● ধর্ম ও বিজ্ঞান
ভ‚মিকা
বৃটিশ নৃবিজ্ঞানী জেমস ফ্রেজার (১৮৫৪-১৯৪১) মনে করতেন যাদু, ধর্ম ও বিজ্ঞান মানুষের
চিন্তার বিবর্তনের তিনটি ধাপ। অসহায় আদিম মানুষের প্রকৃতির উপর প্রভ‚ত্ব করার প্রয়োজন
থেকে যাদুর উদ্ভব। এরই চরম উৎকর্ষ ঘটেছে বিজ্ঞানের মধ্যে। ফ্রেজারের তত্ত¡ অনেক বছর
আগে বাতিল হয়ে গেলেও, এ তিনটি বিষয়ের উপর তুলনামূলক আলোচনাকে একেবারে বাদ
দেওয়া যায় না। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে ধর্ম ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে
এখনও যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।
যাদু
যাদু বলতে বোঝায়Ñ
“ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে অথবা প্রাকৃতিক বা অতিপ্রাকৃতিক শক্তির উপর কর্তৃত্ব করার
জন্য মায়া ও আকর্ষণ সৃষ্টি এবং আচার-অনুষ্ঠানের বিদ্যা।”
"ঞযব ধৎঃ ড়ভ ঢ়বৎভড়ৎসরহম পযধৎসং, ংশরষষং, ধহফ ৎরঃঁধষং, ঃড় ংববশ ঃড় পড়হঃৎড়ষ বাবহঃং ড়ৎ
মড়াবৎহ পবৎঃধরহ হধঃঁৎধষ ড়ৎ ংঁঢ়বৎহধঃঁৎধষ ভড়ৎপবং. (ঙীভড়ৎফ ঈড়হপরংব উরপঃরড়হধৎু ড়ভ"
ঝড়পরড়ষড়মু, ১৯৯৬)
ধর্ম ও যাদু উভয়ই অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাসের দু'টি বাহ্যিক রূপ। ধর্মে মানুষ অতিপ্রাকৃত
শক্তির প্রতি বিনত। অতিপ্রাকৃত শক্তির সাথে আত্মিক যোগাযোগ সৃষ্টি তার উদ্দেশ্য। যাদুর
মধ্যে নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সে অতিপ্রাকৃত শক্তিকে বশ অথবা নিয়ন্ত্রিত করতে চেষ্টা
করে। যাদু সব সময় ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সব ধর্মেই যাদুর উপস্থিতি বাস্তবে লক্ষ্য করা যায়। যাদুর
উপর প্রথম গবেষণা পরিচালনা করেছিলেন ই.বি. টাইলর। যাদুকে তিনি দেখেছিলেন বর্বর
মানুষের ‘কুসংস্কার' হিসাবে। জে.জি. ফ্রেজার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ঞযব এড়ষফবহ ইড়ঁময'
(১৮৯০) এর দুটি খন্ডে বিভিন্ন সমাজের যাদুর নজীর বিধৃত এবং বিশ্লেষণ করেছেন। ফ্রেজার
মনে করতেন মানবচিন্তার বিবর্তনের তিনটি ধাপের প্রথমটি হচ্ছে যাদু, দ্বিতীয়টি ধর্ম এবং
তৃতীয়টি বিজ্ঞান। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিবর্তনবাদী তত্ত¡ ভুল প্রমাণিত হতে থাকলে,
প্রত্যেক সমাজের যাদুকে ঐ সমাজের ভাষার মত একটি বিশেষ ব্যবস্থা হিসাবে চিন্তা করা হয়।
যাদুর তিনটি রূপ চিহ্নিত করা যায়। প্রথমটি হচ্ছে মঙ্গলজনক যাদু। এর উদাহরণ হচ্ছে
পলিনেশিয়ার দ্বীপবাসীরা যখন মাছ ধরার জন্য বিপদজনক সমুদ্রযাত্রায় বের হয় তখন তারা
‘নৌকা যাদু' ঈধহড়ব সধমরপ ব্যবহার করে যাতে তারা নিরাপদে ফিরে আসতে পারে। দ্বিতীয়
রূপ হচ্ছে মায়া বা স্যরস্রি ঝড়ৎপবৎু যা অশুভ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে
অন্যের ক্ষতি করা। ডাকিনি বিদ্যা ডরঃপযপৎধভঃ বলতে বোঝায় অপ- আত্মার সাথে মিলিত
হয়ে অতিপ্রাকৃত শক্তি অর্জন করে অন্যের ক্ষতি সাধন।
দক্ষিণ সুদানের আজান্দে উপজাতির মধ্যে মঙ্গলজনক যাদুকে দেখা হয় নৈতিক বিষয় হিসাবে।
এদের মধ্যে প্রচলিত ডাকিনি বিদ্যার অতিপ্রাকৃত শক্তি বাস করে সাধারণ মানুষের অন্ত্রে এবং
রাতে বের হয়ে তারা মানুষের ক্ষতি করে। মায়াবিদ্যার অধিকারী হচ্ছে অভিজাত মানুষ এবং
এটি ডাকিনীবিদ্যার চেয়ে মারাত্মক।
ধর্ম ও যাদু
ধর্ম ও যাদুর মধ্যে কিছু মিল এবং পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ধর্ম এবং যাদু অতিপ্রাকৃত শক্তিকে
কেন্দ্র করে আবর্তিত। নৃবিজ্ঞানী হোবেল এবং উইভার এর ভাষায়Ñ “অতিপ্রাকৃতের সাথে
সম্পর্কিত হবার মৌলিক কৌশল দু'টি-প্রার্থনা এবং যাদু।”
চৎধুবৎ ধহফ সধমরপ ধৎব ঃযব ঃড়ি নধংরপ ঃবপযহরয়ঁবং ড়ভ ফবধষরহম রিঃয ঃযব ংঁঢ়বৎহধঃঁৎধষ (ঊ.অফধসংড়হ ঐড়বনবষ ধহফ ঞযড়সধং ডবধাবৎ).
সমাজবিজ্ঞানী ভেবারের মতে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম-ভিন্ন প্রতিটি ধর্মে যাদু ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।
❏ ধর্ম ও যাদুর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভেদ হচ্ছে ধর্মে মানুষ অতিপ্রাকৃত শক্তির কাছে
আত্মসমর্পন করে তার সাথে আত্মিক সম্পর্ক সৃষ্টি করে। যাদুতে অতিপ্রাকৃত শক্তিকে
ব্যক্তির অনুক‚লে এনে তার স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয়।
❏ ধর্ম সামাজিক এবং গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের সাথে সম্পৃক্ত, অন্যদিকে যাদুবিদ্যা ব্যক্তিকেন্দ্রিক।
❏ প্রত্যেক ধর্মে জীবন, জগৎ এবং পরকাল নিয়ে কিছু গভীর চিন্তা স্থান পায়। যাদুবিদ্যা
বিশেষ এবং সীমিত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত একটি কৌশল যার মধ্যে কিছু উচ্চারণ, কোন
আচার এবং কিছু নির্দিষ্ট কর্মকান্ড যুক্ত থাকে।
ধর্ম এবং বিজ্ঞান
বাস্তবতার ধারণা আমরা চারভাগে লাভ করে থাকিÑ বিশ্বাস, সাধারণ জ্ঞান বা উপলব্ধি, যুক্তি
এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তব জগতের উপাত্ত। বিজ্ঞান বিশ্বাস বা সাধারণ জ্ঞান থেকে ভিন্ন। ইংরেজি
ঝপরবহপব শব্দটি এসেছে লাতিন মূল ঝপরৎব থেকে যার অর্থ জানা। লাসট্রুসির মতে বিজ্ঞান
হচ্ছে “----- প্রপঞ্চ বিশ্লেষণের একটি বিষয়মুখী, যুক্তিভিত্তিক এবং নিয়মাবদ্ধ পদ্ধতি যা
নির্ভরযোগ্য জ্ঞান সঞ্চয় করার সুযোগ তৈরি করে দেয়।” বিজ্ঞান মনে করে মানব মনের বাইরে
একটি জগৎ রয়েছে যার সম্পর্কে সংশয়বিহীন জ্ঞান অর্জন সম্ভব। এর জন্য বিজ্ঞানকে কিছু শর্ত
মেনে নিতে হয়।
❏ বিজ্ঞান তার গবেষণা এবং চর্চার বিষয়বস্তু হিসাবে বেছে নেয় এমন সব বিষয় যা
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য।
❏ বিজ্ঞানকে হতে হয় বিষয়মুখী। ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাস, ধ্যান-ধারনা, মতামত যেন উপাত্ত
সংগ্রহ বা বিশ্লেষণে কোন প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারে। যে কোন ব্যক্তি যেন একই পদ্ধতি
ব্যবহার করে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে।
❏ বিজ্ঞানের সমস্ত ভাবনা এবং তত্ত¡ যুক্তিনির্ভর। এখানে আবেগের কোন স্থান নেই, নৈতিক
দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যবহার নেই এবং নান্দনিকতার কোন প্রসঙ্গ নেই।
❏ বিজ্ঞান তত্ত¡কে এমনভাবে প্রকাশ বা উপস্থাপন করে তা যেন মিথ্যা প্রতিপন্ন করা যায়।
বিজ্ঞান সবসময় সংশয়কে উৎসাহিত করে। বিজ্ঞানে তাই ক্রমাগত তত্তে¡র মৃত্যু ঘটে।
পুরানো তত্ত¡ পরিমার্জিত হয় অথবা পুরানো তত্তে¡র বদলে নতুন তত্ত¡ নির্মিত হয়।
❏ বিজ্ঞানে জ্ঞান তাই ক্রম-প্রসারমান। বিজ্ঞান অজানাকে ক্রমাগত জানার চেষ্টা করে যায়।
বিজ্ঞানের এই ধারণা থেকে আমরা সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারি ধর্ম ও বিজ্ঞান দুটি ভিন্ন বিষয়।
ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাসভিত্তিক। অতিপ্রাকৃত উৎস হতে যে জ্ঞান সৃষ্টি হয় যা শাশ্বত এবং বলতে
গেলে অপরিবর্তনীয় (বিশ্বাসীদের দৃষ্টিতে) তাই হচ্ছে ধর্ম। ধর্ম জীবনযাত্রার নকশা তুলে ধরে।
ধর্মের সাথে আবেগযুক্ত; ধর্মের সাথে যুক্ত নৈতিকতা এবং নান্দনিকতা। ধর্ম অনুসন্ধান করে
পরম প্রশ্নের উত্তর যা বিজ্ঞানের জন্য অজ্ঞেয়। ধর্ম বিশ্বাস ও আবেগভিত্তিক, বিজ্ঞান যুক্তি ও
প্রমাণভিত্তিক। দু'য়ের জ্ঞানের ভিত্তি ও ধরন আলাদা।
সারাংশ
যাদু, ধর্ম ও বিজ্ঞানÑ এ তিনটি জেমস ফ্রেজারের মতানুযায়ী মানুষের চিন্তার বিবর্তনের
তিনটি ধাপ। ধর্ম ও যাদু উভয়ই অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাসের দু'টি বাহ্যিক রূপ। যাদুর
মধ্যে নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মানুষ অতিপ্রাকৃত শক্তিকে বশ অথবা নিয়ন্ত্রিত করার
চেষ্টা করে। যাদুর তিনটি রূপ লক্ষ্যণীয়। এগুলো হচ্ছে মঙ্গলজনক যাদু, মায়া এবং
ডাকিনীবিদ্যা।
ধর্ম ও যাদুÑ উভয়ের মধ্যেই সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য রয়েছে। উভয়ই অতিপ্রাকৃত শক্তিকে
কেন্দ্র করে আবর্তিত। তবে ধর্মে মানুষ অতিপ্রাকৃত শক্তির কাছে আত্মসমর্পন করে তার
সাথে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। পক্ষান্তরে, যাদুতে অতিপ্রাকৃত শক্তিকে ব্যক্তির
অনুক‚লে এনে তার স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয়।
বিজ্ঞান হচ্ছে প্রপঞ্চ বিশ্লেষণের একটি বিষয়মুখী, যুক্তিভিত্তিক এবং নিয়মাবদ্ধ পদ্ধতি যা
নির্ভরযোগ্য জ্ঞান সঞ্চয় করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। এখানে আবেগের কোন স্থান নেই
এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর কোন ব্যবহার নেই। ধর্ম ও বিজ্ঞান দুটি ভিন্ন বিষয় এবং এদের
জ্ঞানের ভিত্তি ও ধরন আলাদা। কেননা ধর্মের সাথে আবেগযুক্ত, যুক্ত নৈতিকতা এবং
নান্দনিকতা।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন
১. অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাসের বাহ্যিক রূপ কোনটি?
ক. ধর্ম খ. যাদু
গ. বিজ্ঞান ঘ. ধর্ম ও যাদু
২. যাদুকে বর্বর মানুষের কুসংস্কার হিসাবে কোন নৃবিজ্ঞানী দেখেছেন?
ক. ই.বি. টাইলর খ. জেমস ফ্রেজার
গ. হোবেল ঘ. ম্যারেট
৩. ইংরেজি 'ঝপরবহপব' শব্দটি এসেছে কোন ভাষা থেকে?
ক. লাতিন খ. গ্রীক
গ. রোমান ঘ. ফরাসী
৪. নিচের কোনটির সমস্ত ভাবনা এবং তত্ত¡ যুক্তিনির্ভর?
ক. ধর্ম খ. যাদু
গ. বিজ্ঞান ঘ. ধর্ম ও বিজ্ঞান
৫. নৃবিজ্ঞানী হোবেল ও ওয়েবার এর ভাষায় “অতিপ্রাকৃতের সাথে সম্পর্কিত হবার মৌলিক
কৌশলÑÑÑ”
ক. ১টি খ. ২টি
গ. ৩টি ঘ. ৪টি
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. যাদু বলতে কি বোঝায় ?
২. ধর্ম ও বিজ্ঞানের বৈসাদৃশ্যগুলো উল্লেখ করুন।
রচনামূলক প্রশ্ন
১. “যাদু, ধর্ম ও বিজ্ঞান মানব চিন্তার বিবর্তনের তিনটি ধাপ।” উক্তিটি ব্যাখ্যা করুন।
২. যাদু ও ধর্মের সংজ্ঞাসহ সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আলোচনা করুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত