন হয়ে যে পূর্বচেতনা বা জনক কর্মের সহায়তা
বা আনুকুল্য বা পরিপোষকতা করে তার ফলোৎপাদনে সাহায্য করে তাকে বোঝায়। এটি কুশল কিংবা অখুশল দুই-ই
হতে পারে। কুশল জনককর্মের উপস্তম্ভক অবশ্যই কুশল। অনুরূপভাবে অকুশল জনককর্মের উপস্তম্ভক অকুশল হয়।
গ. উপপীড়ক কর্ম : যে কর্ম চেতনা জনককর্মের অন্তরায় সৃষ্টি করে এবং উপস্তম্ভক কর্মের সাথে বিরোধিতা করে তাকে
উপপীড়ক বা উৎপীড়ক কর্ম বলে। এখানে উপপীড়ক কর্ম অকুশলজনক কর্মকে ফল প্রদানে বাধা দান করে। উপপীড়ক
কর্ম সবসময় জনককর্মের বিপরীতে অবস্থান করে।
ঘ. উপঘাতক কর্ম : এ রকম কর্ম উপপীড়ক কর্মের ন্যায় জনককর্মকে শুধু বাধা প্রদান করে না। সেখানে সে নিজেকে
প্রতিষ্ঠা করার জন্য কর্মতীব্রতাকে ধ্বংস করে। অজ্ঞাতে ও অতর্কিতে সুবিধানুসারে এ কর্মের সূচনা হয়। প্রবাহমান কর্মের উপর হঠাৎ বাধা সৃষ্টি নতুন কর্মকে প্রতিষ্ঠা করাই উপঘাতক কর্ম।
মানবকূলে সচরাচর সবাই লোভ, দ্বেষ, এবং মোহাসক্ত হয়। অবিদ্যাজনিত কারণে অকুশল প্রবৃত্তিতে আকৃষ্ট হয়ে সবাই
তিনটি দ্বার দিয়ে নতুন নতুন কর্ম সম্পন্ন করে। ফলে কর্মপ্রবাহ জন্ম-জন্মান্তরে চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান থাকে। কর্মপ্রবাহ
রোধ করার মধ্য দিয়ে পরম মুক্তি লাভ সম্ভব হয়। প্রজ্ঞাময় চিত্ত উৎপন্নকরণের মাধ্যমে তৃষ্ণাক্ষয়ে পরম শান্তি নির্বাণ
লাভ সম্ভব। তৈল শেষ হলে যেমন বাতির আগুন নিভে যায়, অনুরূপভাবে কর্মক্ষয়ে জীব বারবার জন্মজনিত দুঃখ হতে
মুক্তি লাভ করেন। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধের উক্তি ‘যাদের পুরাতন কর্মবীজ ক্ষয় হয়েছে, নতুন কর্ম উৎপন্নের সম্ভাবনা নেই,
তাদের পুনর্জন্মের হেতু নেই। সেই কর্মবীজ ক্ষয়প্রাপ্ত। তৃষ্ণামুক্ত পন্ডিতগণ তৈলহীন প্রদীপের ন্যায় নির্বাণ প্রাপ্ত হন’।
পরিশেষে বলা যায়, বৌদ্ধধর্মের মূলতত্ত¡ হল কর্মবাদ। এখানে জীবজগতে মানুষের দৈহিক, মানসিক জন্ম-মৃত্যু, গতিপ্রকৃতি, বৈষম্য ইত্যাদি কর্মজাত। সুতরাং কর্মকে বৌদ্ধধর্মে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সবাই কর্মের অধীন। এখানে কর্মের ফল সবাইকে ভোগ করতে হয়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন: ১৮.৬
এক কথায় উত্তর দিন
১. বৌদ্ধ পরিভাষায় কর্ম কী?
২. কর্ম কোথায় আগে উৎপন্ন হয়?
৩. মানুষের চিত্তের স্বভাব কী?
৪. কোন ধরনের কর্ম কর্ম নামে অভিহিত হয়?
৫. মানুষ কর্ম অনুসারে কী ভোগ করে?
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. কর্মের সংজ্ঞা প্রদান করুন।
২. কর্মে উৎপত্তিস্থলের পরিচয় দিন।
৩. বৌদ্ধকর্মের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরুন।
৪. বৌদ্ধ কর্মবাদের কয়েকটি উদাহরণ দিন।
৫. কর্মের দ্বার সম্পর্কে লিখুন।
৬. বৌদ্ধ কর্মের প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করুন।
রচনামূলক প্রশ্ন
১. বৌদ্ধ কর্মবাদ সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা প্রদান করুন।
২. কর্মের সংজ্ঞা প্রদান করে বৌদ্ধ কর্মের প্রকারভেদের পরিচয় দিন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]