প্রেক্ষিতকরণের গুরুত্ব
ইউরোপীয় নৃবিজ্ঞানীদের কাছে নিজ সমাজ স্বাভাবিকতার মানদন্ড হিসেবে কাজ করে
ভাষা বিশ্লেষণ সামাজিক ক্ষমতা এবং স্বার্থ উদ্ঘাটনের একটা রাস্তা
জ্ঞাতিত্ব সাংস্কৃতিক/সামাজিক নৃবিজ্ঞানের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। আপনারা ইতোমধ্যে জানেন যে বহু
ইউরোপীয় দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে নৃবিজ্ঞান এথনোলজি (জাতিতত্ত¡) হিসেবে পরিচিত ছিল। অর্থাৎ,
ধরে নেয়া হয়েছিল নৃবিজ্ঞানীদের কাজ বা লক্ষ্য হচ্ছে নির্দিষ্ট কোন জনগোষ্ঠীর এথনোগ্রাফি রচনা।
এখনো কিছু ইউরোপীয় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ এথনোলজি নামে পরিচিত। প্রথম
এথনোগ্রাফি রচয়িতা বহিসেবে যিনি স্বীকৃত তিনি লুইস হেনরি মর্গান (১৮১৮-১৮৮১)। মর্গান তাঁর
রচিত লীগ অফ দ্য ইরোক ওয়া (১৮৫১) গ্রন্থে আমেরিকার আদিবাসী ইরোকওয়া’দের ধর্ম, রাজনীতি
ও অনুষ্ঠান পালন Ñ এসব বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে জ্ঞাতিত্ব ও বিয়ের উপর আলোকপাত করেন।
জ্ঞাতিত্ব ও বিয়ে নিয়ে তাঁর আগ্রহ পরবর্তী পর্যায়ে আরো ধারাবাহিক হয়ে ওঠে এবং বিশ বছর পর তার
সিস্টেমস অফ কনস্যাঙ্গুইনিটি এ্যান্ড এফফিনিটি (১৮৭১) বইটি প্রকাশিত হয়। স্বতন্ত্র জ্ঞানকান্ড
হিসেবে নৃবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা লাভে এই বইটি একটি মাইলফলক। উপরন্তু, নৃবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে
জ্ঞাতিত্ব এবং বিবাহ হচ্ছে কেন্দ্রীয় বিষয় Ñ এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ক্ষেত্রে এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রাখে।
জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন-এর ইতিহাস আর নৃবিজ্ঞানের ইতিহাস Ñ দুটোই প্রায় দেড়শত বছর পুরোনো। সেটা
নিশ্চয়ই আপনারা উপরের অনুচ্ছেদ পড়ে বুঝতে পেরেছেন। তবে, জ্ঞাতিত্ব বলতে কি বোঝায়, অর্থাৎ
কি এর সংজ্ঞা, কি এর গুরুত্ব, কি এর পরিধি Ñ এগুলো অনড়, অটল অথবা অপরিবর্তনীয় কিছু নয়।
গত দেড়শ বছর এগুলোর ক্ষেত্রে বদল ঘটেছে, এবং এই বদল চলমান। যেমন ধরুন: মর্গানের
সময়কাল। তখন বিবর্তনবাদী তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গি শক্তিশালী ছিল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সকল
বিবর্তনবাদী তাত্তি¡ক একইভাবে পরিবার, বিয়ে, অথবা গোত্র-ব্যবস্থার উৎপত্তি ও বিকাশকে দেখেছেন।
অন্যভাবে বললে, যে কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে, চিন্তাবিদ, তাত্তি¡ক, গবেষকদের মাঝে তর্ক-বির্তক
চলতে থাকে। ভিন্ন তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী হলে তো অবশ্যই, আবার একই তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গির
অনুসারী হলেও আমাদের ধরে নেয়া ঠিক হবে না যে সকলে, সব বিষয়ে, সব সময়ে একমত। এক্ষেত্রে
লক্ষ্য করবেন, একই তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী হওয়ার অর্থ হচ্ছে কিছু পূর্বানুমান (ধংংঁসঢ়ঃরড়হং)
এবং কিছু প্রত্যয়ে (পড়হপবঢ়ঃং) অংশীদারিত্ব। এ কারণে যেমন স্ব মিলের জায়গা তৈরী হয়, আবার কিছু
বিষয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর সম্ভাবনাও থাকে।
জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের এই দেড়শত বছরের যাত্রা Ñ শুরুর লগ্নের ভাবনাচিন্তা, তাত্তি¡ক তর্ক-বিতর্ক এবং হাল
আমলের মনোযোগের জায়গার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক অতি সংক্ষেপে জ্ঞাতিত্ব বিষয়ক তিনটি ইউনিটে
জ্ঞাতিত্ব বলতে কি বোঝায়,
অর্থাৎ কি এর সংজ্ঞা, কি এর
গুরুত্ব, কি এর পরিধি Ñ এগুলো
অনড়, অটল অথবা
অপরিবর্তনীয় কিছু নয়। গত
দেড়শ বছর এগুলোর ক্ষেত্রে
বদল ঘটেছে, এবং এই বদল
চলমান।
প্রেক্ষিতকরণ
জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের বিষয়গুলো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে ঘিরে। এই যেমন ধরুন, বাবা-মা, বিয়ে,
ঘর-সংসার, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, পরিবার, সন্তান জন্মদান, শরীরী সম্পর্ক, পিতৃ পরিচয় Ñ আরো অনেক
কিছু। জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন যেসব বিষয় ঘিরে গঠিত সেসব বিষয় আপনার, আমার, আমাদের সত্তা,
পরিচিতি, মূল্যবোধ, দৈনন্দিন জীবন-যাপন, কার্যকলাপ, ঠিক-বেঠিকের ধারণা, নীতি-নৈতিকতা
এসবকে বিশ্লেষণের খাতিরে, বৃহত্তর প্রেক্ষিতে স্থাপন করে। প্রেক্ষিত বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট স্থান-কাল।
তার মানে, “পরিবার”এর কথা উঠলে কোন সমাজের পারিবারিক সম্পর্কের কথা বলছি, তা স্পষ্ট করা
জরুরী। আবার, একই সমাজের কথা বললেও Ñ যেমন ধরুন বাঙ্গালি মুসলমান সমাজ Ñ কোন
সময়কালের কথা বলছি, তার সঠিক ধারণা থাকা আবশ্যিক।
বিষয়টিকে আরো খোলাসা করি। বাঙ্গালি মুসলমান সমাজে ধরুন, “বিয়ে” নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রশ্ন
উঠবে: কোন সময়ের কথা বলা হচ্ছে? বৃটিশরা এদেশে আসার আগে নাকি পরে? সা¤প্রতিককালের
গবেষণায় জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের প্রায় দুইশত বছরের
শাসনামলে এমন ধরনের প্রতিষ্ঠান ও ধ্যান-ধারণার সূত্রপাত ঘটায় যা এদেশের মানুষজনের জীবনধারায়
(ধিু ড়ভ ষরভব বা পঁষঃঁৎব) মৌলিক বদল আনে। ঔপনিবেশিক শক্তি শুধুমাত্র অর্থনীতি বা রাজনীতির
ক্ষেত্রে বদল ঘটায়নি। পরিবার, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, বিয়ে এ সকল প্রতিষ্ঠানে বদল ঘটিয়েছে। অথবা,
বিষয়টাকে এভাবে বলা যায়, ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা বড় ধরনের বদল ঘটিয়েছে (প্রতিষ্ঠান গঠন,
নীতিমালা প্রণয়ন ইত্যাদি) যা এদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতির উপর প্রভাব ফেলেছে।
এবং, গভীর ও সামগ্রিক বদল করে তুলছে আবশ্যিক, অনিবার্য। এর প্রভাব এদেশের মানুষের দৈনন্দিন
জীবনযাপনেও প্রতিফলিত হয়েছে। এবং বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী চলে যাবার পরও তাদের প্রদত্ত ব্যবস্থা
টিকে আছে।
এই প্রসঙ্গে আরো কিছু কথা বলা প্রয়োজনীয়। প্রথমত, বৃটিশ উপনিবেশকালের প্রভাব “ভালো”, বা
“মন্দ” দিয়ে বোঝা যাবে না। বিষয়গুলো অত সহজ, সরল নয়। আরো তলিয়ে দেখা, গভীরভাবে দেখা
জরুরী। দ্বিতীয়ত, পরিবার, বিয়ে, বংশ-পরিচয় Ñ এ সকল বিষয়ের সঙ্গে রাজনীতি বা অর্থনীতি
সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু মনে রাখা জরুরী যে, এই আন্তঃসম্পর্ক সহজ এবং সরল নয়, বরং জটিল।
ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রত্যক্ষ। তৃতীয়ত, সমাজে যে বিভাজনগুলো বিদ্যমান, যেমন ধরুন শ্রেণী ও জাতিগত
বিভাজন, আরো ধরুন, ধর্মীয় ভিন্নতা Ñ এগুলো জ্ঞাতি সর্ম্পককে (উদাহরণস্বরূপ, বিয়ে), জ্ঞাতিভিত্তিক
প্রতিষ্ঠানকে (উদাহরণস্বরূপ, বংশ) ভিন্নতা দান করে। একই দেশের বাসিন্দা হলে কি হবে, গরিব
পরিবারের সন্তানের ভূমিকা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের ভূমিকা থেকে ভিন্ন। গরিব পরিবারের সন্তান
অল্প বয়স হতে পারিবারিক আয় বৃদ্ধির কাজ করেন। অথবা, নিজ ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন পক্ষান্তরে,
মধ্যবিত্ত সন্তান দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিবারের উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল থাকেন। একই দেশের
বাসিন্দা হলে কি হবে, মান্দাই (যাদের বাঙ্গালিরা নেতিবাচক গারো নামে ডাকেন)-দের বংশধারা
মাতৃসূত্রীয়, আর বাঙ্গালিদের হচ্ছে পিতৃসূত্রীয়। বাঙ্গালি হিন্দুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় কাজিন-বিবাহ নিষিদ্ধ
কিন্তু বাঙ্গালি মুসলমান সমাজে এর প্রচলন রয়েছে। আবার, বাঙ্গালি হিন্দু কি বাঙ্গালি মুসলমান, মধ্যবিত্ত
শ্রেণী মাত্রই সন্তান অল্প বয়স থেকে আয়করী ভূমিকা গ্রহণ করে না। এক কথায় বললে, বিভিন্ন সূত্র
(শ্রেণী, জাতি, ধর্ম) জ্ঞাতিসম্পর্ককে ভিন্নতা, আবার সমরূপতা দান করে। আবার একই সাথে
লক্ষ্যণীয়, শ্রেণী, জাতি, ধর্মীয় ভিন্নতা সত্তে¡ও, গড়ে সকল জনগোষ্ঠীর পুরুষেরা, তাদের নিজ
জনগোষ্ঠীর নারীদের তুলনায় ক্ষমতাশালী। এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। বদল রাতারাতি ঘটে না, আবার
সকল ক্ষেত্রে একইভাবে বা সমভাবে বদল ঘটে না। চতুর্থত, জ্ঞাতিসম্পর্ক অনড়, অটল, অপরিবর্তনীয়
কিছু নয়। এগুলো বদলায়। বদলের ধরন কি তা অনুসন্ধানযোগ্য। অনুসন্ধান না করে ঢালাও ভাবে কিছু
বলা ঠিক নয়। এসব বিষয় আরো বিস্তারিতভাবে পরবর্তী পাঠগুলোতে আলোচিত হবে।
জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন যেসব বিষয়
ঘিরে গঠিত সেসব বিষয়
আপনার, আমার, আমাদের
সত্তা, পরিচিতি, মূল্যবোধ,
দৈনন্দিন জীবন-যাপন,
কার্যকলাপ, ঠিক-বেঠিকের
ধারণা, নীতি-নৈতিকতা
এসবকে বিশ্লেষণের খাতিরে,
বৃহত্তর প্রেক্ষিতে স্থাপন করে।
প্রেক্ষিত বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট
স্থান-কাল।
ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা বড়
ধরনের বদল ঘটিয়েছে
(প্রতিষ্ঠান গঠন, নীতিমালা
প্রণয়ন ইত্যাদি) যা এদেশের
অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ,
সংস্কৃতির উপর প্রভাব
ফেলেছে। এবং, গভীর ও
সামগ্রিক বদল করে তুলছে
আবশ্যিক, অনিবার্য।
কথা হচ্ছিলো জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নে যেসব বিষয় পঠিত তা কিভাবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন, আমাদের
সত্তা, আত্ম-পরিচিতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে বিজড়িত। এই বিজড়ন বিষয়গুলো বোঝার ক্ষেত্রে মাঝে
মাঝে সমস্যা তৈরী করতে পারে। ধরুন, একজন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানী যখন তাঁর বিষয় নিয়ে কথা বলেন,
তখন তার কথা আমরা নিরঙ্কুশ ভাবে মেনে নেইনি। তিনি ইলেকট্রন, প্রোটনের সংজ্ঞা দিতে চাইলে
তাঁর সাথে আমরা বিতর্কে নামি না। ধরে নিই তিনি যা বলছেন তা বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞান এবং সাধারণ
মানুষ হিসেবে আমাদের জ্ঞান স্বল্প, সীমিত। কিন্তু সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জ্ঞাতি
সম্পর্ক বিষয়াদির ক্ষেত্রে, যেহেতু আমরা সকলেই পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি, অথবা জন্মগ্রহণ করা
উচিৎ বলে মনে করি এবং নির্দিষ্ট পারিবারিক সম্পর্ক, দৈনন্দিন জীবন-যাপনে অভ্যস্ত, আমরা নিজের বা
নিজেদের ধারণা, নিজের বা নিজেদের কার্যকলাপ ঠিক এবং সবচাইতে গ্রহণযোগ্য, স্বাভাবিক বলে মনে
করে থাকি। ভিন্ন ধরনের কিছু শুনলে আমরা ধাক্কা খাই, হয়তো বা আতঙ্কিত হই। ধরুন, “বাচ্চা
মানুষ করার দায়িত্ব তার মায়ের”; “মায়ের ¯েœহ, পরিচর্যা না পেলে বাচ্চা হয় বেয়াড়া অথবা রুগ্ন হয়ে
উঠতে বাধ্য” Ñ এই ধারণা ইলেকট্রন, প্রোটনের মতো বিমূর্ত (ধনংঃৎধপঃ) বা দূরের নয়। বাচ্চা মানুষ
করার দায়িত্ব আসলে কার Ñ এ বিষয়ে আমাদের দৃঢ় ধারণা আছে, যা আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের
অংশ।
প্রচলিত ধ্যান-ধারণা
সঠিক-বেঠিকের ধারণা শক্তিশালী, এবং সামাজিক। এই ধারণার শক্তিমত্তার ভিত্তি প্রত্যক্ষ বলপ্রয়োগ
নয়। তার মানে, কেউ আমাদের নিরন্তর মারধর করে এসব ধারণা গ্রহণে বাধ্য করছে না। তবে
বলপ্রয়োগ, অথবা চাপপ্রয়োগ শর্ত হিসেবে কাজ করে। বিশেষ সময়কালে, বিশেষ সমাজ ব্যবস্থায়
নির্দিষ্ট জীবনযাপন প্রণালী স্বাভাবিক মনে হয়। স্বাভাবিকত্বের ধারণা সামাজিক ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গে
যুক্ত, যেমন: শ্রেণী, লিঙ্গ, জাতিসত্তা ইত্যাদি। অনেকে বলবেন, স্থানিক সামাজিক সমস্যা বিশ্বব্যাপী
বৈষম্য ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত, বহু ক্ষেত্রে অপ্রত্যক্ষ ভাবে। সা¤প্রতিক কালের নৃবিজ্ঞানের একটি ধারা
স্বাভাবিকত্বের (হড়ৎসধষপু) ধারণা নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরী মনে করছে। এই মহলের নৃবিজ্ঞানীদের
যুক্তি হ’ল, বিশেষ কিছু ক্ষমতার সম্পর্ক এবং সামাজিক স্বার্থ কিভাবে টিকে আছে, এবং গ্রহণযোগ্যতা
লাভ করে Ñ সেটি বোঝা সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। একই সাথে তারা উদ্ঘাটন
করছেন কিভাবে প্রাথমিক পর্যায়ের ইউরোপীয় নৃবিজ্ঞানীরা তাদের নিজ সমাজের স্বাভাবিকত্বের ধারণা
নিয়ে ইউরোপের বাইরের (অ-ইউরোপীয়) সমাজে গবেষণা করেছিলেন। ইউরোপীয় সমাজের
স্বাভাবিকত্বের ধারণার মাপকাঠিতে অন্যান্য সমাজের রীতি-নীতি, প্রথা, মূল্যায়ন ও বিচার করেছিলেন।
সামাজিক স্বার্থ উদ্ঘাটনের একটা রাস্তা হ’ল, এই দৃষ্টিভঙ্গির নৃবিজ্ঞানীদের মতে, ভাষা বিশ্লেষণ।
প্রাত্যহিক জীবনে উচ্চারিত ভাষা Ñ মতামত, ভাবনা Ñ সমাজের সকল মানুষের অভিজ্ঞতা, কিংবা
ভাবনা, কিংবা আকাক্সক্ষাকে ধারণ বা প্রকাশ করে না। সমাজে ক্ষমতাশালী যারা Ñ অর্থবিত্তের দিক
দিয়ে, মান-মর্যাদায়, লিঙ্গীয় বা জাতিগত পরিচয়ে Ñ তাদের ভাবনাচিন্তাও শক্তিশালী। তাদের সামাজিক
অস্তিত্ব নিæবর্গের মানুষজনের জীবনযাপন শুধু নয়, চিন্তাকেও প্রান্তিক বা কোণঠাসা করে তোলে। এবং
এই নৃবিজ্ঞানীরা বলবেন, ভাষা যেহেতু জীবনযাপন প্রণালীকে, অভিজ্ঞতাকে আকৃতি দেয় (“বাবা মারা
যাওয়াতে পুরো পরিবার পথে বসে গেছে”, “মামা’দের অবস্থা ভালো ছিল, ওদের অসুবিধা হয় নাই”)
ভাষা বিশ্লেষণের রাস্তা হল, কোন উক্তি, অভিমত বা বক্তব্যকে সকলের জন্য প্রযোজ্য, কিংবা তা
সকলের মতামতকে প্রতিফলিত করে Ñ এটা ধরে না নেয়া। অর্থাৎ, যা উচ্চারিত হয় সেক্ষেত্রে এই
প্রশ্নগুলো করা জরুরী: কে বলছে? কার/কাদের সম্বন্ধে বলছে? বলার মধ্যে দিয়ে কি প্রকাশিত হচ্ছে,
কি উহ্য থেকে যাচ্ছে? তাঁরা বলবেন, জরুরী হচ্ছে প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত, দুটো বক্তব্যকেই নির্দিষ্ট
সামাজিক প্রেক্ষিতে স্থাপন করে সেটির বিশ্লেষণ করা। বিষয়টাকে স্পষ্ট করার জন্য আবার পূর্বের
উদাহরণে ফিরে যাই: “বাচ্চা মানুষ করার দায়িত্ব তার মায়ের”। এই বাক্যে মায়ের দায়িত্ব যেমন
সা¤প্রতিক কালের নৃবিজ্ঞানের
একটি ধারা স্বাভাবিকত্বের
(হড়ৎসধষপু) ধারণা নিয়ে প্রশ্ন
তোলা জরুরী মনে করছে। এই
মহলের নৃবিজ্ঞানীদের যুক্তি হ’ল,
বিশেষ কিছু ক্ষমতার সম্পর্ক এবং
সামাজিক স্বার্থ কিভাবে টিকে
আছে, এবং গ্রহণযোগ্যতা লাভ
করে Ñ সেটি বোঝা সাংস্কৃতিক
নৃবিজ্ঞানের প্রধান লক্ষ্য হওয়া
উচিত।
সামাজিক স্বার্থ উদ্ঘাটনের
একটা রাস্তা হ’ল - ভাষা
বিশ্লেষণ ।
উপস্থিত করে তোলা হচ্ছে, বাবার দায়িত্বকে অনুপস্থিত করে রাখা হচ্ছে। আবার, মা বলতে জৈবিক
মা-কেই বোঝান হয়েছে।
আমাদের সমাজে প্রচলিত, এবং শক্তিশালী, এ ধরনের কিছু বক্তব্য নিচে হাজির করা হচ্ছে। আপনার
কাজ হচ্ছে এগুলো নিয়ে ভাবা। যেমন ধরুন, পরিবার নিয়ে একটা কথা প্রায় উচ্চারিত হয়ে থাকে:
“যুগ যুগ ধরে পরিবার ব্যবস্থা অপরিবর্তিত রূপে টিকে আছে”।
এ ধরনের ভাবনা কি প্রকাশ করে? কোন পরিস্থিতিতে এটা কে বা কারা উচ্চারণ করে থাকে? পরিবারের
অপরিবর্তনশীলতার এই ধারণা কি আমরা সঠিক বলে ধরে নিতে পারি? আবার খেয়াল করে দেখেন,
জ্ঞাতি-পরিবার-বিয়ে, এসব বিষয়ে নানান কথা অহরহ উচ্চারিত হয় “বর্বর” এবং সভ্য এই মানদন্ড
অনুসারে। এর নানান কাল্পনিক নমুনা উপস্থাপন করা যায়। যেমন:
“পৃথিবী জুড়ে ট্রাইবালরা অসভ্য। ওদের নীতি-নৈতিকতা বোধ কম...। ওদের সভ্য করে
তোলা হচ্ছে শিক্ষিত মানুষের দায়িত্ব”।
সা¤প্রতিক কালের কিছু নৃবিজ্ঞানীদের অবস্থান হচ্ছে: সভ্য-অসভ্যতার মানদন্ড তৈরী হয়েছে
ঐতিহাসিকভাবে। আফ্রিকা এবং এশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। কয়েক ’শ
বছরের ঔপনিবেশিক সময়কালে এই শক্তিশালী ধারণাগুলো প্রতিষ্ঠা পায় যে, পাশ্চাত্য সমাজ হচ্ছে
“সভ্য” এবং অপাশ্চাত্য সমাজ হচ্ছে “অসভ্য”। এবং এই ধারণাগুলো স্বতঃসিদ্ধ হয়ে উঠে। মজার
ব্যাপার হ’ল বিংশ শতকের মাঝামাঝি ইউরোপীয় শাসনের অবসান ঘটে এবং তারপর, যখন একটি
গড়ে-ওঠা দেশীয় শাসক গোষ্ঠী স্বাধীন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন, তাঁরা নিজ দেশের গরিব,
নিপীড়িত মানুষজনকে একই ভাষায় চিত্রিত করা, কিংবা গাল-মন্দ করা, আরম্ভ করেন।
নিæবর্গের মানুষজন যেমন কিনা গরিবদের ক্ষেত্রে এধরনের বিদ্বেষমূলক কথা প্রায়-প্রায় শুনে থাকি
আমরা:
“ছোটলোকেরা শুধু বাচ্চা পয়দা করতে পারে, কিন্তু কই, তাদের তো মানুষ করতে পারে না”
“গরিবের বিয়ের কি আর ঠিক-ঠিকানা আছে? এই মুহূর্ত বিয়ে করে, পর মুহূর্তে ছাড়ে”;
“আচার-আচরণ দেখলেই বোঝা যায় কে ভদ্র ঘরের সন্তান”।
সমস্যা ভদ্রতা নিয়ে নয়। সমস্যা হচ্ছে, ধরে নেয়া হয় যে, একটি বিশেষ শ্রেণী (বড় লোক)-র মানুষ
ভদ্র। এবং সমাজে কেবলমাত্র তারাই ভদ্র। ভদ্রতার যে মাপকাঠি যেমন পোশাক-আশাক, স্বাস্থ্য,
চেহারা-সুরত, আত্মবিশ্বাস এগুলো মূলত শ্রেণীগত ব্যাপার। এধরনের প্রত্যক্ষ, দৃশ্যমান বিষয়ের উপর
গুরুত্বারোপ করলে অপ্রত্যক্ষ এবং মৌলিক বিষয় থেকে আমাদের দৃষ্টি সরে যায়। এটি সামাজিক
বিষয়াদি বুঝতে সমস্যা তৈরী করে। শ্রেণী হচ্ছে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বৈষম্যভিত্তিক
একটি ব্যবস্থা। আবারো উল্লেখ্য করা জরুরী, সমস্যা ভদ্রতা নিয়ে নয়। সমস্যা হচ্ছে, সাধারণভাবে ধরে
নেয়া হয় যে উচ্চ শ্রেণীর মানুষজন, এবং কেবলমাত্র তারাই, ভদ্র। অন্যান্য শ্রেণীর মানুষজন Ñ গরিব,
দুঃস্থ, খেটে-খাওয়া মানুষজন মাত্রই অভদ্র।
“সভ্য-অসভ্য”, “ভদ্র-অভদ্র” যেমন শক্তিশালী মানদন্ড, একইভাবে “পাশ্চাত্য-অপাশ্চাত্য” Ñ এটাও
একটা শক্তিশালী মানদন্ড হিসেবে কাজ করে থাকে এবং প্রাত্যহিক জীবনে আমরা এই মানদন্ড ভাষার
মাধ্যমে স্বতঃসিদ্ধ করে থাকি। পাশ্চাত্য দেশ সম্বন্ধে প্রায়শই দুই ধরনের ঢালাও মন্তব্য শোনা যায়:
বিংশ শতকের মাঝামাঝি
ইউরোপীয় শাসনের অবসান ঘটে
এবং তারপর, যখন একটি গড়েওঠা দেশীয় শাসক গোষ্ঠী স্বাধীন
দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন,
তাঁরা নিজ দেশের গরিব,
নিপীড়িত মানুষজনকে একই
ভাষায় চিত্রিত করা, কিংবা গালমন্দ করা, আরম্ভ করেন।
“পাশ্চাত্য দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে উন্নত কিন্তু পরিবারে স্থিতিশীলতা নাই...। ওখানে তো
শুনি কথায় কথায় ডিভোর্স হয়...। আমাদের দেশ উন্নত না হলেও কি হবে, অন্ততঃ ওদের
মতন বিশৃঙ্খল তো আর না। অবশ্য আজকাল ......”
লক্ষ্য করা জরুরী, কে বলছে, কোন প্রেক্ষিতে বলছে? এটা বলে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছেন তিনি?
আবার, পাশ্চাত্য দেশ সম্বন্ধে একেবারে ভিন্ন, ইতিবাচক, ঢালাও মন্তব্য শোনা যায়, যেমন:
“পাশ্চাত্য দেশগুলি ভালো: নারী-পুরুষের সমান অধিকার আছে, ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তগ্রহণের
স্বাধীনতা রয়েছে... আমাদের দেশে তো সবকিছু চাপিয়ে দেয়া হয়...”
ঢালাও মন্তব্য কিংবা সাধারণীকরণ সামাজিক সম্পর্ক বুঝতে আমাদের সাহায্য করে না। বরং, বহু
ক্ষেত্রে, ঢালাও মন্তব্য করা হয় বিদ্যমান কোন সমস্যার উপস্থিতি অস্বীকার করতে। এই কারণে, যে
কোন বক্তব্য কিংবা উক্তি কিংবা মন্তব্যের ব্যাপারে, চিন্তাভাবনার ব্যাপারে, আমরা কি প্রক্রিয়ায় ভাবি,
কোন ধরনের জিনিসকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে থাকি এগুলো নিয়ে ভাবা জরুরী।
সারাংশ
উপরের আলোচনাকে সংক্ষেপ করলে এরকম দাঁড়ায়: জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের বিষয় প্রাত্যহিক জীবনকে
ঘিরে। নৃবিজ্ঞানীর একটি প্রধান কাজ হচ্ছে প্রেক্ষিতকরণ (পড়হঃবীঃঁধষরুধঃরড়হ)। প্রেক্ষিতকরণ বলতে
বোঝায় স্থান-কাল নির্দিষ্টকরণ অর্থাৎ, যেহেতু ঢালাও বক্তব্য বাস্তব অবস্থা, জটিলতা বোঝার ক্ষেত্রে
প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে সে কারণে সেটাকে নিরন্তর এড়িয়ে চলা জরুরী। নিজ সমাজের ধ্যান-ধারণা,
আচার, প্রথা অনেকাংশেই সেই সমাজের অধিবাসীর কাছে “স্বাভাবিক” মনে হয়। প্রাথমিক পর্যায়ের
ইউরোপীয় নৃবিজ্ঞানীরা নিজ সমাজকে স্বাভাবিকত্বের মানদন্ড ধরে নিয়েছিলেন। হাল-আমলের
নৃবিজ্ঞানীদের মতে, ক্ষমতা এবং সামাজিক স্বার্থের সঙ্গে স্বাভাবিকতা সম্পর্ক-যুক্ত এবং এটাই হওয়া
উচিত অনুসন্ধানের বিষয়। ভাষা বিশ্লেষণ হচ্ছে সামাজিক ক্ষমতা এবং স্বার্থ উদঘাটনের একটা রাস্তা।
ভাষা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নৃবিজ্ঞানী সর্বদা মাথায় রাখেন যে, সামাজিক অবস্থা এবং অভিজ্ঞতা সকলের
একরকম নয়, সেকারণে তিনি মনোযোগ দেন এসব বিষয়ের উপর: কে বলছে? কার/কাদের সম্বন্ধে
বলছে? এই পুনরুচ্চারণের মধ্য দিয়ে কি কি বিষয় “সত্য” হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়?
ঢালাও মন্তব্য কিংবা
সাধারণীকরণ আমাদের
সামাজিক সম্পর্ক বুঝতে সাহায্য
করে না। বরং, বহু ক্ষেত্রে,
ঢালাও মন্তব্য করা হয় বিদ্যমান
কোন সমস্যার উপস্থিতি
অস্বীকার করতে। এ কারণে, যে
কোন বক্তব্য কিংবা উক্তি কিংবা
মন্তব্যের ব্যাপারে, চিন্তাভাবনার
ব্যাপারে, আমরা কি প্রক্রিয়ায়
ভাবি, কোন ধরনের জিনিসকে
প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে থাকি
এগুলো নিয়ে ভাবা জরুরী।
বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান পরিচিতি পৃষ্ঠা-৪৭
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন -
১। প্রথম এথনোগ্রাফি রচয়িতা কে?
ক. ম্যালিনেস্কি খ. ক্লদ লেডি - স্ট্রস
গ. র্যাডক্লিফ-ব্রাউন ঘ. লুইস হেনরী মর্গান
২। মর্গানের ‘লীগ অফ দ্য ইরোক ওয়া’ কত সালে প্রকাশিত হয়?
ক. ১৮৫১ খ. ১৮৪১
গ. ১৮৬১ ঘ. ১৮৩১
৩। স্বতন্ত্র জ্ঞানকান্ড হিসেবে নৃবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা লাভে কোন বইটিকে একটি মাইলফলক হিসেবে
স্বীকার করা হয় -
ক. সিস্টেমস অফ অফ কনস্যাঙ্গুইনিটি এ্যান্ড এফফিনিটি
খ. লীগ অফ দ্য ইরোক ওয়া
গ. এনশিয়েন্ট সোসাইটি
ঘ. এফফিনিটি এ্যাজ এ ভ্যালিউ
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। নৃবিজ্ঞানের সূচনালগ্নে কোন তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গি শক্তিশালী ছিল? এই তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গির সকল
অনুসারীরা কি একইভাবে ভাবতেন?
২। কোন কোন সূত্র জ্ঞাতিসম্পর্ককে ভিন্নতা দান করে, আবার সমরূপতাও তৈরী করে?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। প্রেক্ষিতকরণ কী? এটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
২। সঠিক-বেঠিকের ধারণা শক্তিশালী এবং সামাজিক। উদাহরণের সাহায্যে আলোচনা করুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত