বহির্বিবাহের এবং অন্তর্বিবাহের নীতিমালা বলতে নৃবিজ্ঞানীরা কি বুঝিয়েছেন?
লেভি-স্ট্রস অজাচারকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেছেন?


কাঠামোবাদী নৃবিজ্ঞানী লেভি-স্ট্রসের নামের সাথে মৈত্রী-বন্ধন তত্ত¡ সবচাইতে বেশি যুক্ত। লেভি-স্ট্রস
তাঁর তত্তে¡, বংশধারার পরিবর্তে মৈত্রীবন্ধনের কাঠামোগত এবং সাংগঠনিক দিকের উপর জোর
দিয়েছেন । দ্য এলিমেন্টারি স্ট্রাকচারস অফ কিনশিপ (১৯৬৯) বইয়ে তিনি মৈত্রী-বন্ধন তত্তে¡র প্রধান
বৈশিষ্ট্যের একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছেন।
বংশধারা তাত্তি¡কেরা প্রধানত একটি বিষয় নিয়ে চিন্তাগ্রস্তছিলেন: কি উপায়ে প্রাক-রাষ্ট্রীয় সমাজ টিকে
থাকে এবং কিভাবে নৈরাজ্যপূর্ণ অবস্থা ঠেকানো হয়। এই তত্ত¡-অনুসারে, বংশধারা দল আদিম
মানুষজনের মাঝে স্থিতিশীলতা তৈরি করে। এই তত্ত¡ প্রথম দাঁড় করান বৃটেনের নৃবিজ্ঞানী যাঁরা কাজ
করেছেন আফ্রিকার কিছু, যাকে বলা হয়, অ-রাষ্ট্রীয় বা রাষ্ট্রবিহীন সমাজ নিয়ে। পরবর্তী পর্যায়ে এই
তত্ত¡ বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় আমদানি করা হয়। উল্লেখ করা জরুরী, নতুন স্থানে এই তত্ত¡ খুব বেশি
ভালো কাজ করেনি। সা¤প্রতিক কালের নৃবিজ্ঞানীদের মতে, স্থিতিশীলতার বিষয়টি বিভিন্নভাবে বারেবারে ঔপনিবেশিক সময়কালে নৃবিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এই প্রসঙ্গটি ইউরোপীয়
ঔপনিবেশিক শক্তির জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বংশধারা তত্ত¡ যখন জ্ঞাতি তত্তে¡র শীর্ষস্থানে প্রতিষ্ঠিত
সে সময়ে লেভি-স্ট্রসের মৈত্রীবন্ধন তত্ত¡ (ধষষরধহপব ঃযবড়ৎু) প্রকাশ পায়।
অজাচার সম্বন্ধে নৃবিজ্ঞানী মহলে প্রচলিত ধারণা
জোড়বন্ধন (বা সধঃরহম অর্থাৎ, নারী এবং পুরুষের যৌন সম্মিলন/সহবাস বা বিবাহ)-এর ক্ষেত্রে
অজাচার বিধিনিষেধ সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ Ñ নৃবিজ্ঞানীরা এটা মনে করতেন। বিশেষ বিশেষ জ্ঞাতিকুলের
মাঝে যৌন সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ: এটাকে অজাচার নিষেধাজ্ঞা বলা হয়ে থাকে (অজাচার বিস্তারিতভাবে
আলোচিত হয়েছে ইউনিট ৪-এর ২ নম্বর পাঠে)। পাশ্চাত্য সমাজগুলোতে অজাচার বলতে বোঝায় নিজ
বাবা বা মা, নিজ ভাই বা বোন Ñ এদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন। কিন্তু পৃথিবীর বহু সমাজে
অজাচারের ধারণা এতটা সংকীর্ণ বা সীমিত নয়। যেমন ধরুন সুদানের নুয়ের সমাজ। নৃবিজ্ঞানী ইভান্সপ্রিচার্ড সে সমাজে গবেষণা করেন এবং তাঁর গবেষণা কাজ হতে স্পষ্ট যে নুয়েরদের অজাচার সম্পর্কিত
যৌন বিধিনিষেধ অনুসারে Ñ (ক) একই গোত্রের সদস্যদের মাঝে (খ) ছয় প্রজন্মের অনুষঙ্গিক জ্ঞাতির
মাঝে এবং (গ) একজন নারীর তার শ্বশুরক‚লের পুরুষদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন Ñ অজাচার
হিসেবে বিবেচিত। অজাচার নিষেধাজ্ঞার সাথে যুক্ত বহির্বিবাহ এবং অন্তর্বিবাহ, এই নীতিমালাগুলো।
নৃবিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন, প্রতিটি সমাজে বহির্বিবাহ এবং অন্তর্বিবাহের নীতিমালা বিদ্যমান।
বহির্বিবাহের বিধিমালা বলতে বোঝায়: সেই নীতি যার ভিত্তিতে স্পষ্ট করে তোলা হয় কোন জ্ঞাতি দলের
সদস্যদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া নিষিদ্ধ। অর্থাৎ, বিয়ের সম্পর্ক হতে হবে বিশেষ জ্ঞাতি
দলের বাইরের কারো সাথে। একারণেই একে বহির্বিবাহ রীতি বলা হয়ে থাকে।
পাঠ - ৫
বহির্বিবাহের বিধিমালা বলতে
বোঝায়: সেই নীতি যার
ভিত্তিতে স্পষ্ট করে তোলা হয়
কোন জ্ঞাতি দলের সদস্যদের
সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া
নিষিদ্ধ।
অন্তর্বিবাহের বিধিমালা হচ্ছে তার বিপরীত: প্রতিটি সমাজে বিশেষ কিছু জ্ঞাতি দল হতে বিবাহ সঙ্গী
বাছাই করা বাঞ্ছনীয়। এতে বোঝান হচ্ছে সেই দল যাদের সাথে বিবাহ-বন্ধন স্থাপন অনুমোদিত বা
বাঞ্ছনীয়।
লেভি-স্ট্রসের পূর্বে নৃবিজ্ঞানীরা যৌন বিধিমালা এবং বিয়ের বিধিমালা, এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য
টেনেছেন। তাঁদের যুক্তি ছিল এরূপ: বিয়ে ছাড়াও যৌন সম্পর্ক ঘটতে পারে কিন্তু তার উল্টোটা, মানে
বিয়ের সম্পর্ক স্থাপন হবে কিন্তু শরীরী মিলন হবে না, তা কিন্তু কোন সমাজে ঘটতে দেখা যায় না।
তাঁদের বক্তব্য ছিল, ক্ষেত্র বিশেষে কিছু কিছু সমাজে এমনটা দেখা যায় যে, কিছু জ্ঞাতি সম্পর্কের মধ্যে
বিয়ের সম্পর্ক যেমন নিষিদ্ধ করা হয় কিন্তু যৌনমিলন যদি ঘটে যায় তাহলে সেটা অনুমোদনযোগ্য না
হলেও বরদাশ্ত করা হয়।
লেভি-স্ট্রস কর্তৃক অজাচার সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণার প্রত্যাখ্যান
লেভি-স্ট্রসের দৃষ্টিতে যৌন বিধিনিষেধ এবং বিয়ের বিধিনিষেধ Ñ এ দুয়ের পার্থক্য টানা জরুরী নয়।
তাঁর কথা হ’ল: মূল বিষয় হচ্ছে অজাচার। বিশেষ বিশেষ সম্পর্কে বিয়ে নিষিদ্ধ করার চাইতে বিশেষ
বিশেষ সম্পর্কে বিয়ে বাঞ্ছনীয় করে তোলা হয়। অজাচার নিষেধাজ্ঞার কারণ আলোচনা করতে যেয়ে
তিনি টায়লরকে অনুসরণ করেন। প্রায় ৬০ বছর পূর্বে টায়লর বহির্বিবাহ-সংক্রান্তআলোচনায়
বলেছিলেন, সমাজকে সুসংহত রাখার পিছনে বিয়ের মাধ্যমে স্থাপিত মৈত্রীবন্ধন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করে। টায়লরের যুক্তি ছিলো: আদিম সময়কালে পরিবারের পক্ষে নিঃসঙ্গভাবে টিকে থাকা কঠিন
ছিলো। বড় ধরনের শিকার অভিযানে যেতে কিংবা শত্রæ থেকে আত্মপক্ষ রক্ষা করতে হলে অন্যান্য
পরিবার ও বন্ধুমহলের সাহায্য ছিলো বাঞ্ছনীয়। মিত্রসুলভ সম্পর্ক স্থাপনে বিয়ের ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা।
টায়লরের ভাষায়, রাস্তা ছিলো দুটো: হয় বাইরের দলগুলোর সাথে বিয়ের সম্পর্ক স্থাপন করা আর না
হয় তাদের আক্রমনের শিকার হওয়া। লেভি-স্ট্রস একই যুক্তি ধরে এগোন। তিনি বলেন, অজাচার
নিষেধাজ্ঞার মূল বিষয় কিন্তু এই নয় যে, নিজ বোন কিংবা মা কিংবা কন্যার সাথে যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ।
বরং, অজাচার নিষেধাজ্ঞার মূল বিষয় হচ্ছে অপরের কাছে নিজ বোন কিংবা মা কিংবা কন্যা প্রদান।
তাঁর বক্তব্যের সমর্থন তিনি নৃবিজ্ঞানী মার্গারেট মীড-এর আরাপেশদের মাঝে করা গবেষণা কাজে খুঁেজ
পান। মীড যখন আরাপেশ তথ্যদাতাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, বোনের সাথে জোড়বন্ধনের সম্পর্ক গড়ে
তোলা হয় কিনা, উত্তরে তাঁরা বলেছিলেন :
কখনোই না, তাঁরা বলেন: “না আমরা আমাদের বোনদের সাথে সহবাস করি না। আমরা অন্য পুরুষদের
কাছে আমাদের বোনদের প্রদান করি আর অন্য পুরুষেরা ওদের বোন আমাদের কাছে দেয়”। নৃবিজ্ঞানী
[মার্গারেট মীড] প্রসঙ্গটি আবার তুললেন, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, যদিও এটা অসম্ভব মনে হচ্ছে কিন্তু যদি
কোনভাবে এটা ঘটে যায় তাহলে আপনারা এটাকে কিভাবে দেখবেন, কি ভাষায় এ নিয়ে কথা বলবেন। এই
প্রশ্নের উত্তর দিতে তথ্যদাতাদের কষ্ট হ’ল, এমন পরিস্থিতি ঘটার কথা যেহেতু ভাবাই যায় না। “কি, নিজের
বোনকে বিয়ে করা! আচ্ছা, তোমার হয়েছেটা কি বল তো? তুমি কি ভগ্নিপতি চাও না? তুমি কি বোঝ না যে
তুমি যদি অন্য কোন পুরুষের বোনকে বিয়ে কর এবং অন্য কোন পুরুষ যদি তোমার বোনকে বিয়ে করে
তাহলে তুমি পাবে দুজন নৎড়ঃযবৎ-রহ-ষধি (বাঙ্গালি মুসলমান জ্ঞাতিত্ব ভাষায় “ভগ্নিপতি” এবং “সম্বন্ধি”),
আর তুমি যদি নিজ বোনকে বিয়ে কর তাহলে তুমি একজনও পাবে না? [এই অবস্থায়] তুমি কার সাথে
শিকারে যাবে, কার সাথে তুমি উদ্যান চাষ করবে, কার সাথে বেড়াতে যাবে?”
(লেভি-স্ট্রস, ১৯৬৯ : ৪৮৫)
এই ঘটনা লেভি-স্ট্রসের বক্তব্যকে ভালভাবে ব্যাখ্যা দান করে। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে: অজাচার নিষেধাজ্ঞা
মূল বিষয় নয়। অজাচার নিষেধাজ্ঞা গুরুত্ব আরোপ করে কাদের সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ তার উপর। কিন্তু
অজাচার নিষেধাজ্ঞার মূল বিষয়
কিন্তু এই নয় যে, নিজ বোন
কিংবা মা কিংবা কন্যার সাথে
যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ। বরং,
অজাচার নিষেধাজ্ঞার মূল বিষয়
হচ্ছে অপরের কাছে নিজ বোন
কিংবা মা কিংবা কন্যা প্রদান।
লেভি-স্ট্রস যে বিষয়টির উপর
জোরারোপ করেছেন তা হলো :
বিশেষ বিশেষ সম্পর্কে বিয়ে
নিষিদ্ধ করার চাইতে বিশেষ
বিশেষ সম্পর্কে বিয়ে বাঞ্ছনীয়
করে তোলা হয়।
মূল বিষয় হচ্ছে, সামাজিকভাবে কাদের সাথে বিবাহ বন্ধন (অর্থাৎ, মৈত্রী স্থাপন) অনুমোদিত বা
বাঞ্ছনীয়।
বংশধারা তাত্তি¡কদের থেকে লেভি-স্ট্রসের তত্ত¡ খুবই ভিন্ন। তাঁদের দৃষ্টিতে, “আদিম” সমাজের
সামাজিক সংগঠনের মূলে রয়েছে বংশভিত্তিক সংগঠন। বংশভিত্তিক সংগঠনের কারণেই এই সমাজগুলো
স্থিতিশীল। সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়টি ঔপনিবেশিক শাসকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ
ছিল, এবং হাল-আমলের অনেক নৃবিজ্ঞানীর মতে, ইউরোপীয় নৃবিজ্ঞানীরা বারে বারে অ-ইউরোপীয়
সমাজের স্থিতিশীলতার চাবিকাঠি অনুসন্ধান করাকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে দেখেন। বংশধারা
তাত্তি¡কদের থেকে লেভি-স্ট্রসের ভিন্নতা এখানেই যে তাঁর মতে, আদিম সমাজ বংশ-ভিত্তিক সংগঠনের
মাধ্যমে টিকে থাকে না, বরং একটি বিশেষ ধরনের সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে টিকে থাকে। এই বিশেষ
সম্পর্ক বিবাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর নাম লেভি-স্ট্রস রাখেন “মৈত্রী বন্ধন” । লেভি-স্ট্রসের
দৃষ্টিতে, যে সমাজগুলো আদিম, সেগুলোর আছে একটি “মৌলিক কাঠামো”। আদিবাসী অস্ট্রেলীয়দের
মাঝে এই মৌলিক কাঠামো পাওয়া যায়, আরো পাওয়া যায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলে, দক্ষিণ ভারতে,
এবং দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীদের মাঝে। এইসব অঞ্চলে বিভিন্ন সমাজে যে মৌলিক কাঠামো লক্ষ্য
করা যায় তা ইউরোপ, আফ্রিকা এবং ইনুইত (এস্কিমো)-দের “জটিল কাঠামো”র বিপরীত। যে সকল
সমাজে জটিল কাঠামো বিদ্যমান সেখানকার বিবাহ-রীতি, লেভি-স্ট্রসের ভাষায়, “নেতিবাচক”। তিনি
নেতিবাচক বলেছেন এই কারণে, যেহেতু এই নিয়ম বলে দিচ্ছে কাকে বিয়ে করা যাবে না।
উদাহরণস্বরূপ, সামাজিক রীতিনীতি অনুসারে একই রক্তের ভাই বা বোনকে বিয়ে করা যাবে না, অথবা
বাবা-মাকে বিয়ে করা যাবে না। পক্ষান্তরে, লেভি-স্ট্রসের দৃষ্টিতে, মৌলিক কাঠামো-ভিত্তিক সমাজের
বিবাহ-রীতি “ইতিবাচক” কারণ কাকে বিয়ে করা উচিত, সেটা বিধিবদ্ধ করা হচ্ছে।
লেভি-স্ট্রসের বই মূলত মৌলিক কাঠামো নিয়ে: তাঁর দৃষ্টিতে বিবাহ-রীতি সমাজকে সুসংহত করে
তোলে। তাঁর যুক্তিকে তিনি এভাবে দাঁড় করাচ্ছেন: মৌলিক কাঠামো দুই ধরনের। প্রথম ধরনের
মৌলিক কাঠামোতে দুটি দল থাকে, ধরুন “ক” এবং “খ”। এ ধরনের সমাজের ইতিবাচক বিবাহ-রীতি
মোতাবেক “ক” দলের মানুষজনের বিয়ে করা উচিত “খ” দলের মানুষজনকে, আর “খ” দলের
মানুষজনের বিয়ে করা উচিত “ক” দলের লোকজনকে। লেভি-স্ট্রস এ ধরনের ব্যবস্থার নামকরণ
করেছেন “প্রত্যক্ষ বিনিময়”। তাঁর যুক্তি হ’ল, তিনি যাদের মাঝে গবেষণা কাজ করেছেন, সে সমাজের
মানুষেরা বিষয়টাকে দেখেন একদল হতে আরেক দলে নারীর বিনিময় হিসেবে। দ্বিতীয় ধরনের মৌলিক
কাঠামোর ক্ষেত্রে ঘটে থাকে “অপ্রত্যক্ষ বিনিময়”। এই সমাজের রীতি ভিন্ন কারণ এখানে দলের সংখ্যা
দুয়ের অধিক। বেশী সংখ্যক দল হলে সামাজিক সংহতি ভিন্নভাবে ঘটে থাকে ভিন্ন ধরনের বিবাহরীতির মাধ্যমে। এখানে “ক” দলের মানুষজনের “খ” দলের মানুষজনকে বিয়ে করার নিয়ম রয়েছে,
কিন্তু “খ” দলের মানুষজন “ক” দলের লোকজনকে বিয়ে না করে বরং “গ” দলের সাথে বিবাহ-বন্ধনে
আবদ্ধ হন। আবার দেখা যায়, “গ” দলের মানুষজন বিয়ে করছেন “ক” দলে। অপ্রত্যক্ষ বিনিময়
ব্যবস্থায় বিয়ে ঘটে চক্রাকারভাবে, এই চক্রের কোন পর্যায়ে ইতি টানা হয় না (যেমন কিনা প্রত্যক্ষ বিয়ে
ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ঘটে)।
লেভি-স্ট্রস তাঁর মৈত্রীবন্ধন তত্ত¡ দাঁড় করান ক্রস-কাজিন বিবাহ ব্যবস্থা (ফুপাত-মামাত ভাই ও বোন) যে
সকল সমাজে প্রচলিত তার প্রেক্ষিতে। তাঁর মতে, এই বিবাহ ব্যবস্থা নারী বিনিময় ব্যবস্থার অংশ।
বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ দলগুলো নারী বিনিময়ের মাধ্যমে স্থায়ী মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তোলে। দুই পরিবার
বা দলের মধ্যে নারী বিনিময় আন্তঃনির্ভরশীলতা নিশ্চিত করে তোলে। যদি নারী বিনিময় না ঘটে, যদি
নিজ দল হতে বিবাহ সঙ্গী বাছাই করা হ’ত তাহলে এই মৈত্রী তৈরি হ’ত না, সংহতি তৈরী হ’ত না।
বহির্বিবাহ রীতি পারিবারিক বিনিময় নিশ্চিত করে এবং এর মাধ্যমে বৃহত্তর ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি সম্ভব
করে। ফরাসী সমাজবিজ্ঞানী মার্সেল মস অনুসারে, লেভি-স্ট্রস মনে করতেন উপহার বিনিময় হচ্ছে
পারস্পরিক আন্তঃনির্ভরশীলতার প্রতীকী রূপ। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে: পরিবার এবং দল অন্য কিছু
বিনিময় না করে কেন নারীদের বিনিময় করবেন? তাঁর উত্তর ছিল এরকম: যদি দুই দলের মধ্যে নারী
বিনিমিত না হয়ে কোন বস্তু’র বিনিময় ঘটত তাহলে একবার বস্তু হস্তান্তরিত হয়ে যাওয়ার পর সেই সম্পর্ক
থাকত না যা কিনা নারী বিনিমিত হওয়ার কারণে সম্ভব। বস্তু বিনিময় প্রথার পূর্বে নারী বিনিময় ব্যবস্থা
প্রচলিত ছিল Ñ এই ছিল লেভি-স্ট্রসের অভিমত।
ইতিবাচক বিবাহ-নীতির গুরুত্ব এর আগেও দৃষ্টি কেড়েছিল নৃবিজ্ঞানীদের। দলকে সম্পর্কযুক্ত করার
ক্ষেত্রে বিয়ের গুরুত্ব ধরা পড়েছিল দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলে করা বৃটিশ এবং ওলন্দাজ নৃবিজ্ঞানীদের
কাজে। তবে নিশ্চিতভাবেই লেভি-স্ট্রসের তত্তে¡র ছিল বি¯তৃতি। প্রকাশনার পর থেকে এই বইটি যেমন
সমাদর পেয়েছে, আবার সমালোচনারও সম্মুখীন হয়েছে। প্রথমত, বিবর্তনবাদী বক্তব্যের কারণে এই
বইটি সমালোচিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, লীচ মায়ানমার (পূর্বে বার্মা নামে পরিচিত)-এ সম্পন্ন করা
কাজের ভিত্তিতে বলেন, বিবাহ-নীতি বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করা সঙ্গত নয়। সবসময় এ নীতিগুলোকে
রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়াদির প্রেক্ষিতে বিচার করা উচিত। তৃতীয়ত, বিবাহ-নীতি এবং
সংযুক্তকরণের যে আবশ্যিক সম্পর্ক লেভি-স্ট্রস দেখেছেন, তাকে প্রশ্ন-সাপেক্ষ করে তোলেন লুই
ডুমো। ডুমো বলেন, যদিও দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে লেভি-স্ট্রস যাকে বলবেন
“মৌলিক কাঠামো”, তা আছে, কিন্তু এই নীতির সামাজিক অর্থ সকল স্থানের জন্য একরকম নয়।
যেমন ধরুন, দক্ষিণ ভারতে যদিও বা বিবাহ-বন্ধন স্থাপনের মধ্য দিয়ে মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হয় কিন্তু একই
কথা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী সমাজের ক্ষেত্রে বলা যায় না।
সারাংশ
“জ্ঞাতি বীজগণিত”-এর স্থলে বিংশ শতকের প্রথমার্ধে, বংশধারা তত্ত¡ জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নে কেন্দ্রীয় জায়গা
দখল করে নেয়। বেশ কয়েক দশক পর্যন্তএই তত্ত¡ ছিল অপরিবর্তিত। লেভি-স্ট্রসের মৈত্রীবন্ধন তত্ত¡
বংশধারা তত্তে¡র গুরুত্বকে লাঘব করে দেয়। বংশধারা তত্তে¡র কারণে বংশ, গোষ্ঠী এবং জৈবিক
সূত্রিতার বিষয়গুলি জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের কেন্দ্রে ছিল। লেভি-স্ট্রসের তাত্তি¡ক উদ্ভাবনের কারণে জ্ঞাতিত্ব
অধ্যয়নের কেন্দ্রে চলে আসে মৈত্রী স্থাপনের বিষয়টি। বংশধারা তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে
তিনি বলেন, আদিম সমাজ বংশভিত্তিক সংগঠনের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয় না। বরং, এ সমাজগুলো
সংরক্ষিত হয় বিশেষ ধরনের সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে। অজাচার, বিবাহের নিষেধাজ্ঞা, যৌন
নিষেধাজ্ঞা সম্বন্ধে যে ধ্যান-ধারণা নৃবৈজ্ঞানিক মহলে প্রচলিত, লেভি-স্ট্রস সেগুলোকে প্রত্যাখান করেন।
লেভি-স্ট্রসের পূর্বে নৃবিজ্ঞানীরা এগুলোকে নেতিবাচক রীতিনীতি (“নিষেধাজ্ঞা”) হিসেবে দেখতেন।
দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গি লেভি-স্ট্রস উল্টে দেন। তাঁর চিন্তা যে বিষয়ের উপর তাত্তি¡ক গুরুত্ব আরোপ করে
তা হ’ল: বিয়ের সম্পর্ক (এবং সামাজিক সম্পর্ক) বুঝতে হলে কোন্ কোন্ ধরনের সম্পর্ক স্থাপন
সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ Ñ এভাবে না দেখে সামাজিক রীতি-নীতিগুলো কি হাসিল করতে চাচ্ছে Ñ
সেভাবে দেখা আরো কাজের। বিয়ের সম্পর্ক বিশ্লেষণে তিনি গোত্রের আনুষ্ঠানিক নিয়মাবলীর চাইতে
বেশী গুরুত্ব আরোপ করেন বিনিময় এবং পারস্পরিকতার উপর।
যদি নারী বিনিময় না ঘটে, যদি
নিজ দল হতে বিবাহ সঙ্গী
বাছাই করা হ’ত তাহলে এই
মৈত্রী তৈরি হ’ত না, সংহতি
তৈরী হ’ত না।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন -
১। নিচের কোন নৃবিজ্ঞানী মৈত্রী-বান্ধন তত্তে¡র সাথে সবচাইতে বেশী যুক্ত?
ক. লুইস হেনরী মর্গান খ. র‌্যাডক্লিফ-ব্রাউন
গ. ব্রনিম্ন ম্যালিনোস্কি ঘ. ক্লদ লেভী-স্ট্রস
২। লেভি-স্ট্রস তাঁর মৈত্রীবন্ধন তত্ত¡ দাঁড় করান কোন বিবাহ ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে?
ক. ক্রস-কাজিন বিবাহ ব্যবস্থা খ. প্যারালাল-কাজিন বিবাহ ব্যবস্থা
গ. ক ও খ উভয়ই ঘ. উপরের কোনটিই নয়।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। বহির্বিবাহের এবং অন্তর্বিবাহের নীতিমালা বলতে নৃবিজ্ঞানীরা কি বুঝিয়েছেন?
২। লেভি-স্ট্রস অজাচারকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেছেন?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। অজাচার বিশ্লেষণে লেভি-স্ট্রস নিষেধাজ্ঞার উপর গুরুত্ব আরোপ করেননি, করেছেন বিবাহের
ইতিবাচক রীতিনীতির উপর। আলোচনা করুন।
২। বংশধারা তাত্তি¡কদের মতে, বংশ সমাজকে টিকিয়ে রাখে। লেভি-স্ট্রসের মতে, মৈত্রী-স্থাপন
সমাজকে টিকিয়ে রাখে। আলোচনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]