বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ আরোচনা কর

মহামতি গৌতম বুদ্ধ খ্রিষ্টপূর্ব ছয়শত বছর পূর্বে জাতীয় জীবনের বিশেষ এক যুগ সন্ধিক্ষণে আবির্ভাব হয়েছিল। প্রাচীন
ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার এক চরম বির্পযয় দেখা দিয়েছিল। এ সময় বুদ্ধের জন্ম ও তাঁর ধর্ম
প্রচার তৎসমকালীন ভারতীয় চিন্তাধারায় আমুল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে অনেক রাজা-শ্রেষ্ঠী
বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। বুদ্ধের সমকালীন থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এ ভাবধারা বিরাজমান ছিল।
প্রাক্ বৌদ্ধযুগের সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা
সামাজিক অবস্থা
বুদ্ধ সমকালীন ভারতে বর্ণ-ব্যবস্থা খুবই চরম আকার ধারণ করেছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র - এ চারটি বর্ণই
সমাজজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। পরবর্তী কালে এ বর্ণ প্রথাই কঠোর জাতিভেদের জন্ম দেয়। এক কথায় এ ধরনের
প্রথাই ভারতীয় সমাজব্যবস্থাকে প্রায় পঙ্গু করে তোলে। এ যুগে ব্রাহ্মণদের প্রবল আধিপত্য ছিল। তারা সমাজ ব্যবস্থাকে
পরিচালনা করতেন এবং অপর দিকে শাস্ত্রপাঠ, যাগযজ্ঞ ও পৌরহিত্য করতেন। ক্ষত্রিয়েরা যুদ্ধ বিদ্যায় সিদ্ধ হস্ত ছিলেন।
রাজ্য পরিচালনায় তারা কৃতিত্ব অর্জন করতেন। বৈশ্যরা করতেন কৃষি কাজ, পশুপালন ও ব্যবসা-বাণিজ্য। শূদ্ররা সমাজের
নিচু স্তরে অবস্থান করে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থকতো। তাই শূদ্রের কপালে জুটতো অবজ্ঞা, অবহেলা ও লাঞ্চনা
জাতিভেদ প্রথা জন্মগত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ব্রাহ্মণেরা অহংকারী ও আরাম প্রিয় হয়ে উঠলেন। বৈশ্যরা বাণিজ্যে লক্ষèীর
আশীর্বাদ পুষ্ট হলেন। ভোগ-বিলাস ও সুখভোগে কালযাপন করতেন তারা। নারীদেরও সামাজিক মর্যাদা তেমন ভাল ছিল না।
ধর্মীয় অবস্থা
সে যুগে বৈদিক ক্রিয়াকলাপে দেশ আচ্ছাদিত ছিল। ব্রাহ্মণরা তাদের ধর্মীয় প্রচার অভিযান বৃদ্ধি করল। ধর্মের নামে যজ্ঞ
হতো, আর সেখানে পশুরক্তে রঞ্জিত হত সেই যজ্ঞ। ধর্ম যাজকরা যজ্ঞানুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচুর ধন-সম্পদ অর্জন করতে
লাগলেন। অন্যদিকে ইহ-পরকালের অপরিমেয় সুখ ও শান্তির বানী প্রচার করলেন বুদ্ধ। আশ্রম জীবনের চারটি ব্যবস্থা
বিরাজমান ছিল। ব্রহ্মচর্য জীবনে শাস্ত্র অধ্যয়ন করে গুরুগৃহে কাটাতে হতো। গার্হস্থ্যজীবন ছিল সংসারজীবন পালন করা।
বাণপ্রস্থ অবলম্বন করলে সংসার ত্যাগ করে অরণ্যে বাস করতে হতো। আশ্রম জীবন ছিল সন্ন্যাসব্রত। সন্ন্্যাসীরা মোক্ষ ও
শান্তি অনুসন্ধান করতেন। ছয় জন তৈর্থিক তাঁদের বিসদৃশ ধর্ম মতবাদ প্রচার করছেন। এ ছয়জন তৈর্থিক হলেন যথাক্রমে
Ñ পুরাণ কাশ্যপ, মো¹লী গোশাল, নিগ্রন্থ নাথপুত্র, অজিত কেশকম্বল, পকুধ কাত্যায়ান ও সঞ্জয়বেলট্টি পুত্র। এদের কেউ
বলতেন প্রাণি হত্যা, চুরি,মিথ্যা বললে পাপ হয় না। কেউ সুখ-দুঃখের কারণ বিশ্বাস করতেন না। বিশ্বাস করতেন মোক্ষ
লাভ করার জন্য বহুবার জন্ম গ্রহণ করতে হয়। আবার অন্যজন অজ্ঞানবাদে বিশ্বাস করতেন ধর্মকে কেউ দ্বৈত অর্থবোধক
হিসেবে প্রচার করতেন। নিগ্রন্থনাথ পুত্র যিনি মহাবীর নামেই সমধিক পরিচিতি ছিলেন। তিনি কর্মফলের উপর জোড়
দিতেন। এভাবে ধর্মীয় জীবনে চলছিল বহুমত ও পথের ব্যবহার। এ সময় সাধারণ মানুষ সঠিক ধর্ম কোনটি তা সহজে বেছে নিতে পারল না।
বুদ্ধের সমকাল : রাষ্ট্রীয় শাসন পদ্ধতি
বুদ্ধের সমকালে প্রাচীন ভারতে ষোলটি জনপদ ছিল এগুলো ‘ষোড়শ মহাজনপদ’ নামে পরিচিত। এ রাজ্যগুলো নানা ধারায়
শাসিত হতো। কোশল ও মগধ সর্ব বৃহৎরাজ্য ছিল। এগুলো স্থানীয় শাসক দ্বারা শাসিত হতো। তারা তাদেরকে কর দিত।
রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র উভয়ের সমন্বয়ে রাজ্য পরিচালনা করা হতো। শাক্যজাতি তাদের স্বজাতীয় প্রধানকে রাজা হিসেবে
নির্বাচন করতেন। বৃজি জাতি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী একটি জাতি। তাঁদের শৌর্য-বীর্য ও একতার দরুন মগধরাজ
বিম্বিসার ও কোশলরাজ প্রসেনজিৎ শংকিত থাকতেন। বৃজিরা আটটি গোত্র থেকে আটজন প্রতিনিধি নির্বাচন করে
রাজ্যশাসন ও বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। কৌশাম্বীর রাজা উদয়ন ও উজ্জয়নী রাজ চন্দ্রপ্রদ্যেৎ অনেকটা স্বাতন্ত্র্য রক্ষা
করতেন রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রে।
বুদ্ধের সময় কালে যে ক’জন শ্রেষ্ঠী বা ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অনাথপিন্ডিক এবং ধনঞ্জয় অন্যতম ছিলেন। অনেক
সময় রাজা আর্থিক সহায়তার জন্য তাঁদের শরণাপন্ন হতেন। কপিলাবস্তু, কৌশাম্বী, উজ্জয়নী, তক্ষশীলা, গান্ধার, শ্রাবস্তী,
রাজগৃহ, বৈশালী, প্রভৃতি নগরীগুলো ছির সমৃদ্ধশালী। তক্ষশীলার খ্যাতি ছিল বিশ্বব্যাপী। প্রজারা সামন্তরাজাদের কর
দিতেন। অন্যদিকে সামন্ত রাজারা তাঁদের আয়ের একটা অংশ ঊর্দ্ধতন রাজাদের নিকট প্রদান করতেন। বৌদ্ধধর্মে প্রচার -প্রসার
বুদ্ধ বারাণসীর ইসিপতন মৃগদাবে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের নিকট তাঁর প্রবর্তিত নবধর্ম সর্বপ্রথম প্রচার করেন। এ সময় রাজগৃহের
বিখ্যাত ধনী যশ প্রমুখ ৫৯ জন গৃহী বুদ্ধের ধর্মবাণী শুনে তাঁর ধর্মে দীক্ষা নেন। এদের নিয়েই সর্ব প্রথম সংঘ গঠিত হয়।
তাঁরা ধর্ম প্রচারের জন্য বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েন। এ সময় উরুবিল্বের কাশ্যপ নামক এক অগ্নি উপাসক তার ভাই এক
হাজার শিষ্য নিয়ে বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এতে বুদ্ধের নব ধর্মের প্রতি সাধারণ জনগণের শ্রদ্ধা এবং ভক্তি বৃদ্ধি পেতে
লাগলো। রাজণ্যবর্গের মধ্যে বারাণসীর মগধরাজ বিম্বিসার সবার আগে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। বিম্বিসারের অনুপ্রেরণায়
সংঘের অনেক নিয়মকানুন মগধের রাজধানী রাজগৃহের বেণুবনে বুদ্ধের অবস্থানের সময় বিধিবদ্ধ হয় বুদ্ধের বর্ষাবাসের জন্য
রাজা বিম্বিসার বেণুবন বিহার নির্মাণ করে বুদ্ধকে দান করেছিলেন।
কোশলরাজ প্রসেনজিৎ বুদ্ধের সমসাময়িক ছিলেন। প্রথমে তিনি আজীবক ধর্মের অনুসারী হলেও পরবর্তীতে বুদ্ধের প্রতি
শ্রদ্ধান্বিত হন। তিনিও বুদ্ধের ধর্ম প্রচারে সহায়তা করেছিলেন। রাজাকারাম বিহার প্রতিষ্ঠা তাঁর অবদান। অবন্তীর রাজা
চন্দ্রপ্রদোৎ মহাকাত্যায়ন স্থবিরের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি বৌদ্ধধর্মে প্রতি খুবই অনুরক্ত ছিলেন। তাঁরই ঐকান্তিক
প্রচেষ্টায় অবন্তী বৌদ্ধধর্মের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কৌশাম্বীর রাজা উদয়ন ভিক্ষু পিন্ডোল ভারদ্বাজের
নিকট বুদ্ধের ধর্মবাণী শ্রবণ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। বুদ্ধের সময়ে রাজগৃহ এবং শ্রাবস্তীর পরেই কৌশাম্বীর স্থান
গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বৌদ্ধধর্ম প্রচার-প্রসারে শ্রেষ্ঠী অনাথপিন্ডিক এবং শ্রেষ্ঠী ধনঞ্জয়-এর নাম কোন অংশে কম নয়। তাছাড়া
বুদ্ধের জন্য জেতবন বিহার মহাবিহার নির্মাণের কাহিনী অত্যন্ত চমকপ্রদ। মহা-উপাসিকা বুদ্ধের প্রতি খুবই শ্রদ্ধশীল
ছিলেন। রাজন্যবর্গ ও শ্রেষ্ঠীদের উদারতা, সহায়তা সর্বোপরি পৃষ্টপোষকতায় বৌদ্ধধর্মে প্রচার-প্রসার লাভ করে। বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসারের ইতিহাসে তাঁদের অবদান চিরস্মরণীয়।
মৌর্য যুগ
মৌর্য যুগকে বৌদ্ধধর্মে ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয়। কথিত আছে, মৌর্যবংশের দ্বিতীয় সম্রাট বিন্দুসার-এর মহাপ্রয়াণ হলে
তার একশত পুত্রের মধ্যে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে সংঘর্ষ ঘটে। এ সংঘর্ষকে কলিঙ্গ যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়।এ
সংঘর্ষে অশোক তাঁর বৈমাত্রীয় নিরানব্বই জন ভাইকে হত্যা করে মগধের সিংহাসনে আসীন হন। কলিঙ্গ যুদ্ধের বিভীষিকাময়
অবস্থা দেখে তাঁর মনের মধ্যে এক বৈপ বিক পরিবর্তন আসে। এ সময় নিে - গ্রাধ শ্রামণের নিকট বুদ্ধের ধর্মবাণী শ্রবণ করে
বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা লাভ করেন। বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে তিনি এ ধর্মের প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বুদ্ধ প্রবর্তিত
ধর্মনীতি অনুসারে আদর্শ জীবনযাপনের উপর অত্যাধিক জোর দেন। ধর্মের বাণী প্রচারের জন্য ধর্মমহামাত্র নামে একটি ধর্ম
প্রচারক পরিষদ নিয়োগ করে বিভিন্ন জনপদে প্রেরণ করেন। লোকশিক্ষা ও ধর্মবাণীগুলো পর্বতগাত্রে, প্রস্তরস্তম্ভে ও গুহায় খোদিত করেন। এগুলো অশোক স্তম্ভ নামে খ্যাত।
ভিক্ষুসংঘের মতানৈক্যে নিরসনে তিনি পাটলিপুত্রের অশোকারাম বিহারে এক বৌদ্ধ সংগীতি আহবান করেন। বৌদ্ধধর্মের
ইতিহাসে এটি তৃতীয় সংগীতি নামে অভিহিত। তবে বলা যায়, তাঁর পৃষ্টপোষকতায় বৌদ্ধধর্মে প্রচার-প্রসার যেভাবে বৃদ্ধি
পেয়েছিল অন্যকোন রাজার আমলে তা হয়নি।
কুষাণ যুগ
মৌর্যযুগে বৌদ্ধধর্মের বেশ প্রভাব থাকলেও শুঙ্গবংশের সময়ে কিছুটা ম্রিয়মান হয়ে পড়ে। তবে আশার কথা কুষাণ যুগে সে
ধারা আবার পুনরুজ্জীবিত হয়। কনিষ্ক ছিলেন কুষাণ বংশের সর্বশ্রেষ্ট নরাধিপতি। তিনি ভিক্ষু পাশ্বের উপদেশে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ
করেন। সদ্ধর্মের প্রচার-প্রসারে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি তাঁর ধর্মগুরু পাশ্বের পরামর্শ অনুযায়ী জরন্ধরে একটি বৌদ্ধ
সংগীতি আহবান করেন। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে এটি চতুর্থ সংগীতি নামে অভিহিত। এ সংগীতির মধ্য দিয়ে মহাযান ধর্ম মতবাদের উৎপত্তি হল। তাছাড়া সমগ্র ত্রিপিটকও সংস্কৃতভাষায় সংকলিত হয়।
সম্রাট কনিষ্ক মহাযান বৌদ্ধ মতবাদের অনুসারী ছিলেন। তাঁর অর্থায়নে ভিক্ষুদের বর্ষাবাসের জন্য পেশোয়ারে একটি বিহার
নির্মিত হয়। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে এটি কনিষ্ক মহাবিহার নামে পরিচিত। অশ্বঘোষ, পার্শ্ব, বসুবন্ধু, বসুমিত্র, নার্গাজুন দিঙনাগ
প্রভৃতি বৌদ্ধ আচার্যগণ তাঁর সার্বিক সহযোগিতা এবং আনুকূল্যতা লাভ করেন। সংগীতি শেষে তিনি নেপাল, তিব্বত, চীন
মঙ্গেলিয়া প্রভৃতি দেশে বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারক পরিষদ প্রেরণ করেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সেই সময় মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসার বৃদ্ধি পায়।
পালযুগ
বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে পালরজাদের অবদান উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় বিরাজমান। বৌদ্ধধর্মে প্রচার এবং প্রসারে গোপাল এবং
ধর্মপালের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গোপাল ৭৪০ শতাব্দীতে সিংহাসনে আরোহন করেন। তাঁর রাজত্ব গ্রহণের বছরেই
তিনি ওদন্তপুর বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলিন তিনি। বৌদ্ধধর্মের নৈতিক শিক্ষা আয়ত্ব করা তাঁর
জীবনে আর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
পিতার ন্যায় ধর্মপাল বৌদ্ধ ছিলেন। বৌদ্ধধর্মের উন্নতি সাধনে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। তিনিই পাল রাজাদের মধ্যে প্রথম
সর্বোচ উপাধি ‘পরমেশ্বর’, ‘পরম ভট্টরক, মহারাজাধিরাজ প্রাপ্ত হন। ভাগলপুরের ২৪ মাইল উত্তরে তিনি বিক্রমশীল স্থানের
নামানুসারে বিক্রমশীল বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। বরেন্দ্র অঞ্চলে সোমপুর বিহার নামে আর একটি বিহার নির্মাণ করেন। প্রাচীন
ভারতে সর্ববৃহৎ বৌদ্ধ বিহার ছিল এটি। বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার জন্য অসংখ্য শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ধর্মপালের পুত্র দেবপাল তাঁর পুণ্যশীলা মাতা রন্নাদেবীর সহায়তায় দীর্ঘকাল রাজত্ব করেছিলেন। যবদ্বীপের রাজা
শ্রীবালপুত্রদেবের অনুরোধে তিনি নালন্দা বিহার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাঁচটি গ্রাম দান করেছিলেন। সে
গ্রামগুলো হলো যথাক্রমে : নন্দীবনাক, মনিবায়ক, নারিকা, হস্তিগ্রাম, এবং গয়ার পালামর গ্রাম। নালন্দা বিহারের
রক্ষণাবেক্ষণের সমস্ত ব্যয়ভার এ গ্রামগুলোর উপস্বত্ব থেকে নির্বাহ করা হতো। বাংলাদেশের উজ্জ্বল জোতিষ্ক খড়গবংশীয়
রাজ কুমার ভিক্ষু শীলভদ্র এবং বিশ্বনন্দিত পন্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান প্রাচীন নালন্দা মহাবিহারের আচার্য ছিলেন। রাজা
ধর্মপাল বাংলার সাথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ দেশসমূহের সৌভ্রাতৃত্বময় সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। পাল
রাজত্বকে বৌদ্ধধর্ম প্রচার এবং প্রসারের যুগ বলা হয়। নিচে পালরাজাদের সময়কাল তুলে ধরা হলো : রাজার নাম সিংহাসনে আরোহণের কাল(আনু) রাজত্ব কাল(আনু)
প্রথম-গোপাল ৭৫০ ২০ বৎসর
ধর্মপাল ৭৭৫ Ñ ৮১০ ৩৫ বৎসর
দেবপাল ৮১০ Ñ ৮৪৭ ৩৭ বৎসর
১ম সূরপাল ৮৪৭ Ñ ৮৬০ ১২ বৎসর
১ম বিগ্রহপাল ৮৬০ Ñ ৮৬১ ১ বৎসর
নারায়ণ পাল ৮৬১ Ñ ৯১৭ ৫৫ বৎসর
রাজ্যপাল ৯১৭ Ñ ৯৫২ ৩৫ বৎসর
২য় গোপাল ৯৫২ Ñ ৯৭২ ২০ বৎসর
১ম মহীপাল ৯৭২ Ñ ৯৭৭ ৫ বৎসর
২য় বিগ্রহ পাল ৯৭৭ Ñ ১০২৭ ৫০ বৎসর
নয়পাল ১০২৭ Ñ ১০৪৩ ১৫ বৎসর
৩য় বিগ্রহ পাল ১০৪৩ Ñ ১০৭০ ২৬ বৎসর
২য় মহীপাল ১০৭০ Ñ ১০৭১ ১ বৎসর
২য় সূরপাল ১০৭১ Ñ ১০৭২ ২ বৎসর
রামপাল ১০৭২ Ñ ১১২৬ ৫৩ বৎসর
কুমারপাল ১১২৬ Ñ ১১২৮ ২ বৎসর
৩য় গোবিন্দ পাল ১১২৮ Ñ১১৪৩ ১৫ বৎসর
মদন পাল ১১৪৩ Ñ ১১৬১ ১৮ বৎসর
গোবিন্দ পাল ১১৬১ Ñ ১১৬৫ ৪ বৎসর
আধুনিক যুগ
উনবিংশ শতকে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে অভূতপূর্ব জাগরণের সূত্রপাত হয়। এ সময়ে আধুনিক বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের
নবোত্থান শুরু হয়। বাংলাদেশের বসবাসরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বড়–য়া, মুৎসুদ্দী, তালুকদার, চেীধুরী, সিংহ, চাক্মা, মারমা,
তঞ্চঙ্গা, চাক, খেয়াং, খীসা এবং উত্তরবঙ্গের ওরাও উপাধিধারীরা সবাই বৌদ্ধ। বাংলাদশের বৌদ্ধরা মূলত দুভাগে
বিভাজিত। যথা : সমতলের বৌদ্ধ এবং পাবর্ত্য অঞ্চলের আদিবাসী বৌদ্ধ। তাছাড়া সমতলের উত্তরবঙ্গের বিছু এলাকায়
এবং পটুয়াখালি অঞ্চলে আদিবাসী বৌদ্ধরা বসবাস করে।
খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতক থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত বাংলাদেশের বৌদ্ধদের ইতিহাস ঘন অন্ধকারে আচ্ছাদিত। আবার অষ্টাদশ
শতকের ইতিহাস বিশে ষণ করলে দেখা যায় যে, সে সময় বৌদ্ধসমাজ খুব - বেশী উন্নত ছিল না। বৌদ্ধধর্ম এ সময় অনেক
পরিবর্তনের সন্মুখীন হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘ তাদের জীবনযাত্রায় এবং আচার-আচরণে বৌদ্ধ বিনয়ের নিয়মনীতি তেমন
পরিপালন করতেন না। বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘ বুদ্ধ মতবাদ থেকে সরে গিয়ে তন্ত্র-মন্ত্রকে ধর্মের অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেন।
হিন্দুধর্মীয় লক্ষী পূজা, স্বরস্বতী পূজা, শনি পূজা ইত্যাদি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে পরিণত হয়। বাংলায় তেমন
বৌদ্ধদের জন্য ধর্মীয় গ্রন্থ ছিল না। এমতাবস্থায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন মিথ্যাদৃষ্টিকে পরিহার করে বুদ্ধের ধর্ম প্রতিষ্ঠায় আরাকান
থেকে এগিয়ে আসলেন সারমেধ মহাথের। তিনি সারমিত্র মহাস্থবির নামে অত্যধিক পরিচিত। উল্লেখ থাকে যে, তিনি ১৮৫৬
খ্রি. আরাকান (বর্তমান মায়ানমার-এর একটি প্রদেশ) থেকে চট্টগ্রাম হয়ে তীর্থ দর্শনে ভারত যাচ্ছিলেন। এ যাত্রা পথে তিনি
কয়েকদিন চট্টগ্রাম অবস্থান করেন। অবস্থান কালে তিনি ভিক্ষু এবং গৃহীদের অবৌদ্ধিক কর্মকান্ড দেখে চিন্তিত হন।
অনুরূপভাবে চন্দ্র মোহন মহাস্থবিরও কলকাতায় বৌদ্ধধর্ম বিনয় শিক্ষা করে চট্টগ্রাম ফিরে এসে বৌদ্ধধর্ম ব্যাখ্যার অনুভব
করেন। আচার্য পূর্ণাচার মহাস্থবির এ সময় মায়ানমারের মান্দালয় এবং শ্রীলংকায় ধর্ম বিনয়শিক্ষা করে চট্টগ্রামে ফিরে
এসে বৌদ্ধধর্মের উন্নতি সাধনে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় শুরু হয় ধর্মসংষ্কার আন্দোলন।
উনবিংশ শতকের শেষের দিকে মহামুনি, সাতবাড়িয়া এবং হারভাং -এ তিনটি মডেল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধদের
সাধারণ শিক্ষার অগ্রগতিতে বৌদ্ধদের প্রতিষ্ঠিত এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ
উনবিংশ শতকে প্রারম্ভ থেকেই এ দেশের বৌদ্ধরা বিশ্বের বৌদ্ধদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং বিশ্ব বৌদ্ধ
রাষ্ট্রসমূহের বৌদ্ধধর্মের আদর্শ ও নীতি অনুসরণ করে নিজেদের ভবিষ্যৎ রচনায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
বিংশ শতক থেকে বৌদ্ধরা ধর্মচর্চা, সমাজউন্নয়ন, শিক্ষা-দীক্ষায়, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, ব্যবসায় সর্বোপরি সরকারি প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসে সততা-নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন: ১৮.৯
এক কথায় উত্তর দিন
১. প্রাচীন ভারতে বর্ণব্যবস্থা কেমন ছিল?
২. ধর্মের নামে কী হতো?
৩. প্রচীন ভারতের নামে কী?
৪. অনাথপিন্ডিক কে ছিলেন?
৫. মৌর্য যুগকে কী বলা হয়?
৬. কুষাণ যুগের শ্রেষ্ঠ নরপতির নাম কি?
৭. ধর্মপালের পিতার নাম কি?
৮. বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মে অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ বলা হয় কোন শতককে?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. প্রাক্ বৌদ্ধযুগ বলতে আপনি কী বোঝেন?
২. বুদ্ধ সমকালীন অবস্থায় প্রাচীন ভারতের অবস্থা কেমন ছিল?
৩. বুদ্ধ কোথায় এবং কাদের প্রথম ধর্মপ্রচার করেন?
৪. সম্রাট অশোক কে ছিলেন?
৫. তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতি কালে রাজত্বকালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল?
৬. সম্রাট কনিষ্ক কে ছিলেন?
৭. বিক্রমশীল বিহার কার নামে করা হয়?
৮. প্রাচীন ভারতে সর্ববৃহৎ বিহারের নাম কী?
৯. কোন সময়কে আধুনিক বৌদ্ধধর্মে পুনরুত্থানের সময় বলা হয়?
রচনামূলক প্রশ্ন
১. প্রাক্ বৌদ্ধযুগের সামাজিক এবং ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে যা জানেন লিখুন।
২. বুদ্ধের সমকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ নিবন্ধ লিখুন।
৩. মৌর্য এবং কুষাণ যুগে বৌদ্ধধর্মের অবস্থা সম্পর্কে একটি ধারণা প্রদান করুন।
৪. পালযুগে বৌদ্ধ রাজাদের অবদান কেমন ছিল -আলোচনা করুন।
৫. আধুনিক যুগের বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে স্বচ্ছ একটি ধারণা প্রদান করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]