জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা কী?
প্রাচ্যবাদ কী?


 পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণায় “আদিম” এবং “সভ্য” হিসেবে সমাজের বিভাজন
 জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা এবং নৃবিজ্ঞানের জন্য জ্ঞাত্বিতের গুরুত্ব
“সমাজ” এবং “জ্ঞাতিত্ব” Ñ এই দুই প্রত্যয়ের অর্থ কি, এ দুয়ের আন্তঃসম্পর্ক কি Ñ এসব হচ্ছে এই
পাঠের বিষয়। সর্বপ্রথমে, কয়েকটি বিষয়ের ব্যাপারে স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এক: সমাজ এবং জ্ঞাতিত্ব,
এগুলো হচ্ছে প্রত্যয়। অর্থাৎ, এমন ধারণা যা শুধুমাত্র বর্ণনামূলক নয়, বরং ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ করতে
সাহায্য করে। উদাহরণ স্বরূপ: “পরিবার হচ্ছে একটি সামাজিক গোষ্ঠী যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী
ও ছেলে-মেয়েদের একত্রে বসবাস”। এধরনের বাক্য বর্ণনামূলক বিবরণের অংশ। পক্ষান্তরে,
“ইংল্যান্ডের শিল্পপতি শ্রেণীর গঠনকালে, বিয়ে এই শ্রেণীর অর্থনৈতিক পাটাতন হয়ে ওঠে” Ñ এই
বাক্যটি বিশ্লেষণমূলক হিসেবে বিবেচিত হবে। কেন? লক্ষ্য করুন প্রথম বাক্যে কোন নির্দিষ্টতা নেই।
কোন্ সমাজের কথা বলা হচ্ছে, কোন সময়কালের কথা বলা হচ্ছে, কোন্ শ্রেণী কিংবা কোন্
জাতিসত্তা, অথবা কোন্ ধর্মাবলম্বীদের সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, কিছুই স্পষ্ট না। অনেকে একমত হবেন যে,
এটি একটি কালোত্তীর্ণ স্বর, এবং এটি (লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, এবং ঔচিত্যবোধ ছাড়া) কিছু বুঝতে সাহায্য
করে না। দ্বিতীয় যে বাক্যটি আপনি পড়লেন, সেখানে আপনি লক্ষ্য করুন, একটি প্রধান বক্তব্য হাজির
করা হচ্ছে: বিয়ে এবং শ্রেণী গঠন আন্তঃসম্পর্কিত। অর্থাৎ বিয়ে শ্রেণী নিরপেক্ষ নয়, বিয়ে আকাশ থেকে
পড়ে না। বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে বিয়ের বিশেষ অর্থ দাঁড়ায়। বিয়ে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক
ক্ষমতার শর্তসাপেক্ষ। যে শ্রেণীর (ইংরেজ শিল্পপতি শ্রেণী) কথা বলা হচ্ছে, সেটি ছিল ক্ষমতাশালী
শ্রেণী। কেবলমাত্র ইংল্যান্ডের পরিসরে নয়, সমগ্র বিশ্বে এই শ্রেণীর ক্ষমতা ধীরে ধীরে স¤প্রসারিত হয়।
তার মানে কি এই যে, বর্ণনা কাজের কিছু না? তা নয় মোটেই। বর্ণনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বর্ণনার
খাতিরে করা বর্ণনা নয়। দ্বিতীয় বাক্যের বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করতে লিওনর ডেভিডফ এবং ক্যাথরিন হল
বর্ণনার সাহায্য নিয়েছেন। মোট কথা, বর্ণনার লক্ষ্য উদ্দেশ্য থাকা জরুরী।
কথা হচ্ছিল, সমাজ এবং জ্ঞাতিত্ব যে প্রত্যয়, তা নিয়ে। সামাজিক বিজ্ঞানে এমন শব্দ রয়েছে যা
মানুষজন প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করে, যেমন: ইতিহাস, শ্রেণী, জাতীয়তাবাদ, পরিবার ইত্যাদি।
এই একই শব্দগুচ্ছ আবার সমাজবিজ্ঞানীদের জন্য বিশেষ অর্থ বহন করে। এগুলো সাধারণ শব্দ হিসেবে
না, বরং প্রত্যয় হিসেবে বিবেচিত। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সচরাচর এমনটি ঘটে না। ইলেকট্রন,
প্রোটন, এটম এগুলো সাধারণত বৈজ্ঞানিক আলাপচারিতার বাইরে ব্যবহৃত হয় না (১ নং পাঠে
বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে)। নৃবিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে, এই
সাধারণভাবে ব্যবহৃত শব্দের যে বিশেষ প্রত্যয়গত ওজন আছে, সে ব্যাপারে সতর্ক হতে শেখা জরুরী।
দুই, সমাজ এবং জ্ঞাতিত্ব Ñ নৃবিজ্ঞানীরা এ দুই প্রত্যয়ের-ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। তাদের ব্যাখ্যা
বিশ্লেষণের পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়, এ দুটি প্রত্যয়ের অর্থ সকল নৃবিজ্ঞানীর কাছে এক রকম নয়।
নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন তাত্তি¡ক ধারা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখেছে বিষয়গুলোকে। হয়তো বা এমনটা ঘটেছে যে,
পাঠ - ২
মনে রাখবেন, নৃবিজ্ঞঅখন্ড জ্ঞানকান্ড নয়।সকল জ্ঞানকান্ডের মতনৃবিজ্ঞানও বেড়ে উঠেশক্তিশালী হয়েছে ভিনচিন্তাসূত্রে, এবং নানানতর্ক বিতর্কের মাধ্যমেচিন্তাসূত্রে, এবং নানানতর্ক বিতর্কের মাধ্যমেসমাজ এবং জ্ঞাতিত্ব, এগুলো
হচ্ছে প্রত্যয়। অর্থাৎ, এমন
ধারণা যা শুধুমাত্র বর্ণনামূলক
নয়, বরং ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ
করতে সাহায্য করে।
কোন একটি তাত্তি¡ক ধারা যেই বিশেষ ভাবে একটি প্রত্যয়ের অর্থ দাঁড় করিয়েছে, অন্য তাত্তি¡ক ধারা
আবার সেই অর্থকেই প্রত্যাখ্যান করেছে। তিন, মনে রাখবেন, নৃবিজ্ঞান কোন অখন্ড জ্ঞানকান্ড নয়।
অপরাপর জ্ঞানকান্ডের মতন নৃবিজ্ঞানও বেড়ে উঠেছে, শক্তিশালী হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাসূত্রে, এবং
নানান ধরনের তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে।
এই পাঠের প্রথম অংশে, অতি সংক্ষেপে নৃবিজ্ঞানের (এবং সামাজিক বিজ্ঞান) কিছু কেন্দ্রীয় তাত্তি¡ক
ধারার সাথে আপনার পরিচয় ঘটানো হবে। ধারাগুলো হলো: ১. বিবর্তনবাদ ২. মার্ক্সবাদ ৩. ক্রিয়াবাদ
৪. কাঠামোবাদ ৫. প্রতীকবাদ এবং ৬. নারীবাদ। নৃবিজ্ঞান (এবং সামাজিক বিজ্ঞান) বোঝার জন্য,
ব্যবহার করার জন্য তত্ত¡ এবং প্রত্যয়ের সাথে একটি নূন্যতম পরিচয় প্রয়োজন। নিচের এই সংক্ষিপ্ত
পরিচিতি এই উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে। এই পাঠের দ্বিতীয় অংশে জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা এবং জ্ঞাতিত্ব
নৃবিজ্ঞানে কি গুরুত্ব বহন করে তা আলোচিত হয়েছে।
বিভিন্ন তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গি
১. বিবর্তনবাদ (ঊাড়ষঁঃরড়হরংস): বিবর্তনবাদী তত্ত¡ মতে, একটি প্রজাতি অথবা একটি বিশিষ্ট
জীবের জনসমষ্টি কাঠামোগতভাবে ক্রম পরিবর্তিত হয়। প্রতিবেশের সাথে আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে এই
কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটে থাকে। বংশ (যবৎবফরঃু) এবং প্রতিবেশ (বপড়ষড়মু), কোনটার ভূমিকা
কতখানি, এ নিয়ে বিবর্তনবাদে বিভিন্ন তাত্তি¡ক ধারা রয়েছে। এসত্তে¡ও, মোটের উপর বিবর্তনবাদ ধরে
নেয় যে, প্রতিবেশের সাথে জীবের অধিকতর উপযোগী হয়ে উঠা হচ্ছে বিবর্তনের সামগ্রিক ধারা। এবং
বির্বতনবাদীরা ধরে নেন, একটি নির্দিষ্ট প্রতিবেশের উপযোগী হয়ে উঠার সাথে সাথে প্রতিটি প্রজাতি
অধিকতর জটিল, পৃথকীকৃত এবং বিচিত্র হয়ে উঠে। জৈবিক বিবর্তনের এই ধারণা সামাজিক বিজ্ঞানে
আমদানি করা হয়, ব্যবহার করা হয়। যে দৃষ্টিভঙ্গি দাবি করে যে, সমাজ এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির
(যেমন পরিবার, বিবাহ) পরিবর্তন বিবর্তনের ধারণার মাধ্যমে বোঝা সম্ভব, তাকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক
বিবর্তন বলা হয়। (বিবর্তনের দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে ৩ নং পাঠে। দেখুন “পরিবারের উৎপত্তি এবং
বিকাশ সম্পর্কিত তত্ত¡”)। উনবিংশ শতক ছিলো বিবর্তনবাদী তত্তে¡র স্বর্ণযুগ। নৃবিজ্ঞানে বিবর্তনবাদী
ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন মর্গান, ম্যাকলেনান, মেইন, বাকোফেন, টায়লর, ফ্রেজার এবং আরও
অনেকে।
ক্রিয়াবাদীদের দৃষ্টিতে, বিবর্তনবাদ হচ্ছে কুর্সী-কেদারায় বসে বসে করা নৃবিজ্ঞান। সকল মানব সমষ্টির
ক্রম পরিবর্তনের যে ধারণা ধরে বিবর্তনবাদীরা এগোন, সেটি সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সমগ্র
বিশ্বের যে ঐকিক ইতিহাস বিবর্তনবাদ দাঁড় করায়, তা বিভিন্ন অঞ্চলের, ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাসের
নির্দিষ্টতাকে অস্বীকার করে। এটি হচ্ছে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান সমালোচনা।

২. ক্রিয়াবাদ (ঋঁহপঃরড়হধষরংস): সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানাদি, সর্ম্পক এবং আচরণ
সামাজিক সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় কি কার্য পালন করে ক্রিয়াবাদ তারই তত্ত¡। এই তাত্তি¡ক কাঠামো বিংশ
শতকের বৃটিশ নৃবিজ্ঞানের সবচাইতে শক্তিশালী ধারা ছিল। বলা হয়, বৃটিশ নৃবিজ্ঞানীরা উদ্বুদ্ধ
হয়েছিলেন ফরাসী সমাজতাত্তি¡ক এমিল ডুর্খাইম দ্বারা। ক্রিয়াবাদী তত্ত¡ বিশেষ করে বৃটিশ নৃবিজ্ঞানী
ব্রনি¯- ম্যালিনোস্কির নামের সাথে যুক্ত। তিনি বিবর্তনবাদের ভাবনা চিন্তা প্রত্যাখ্যান করে এই তাত্তি¡ক
কাঠামোর প্রবর্তন ঘটান। ম্যালিনোস্কির দৃষ্টিতে মনুষ্য প্রাণীর মৌলিক চাহিদা পূরণ করার যে ভূমিকা
সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদি পালন করে থাকে, সেটাই হচ্ছে ক্রিয়া। এবং “চাহিদা” পূরণের এই ক্রিয়াই
হওয়া উচিত নৃবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু। ম্যালিনোস্কির দৃষ্টিতে চাহিদা দুই প্রকার: মৌলিক (দৈহিক
এবং অনুভূতিমূলক) এবং গৌণ।
ম্যালিনোস্কির দৃষ্টিতে মনুষ্য
প্রাণীর মৌলিক চাহিদা পূরণ
করার যে ভূমিকা সামাজিক
প্রতিষ্ঠানাদি পালন করে থাকে,
সেটাই হচ্ছে ক্রিয়া।
বিবর্তনবাদী তত্ত¡ মতে, একটি
প্রজাতি অথবা একটি বিশিষ্ট
জীবের জনসমষ্টি
কাঠামোগতভাবে ক্রম
পরিবর্তিত হয়।
ম্যালিনোস্কির মৃত্যুর পর তাঁর ছাত্র র‌্যাডক্লিফ-ব্রাউন ক্রিয়াবাদী চিন্তা ভাবনার নতুন নামকরণ করলেন:
কাঠামোগত-ক্রিয়াবাদ। অনেকের মতে, এই নামকরণ অহেতুক জটিলতা সৃষ্টি করেছে। র‌্যাডক্লিফব্রাউনের দৃষ্টিতে, সমাজ কাঠামো হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক এবং প্রতিষ্ঠানের সেই জাল যা সমাজের টিকে
থাকা নিশ্চিত করে। অপর পক্ষে, ক্রিয়া বলতে তিনি বুঝিয়েছেন সামাজিক সম্পর্ক এবং প্রতিষ্ঠানের
ক্রিয়াশীলতা। তাঁর যুক্তি ছিল এরূপ: সমাজ হচ্ছে একটি সমগ্র যা টিকে থাকে। নির্দিষ্ট কোন সমাজে,
সমাজের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন রাজনীতি, অর্থনীতি, জ্ঞাতিত্ব, ধর্ম এগুলো নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন
করে। সমাজ এ কারণে টিকে থাকে। শুধুমাত্র টিকে থাকে বললে ভুল হবে। সমাজ, র‌্যাডক্লিফব্রাউনের দৃষ্টিতে, সুসংহত এবং সুসমন্বিতভাবে বারে বারে পুর্নজন্ম লাভ করে।
ক্রিয়াবাদের প্রধান সমালোচনা হ’ল: প্রথমত, ক্রিয়া এবং কাঠামোর যে ধারণা কাঠামোগত-ক্রিয়াবাদীরা
দিয়ে থাকেন সেগুলো অনৈতিহাসিক। অর্থাৎ, সমাজের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক যে রূপান্তর ঘটে থাকে তা
এই দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে বোঝা সম্ভব না। দ্বিতীয়ত, এই দৃষ্টিভঙ্গি অভ্যন্তরীণ সংঘাত বা দ্ব›দ্ব Ñ এই
প্রসঙ্গটিকে এড়িয়ে চলে।
৩. কাঠামোবাদ (ঝঃৎঁপঃঁৎধষরংস): কাঠামোবাদের সূত্রপাত ঘটে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন
হিসেবে। এই আন্দোলন প্রথমে দানা বাঁধে ভাষাতত্তে¡ । পরবর্তী পর্যায়ে, এই দৃষ্টিভঙ্গি নৃবিজ্ঞান, দর্শন
এবং সাহিত্য সমালোচনায় ছড়িয়ে পড়ে। নৃবিজ্ঞানে এর জনক ক্লদ লেভি-স্ট্রস। তাঁর দৃষ্টিতে, মনুষ্য
মন ও মনুষ্য সংস্কৃতি বোঝার মডেল হচ্ছে ভাষাতত্ত¡।
পূর্বে ভাষাতাত্তি¡ক ফার্ডিনান্দ সস্যুঘ কিছু কেন্দ্রীয় প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছিলেন। সেগুলো ছিল এরূপ:
প্রথমত, ভাষাকে অধ্যয়ন করতে হবে তার উৎপত্তি, তার ঐতিহাসিক বিকাশ, এভাবে নয়, বরং একটি
চিহ্ন ব্যবস্থা (ধ ংুংঃবস ড়ভ ংরমহং) হিসেবে। দ্বিতীয়ত, শব্দের অর্থ হচ্ছে সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ, কোন
শব্দের অর্থ বিচ্ছিন্ন ভাবে বোঝা সম্ভব নয়। “কুঁড়ে ঘর” আর “গোয়াল ঘর”, দুটোই আকার আকৃতির
দিক দিয়ে ছোটখাট ঘরকে বোঝায়। কিন্তু একটাতে মানুষ বসবাস করে, অপরটাতে গরু-বাছুর। যদিও
দুটো শব্দই ঘরকে বোঝায়, কিন্তু এদের ব্যবহার ভিন্ন, আবার সম্পর্কযুক্ত (একটাতে মানুষ থাকে,
অপরটাতে পশু)। তৃতীয়ত, ভাষা বাস্তবতাকে গঠন করে, বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি নয়। সস্যুঘ বলছেন,
মানুষের মনোজগতে যে কোন বস্তু বা ভাবনা, অর্থযুক্ত। ভাষা এই অর্থ গঠন করে, সেটিকে প্রকাশ
করে। এবং এই অর্থেই, সস্যুঘের দৃষ্টিতে, ভাষার বাইরে কোন বাস্তবতা নেই। বিষয়টিকে স্পষ্ট করার
জন্য বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। “মুক্তিযোদ্ধা” এবং “সন্ত্রাসবাদী” দুটি
শব্দ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এবং তার মিত্রদের দৃষ্টিতে বর্তমানে ওসামা বিন লাদেন হচ্ছেন
“সন্ত্রাসী” (বর্তমানে বলা হচ্ছে কারণ লাদেন যখন সোভিয়েত দখলের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে যুদ্ধ
করেন তখন তিনি একই মহলের কাছে ছিলেন “মুক্তিযোদ্ধা”)। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য, এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বহু দেশের মানুষের কাছে লাদেন হচ্ছেন একজন “মুক্তিযোদ্ধা”। যদি আপনি বলেন,
“মুক্তিযোদ্ধা না কি সন্ত্রাসী, এতসব বুঝি না। লাদেন হচ্ছেন একজন মানুষ”। আপনার মনে হতে
পারে, “মানুষ” শব্দ ব্যবহার করে ভাষার অত প্যাঁচ-গোঁচ এড়ান যাবে, “মানুষ” হচ্ছে বাস্তবতার
প্রতিচ্ছবি। এখানে আবার রাজনীতি-টাজনীতির ব্যাপার-স্যাপার নাই। কিন্তু সস্যুঘ অনুসারী আপনাকে
বলতে পারেন, হ্যাঁ, কিন্তু, তোমার কথার প্রত্যুত্তরে তোমাকে যদি কেউ চ্যালেঞ্জ করে বসে, যদি বলে
বসে, “ও কিসের মানুষ? ও তো পশু। ১১ই সেপ্টেম্বর এতগুলো মানুষকে হত্যা করল...” অর্থাৎ, বর্গ
(“মানুষ”, “পশু”) বাস্তবতাকে নির্মাণ করে। (লাদেনকে যিনি পশু ডেকেছেন, তার প্রত্যুত্তরে আপনি
অবশ্য বলতে পারেন, “হ্যাঁ, কিন্তু ১১ই সেপ্টেম্বরের ধ্বংসযজ্ঞ লাদেনই ঘটিয়েছিল তার প্রমাণ কই?” Ñ
এগুলো অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ)।
কাঠামোবাদের সূত্রপাত ঘটে
একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন
হিসেবে। এই আন্দোলন প্রথমে
দানা বাঁধে ভাষাতত্তে¡ ।
সস্যুঘ অনুসরণে লেভি-স্ট্রসের বক্তব্য ছিল, কাঠামোবাদের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের মনোজগত কিভাবে
কাজ করে বিভিন্ন সংস্কৃতির বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেটিকে বোঝা। লেভি-স্ট্রসের পূর্বানুমান হচ্ছে: মনুষ্য
প্রজাতি মাত্রই অভিজ্ঞতাকে সাজায়, সেটির শ্রেণীকরণ করে। মানুষের মনোজগতের এই কাঠামো এবং
এই প্রবৃত্তি সর্বজনীন। তার কারণ হচ্ছে, এই কাজটি করে থাকে মগজ এবং সকল মানুষের মগজ একই
ধরনের । মগজের উপরের স্তরের প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন, এবং সেটি সাংস্কৃতিক। অর্থাৎ, এক সংস্কৃতি হতে
আরেক সংস্কৃতির প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে কিন্তু ভিত্তিস্বরূপ বিন্যস্তমূলনীতি (ঁহফবৎষুরহম ড়ৎফবৎরহম
ঢ়ৎরহপরঢ়ষবং) একই। অর্থাৎ, এটি বিশ্বব্যাপী। কাঠামোবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে “বিপরীত জোড়”-এর
(নরহধৎু ড়ঢ়ঢ়ড়ংরঃরড়হ) ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ কোন প্রত্যয়কে বোঝে নেতির মাধ্যমে। “দিন”এর
অর্থ আমরা তখনই বুঝি যখন মনে মনে হলেও তুলনা করি “রাত”এর সাথে। যদি আলোর ধারণা না
থাকে “আধাঁর”এর অর্থ দাঁড়ায় না যেহেতু আধাঁরের মানে হচ্ছে আলোহীনতা; একইভাবে, “মৃত্যু”
মানেই “প্রাণ”হীনতা। লেভি-স্ট্রসের মতে, কিছু বিপরীত জোড় বিশ্বব্যাপী যেমন, ডান-বাম, কাঁচারন্ধনকৃত, সংস্কৃতি-প্রকৃতি, কেন্দ্র-প্রান্তএবং পুরুষ-নারী।
কাঠামোবাদের সমালোচকরা বলেন, এই তত্ত¡ নিশ্চল এবং অনৈতিহাসিক। বিষয়টিকে তাঁরা এই ভাবে
ব্যাখ্যা করেন: সমাজ-সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মানুষের যে ভূমিকা, কাঠামোবাদ সেটাকে গুরুত্ব
দেয় না। মনে হবে, মানুষ কাঠামো দ্বারা পরিচালিত। উপরন্তু, কাঠামোবাদী তত্তে¡ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায়
সৃষ্ট ব্যবস্থার রূপান্তর ক্ষমতা (সামন্তবাদ হতে পুঁজিবাদে রূপান্তর), এর গতিময়তা, এসব বিষয়
উপেক্ষিত।
৪. মার্ক্সবাদ (গধৎীরংস): তাত্তি¡ক অর্থে মার্ক্সবাদ হচ্ছে, কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) এবং ফ্রেডরিক
এঙ্গেলসের (১৮২০-১৮৯৫) রচনাসমগ্র, এবং তার উপর ভিত্তি করে নিরন্তর রচিত হতে থাকা নানান
মার্ক্সবাদীদের লেখালেখি। রাজনৈতিক অর্থে মার্ক্সবাদ হচ্ছে, সর্বহারার বৈপ্লবিক সংগ্রাম, যে সংগ্রাম
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটাবে। বর্তমান আলোচনার সুবিধার্থে মার্ক্সবাদ বলতে আমরা বুঝব: (ক)
একটি দর্শন যার বিষয়বস্তু হচ্ছে বিদ্যমান মানব সমাজ, এবং ভবিষ্যতের মানব সমাজ (কি হওয়া
উচিত) (খ) একটি তত্ত¡ সমগ্রযার বিষয় বস্তু হচ্ছে সমাজের স্বরূপ এবং (গ) বিশ্লেষণ করার, ও
সামাজিক রূপান্তর ঘটানোর একটি পদ্ধতি। আধুনিক বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা, যথা, শিল্প-পুঁজিবাদের
উৎপত্তি এবং স¤প্রসারণ ছিল মার্ক্সের প্রধান কাজের জায়গা। এই মনোযোগের ফলাফল হচ্ছে তাঁর
রচিত তিন খন্ডের ক্যাপিটাল গ্রন্থ।
সামাজিক ব্যবস্থা, মার্ক্সের মতে, নিয়মানুসারে প্রবর্তিত হয়, পরিবর্তিত হয়। মানুষ অন্য প্রজাতি হতে
এই অর্থে ভিন্ন যে, কেবলমাত্র মানুষই তার আহার্য উৎপাদন করার ক্ষমতা রাখে। শ্রম বিভাজনের
মাধ্যমে উৎপাদনের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে। এই উদ্বৃত্ত নিয়ন্ত্রণ মানব ইতিহাসের এক পর্যায়ে
দ্ব›েদ্বর সহৃত্রপাত ঘটায়। সাধারণভাবে দেখা যায় যে, যে দল সম্পদের (উৎপাদনের উপায়) উপর
একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে, সেই দল হয়ে উঠে সমাজের শাসক শ্রেণী। উৎপাদনের উপায়ের সাথে
সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে সমাজের অন্যান্য শ্রেণী গড়ে উঠে। উৎপাদনের উপায় কি? মার্ক্সের দৃষ্টিতে,
উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত সকল উপাদানই হচ্ছে উৎপাদনের উপায় (সবধহং ড়ভ ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ)।
যথা: ভূমি, কাঁচা মাল, প্রযুক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদি। সমাজের সকল মানুষের উৎপাদনের
উপায়ের উপর ক্ষমতা একই রকম না Ñ কেউ বা ভূমির মালিক, কেউ মালিক না, শুধুমাত্র বর্গাদার।
কেউ আবার কৃষিজমিতে মজুরি খাটেন। উৎপাদনের উপায়কে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক তা
হচ্ছে উৎপাদনের সম্পর্ক (ভূমি-মালিক, কৃষি-মজুর: ৎবষধঃরড়হং ড়ভ ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ)। ভিন্নতর এই
ক্ষমতা সমাজে শ্রেণী সম্পর্কের ক্ষমতা তৈরী করে। উৎপাদনের সাথে মানুষের যে সম্পর্ক ম্ফসটি
সমাজের কোন নির্দিষ্ট ক্ষেত্র বা পরিসরে ধরুন, কেবলমাত্র অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি হয়ে
উঠে সমাজের সামগ্রিক চেহারা। সংক্ষেপে, এই হচ্ছে “ইতিহাসের বস্তুগত তত্ত¡”। এই তত্ত¡ অনুসারে,
লেভি-স্ট্রসের বক্তব্য ছিল,
কাঠামোবাদের লক্ষ্য হচ্ছে
মানুষের মনোজগত কিভাবে
কাজ করে বিভিন্ন সংস্কৃতির
বিশে- ষণের মাধ্যমে তা
বোঝা।
মার্ক্সবাদ বলতে আমরা বুঝব:
(ক) একটি দর্শন যার বিষয়বস্তু
হচ্ছে বিদ্যমান মানব সমাজ,
এবং ভবিষ্যতের মানব সমাজ
(কি হওয়া উচিত) (খ) একটি
তত্ত¡ সমগ্র যার বিষয় বস্তু হচ্ছে
সমাজের স্বরূপ এবং (গ)
বিশ্লেষণ করার, ও সামাজিক
রূপান্তর ঘটানোর একটি
পদ্ধতি।
সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা কেন্দ্রীয়, তার কারণ এটি হচ্ছে ভিত্তি (নধংব)। উৎপাদন ব্যবস্থা সমাজের
রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাকে রূপদান করে; যেহেতু এই ব্যবস্থাগুলো উৎপাদন ব্যবস্থা দ্বারা
নির্ধারিত. সেকারণে এগুলো হচ্ছে উপরিকাঠামো (ংঁঢ়বৎংঃৎঁপঃঁৎব)।
মানব ইতিহাসকে মার্ক্স কিছু ক্রমান্বয়িক পর্বে ভাগ করেন: আদি সাম্যবাদ বা উপজাতি ভিত্তিক সংগঠন,
দাসত্ব, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ। জীবনের শেষ দিকে, তিনি সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাস অনুসন্ধানের
কাজটিকে আরও পেছনের দিকে ঠেলে দেন। আদি অর্থনৈতিক সমাজের অনুসন্ধান সূত্রে তাঁর পরিচয়
ঘটে নৃবিজ্ঞানের সাথে। লুইস হেনরী মর্গানের যুগ বিভাগ তত্তে¡ অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি বই লেখার কাজে
হাত দেন। বই পরিকল্পনারত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু ঘটে; এঙ্গেলস মার্ক্সের রেখে যাওয়া নথি পত্রের
সাহায্যে কাজটি সম্পন্ন করেন (পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি, ১৮৮৪)।
ইউরোপীয় আলোকময়তার দার্শনিকদের মতন মার্ক্সও ভাবতেন, মানব সমাজ অধিকতর প্রগতির ধারায়
বিকশিত হচ্ছে, পরিবর্তন ঘটছে মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সামন্তবাদের
তুলনায় পুঁজিবাদে মুক্তির সম্ভাবনা অধিকতর। কিন্তু প্রগতির এই যাত্রা শান্তিপূর্ণ বা সংঘাতহীন নয়;
বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর ক্ষমতার লড়াইয়ের ফসল। মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে, ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের
ইতিহাস। সেই অর্থে, মার্ক্সীয় ইতিহাসের ধারণা প্রথাগত ইতিহাসের ধারণা (এক রাজবংশের বদলে
আরেক রাজবংশ, কিংবা ধীরে ধীরে জাতিসত্তা অর্জন অথবা সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা) থেকে ভিন্ন। শ্রেণী
ইতিহাসের চাবিকাঠি হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সুবিধাদি
অর্জনের লড়াই ও সংগ্রাম।
সা¤প্রতিককালে, ১৯৬০’র দশক হতে, নৃবিজ্ঞানে মার্ক্সবাদ প্রতিষ্ঠিত হয় ই টেরে, এম গদলেয়ার,
এরিক উলফ, পিটার উর্সলি প্রমুখদের কাজের মাধ্যমে।
৫. প্রতীকবাদ (ঝুসনড়ষরংস): প্রতীকের অর্থ অনুসন্ধান নানাবিধ নৃবিজ্ঞানীদের আগ্রহ এবং
চিন্তাভাবনাকে এক জায়গায় জড়ো করতে সক্ষম হয়। যেমন লেভি-স্ট্রস, ডেভিড শ্নাইডার, ক্লিফোর্ড
গিয়ার্টজ, ভিক্টর টার্নার, মেরি ডাগলাস ইত্যাদি। এদের মাঝে কিছু তাত্তি¡ক ভিন্নতা থাকা সত্তে¡ও
সমিলের একটি কেন্দ্রীয় জায়গা আছে এবং তা হচ্ছে: অর্থ এবং যোগাযোগের অনুসন্ধান। প্রতীক বলতে
বোঝায় এমন কিছু যা অন্য কিছুর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়। যেমন ধরুন, বাংলাদেশের পতাকা হচ্ছে এই
দেশের সার্বভৌমত্বের একটি প্রতীক। অথবা, শহীদ মিনার হচ্ছে ভাষা আন্দোলনের প্রতীক। এই ধারা,
ষাটের দশকের শেষভাগ হতে সত্তরের দশকে, নৃবিজ্ঞানে শক্তিশালী হয়ে উঠে। প্রতীকী নৃবিজ্ঞান
সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করে অর্থ ব্যবস্থা হিসেবে। প্রতীকবাদী নৃবিজ্ঞানীদের মতে, সংস্কৃতি একটি স্বতন্ত্র
ব্যবস্থা। এই অর্থ ব্যবস্থাকে নৃবিজ্ঞানী উদঘাটন করেন আচারাদি (ৎরঃঁধষং) এবং প্রতীক/চিহ্ন
ব্যাখ্যাদানের সাহায্যে।
প্রতীকী নৃবিজ্ঞান বা প্রতীকবাদ চারটি গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে: প্রথমত, প্রতীকবাদ
সামাজিক কার্যকে যথাযথ গুরুত্ব দেয় না। মনে হবে মানুষজনের কার্যকলাপ প্রতীক এবং অর্থ তৈরী
দ্বারা পরিচালিত। দ্বিতীয়ত, এই তত্ত¡ সামাজিক এবং ঐতিহাসিক পরিবর্তন বুঝতে সাহায্য করে না।
তৃতীয় সমালোচনার জায়গা তৈরী করে দিয়েছেন নারীবাদীরা। তাদের বক্তব্য হ’ল, প্রতীকের অর্থ
সকলের জন্য এক রকম নয়। ধরুন, চাঁদ-তারা। এই দেশের কিছু মানুষের জন্য এটি ইসলামী ঐক্যের
প্রতীক। আবার অনেক মানুষের কাছে এটি পাকিস্তানী শাসনামল ও পাকিস্তান সরকারের বাঙ্গালিদের
উপর নিপীড়নের প্রতীক। একই দেশের মানুষজনের মধ্যেকার এই বিভাজনগুলো বাস্তব। তাহলে আমরা
কিভাবে ধরে নিতে পারি যে সংস্কৃতি একটি অখন্ড অর্থ ব্যবস্থা, প্রতীকের সমষ্টি, যার অর্থ সকলের জন্য
একই রকম?
প্রতীকবাদী নৃবিজ্ঞানীদের মতে,
সংস্কৃতি একটি স্বতন্ত্র ব্যবস্থা।
এই অর্থ ব্যবস্থাকে নৃবিজ্ঞানী
উদঘাটন করেন আচারাদি
(ৎরঃঁধষং) এবং প্রতীক/চিহ্ন
ব্যাখ্যাদানের সাহায্যে।
৬. নারীবাদ (ঋবসরহরংস): নারীবাদ মার্ক্সবাদের মতনই। শুধু মাত্র তত্ত¡ নয়, সমাজে বাস্তবিক পরিবর্তন
ঘটানোর আন্দোলন বা সংগ্রাম এর অবিচ্ছিন্ন দিক। নারীবাদের কেন্দ্রীয় প্রস্তাবনা হচ্ছে: নারী নিপীড়িত,
নারী নিপীড়নের অপর দিক হচ্ছে পুরুষ আধিপত্য। নারীবাদের মধ্যে ভিন্ন পজিশন থাকা সত্তে¡ও সকলে
কিছূ বিষয়ে একমত হবেন। যথা, নারী অধীনস্ততা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক বা ঈশ্বর প্রদত্ত নয়। এটা
সামাজিক এবং ঐতিহাসিক। পুরুষ আধিপত্যও তাই: নির্দিষ্ট ক্ষমতা কাঠামো দ্বারা সৃষ্ট, যার কারণে
পুরুষ সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সুবিধাদি ভোগ করে। নারীবাদীদের মধ্যকার কেন্দ্রীয়
বিভাজন নারীর অবস্থার বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে, কিভাবে এই অবস্থার পরিবর্তন আনা সম্ভব, কি ধরনের
পরিবর্তন কাম্য Ñ এসব কে কেন্দ্র করে।
উদারনৈতিক নারীবাদীদের মতে, ব্যক্তি হিসেবে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, প্রতিষ্ঠিত করতে
হবে। নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য দূর করার জন্য তাঁরা গুরুত্ব আরোপ করেন আইনী সংস্কারের
উপর। তাঁদের বক্তব্য হল: বলা হয়ে থাকে আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। কিন্তু নারীবাদী গবেষণা
সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করে কিভাবে পুরুষের ক্ষমতা বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। উদারনৈতিক
নারীবাদীরা গুরুত্ব দেন এধরনের বিষয়ের উপর: নারী ও পুরুষের মজুরির হার একই হওয়া উচিত,
চাকরির একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকা উচিত ইত্যাদি। সমাজতান্ত্রিক/মার্ক্সবাদী নারীবাদীদের
মতে, লিঙ্গীয় বৈষম্য শ্রেণী বৈষম্যের মতনই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথাগত মার্ক্সবাদীদের ধারণা হচ্ছে, ব্যক্তি
মালিকানাধীন ব্যবস্থা ভেঙে ফেললে নারী নিপীড়ন আর থাকবে না। তাঁদের দৃষ্টিতে, ব্যক্তি মালিকানা
কেবলমাত্র শ্রেণী শাসন নয়, নারী নিপীড়নেরও কারণ। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা এ ধারণা প্রত্যাখ্যান
করেন। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, বিত্তহীন শ্রেণী, যাদের কিনা সম্পত্তি নাই, সেই শ্রেণীর নারী পুরুষের
সম্পর্কও বৈষম্যপূর্ণ। পুরুষ আধিপত্য ও শ্রেণী আধিপত্যকে আলাদা ভাবে বুঝতে হবে, এ দুই
আধিপত্য কিভাবে একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত তা নিরিখ করে দেখতে হবে।
সা¤প্রতিককালে, এই দুই ধরনের নারীবাদ তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের/কৃষ্ণাঙ্গ
নারীবাদীদের দ্বারা। এঁরা বর্ণবাদের বিষয় সামনে নিয়ে এসেছেন। এঁদের বক্তব্য হচ্ছে: বিদ্যমান
নারীবাদী তত্তে¡ পুরুষ আধিপত্য কেন্দ্রীয়। উদারনৈতিক নারীবাদে শ্রেণী বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না,
যা কিনা সমাজতন্ত্রী নারীবাদীরা করেন। কিন্তু বর্ণ বৈষম্যের প্রসঙ্গ ও তাৎপর্য উভয় ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।
সমাজে একাধিক কেন্দ্রীয় বিভাজন উপস্থিত: শুধুমাত্র লিঙ্গীয় এবং শ্রেণী বৈষম্য নয়, নরবর্ণ ভিত্তিক
(ৎধপব) বৈষম্য একইভাবে কেন্দ্রীয়। এই বৈষম্যের মুখোমুখি না হলে নারীর মধ্যকার বিভেদ এবং কি
ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংহতি রচনা করা সম্ভব Ñ এগুলোর পথ খোঁজা দুরূহ হয়ে পড়বে।
উপরে নৃবিজ্ঞানের কিছু প্রধান তাত্তি¡ক ধারার সাথে Ñ বিবর্তনবাদ, মার্ক্সবাদ, ক্রিয়াবাদ, কাঠামোবাদ,
প্রতীকবাদ এবং নারীবাদ Ñ আপনার পরিচয় ঘটানো হয়েছে। গত দুই দশকে কেবল নৃবিজ্ঞান নয়,
সামাজিক বিজ্ঞান এবং মানবিক বিষয়ের (সাহিত্য অধ্যয়ন, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি) তত্ত¡ জগতে
তোলপাড় ঘটেছে উত্তর-কাঠামোবাদ, উত্তর-আধুনিকতাবাদ, উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ নামক তত্ত¡ীয়
উদ্ভাবনের কারণে। দৃষ্টিভঙ্গিগত দিক দিয়ে, এই তত্ত¡গুলোর মধ্যে কিছু সামিল রয়েছে। স্থানের অভাবে
এগুলোর সাথে আপনাদের পরিচয় ঘটানো সম্ভব নয়। এ বাদে, একই সময়কালে সংস্কৃতি তাত্তি¡ক
এডওয়ার্ড সাঈদ উত্থাপন করেছেন প্রাচ্যবাদের (ড়ৎরবহঃধষরংস) ধারণা। প্রাচ্যবাদ হচ্ছে প্রাচ্য সংক্রান্ত
অধ্যয়ন। প্রাচ্যবাদ হচ্ছে পাশ্চাত্যের উৎপাদিত প্রাচ্য সম্বন্ধে একটি জ্ঞানব্যবস্থা। শুধুমাত্র বিদ্যাজাগতিক
লেখালেখি নয়, প্রাচ্য সম্বন্ধে “জ্ঞান” তৈরি হয়েছে নানাভাবে: ভ্রমণ কাহিনী, সাহিত্য, উপন্যাস,
সরকারী কর্মকর্তাদের বিবরণ, চিঠিপত্র ইত্যাদি। সাঈদ বলেন, প্রাচ্যবাদ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক এবং
বুদ্ধিবৃত্তিক প্রপঞ্চ। এটি অনড়, অটল নয়; সহজ-সরলও নয়। প্রাচ্য সম্বন্ধে দীর্ঘ সময় ধরে যে জ্ঞান
পাশ্চাত্য উৎপাদন করেছে তা নিরিখ করলে বোঝা যায় যে, এই জ্ঞানব্যবস্থা নিরপেক্ষ নয়। এই জ্ঞান
নারীবাদের কেন্দ্রীয় প্রস্তাবনা
হচ্ছে: নারী নিপীড়িত, নারী
নিপীড়নের অপর দিক হচ্ছে
পুরুষ আধিপত্য।
পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যের স্মারক। পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক শক্তি থেকে
এই জ্ঞানব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা অযৌক্তিক।
যে তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গিগুলো উপরে উপস্থাপিত হয়েছে, তাদের মধ্যকার ফারাক অনেক। কি ধরনের?
যেমন ধরুন, কিছু নৃবিজ্ঞানী উপরে আলোচিত তত্ত¡গুলোকে দুইভাগে ভাগ করবেন: (ক) মার্ক্সবাদী
(এতে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদকেও অন্তর্ভুক্ত করবেন তাঁরা) এবং (খ) অ-মার্ক্সবাদী তত্ত¡। খোদ মার্ক্সের
ভাষায় বললে, এই ফারাকের কেন্দ্রীয় দিক হচ্ছে, অন্য সকল দর্শন জগতকে বুঝতে চায়, পক্ষান্তরে,
মার্ক্সবাদ জগতকে পরিবর্তন করতে চায় (তবে, মনে রাখবেন, মার্ক্স নিজে কখনও “মার্ক্সবাদ” শব্দটি
উচ্চারণ করেননি)। মার্ক্সবাদী তত্তে¡ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সংঘাতের উপর। তার বিপরীতধর্মী
তত্ত¡, উদাহরণস্বরূপ ক্রিয়াবাদী তত্তে¡, গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ভারসাম্যের উপর, সামাজিক
স্থিতিশীলতার উপর। মার্ক্সবাদে শোষণ এবং শোষণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়া,
বিপ- ব এবং মানব মুক্তির পক্ষে লড়াই করা গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়গুলো মার্ক্সবাদের কেন্দ্রে, এই
বিষয়গুলো মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে ঐতিহাসিক। পক্ষান্তরে, আপনারা উপরের আলোচনায় দেখেছেন যে,
সমালোচকদের মতে, অ-মার্ক্সবাদী তত্তে¡র একটি প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে সেগুলো মূলত অনৈতিহাসিক।
তবে, এক্ষেত্রে উল্লেখ করা জরুরী যে, বর্তমানের বহু মার্ক্সীয় নৃবিজ্ঞানীদের মতে, লুইস হেনরী মর্গানের
বিবর্তনবাদী পরিকাঠামো গ্রহণ করার কারণে খোদ মার্ক্স এবং এঙ্গেলস তাঁদের উদ্ভাবিত ঐতিহাসিক
বস্তুবাদী বিশ্লেষণ পদ্ধতি থেকে সরে যান। মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের সমাজের ক্রম বিকাশের পর্ব,
স্টালিনীয় যুগে
১ একটি যান্ত্রিক ফর্মুলায় পর্যবসিত হয়। পৃথিবীর বিবিধ ইতিহাস কিছূ অনড় পর্বে
বন্দীকৃত হয়ে পড়ে।
জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা ও নৃবিজ্ঞানে জ্ঞাতিত্বের গুরুত্ব
জ্ঞাতিত্বকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে: জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে প্রাকৃতিক বা জৈবিক সত্যের সামাজিক কিংবা
প্রাকৃতিক নির্মাণ। এই অর্থে, জ্ঞাতিত্ব একইসাথে প্রাকৃতিক বা জৈবিক, এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক।
গোড়াপত্তন থেকে বর্তমানকাল, এই দেড়শত বছরের জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়,
জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ভিত্তি ছিল কিছু শক্তিশালী পূর্বানুমান। প্রথমত, ধরে নেয়া হয়েছিল জ্ঞাতিত্ব সকল
সমাজে বিভাজন তৈরী করে: কারা রক্ত (অথবা, কোন কোন সমাজে জ্ঞাতিবন্ধনের ভিত্তি হচ্ছে হাড়,
আর কোথাও বীর্য) সূত্রে জ্ঞাতিবন্ধনে আবদ্ধ এবং কারা জ্ঞাতিকুল না, এটা একটি কেন্দ্রীয় বিভাজন।
দ্বিতীয়ত, ধরে নেয়া হয়েছিলো, এই বিভাজনের ভিত্তি হচ্ছে জন্মদান সংক্রান্তপ্রাকৃতিক বিষয়াবলী।
প্রজনন (ঢ়ৎড়পৎবধঃরড়হ) এবং রক্ত সম্পর্ক (নষড়ড়ফ-ৎবষধঃবফহবংং) Ñ এগুলো হচ্ছে মৌলিক সত্য কারণ
এগুলো প্রাকৃতিক (অপরিবর্তনীয়, অনড়, অটল অর্থে) এবং বিশ্বজনীন (সময়কাল এবং স্থানিক ভিন্নতার
উর্ধ্বে)। এ দুটি কেন্দ্রীয় পূর্বানুমান তৈরী করে দেয় তৃতীয় পূর্বানুমান: জৈবিকতা হচ্ছে জীববিজ্ঞানীদের
কার্যক্ষেত্র, নৃবিজ্ঞানীদের কার্যক্ষেত্র হচ্ছে জৈবিকতার সাংস্কৃতিক নির্মাণ। নৃবিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন
যে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদি নৃবিজ্ঞানীদের জন্য কেন্দ্রীয়, কিন্তু এগুলো জৈবিক সম্পর্ক হতে
উদ্ভূত, জৈবিকতার তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নির্মাণ এক সমাজ হতে আরেক
সমাজে ভিন্ন হতে পারে, উদাহরণস্বরূপ: মান্দাই সমাজ হচ্ছে মাতৃতান্ত্রিক, পক্ষান্তরে চাকমারা
পিতৃতান্ত্রিক; আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে জমি বাপ-চাচাদের সাথে চাষ করা হয়, আবার কোথাও কোথাও
মামাদের সাথে; বাঙ্গালী মুসলমানেরা যাকে “ফুপু” ডাকেন, বাঙ্গালী হিন্দুরা তাকে ডাকেন “পিসী”
ইত্যাদি।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন হচ্ছে নৃবিজ্ঞানের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। কেন্দ্রীয় হবার
কারণ হিসেবে সাধারণত যে বিষয়গুলো নৃবিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেন, তা হ’ল: জ্ঞাতিত্বের সামাজিক এবং

১ স্টালিনীয় যুগ বলতে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নে স্টালিনের শাসনকাল (১৯২০’র শেষ হতে ১৯৫০র শুরু) বোঝায় ।
প্রাচ্যবাদ হচ্ছে প্রাচ্য সংক্রান্ত
অধ্যয়ন; প্রাচ্যবাদ হচ্ছে
পাশ্চাত্যের উৎপাদিত প্রাচ্য
সম্বন্ধে একটি জ্ঞান ব্যবস্থা।
জ্ঞাতিত্বকে সংজ্ঞায়িত করা
হয়েছে এভাবে: জ্ঞাতিত্ব হচেছ
প্রাকৃতিক বা জৈবিক সত্যের
সামাজিক কিংবা প্রাকৃতিক
নির্মান
সাংস্কৃতিক অর্থ কেবলমাত্র নৃবিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করেন, এ বিষয়ে কেবলমাত্র তাঁরা গবেষণা চালান,
লেখালেখি করেন। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান কেবলমাত্র নৃবিজ্ঞানীদেরই আছে, সে কারণে এটা
একান্তভাবে নৃবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ইত্যাদি। সা¤প্রতিক কালে এধরনের কথাবার্তা আরও তলিয়ে দেখা
হচ্ছে। নৃবিজ্ঞানে জ্ঞাতিত্বের কেন্দ্রিকতা ও গুরুত্বের ভিন্নতর ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছেন কিছু নৃবিজ্ঞানী।
সেটি এরকম: পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণায় বিশ্বের সকল সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত: “আদিম” এবং “সভ্য”।
সমাজের এই বিভাজন পাশ্চাত্য ইতিহাসে কয়েকশত বছর পুরোনো। পাশ্চাত্যীয় ধ্যান-ধারণায় এটি
প্রতিষ্ঠিত যে, আদিম সমাজ গোষ্ঠীকেন্দ্রিক, সভ্য সমাজ ব্যক্তিকেন্দ্রিক। পাশ্চাত্যের ইতিহাসে আদিম
এবং সভ্যের এই বিভাজন শুধুমাত্র বিশ্বের সকল সমাজকে দুই ভাগে ভাগ করেনি, জ্ঞানজগতের একটি
শ্রম বিভাজনকেও প্রতিষ্ঠিত করেছে। নৃবিজ্ঞান (এবং নৃবিজ্ঞানীদের) ক্ষেত্র হচ্ছে সরল, জ্ঞাতি ভিত্তিক,
রাষ্ট্রবিহীন সমাজ যেখানে আছে উপহার অর্থনীতি, পক্ষান্তরে সমাজ বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হচ্ছে আধুনিক,
শিল্প ভিত্তিক এবং (উৎপত্তি অর্থে) পাশ্চাত্য সমাজ।
নৃবিজ্ঞানের গোড়াপত্তনের সময়ে, যখন কিনা “আদিম সমাজ” বিষয়বস্তু হিসেবে স্বীকৃত হয়, সেই একই
সময়কালে “সমাজ” মানেই “জ্ঞাতিত্ব”, এই প্রত্যয়গত সমীকরণও ঘটে। এবং এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়
যে আদিম সমাজের গঠনমূলক একক হচ্ছে জ্ঞাতিত্ব। ক্ষুদ্র পরিসরে আদিম সমাজ কিভাবে সংগঠিত,
কিভাবে কাজ করে Ñ এগুলো বোঝার জন্য জ্ঞাতিত্ব অপরিহার্য হিসেবে বিবেচিত হয়। সা¤প্রতিক
নৃবিজ্ঞানীরা বলেন, পাশ্চাত্য মানসে আদিম সমাজ নামক যে বর্গ ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠে, একটি
স্বতন্ত্র জ্ঞানকান্ড হিসেবে নৃবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা এই বর্গকে জ্ঞানজাগতিক বৈধতা দান করে। আদিম সমাজ
সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। নৃবিজ্ঞানীরা আদিম সমাজের কিছু মূলনীতি দাঁড় করান, যেটির মধ্যে
কেন্দ্রীয় হচ্ছে জ্ঞাতিত্ব। যেমন ধরুন নৃবিজ্ঞানী ফোর্টসের এই কথাগুলো: আদিম সমাজের সামাজিক
জীবনের সাংগঠনিক মূলনীতি হচ্ছে জ্ঞাতিত্ব, এটি একটি অনস্বীকার্য সত্য। আদিম সমাজে “সমাজ”
মানেই জ্ঞাতিত্ব Ñ এই ধারণার ভিত্তিতে নৃবিজ্ঞানীরা কাজ করেন, এবং বিভিন্ন তত্ত¡ দাঁড় করান। এর
মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বংশধারা তত্ত¡: সামাজিক দল গঠনের ভিত্তি হচ্ছে বংশধারা। এই দলগুলো
বহির্বিবাহ নীতি অনুসরণ করে, কন্যা বিনিময়ের ভিত্তিতে দুই দলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে
উঠে। নৃবিজ্ঞানীরা আরও ধরে নেন যে, জ্ঞাতি পদাবলী সামাজিক সংগঠন প্রকাশ করে। জ্ঞাতি ভিত্তিক
আদিম সমাজের যে সামাজিক ব্যবস্থা, সেটি, নৃবিজ্ঞানীদের মতে, পাশ্চাত্য সমাজ হতে খুব ভিন্ন।
আদিম বা অপাশ্চাত্য সমাজে জ্ঞাতিভিত্তিক সংগঠন যে ভূমিকা পালন করে, সেই ভূমিকা পাশ্চাত্য
সমাজে পালন করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে কর্মক্ষেত্র, রাষ্ট্র।
গত দুই দশক ধরে, জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের পূর্বানুমান, এবং আরও মৌলিক বিষয় যেমন “আদিম” ও
“সভ্যতার” পাশ্চাত্যীয় বিভাজন নিয়ে, তীব্র সমালোচনা উচ্চারিত হচ্ছে। জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের যেই পাঠ
এই পুস্তকের তিনটি ইউনিটে লিখিত হয়েছে, সেখানে দুই ধরনের কাজই উপস্থাপন করা হচ্ছে।
গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে একশত বছরের জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন এবং হাল আমলের চিন্তাভাবনা যা
ভিন্নধরনের কাজের স‚ত্রপাত ঘটাচ্ছে। জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের শিক্ষার্থী হিসেবে দু’ ধরনের কাজের সাথেই
আপনার পরিচিত হওয়া সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরী। চতুর্থ ইউনিটের শেষতম পাঠে জ্ঞাতিত্বের
যে মূল সংজ্ঞা Ñ জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে প্রাকৃতিক বা জৈবিক সত্যের সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক নির্মাণ Ñ তার
প্রত্যয়গত পূর্বানুমান তুলে ধরা হবে।
সারাংশ
নৃবিজ্ঞানের গোড়াপত্তনের
সময়ে, যখন কিনা “আদিম
সমাজ” বিষয়বস্তু হিসেবে
স্বীকৃত হয়, সেই একই
সময়কালে “সমাজ” মানেই
“জ্ঞাতিত্ব”, এই প্রত্যয়গত
সমীকরণও ঘটে।
এই পাঠে কেন্দ্রীয় কিছু তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে Ñ বিবর্তনবাদ, মার্ক্সবাদ, ক্রিয়াবাদ, কাঠামোবাদ এবং
নারীবাদ Ñ আপনার পরিচয় ঘটানো হয়েছে। নৃবিজ্ঞান (এবং সামাজিক বিজ্ঞান) বোঝার জন্য, ব্যবহার
করার জন্য সংক্ষিপ্ত রূপে হলেও, এই তাত্তি¡ক এবং প্রত্যয়গত পরিচয় জরুরী। সা¤প্রতিককালে
এডওয়ার্ড সাঈদের প্রাচ্যবাদের ধারণা সামাজিক এবং মানবিক শাখার বিভিন্ন জ্ঞানকান্ডে আলোড়ন সৃষ্টি
করেছে। বর্তমানের অনেক চিন্তাবিদের উপলব্ধি হচ্ছে যে, এ পর্যন্তযে প্রত্যয় বা তত্ত¡ উদ্ভাবিত হয়েছে,
সেগুলো সর্বজনীন ঘটনাবলী ব্যাখ্যাদানের দাবি করে। কিন্তু ভালভাবে নিরিখ করলে দেখা যায় যে, এই
তত্ত¡ এবং প্রত্যয়গুলোর ব্যাখ্যাদানের ক্ষমতা সীমিত। এগুলো বিশ্বের বৈচিত্র্য এবং বিবিধতাকে বুঝতে
বা অনুসন্ধান করতে সাহায্য করে না। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে এগুলো পাশ্চাত্য সমাজের প্রচলন ও
অনুশীলনকে মানদন্ড হিসেবে দাঁড় করায়। এ সকল কারণে বর্তমানে অনেকে ঝুঁকে পড়েছেন প্রত্যয় বা
তত্ত¡ বা জ্ঞানের ইতিহাস এবং এর পক্ষপাতিত্ব অনুসন্ধানে। জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের গুরুত্ব ঠিক একইভাবে
সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন -
১। ‘বিবর্তনবাদ হচ্ছে কুর্সী - কেদারায় বসে বসে করা নৃবিজ্ঞান’ - উক্তিটি কাদের ?
ক. কাঠামোবাদীদের খ. মার্ক্সবাদীদের
গ. ক্রিয়াবাদীদের ঘ. নারীবাদীদের
২। নৃবিজ্ঞানে কাঠামোবাদের জনক কে ?
ক. লুইস হেনরী মর্গান খ. ক্লদ লেভি-স্ট্রস
গ. ফার্ডিনান্দ সস্যুঘ ঘ. হেনরী মেইন
৩। ‘সংস্কৃতি একটি স্বতন্ত্র ব্যবস্থা’ - উক্তিটি কাদের ?
ক. প্রতীকবাদী নৃবিজ্ঞানীদের খ. নারীবাদীদের
গ. মার্ক্সবাদীদের ঘ. কাঠামোবাদীদের
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা কী?
২। প্রাচ্যবাদ কী?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। এই পাঠে আলোচিত প্রতিটি তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গির সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা দিন। কোন তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গি
আপনার কাছে বেশী গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে এবং কেন, সেটির তুলনামূলক আলোচনা করুন।
২। নৃবিজ্ঞানীরা জ্ঞাতিত্বকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন? দীর্ঘ সময়ের জন্য নৃবিজ্ঞানীরা ধরে
নিয়েছিলেন যে “সমাজ” মানেই “জ্ঞাতিত্ব”। কেন?

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]