সামাজিক প্রতিষ্ঠানÑ ধর্ম
সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানে ধর্মকে একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে মনে করা হয় যার
বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ জরুরী। ধর্মের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রদানের প্রচেষ্টা দীর্ঘকাল ধরে চললেও
এখনও তা সফল হয়নি। সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুরক্যাঁ ধ্রুপদী সংজ্ঞানুযায়ী ধর্ম হচ্ছে পবিত্র
বস্তুর সাথে যুক্ত বিশ্বাস এবং অনুশীলনের সামগ্রিক ব্যবস্থা যা বিশ্বাসীদের নিয়ে একটি নৈতিক
সম্প্রদায় সৃষ্টি করে। সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানে ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত কয়েকটি তত্ত¡
রয়েছে। এগুলো হল- সর্বপ্রাণবাদ, প্রাক-সর্বপ্রাণবাদ, ক্রিয়াবাদ ও মার্কসীয় তত্ত¡।
বৃটিস নৃবিজ্ঞানী জেমস ফ্রেজার মনে করেন-যাদু, ধর্ম ও বিজ্ঞান মানব চিন্তার বিবর্তনের তিনটি
ধাপ। ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে অথবা প্রাকৃতিক বা অতি-প্রাকৃত শক্তির উপর কর্তৃত্ব
করার জন্য মায়া ও আকর্ষণ সৃস্টি এবং আচার-অনুষ্ঠানের বিদ্যাই হল যাদু। ধর্ম ও যাদু
উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য থাকলেও বৈসাদৃশ্যও লক্ষ্যণীয়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান একটি ভিন্ন বিষয় যা
প্রপঞ্চ বিশ্লেষণের একটি বিষয়মুখী, যুক্তিভিত্তিক এবং নিয়মাবদ্ধ পদ্ধতি। ধর্ম ও যাদু
অতিপ্রাকৃত শক্তিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও, ধর্মে মানুষ আত্মসমর্পণ করে অতিপ্রাকৃত
শক্তির কাছে, কিন্তু এই অতিপ্রাকৃত শক্তিকে যাদুতে ব্যক্তির অনুকূলে এনে ব্যবহার করা হয়
স্বার্থসিদ্ধিতে।
সমাজ পরিবর্তনে ধর্মের ভ‚মিকা নিয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা করে থাকে ধর্মের
সমাজবিজ্ঞান।এক্ষেত্রে ইউরোপে ধনতন্ত্রের বিকাশের কারণ খুঁজতে গিয়ে ম্যাক্স ভেবার
প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের কালভীনবাদের কতিপয় বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেন। প্রোটেস্ট্যান্ট ও
ক্যাথলিক ধর্মের স্বীকৃতি আসে ইউরোপে ধর্মসংস্কারের মধ্য দিয়ে এবং তার মধ্য দিয়ে শুরু হয়
ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি।
মানুষের বিশ্বাস, আচার-আচরণ, পারস্পরিক সম্পর্ক প্রভৃতিতে রয়েছে ধর্মের প্রভাব। সমাজ ও
ব্যক্তি জীবন -এ দু'টি ক্ষেত্রেই ধর্মের ভ‚মিকা লক্ষ্যণীয়। ধর্ম শংকা ও দু:শ্চিন্তা থেকে মানুষকে
দেয় মুক্তি, জীবন ও জগৎকে করে তোলে সুন্দর ও আনন্দময়। সমাজের সংহতিতে ধর্মের
গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। তাছাড়া সামাজিকীকরণ ও সমাজ নিয়ন্ত্রণের বাহন
হিসাবেও ধর্মের বিশেষ ভ‚মিকা রয়েছে।
এ সকল বিষয় নিয়েই এই ইউনিটে আলোচনা করা হয়েছে।
ধর্মের সংজ্ঞা, উৎপত্তি ও তত্ত¡
উবভরহরঃরড়হ, ঙৎরমরহ ধহফ ঞযবড়ৎরবং ড়ভ জবষরমরড়হ
ভ‚মিকা
সমাজবিজ্ঞান ধর্মের তুলনামূলক এবং মূল্যবোধ নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে। ধর্ম সত্য
না মিথ্যা এই বিবেচনায় সমাজবিজ্ঞান প্রবেশ করেনা। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন ধর্ম অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যার বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ জরুরী। নৃবিজ্ঞানীদের মতে ধর্মের সূচনা এবং
বিকাশ কম-বেশি এক লক্ষ বছর আগে। এখনও ধর্ম আমাদের জীবনের সাথে গভীরভাবে
সম্পৃক্ত।তবে আধুনিক যুগে ধর্ম ও রাষ্ট্রের অবিচ্ছিন্নতা ভেঙে পড়ছে এবং বেড়েছে
সহনশীলতা। ধর্ম স্থান করে নিয়েছে ব্যক্তির জীবনে এবং মননে।
ধর্মের সংজ্ঞা
সমাজবিজ্ঞান এবং নৃবিজ্ঞানে ধর্মের একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা চলছে দীর্ঘকাল
থেকে। তা এখনও সফল হয়নি। ফরাসী সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুরক্যাঁ ঊসরষব উঁৎশযবরস -
এর ধ্রুপদী সংজ্ঞা তাই এখনও প্রচলিত।
“ধর্ম হচ্ছে পবিত্র বস্তুর সাথে যুক্ত বিশ্বাস এবং অনুশীলনের সামগ্রিক ব্যবস্থা যা বিশ্বাসীদের
নিয়ে একটি নৈতিক সম্প্রদায় সৃষ্টি করে।”
"অ ৎবষরমরড়হ রং ধ ঁহরভরবফ ংুংঃবস ড়ভ নবষরবভং ধহফ ঢ়ৎধপঃরপবং ৎবষধঃরাব ঃড় ংধপৎবফ ঃযরহমং...
নবষরবভং ধহফ ঢ়ৎধপঃরপবং যিরপয ঁহরঃব রহঃড় ধ ংরহমষব সড়ৎধষ পড়সসঁহরঃু .... ধষষ ঃযড়ংব যিড়
ধফযবৎব ঃড় ঃযবস."
এই সংজ্ঞায় পবিত্র বস্তুকে গ্রহণ করার কারণ হচ্ছে বৌদ্ধ বা কনফুসিয়ান ধর্মের মত কোন
কোন ধর্মে ঈশ্বরের ধারণা নেই। দুরক্যাঁ তাঁর ধর্ম চিন্তায় পবিত্র ঝধপৎবফ এবং সাধারণ বা
লোকজ চৎড়ভধহব বস্তুর মধ্যে বিভাজন টেনেছেন। জীবনে যা কিছু গোষ্ঠীগতভাবে পবিত্র তাই
ধর্ম। সংজ্ঞাটি বেশ ব্যাপক। পবিত্র শব্দটির সাথে অতিপ্রাকৃত যোগ করলে সংজ্ঞাটি আরো
স্পষ্ট হবে।
ধর্মের উৎপত্তি
ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে সাধারণত: চর্চা করে থাকে সাংস্কৃতিক বা সামাজিক নৃবিজ্ঞান। সাংস্কৃতিক
বা সামাজিক নৃবিজ্ঞানে ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে কয়েকটি তত্ত¡ প্রচলিত রয়েছে।
সর্বপ্রাণবাদ অহরসরংস
সর্বপ্রাণবাদের প্রবক্তা হচ্ছেন বৃটিশ নৃবিজ্ঞানের জনক ই.বি. টাইলর (১৮৩২-১৯১৭)।
টাইলরের মতে ধর্মের উৎপত্তি হচ্ছে স্বপ্নের অভিজ্ঞতা এবং মৃত্যুর চেতনা থেকে। স্বপ্নের
অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ উপনীত হয় আত্মা বা প্রেতাত্মার ধারণায়। স্বপ্নের ভিতর দিয়ে মানুষ
বিচরণ করে নানা কাল্পনিক এবং অলীক অবস্থায় যা আদিম মানুষের কাছে সত্য বলে মনে
হয়। তাই তারা অন্য প্রাণী এবং এমনকি জড় বস্তুর উপর আরোপ করে প্রেতাত্মার ধারণা।
মৃত্যুর পরে আত্মা প্রেতাত্মা বা মুক্ত আত্মায় রূপান্তরিত হয় এবং তারা কখনও অগোচরে
মানুষের কাছে অথবা ভিন্ন কোন জগতে বাস করে। বিবর্তনবাদী টাইলর মনে করতেন
সর্বপ্রাণবাদ থেকে বিবর্তনের ক্রমধারায় বিকাশ লাভ করেছে প্রকৃতি-পূজা এবং একেশ্বরবাদ।
টাইলরের তত্তে¡র পেছনে কোন প্রমাণ নেই। তবে নৃবিজ্ঞানী রবার্ট লোঈর জড়নবৎঃ খড়রিব
মতে নৃবিজ্ঞানে ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে এর চাইতে পরিমার্জিত কোন তত্ত¡ নেই।
প্রাক্-সর্বপ্রাণবাদ অহরসধঃরংস
প্রাক্-সর্বপ্রাণবাদের তত্ত¡ প্রদান করেন বৃটিশ নৃবিজ্ঞানী জ.জ. গধৎবঃঃ (১৮৬৬-১৯৪৩)। নৃবিজ্ঞানী
ম্যারেট মেলিনেশিয়ার ধর্ম বিশ্লেষণ করে দেখলেন আদিম মানুষ আত্মার বাইরেও কোন বিশেষ
শক্তির ধারণা সৃষ্টি করতে পারে। মেলিনেশীয় ভাষায় এর নাম মানা গধহধ। এটি এমন একটি
শক্তি যা মাথায় অবস্থিত বলে বিশ্বাস করা হয় এবং উঁচু সামাজিক এবং আচরণগত মর্যাদার
সাথে যুক্ত। আচারের মাধ্যমে এই শক্তিকে অন্যের কাছে প্রদান করা যায়। ফলে ম্যারেট যুক্তি
প্রদান করলেন আদিম মানুষ প্রথমে এই মানার ধারণায় উপনীত হয়েছিল। আত্মা বা প্রেতাত্মার
ধারণা নয়, মানার ধারণা থেকেই ধর্মের সত্যিকার উৎপত্তি।
ক্রিয়াবাদী তত্ত¡
ধর্মের ক্রিয়াবাদী তত্ত¡ প্রদান করেছেন ফরাসী সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুরক্যাঁ। তাঁর মতে সমাজের
সংহতি টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে ধর্মের সৃষ্টি। যে মূল্যবোধ এবং শ্রেয়োবোধের ভিত্তিতে যৌথ
সামাজিক জীবন পরিচালিত হয় তার জন্য মহত্তর-স্বর্গীয়, পবিত্র বা অতিপ্রাকৃত উৎস
প্রয়োজন। সমাজের মূল্যবোধগুলো যে সবাই গ্রহণ করে এবং মেনে চলে তার কারণ এর
অতিপ্রাকৃত ভিত্তি রয়েছে। ফলে সমাজের সংহতির প্রয়োজনে মানুষের ধর্মকে নির্মাণ করতে
হয়। আচার-অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে ধর্ম মূর্ত হয়ে উঠে। এর মাধ্যমে মানুষের সাথে মানুষের
সম্পর্ক এবং সংহতি গড়ে ওঠে। আদিম কৌমভিত্তিক জীবনে নানা ধরনের আচারের ভিতর
দিয়ে ধর্মের উৎপত্তি। ধর্ম প্রধানত: চারটি ক্রিয়া ঋঁহপঃরড়হ সম্পাদন করে।
❒ শৃ´খলা বিধান
❒ পারস্পরিক সম্পর্ক শক্তিশালীকরণ
❒ সামাজিক ঐতিহ্য পুনরুৎপাদন
❒ প্রফুল্লতা সৃষ্টি
মার্কসীয় তত্ত¡
কার্ল মার্কস্ -এর মতে ধর্ম একটি অলীক কল্পনা বা ভাবাদর্শ যা মালিক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ
করে এবং সমাজের বিরাজমান অসমতাকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। শোষিত মানুষদের
জন্য ধর্ম নেশার মত কাজ করে। “ওঃ রং ঃযব ড়ঢ়রঁস ড়ভ ঃযব ঢ়ড়ড়ৎ"। ধর্ম মানুষকে সত্যিকার
মানবিক সত্ত¡া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ধর্ম মানুষের কল্পনা, অথচ সেই কল্পনাকেই সে
মহাসত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। বিরাজমান সমাজব্যবস্থা এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবের
কারণে সমাজে ধর্ম এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। সমাজ প্রগতির প্রক্রিয়ায় ধর্মের প্রভাব ক্রমেই
হ্রাস পাবে।
সারাংশ
সমাজবিজ্ঞানে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খীমের মতে ধর্ম হচ্ছে পবিত্র বস্তুর সাথে যুক্ত বিশ্বাস এবং অনুশীলনের
সামগ্রিক ব্যবস্থা যা বিশ্বাসীদের নিয়ে একটি নৈতিক সম্প্রদায় সৃষ্টি করে। সাংস্কৃতিক বা
সামাজিক নৃবিজ্ঞানে ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে কয়েকটি তত্ত¡ প্রচলিতÑ সর্বপ্রাণবাদ অহরসরংস,
প্রাক্-সর্বপ্রাণবাদ অহরসধঃরংস, ক্রিয়াবাদী তত্ত¡ ও মার্কসীয় তত্ত¡।
সর্বপ্রাণবাদ অহরসরংস-এর প্রবক্তা নৃবিজ্ঞানী টাইলর স্বপ্নের অভিজ্ঞতা এবং মৃত্যুর চেতনা
থেকে ধর্মের উদ্ভব বলে মনে করেন। বৃটিশ নৃবিজ্ঞানী ম্যারেট প্রদান করেন প্রাকসর্বপ্রাণবাদ ধারণা যেখানে মানা গধহধ নামক একটি শক্তি থেকে ধর্মের উৎপত্তি।
ধর্মের ক্রিয়াবাদী তত্তে¡ এমিল দুরক্যাঁ সমাজের সংহতি টিকিয়ে রাখার জন্য ধর্মের সৃষ্টি
বলে মতামত প্রদান করেন। ধর্মের মার্কসীয় তত্ত¡ ধর্মকে অলীক কল্পনা বা ভাবাদর্শ যা
মালিক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ করতে এবং সমাজের বিরাজমান অসমতাকে টিকিয়ে
রাখতে সাহায্য করে বলে মনে করে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন
১. ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত সর্বপ্রাণবাদ অহরসরংস-এর প্রবক্তা কে?
ক. কার্ল মার্কস্ খ. ম্যাক্স ওয়েবার
গ. এমিল দুরক্যাঁ ঘ. ই.বি. টাইলর
২. “ধর্ম একটি অলীক কল্পনা বা ভাবাদর্শ যা মালিক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ করে”Ñ উক্তিটি
কোন তত্তে¡র সাথে সম্পর্কিত?
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত