সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তন কী?
বিবর্তন এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সামাজিক ডারউইনিজম কী? এটি কিভাবে জৈবিক ডারউইনিজমের সাথে সম্পর্কিত?


পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কিত এই পাঠে আমরা একটি কেন্দ্রীয় প্রসঙ্গের মুখোমুখি হব।
কেন্দ্রীয় এই প্রসঙ্গটিকে ছোট-ছোট একাধিক প্রশ্নের মাধ্যমে উত্থাপন করা যায়। যেমন: পরিবার কি
অপরিবর্তনীয় কিছু, নাকি রূপান্তরশীল? অর্থাৎ পরিবারের কি ইতিহাস আছে? যদি পরিবার
রূপান্তরশীল হয়ে থাকে, তাহলে এই রূপান্তর প্রক্রিয়া আমরা কিভাবে বুঝব? কোন্ তত্তে¡র সাহায্যে?
উনবিংশ শতকের চিন্তাবিদরা এ ধরনের প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছিলেন। সেই শতক ছিল বিবর্তনবাদী তত্তে¡র
স্বর্ণযুগ। আরো ছিল, স্বতন্ত্র জ্ঞানকান্ড হিসেবে নৃবিজ্ঞানের গড়ে ওঠার সময়কাল। পরিবার, বিয়ে Ñ এসব
বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেছিলেন এবং তত্ত¡ দাঁড় করিয়েছিলেন এমন সব লেখক ও তাত্তি¡ক যাঁরা কিনা
নৃবিজ্ঞানী ছিলেন না। ধরুন মর্গান, কিংবা মেইন। দুজনই ছিলেন আইনজীবী। কিন্তু, তা সত্তে¡ও
নৃবিজ্ঞানীদের জন্য তাঁদের কাজ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তার কারণ, এই সময়কালে জ্ঞাতিত্ব
নৃবিজ্ঞানীদের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়। পরবর্তী প্রজন্মের পেশাজীবী নৃবিজ্ঞানীরা, অর্থাৎ,
উনবিংশ শতকের শেষ ভাগ এবং বিংশ শতকের শুরুর দশকের নৃবিজ্ঞানীরা, নিজেদের চিন্তাভাবনা ও
তত্ত¡ দাঁড় করান এই বিবর্তনবাদীদের কাজের প্রেক্ষিতে। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা বিবর্তনবাদী চিন্তার
বিরোধিতা করেন। আবার, কিছু নৃবিজ্ঞানী বিবর্তনবাদী ধারায় কাজ অব্যাহত রাখেন। বিংশ শতকের
প্রবল ধারার নৃবিজ্ঞান অনেকের মতে ছিল, বিবর্তনবাদ-বিরোধী।
এই পাঠে প্রথমে বিবর্তনবাদ কি, তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে। এই আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা
দেখব কিভাবে জৈবিক বিবর্তনের ধারা সামাজিক বিজ্ঞানে আমদানি করা হয়, ব্যবহার করা হয়। যে
দৃষ্টিভঙ্গি দাবি করে যে সমাজ এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির (যেমন পরিবার, বিবাহ) পরিবর্তন
বিবর্তনের ধারণার মাধ্যমে বোঝা সম্ভব, সেটিকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তন বলা হয়। দ্বিতীয়ত,
পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ-সম্পর্কিত তাত্তি¡কদের কাজের সাথে আপনার পরিচয় ঘটানো হবে:
বাকোফেন, মেইন, ম্যাকলেনান, মর্গান এবং এঙ্গেলস। তৃতীয়ত, বিবর্তনবাদের সমালোচনা এবং
নারীবাদীদের কাছে এঙ্গেলসের গুরুত্ব আলোচিত হবে।
জৈবিক বিবর্তনবাদ এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তনবাদ
বিবর্তনবাদী তত্ত¡ মতে, একটি প্রজাতি অথবা একটি বিশিষ্ট জীবের জনসমষ্টি কাঠামোগতভাবে ক্রম
পরিবর্তিত হয়। প্রতিবেশের সাথে আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে এই কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটে থাকে। বংশপরম্পরা এবং প্রতিবেশ, কোনটার ভূমিকা কতখানি, এ নিয়ে বিবর্তনবাদে বিভিন্ন তাত্তি¡ক ধারা রয়েছে।
এসত্তে¡ও, মোটের উপর বিবর্তনবাদ ধরে নেয় যে, বিবর্তনের সামগ্রিক ধারা হচ্ছে প্রতিবেশের সাথে
জীবের অধিকতর উপযোগী হয়ে ওঠা। এবং বিবর্তনবাদীরা ধরে নেন, একটি নির্দিষ্ট প্রতিবেশের
উপযোগী হয়ে ওঠার সাথে-সাথে প্রতিটি প্রজাতি অধিকতর জটিল, পৃথকীকৃত, এবং বিচিত্র হয়ে উঠে।
চার্লস ডারউইনের নাম বিবর্তনবাদের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত যদিও বিবর্তনবাদী চিন্তাভাবনা পাশ্চাত্য
ঐতিহ্যে অনেক পুরানো। ডারউইনের বিবর্তনের ধারণা এবং স্পেনসারের বিবর্তনের ধারণা Ñ এ দুটোর
ভিন্নতার প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানী হিসেবে ডারউইন বিবর্তনের জৈবিকতার প্রতি
মনোনিবেশ করেছিলেন। ডারউইনের দৃষ্টিতে, বিবর্তনের মূলনীতি ছিলো প্রাকৃতিক নির্বাচন: বেশি
উপযোগী প্রজাতির টিকে থাকা। প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া আকস্মিক: বিচিত্রতার উদ্ভব ঘটে
এলোমেলোভাবে। অর্থাৎ, নতুন প্রজাতি জন্ম লাভ করে, তার মধ্যে যে কোন একটি আরো-উপযোগী
হওয়ার কারণে টিকে যায়। এই প্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট গতিপথ নেই।
ডারউইনের দ্য ওরিজিন অফ দ্য স্পিশিস (১৮৫৯) গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে বৃটিশ সামাজিক
তাত্তি¡ক হারবার্ট স্পেনসার (১৮২০-১৯০৩) প্রস্তাব করেছিলেন যে, অজৈবিক, জৈবিক এবং অতি
জৈবিক Ñ সকল ক্ষেত্রেই Ñ বিবর্তন ঘটে থাকে। শুধু তাই নয়, বিবর্তনের মাধ্যমে সম্পূরক এবং সরল
আকৃতি হয়ে ওঠে বহুরূপী, পৃথকীকৃত এবং জটিল। দ্য ওরিজিন অফ দ্য স্পিশিস প্রকাশিত হবার পর
স্পেনসার ডারউইনের চিন্তাভাবনা গ্রহণ করে “যোগ্যতমের টিকে থাকা” Ñ এই ধারণাটির জন্ম দেন।
সামাজিক বিজ্ঞানে বিবর্তনবাদের ধারণার প্রসার ঘটে প্রধানত স্পেনসারের চিন্তাভাবনার মাধ্যমে। এবং
ডারউইন যেহেতু বিবর্তনবাদ বিষয়ে সবচাইতে সুসংহত তত্ত¡ দাঁড় করান সে কারণে এই তাত্তি¡ক ধারা
“সামাজিক ডারউইনিজম” নামে পরিচিত।
সামাজিক ডারউইনিজমের প্রধান দুটি পূর্বানুমান লক্ষ্যণীয়। প্রথমটি হলো, জীবের মতন সমাজও বিভিন্ন
অংশ বা উপাদানে গঠিত। স্পেনসারের বক্তব্য হচ্ছে, জীবন্তপ্রাণীর মত সামাজিক গঠনও সরল,
সমরূপ, অপৃথকীকৃত কাঠামো হতে আরো জটিল এবং অভ্যন্তরীণ ভাবে পৃথকীকৃত গঠন ধারণ করে।
এই উপাদানগুলো যেমন বাড়ে, কমে, আবার তেমনি হয়ে ওঠে পৃথকীকৃত। সরলাকৃতির হোক কি
জটিলাকৃতির, উপাদানগুলো কাজ করে সমন্বিতভাবে। সরল সমাজ ধীরে-ধীরে জটিল হয়ে ওঠে, এবং
এটি একটি প্রক্রিয়া। সরল অবস্থায় সমাজের থাকে অল্প অঙ্গসংগঠন। এগুলো পৃথকীকৃত নয়। যেমন
ধরুন, গৃহস্থালী। আদিম সমাজে, গৃহস্থালী সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক Ñ বিভিন্ন ধরনের কাজ
সম্পাদন করে থাকে। যারা একসাথে বসবাস করে, তারা তাদের আহারের চাহিদা পূরণ করে শিকার
করে, কিংবা মাছ ধরে, অথবা ফল-মূল সংগ্রহ করে। এ ধরনের সমাজে ন্যূনতম একটি শ্রম বিভাজন
কাজ করতে পারে: পুরুষরা পশু শিকার করে, নারীরা ফল-মূল সংগ্রহ করে। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে,
সামাজিক একক (জ্ঞাতিভিত্তিক গৃহস্থালী) আবার একই সথে অর্থনৈতিক এককও (সংগ্রহের মাধ্যমে
খাদ্য উৎপাদন করে)। সমাজ জটিল হয়ে পড়ার অর্থ হচ্ছে, এর অঙ্গসংঙ্গঠন বৃদ্ধি পায়, কাজ’ও হয়ে
উঠে আরো জটিল, বিবিধ। সভ্যতার বিকাশের সাথে নগর-অঞ্চল গড়ে উঠে। গৃহস্থালী পৃথকীকৃত হয়ে
যায়: দেখা দেয় দুই ধরনের গৃহস্থালী: গ্রামের কৃষক গৃহস্থালী এবং নগরাঞ্চলের গৃহস্থালী। নগরাঞ্চলের
গৃহস্থালী শস্য উৎপাদন করে না। এই গৃহস্থালীর সদস্যরা হয়ত করেন ব্যবসা-বাণিজ্য, কিংবা দেশের
রাজনীতি পরিচালনা। তাদের খাদ্য চাহিদা পূরণ করে গ্রামের কৃষক গৃহস্থালী।
সামাজিক ডারউনিজমের দ্বিতীয় পূর্বানুমান প্রাকৃতিক নির্বাচনের মূলনীতিকে ঘিরে। যোগ্যতমের টিকে
থাকার ধারণাকে স্পেনসার এবং তার অনুসারীরা প্রয়োগ করেন মনুষ্য সমাজের ক্ষেত্রে। গরিব, অসুস্থ
এবং কম যোগ্য মানুষজন বিবেচিত হন “অযোগ্য” হিসেবে। এই দৃষ্টিতে ধরে নেয়া হয়, সমাজের
স্বাভাবিক প্রগতির উদ্দেশ্যে, “অযোগ্য”দের বিলুপ্ত হতে দেয়া উচিত।
পরিবারের উৎপত্তি এবং বিকাশ-সম্পর্কিত তত্ত¡
এই পাঠের প্রথমে যে কেন্দ্রীয় প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছিল, আমরা তাতে ফিরে যাই। পরিবারের কি
ইতিহাস আছে? ফ্রাইডরিক এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫; সমাজতান্ত্রিক এবং বিপ্লবী কার্ল মার্ক্সের সহযোগী,
তিনি নিজেও বিপ্লবী ছিলেন আর ছিলেন মার্ক্সবাদী তাত্তি¡ক) এ প্রসঙ্গে ইউরোপীয়দের উদ্দেশ্য করে
বলেন, “আপনারা ভাবেন, পরিবারের ক্ষেত্রে কোন ঐতিহাসিক বিকাশ ঘটেনি। আপনারা ধরে নেন যে,
সামাজিক বিজ্ঞানে বিবর্তনবাদের
ধারণার প্রসার ঘটে প্রধানত
স্পেনসারের চিন্তাভাবনার
মাধ্যমে। এবং ডারউইন যেহেতু
বিবর্তনবাদ বিষয়ে সবচাইতে
সুসংহত তত্ত¡ দাঁড় করান সে
কারণে এই তাত্তি¡ক ধারা
“সামাজিক ডারউইনিজম” নামে
পরিচিত।
খ্রিস্টীয় ধর্মগ্রন্থে পিতৃ প্রধান পরিবারের যে রূপ অঙ্কিত, সেটা সঠিক এবং সত্য।”১
এঙ্গেলসের লক্ষ্য ছিল, পরিবার যে একটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান (এর অতীত এবং বর্তমান আছে, এর
বদল ঘটে, এটা বদলযোগ্য), তা যুক্তিসহকারে প্রমাণ করা। উনবিংশ শতকের শেষার্ধে, ইংল্যান্ডে,
পরিবার নিয়ে বিশাল বিতর্ক চলছিল। বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল এমন ধরনের বিষয়: সমাজ গঠনে
পরিবারের ভূমিকা কি? পিতৃতান্ত্রিক পরিবার কি বিশ্বব্যাপী? এই বিতর্কে প্রবল ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন
মেইন। ইংরেজ এই আইনজ্ঞের পুরো নাম হেনরি জেমস সামনার মেইন (১৮২২-১৮৮৮)। তিনি
এনশিয়েন্ট ল’ (১৮৬১) গ্রন্থের লেখক এবং গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক তাত্তি¡ক হিসেবে বিবেচিত। মেইনের
বক্তব্য ছিল, আদিযুগে মানব সমাজ বলতে বোঝাত পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার সকল
সমাজে উপস্থিত।
বাকোফেন এবং মর্গান, মেইনের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। মেইনের মতন য়োহান্নেস য়াকব
বাকোফেন (১৮১৫-১৮৫৭)-ও ছিলেন আইনজীবী। সুইটজারল্যান্ডের এই অধিবাসী প্রাচীন গ্রীস ও
রোমের সাহিত্যের পন্ডিত ছিলেন। তিনি মিথ, রিলিজিআন এ্যান্ড মাদার-রাইট (১৮৬১)-এর রচয়িতা।
প্রাচীনকালের পুরাণে আগ্রহ থেকে তিনি জ্ঞাতি ব্যবস্থার বিবর্তনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তাঁর মতে, আদি
যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল বাছ-বিচারহীন যৌন সম্ভোগ। একে তিনি মাতৃতন্ত্র (সধঃৎরধৎপযু) অথবা মাতৃ-
অধিকার (সড়ঃযবৎ ৎরমযঃ) হিসেবে চিহ্নিত করেন। বাকোফেন বলেন, আদি যুগের এই ব্যবস্থা
পরিবর্তিত হয়। তার স্থলে গড়ে উঠে পিতৃসূত্রীয় (ঢ়ধঃৎরষরহবধষ) অথবা পিতৃ-অধিকার ব্যবস্থা।
পরিবর্তনের মূল কারণ ছিল ব্যক্তি মালিকানা ব্যবস্থার উদ্ভব এবং পুরুষদের নিজ সন্তানের জন্য সম্পত্তি
রেখে যাওয়ার প্রবণতা।
এই বক্তব্যের সমর্থন মেলে ল্ইুস হেনরী মর্গান (১৮১৮-১৮৮১)-এর কাজে। তিনিও ছিলেন
আইনজীবী। মর্গান বহু গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের লেখক: লীগ অফ দ্য ইরোকওয়া (১৮৫১) , সিষ্টেমস অফ
কনস্যাঙ্গুইনিটি এ্যান্ড এফফিনিটি (১৮৭১) এবং এনশিয়েন্ট সোসাইটি (১৮৭৭) । মর্গান তার কাজে,
মন্টেস্ক্যু’র উদ্ভাবিত যুগ-বিভাগের শ্রেণীকরণ ব্যবহার করেন: আদিম বা বন্য যুগ (শিকারী-সংগ্রহকারী),
বর্বর যুগ (কৃষি-ভিত্তিক) এবং সভ্যতা (জটিল, বিশেষায়িত সমাজ) (ঈযধৎষবং-খড়ঁরং ফব ঝবপড়হফধঃ
গড়হঃবংয়ঁরবঁ, খ'বংঢ়রৎরঃ ফবং খড়রং, ১৭৪৮)। মন্টেস্ক্যুর প্রথম দুটি শ্রেণীকে মর্গান তিনটি পর্যায়ে ভাগ
করেন Ñ নি¤œ, মধ্য, উচ্চ। বাকোফেনের মতনই, মর্গানও মনে করেন, মানব সভ্যতার আদিযুগে ছিল
নির্বিচার যৌন সম্ভোগ। তারপর, ক্রমান্বয়ে এই আদি অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। দেখা দেয়: একরক্ত
সম্পর্কের পরিবার। এটি পরিবারের প্রথম স্তর। এ পর্যায়ে, বিবাহের দলগুলি বিভিন্ন প্রজন্মে বিভাজিত
হয়ে পড়ে। পরিবারের গন্ডির মধ্যে সমস্তদাদা-দাদীরা পরস্পরের স্বামী-স্ত্রী, তাদের সন্তানেরা (অর্থাৎ,
বাবা-মা প্রজন্ম) পরস্পরের স্বামী-স্ত্রী। তাদের সন্তানেরা অর্থাৎ, ফুপাত, চাচাত, মামাত, খালাত ভাই-
বোন এবং নিজ ভাই-বোনেরা পরস্পরের স্বামী-স্ত্রী। পরিবারের এই স্তরে মাতা-পিতার সাথে যৌন সম্পর্ক
নিষিদ্ধ হয়ে উঠলেও ভাই-বোন সম্পর্কের মধ্যে যৌন সম্পর্ক প্রচলিত ছিল। পলিনেশীয় এবং হাওয়াইএর সমাজে এই রীতির প্রচলন ছিলো বলে মর্গান দাবি করেন।
দ্বিতীয় স্তরে, পুনালুয়া পরিবার গঠিত হয়। ভাই-বোনদের যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। বিয়ে হয়
প্রথম, দ্বিতীয় বা তারও অধিক দূরত্বের কাজিন বোনদের সাথে এমন এক দল পুরুষের যারা একইভাবে
রক্ত-সম্পর্কিত। পুনালুয়া শব্দটির অর্থ হল, “ঘনিষ্ট সাথী” এবং পুরুষেরা পরস্পর পরস্পরকে এই নামে
সম্বোধন করেন। স্ত্রীরাও একে অপরের পুনালুয়া। পুনালুয়া পরিবার থেকে গোত্র সংগঠনের উৎপত্তি
হয়েছে বলে মর্গান ধারণা করেছিলেন। যদিও সমগ্র পরিবারের সমস্ত সন্তান সন্তুতিদের

১ গড়রৎধ গধপড়হধপযরব, "ঊহমবষং, ঝবীঁধষ উরারংরড়হং, ধহফ ঃযব ঋধসরষু," রহ ঔধহবঃ ঝধুবৎং, গধৎু
ঊাধহং ধহফ ঘধহহবশব জবফপষরভঃ (বফং) ঊহমবষং জবারংরঃবফ. ঘবি ঋবসরহরংঃ ঊংংধুং, খড়হফড়হ:
ঞধারংঃড়পশ চঁনষরপধঃরড়হং, ১৯৮৭, ঢ়. ১০০ এ উদ্ধৃত।
এঙ্গেলস বলছেন : ইউরোপীয়রা
ধরে নেন যে, পরিবারের কোন
ইতিহাস নেই। পরিবার হচ্ছে
অনড়, অটল, অপরিবর্তনীয়।
... খ্রিষ্টীয় ধর্মগ্রন্থে পিতৃ প্রধান
পরিবারের যে রূপ অঙ্কিত,
সেটাকেই সঠিক এবং সত্য বলে
ধরে নেন।
মর্গানও মনে করেন ...
পরিবারের প্রথম স্তরে ...
বিবাহের দলগুলি বিভিন্ন প্রজন্মে
বিভাজিত হয়ে পড়ে।
পরিবারের গন্ডর মধ্যে সমস্ত
দাদা-দাদীরা পরস্পরের স্বামী-
স্ত্রী, তাদের সন্তানেরা (অর্থাৎ,
বাবা-মা প্রজন্ম) পরস্পরের
স্বামী-স্ত্রী।
মেইনের বক্তব্য ছিল, আদিযুগে
মানব সমাজ বলতে বোঝাত
পিতৃতান্ত্রিক পরিবার।
বাকোফেনের মতে, আদি
যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল বাছবিচারহীন যৌন সম্ভোগ। একে
তিনি মাতৃতন্ত্র অথবা মাতৃ-
অধিকার হিসেবে চিহ্নিত
একজন নারী নিজ সন্তান বলে সম্ভাষণ করেন, এ সত্তে¡ও নিজের পেটের ছেলে-মেয়েদের তিনি আলাদা
করতে পারেন। যেহেতু এ পর্যায়ে একমাত্র মায়ের দিক দিয়ে বংশপরম্পরা নিশ্চিতভাবে জানা যায়
সেকারণেই মাতৃধারা স্বীকৃত হয়। আদি মাতার বংশজাত কন্যাসন্তান এবং তাদের সন্তানসন্ততি মিলে
গঠিত হয় আদি গোত্র। যখন সমস্তভাই-বোনদের, এমনকি মায়ের দিক দিয়ে দূর সম্পর্কের সমান্তরাল
ভাই-বোনদের মধ্যে পর্যন্তযৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ হয় তখনই উপরুুক্ত গোষ্ঠী রূপান্তরিত হয় গোত্রে।
অর্থাৎ, মায়ের দিক দিয়ে রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়ের একটি সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠী গড়ে ওঠে যাদের মধ্যে বিয়ে
অনুমোদিত নয়। পুনালুয়া পরিবার থেকেই গোত্রের উদ্ভব। মর্গানের মতে, ইউরোপ, এশিয়া এবং
আমেরিকায় পুনালুয়া পরিবারের প্রচলন ছিলো সুদূর অতীতে; পলিনেশিয়ায় এর প্রচলন উনবিংশ শতক
পর্যন্তছিল।
সমষ্টি-বিবাহের সময়কালে অথবা তারও পরে কমবেশি সময়ের জন্য জোড়বাঁধা পরিবার দেখা দেয়।
এটি হচ্ছে তৃতীয় স্তর। বহু পতœীর মধ্যেও একজন পুরুষের একজন প্রধান পতœী থাকে। এই পুরুষটি
আবার তার প্রধান পতœীর বহু পতিদের মধ্যে প্রধান। দুই পক্ষের যে কোন পক্ষ সহজেই এই বিয়ে ভেঙ্গে
দিতে পারে। বিয়ে ভেঙ্গে গেলে, সন্তান-সন্ততিরা আগের মত কেবল মায়ের অধিকারভুক্ত। বন্য অবস্থা ও
বর্বরতার সীমারেখায় জোড়বাঁধা পরিবার দেখা দেয়। মর্গান দাবি করেন যে, যখন আমেরিকান
আদিবাসীরা আবিষ্কৃত হয় তখন তাদের উত্তরণ ঘটে এবং তারা জোড়বাঁধা পরিবার গঠন শুরু করেন।
বর্বরতার মধ্যবর্তী স্তর থেকে উচ্চতর স্তরে উৎক্রমণ যুগে জোড়বাঁধা পরিবার থেকে চতুর্থ এবং বর্তমানে
প্রচলিত একপতিপতœী পরিবারের উৎপত্তি। ধরে নেয়া হয় এই পরিবার ব্যবস্থা সভ্যতার সূচনার অন্যতম
লক্ষণ।
কি কি কারণে বিয়ে ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে? মর্গানের বক্তব্য ছিল, জীবন-ধারণের সামগ্রী লাভ করার
যে কলাকৌশল, তাতে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন আহার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে। এই পরিবর্তনের ফলে,
বিয়ে এবং পরিবার, ও রাজনৈতিক সংগঠনে অনুরূপ পরিবর্তন ঘটে। এঙ্গেলস যে মর্গানের কাজে উদ্বুদ্ধ
হন সেটা তাঁর লেখা পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি (১৮৮৪) পড়লেই বোঝা যায়।
মর্গানের তথ্যসম্ভার আর প্রধান বক্তব্য গ্রহণ করে এঙ্গেলস শ্রেণী এবং লিঙ্গীয় বৈষম্যের উৎপত্তির
প্রসঙ্গটিকে কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। এঙ্গেলস বলেন, যাযাবর জীবন ছেড়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ী বসবাসের
প্রক্রিয়া আরম্ভ হয় যখন উৎপাদনের শক্তি Ñ প্রধানত যন্ত্রপাতি Ñ আবিষ্কার হয়। তীর-ধনুক, কাঠের
পাত্র, বেতের ঝুড়ি, পাথরের যন্ত্রপাতি, বাড়িঘর তৈরী যাযাবর জীবনকে করে তোলে অনাবশ্যিক।
কুড়াল ও কোদালের মতন লৌহ যন্ত্রপাতি আবিস্কার, বনজঙ্গল সাফ করে বসতি স্থাপনের সম্ভাবনা তৈরী
করে; পশু-পালন এবং চাষ-বাসের উদ্ভব ঘটে। অরণ্যে বসবাস থামিয়ে মানুষ সমতল ভুমিতে বসবাস
আরম্ভ করে।
উৎপাদনের বিকাশের এই পর্যায়ে, এঙ্গেলস বলেন, “মাতৃ-অধিকার” প্রচলিত ছিল। সন্তান কোন বংশের
তা নির্ধারিত হত তার মায়ের মাধ্যমে। একত্রে বসবাসের রীতি ছিলো মাতৃস্থানিক, পিতৃস্থানিক নয়। শ্রম
বিকাশের এই পর্যায়ে গৃহস্থালীর সকল নারী ছিলেন একই গোত্রের, আর পুরুষেরা ছিলেন ভিন্ন-ভিন্ন
গোত্রের। উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে মাতৃ-অধিকার ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটে। পশুপালন, লৌহকর্ম, কাপড় বোনা, এবং কৃষিকাজ সম্ভব করে তোলে এমন সম্পদের সৃষ্টি যা অব্যবহৃত
থেকে যায়। উদ্বৃত্ত পুরুষের কর্ম পরিসরে তৈরি হওয়াতে, এর মালিকানা হয়ে ওঠে পুরুষের। বিকশিত
উৎপাদনের শক্তি এবং মাতৃ-অধিকার ভিত্তিক পারিবারিক ব্যবস্থা Ñ এ দুয়ের মধ্যে বৈপরীত্য তৈরি হয়।
মাতৃ-অধিকার ভিত্তিক ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটে, এর স্থলে গড়ে উঠে পিতৃ-অধিকার ব্যবস্থা। এই নতুন
ব্যবস্থায় সম্পদ প্রবাহিত হয় পিতার মাধ্যমে, মাতার মাধ্যমে নয়। এই পরিবর্তন, এঙ্গেলসের মতে,
নারী অধস্তনতার সূত্রপাত ঘটায়। নারী হয়ে উঠে সন্তান উৎপাদনের একটি উপায় মাত্র।
মর্গানের তথ্যসম্ভার আর প্রধান
বক্তব্য গ্রহণ করে এঙ্গেলস শ্রেণী
এবং লিঙ্গীয় বৈষম্যের উৎপত্তির
প্রসঙ্গটিকে কেন্দ্রে নিয়ে
আসেন। এঙ্গেলস বলেন,
যাযাবর জীবন ছেড়ে নির্দিষ্ট
স্থানে স্থায়ী বসবাসের প্রক্রিয়া
আরম্ভ হয় যখন উৎপাদনের
শক্তি - প্রধানত যন্ত্রপাতি -
আবিস্কার হয়।
ছক - ১ : মর্গানের বিবর্তনবাদী নকশার যে রূপ এঙ্গেলস গ্রহন করেন তার সংক্ষিপ্তসার২
----------------------------------------------------------------------------------------
--
পরিবারের ধরন ইতিহাসের যুগ-বিভাগ জীবন ধারণ সামগ্রী লাভের কৃৎ-কৌশল
----------------------------------------------------------------------------------------
--
দলগত বিবাহ অসভ্য: নি¤œ ফল-মূল, শিকার
মধ্য মৎস, আগুন এবং মাংস
উচ্চ তীর ও ধনুক
জোড় বিবাহ বর্বর: নি¤œ ভুট্টা ও জনার চাষ, মৃৎ শিল্প
মধ্য গৃহপালিত পশু থেকে মাংস ও
দুধ সংগ্রহ
উচ্চ সেচের সাহায্যে কৃষি কাজ
লৌহ-আকর গলানো এবং লৌহ
হাতিয়ারের (যেমন লাঙ্গল) উদ্ভব
একগামী বিবাহ সভ্যতা বর্ণমালা ও লেখার আবিষ্কার
----------------------------------------------------------------------------------------
--
একই সাথে, সম্পত্তি হয়ে উঠে ব্যক্তি মালিকানার বিষয়। এঙ্গেলস বলেন, শ্রম বিকাশ এবং উৎপন্ন
পরিমাণ যত কম হয়, সমাজের সম্পদ যত সীমিত হয়, তত বেশি সমাজ ব্যবস্থা জ্ঞাতি সম্পর্ক দ্বারা
পরিচালিত হয়। কিন্তু যখন কৌলিক বন্ধনের ভিত্তিতে গঠিত এই সমাজ কাঠামোর মধ্যে শ্রমের
উৎপাদিকা শক্তি বাড়তে থাকে তখন একাধিক জিনিস একইসাথে ঘটে: ব্যক্তিগত মালিকানা ও দ্রব্য
বিনিময় বিকশিত হয়, ধনের অসমতা বৃদ্ধি পায়, অপরের শ্রমশক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি হয়, আর
তৈরি হয় শ্রেণী বিরোধের ভিত্তি। কৌলিক বন্ধনের পরিবর্তে দেখা দেয় রাষ্ট্র হিসেবে সংগঠিত একটি
নতুন সমাজের উত্থান।
একপতিপতœী পরিবারের সূচনা পুরুষ আধিপত্যের সূত্রপাত ঘটায়। এই পরিবারের লক্ষ্য হচ্ছে
পিতৃধারায় সন্তান উৎপাদন, এটি নিশ্চিত হলে তবেই সন্তানসন্ততি প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী হিসেবে যথা
সময়ে বাপের সম্পত্তি পায়। জোড়বাঁধা বিবাহ থেকে একপতি-পতœী পরিবারের পার্থক্য হচ্ছে এই যে,
শেষোক্ত বিবাহে বন্ধনটি অনেক বেশি শক্ত, যে কোন পক্ষের মর্জি মত বিয়ে ভেঙে ফেলা সম্ভব না।
কেবল মাত্র স্বামীই পারে বিবাহ বন্ধন বিচ্ছেদ করে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে। এ প্রসঙ্গে এঙ্গেলস বলেন,
একপতিপতœী ব্যবস্থার সূত্রপাত কিন্তু নারী-পুরুষের সমতার কারণে ঘটেনি। এটিকে বিবাহের উচ্চতম
রূপ হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক নয় যেহেতু এই বিয়েতে নারী হচ্ছে অধস্তন এবং পুরুষ হচ্ছে কর্তা,
অধিপতি। শ্রেণীগত নিপীড়নের সূচনা (গরিবের উপর ধনীর) এবং লিঙ্গীয় নিপীড়নের সূচনা (নারীর
উপর পুরুষের) একই সূত্রে গাঁথা। এঙ্গেলসের মতে, ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব এবং শ্রেণী-সমাজের গঠন

২ গড়রৎধ গধপড়হধপযরব, "ঊহমবষং, ঝবীঁধষ উরারংরড়হং, ধহফ ঃযব ঋধসরষু," রহ ঔধহবঃ ঝধুবৎং, গধৎু
ঊাধহং ধহফ ঘধহহবশব জবফপষরভঃ (বফং) ঊহমবষং জবারংরঃবফ. ঘবি ঋবসরহরংঃ ঊংংধুং, খড়হফড়হ:
ঞধারংঃড়পশ চঁনষরপধঃরড়হং, ১৯৮৭, ঢ়. ১০২ এ উদ্ধৃত।
এঙ্গেলস বলেন, শ্রম বিকাশ
এবং উৎপন্ন পরিমাণ যত কম
হয়, সমাজের সম্পদ যত
সীমিত হয়, তত বেশি সমাজ
ব্যবস্থা জ্ঞাতি সম্পর্ক দ্বারা
পরিচালিত হয়।
ডেকে আনে “নারীর ঐতিহাসিক পরাজয়”। তিনি আরো বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবস্থা যতদিন
টিকে থাকবে, ততদিন পুরুষ আধিপত্য এবং নারী অধস্তনতা টিকে থাকবে। একপতিপতœী বিয়ে নারীর
জীবনকে শৃঙ্খলিত করে। এব্যবস্থায়, নারীর ভুমিকা উৎপাদনমূলক নয়, সে হয়ে ওঠে স্বামীর ব্যক্তিগত
সেবা প্রদানকারী। নতুন এই ব্যবস্থায় নারী অর্জন করে বিনিময় মূল্য। আপাত দৃষ্টিতে যদিও মনে হয়
বিয়ে একটি চুক্তি, এবং দুইজনই এই চুক্তিতে স্বেচ্ছায় স্বাক্ষর করেন, কিন্তু আসলে বিয়ের চুক্তি ব্যক্তিগত
ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়; প্রেম-ভালবাসা এর ভিত্তি নয়। বরং বিয়ের চুক্তি সম্পত্তি এবং পারিবারিক স্বার্থ
দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
এ তো হচ্ছে মালিক শ্রেণীর নারী-পুরুষের সম্পর্ক। প্রলেতারিয়েত অথবা সর্বহারা শ্রেণীতে নারীপুরুষের বিবাহ কি একইরকম? এঙ্গেলস বলেন, এই শ্রেণী যেহেতু সম্পত্তি-বিহীন সে কারণে কেবলমাত্র
এই শ্রেণীর বিয়ের ভিত্তি হচ্ছে, প্রেম-ভালবাসা। এই শ্রেণীতে যদি বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে তাহলে
দ্রæত নিষ্পত্তি হয়ে যায়; ধনী শ্রেণীর ক্ষেত্রে সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা করতে ফ্যাঁকড়া বেধে যায়,
সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তবে, শাসক শ্রেণীর ক্ষমতা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, এই শ্রেণীর
ধ্যান-ধারণা, জীবনযাপন পদ্ধতিও শক্তিশালী। সে কারণে, সর্বহারা শ্রেণীর বিয়ের সম্পর্কে শ্রেণীগত
পুরুষ-আধিপত্যের প্রভাব পড়তে পারে।
বিবর্তনবাদের সমালোচনা
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবর্তনবাদী তত্ত¡ সমালোচিত হয়েছে। ক্রিয়াবাদী নৃবিজ্ঞানীরা এর নামকরণ
করেছে “আর্মচেয়ার নৃবিজ্ঞান”। তাঁদের অনেকেরই মনে হয়েছে, বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে
নৃবিজ্ঞানের হতে হবে মাঠ-গবেষণা ভিত্তিক। বিভিন্ন জায়গার, বিভিন্ন মানুষ দ্বারা (ঔপনিবেশিক
সরকারের কর্মকর্তা, ধর্ম যাজক, ভ্রমণকারী), বিভিন্ন উপায়ে জড়ো করা তথ্য, এবং অনেকাংশেই
কল্পনা-প্রসূত তথ্য, নৃবিজ্ঞানের কাক্সিক্ষত বৈজ্ঞানিক মর্যাদাকে ক্ষুণœ করতে পারে। বিবর্তনবাদের আরো
মৌলিক সমালোচনা দাঁড় করিয়েছেন ঔপনিবেশিকতা বিরোধী নৃবিজ্ঞানীরা, নব্য মার্ক্সবাদীরা, এবং
নারীবাদী নৃবিজ্ঞানীরা। এঁদের সমালোচনাগুলোকে জড়ো করলে প্রধান যে বিষয়গুলো বেরিয়ে আসে, তা
হ’ল, এই তত্তে¡র পদ্ধতিগত দুর্বলতা এবং এর মতাদর্শিক চেহারা। এই দুটো বিষয়
আন্তঃসম্পর্কিত। দৈহিক নৃবিজ্ঞান যেভাবে বানর হতে মানুষে দৈহিক বিবর্তনের লুপ্ত ধাপগুলি অনুসন্ধান
করতে থাকে, ঠিক একইভাবে সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা লুপ্ত সাংস্কৃতিক ধাপগুলো অনুসন্ধান করতে
থাকে। এই ধাপ অনুসন্ধান করতে গিয়ে, বিবর্তনবাদীরা সমসাময়িক ইউরোপীয় এবং অ-ইউরোপীয়
সমাজ হতে প্রাপ্ত তথ্যকে “নিচু” থেকে “উঁচু” মানদন্ডে ক্রমান্বয়ে সাজান। তাঁদের পূর্বানুমান ছিল:
সমসাময়িক অ-ইউরোপীয় সমাজ যদিও বর্তমান তবুও এটি মানব সভ্যতার একটি পূর্বতন, হারিয়েযাওয়া অতীতকে প্রতিনিধিত্ব করে। এই অনুমান সম্ভব হয়েছিল, সমালোচকদের মতে, কারণ
বিবর্তনবাদীরা ধরে নিয়েছিলেন যে, সমসাময়িক ইউরোপীয়রা, এবং তাদের সমাজিক প্রতিষ্ঠানাদি,
বিবর্তনের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে গেছে। সেই অর্থে, বিবর্তনবাদী তত্ত¡ ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্ববোধের
নামান্তর। বিবর্তনবাদ মানব বিবর্তনের একটি বিশ্বজনীন তত্ত¡ দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। যদিও এঙ্গেলস
সমসাময়িক বুর্জোয়া-শাসিত সমাজের কট্টর সমালোচক ছিলেন এবং স¤প্রতিক সমালোচকরা যে
ব্যাপারে ওয়াকিবহাল তাদের সমালোচনার বিষয় হচ্ছে এঙ্গেঁলসের অনুসৃত পদ্ধতি।
বর্তমানের সমালোচকরা বলেন, দৈহিক বিবর্তনবাদীদের যুক্তি মেনে নিলেও Ñ যে বিশ্বের সকল মানুষ
একই প্রক্রিয়ায় বানর হতে মানুষে বিবর্তিত হয়েছে Ñ সেই যুক্তি সাংস্কৃতিক পরিসরে প্রয়োগ করা হলে
সেটা মেনে নেয়া কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, কি যুক্তিতে আমরা মেনে নিতে পারি যে পৃথিবীর সকল
সমাজে বিবাহের অর্থ এক এবং অভিন্ন? তথ্যগত ভুল-ভালও রয়েছে। যেমন ধরুন মর্গানের তত্ত¡ মতে,
নির্বিচার যৌন সম্পর্ক ছিল আদি অবস্থার বৈশিষ্ট্য। এই অবস্থান থেকে উত্তরণ ঘটে ভাই-বোন বিয়ের
মাধ্যমে। ভাই-বোন বিয়ের প্রমাণাদি তিনি পান হাওয়াই সমাজে যেখানে সকল চাচা, মামা, ফুপা এবং
খালুদের একই নামে সম্বোধন করা হ’ত, বোনদের ক্ষেত্রেও তাই। এ থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তেপৌঁছান
শ্রেণীগত নিপীড়নের সূচনা
(গরিবের উপর ধনীর) এবং
লিঙ্গীয় নিপীড়নের সূচনা (নারীর
উপর পুরুষের) একই সূত্রে
গাঁথা।
হাল-আমলের সমালোচকদের
মতে, এঙ্গেলস মর্গানের
নড়বড়ে পদ্ধতি গ্রহণ করে
পরিবারের পরিবর্তনের যে
ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন তা
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ-বিরুদ্ধ।
মর্গানের পদ্ধতি গ্রহণ করার
ফলে তিনি প্রাক-পুঁজিবাদী
সমাজের সামাজিক এবং
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সমরূপ
করে ফেলেছেন। এটি
ঐতিহাসিক বস্তুবাদী পদ্ধতির
বিবর্তনবাদের ... মৌলিক
সমালোচনা দাঁড় করিয়েছেন
ঔপনিবেশিকতা বিরোধী
নৃবিজ্ঞানীরা, নব্য মার্ক্সবাদীরা,
এবং নারীবাদী নৃবিজ্ঞানীরা।
এঁদের সমালোচনাগুলোকে
জড়ো করলে প্রধান যে
বিষয়গুলো বেরিয়ে আসে, তা
হ’ল, এই তত্তে¡র পদ্ধতিগত
দুর্বলতা এবং এর মতাদর্শিক
চেহারা।
যে, ভাই-বোনদের মধ্যে নিশ্চয়ই বিয়ের প্রচলন ছিল এবং সে কারণেই “পিতা” ও “চাচা”কে পৃথক
করার মত কোন শব্দের উদ্ভব হয়নি। সমালোচকেরা বলেন, এই যুক্তি নড়-বড়ে। আর যদিও বা এটি
হাওয়াই সমাজের ক্ষেত্রে সত্য হয়ে থাকে, আমরা কেন ধরে নেব যে এই প্রচলন বিশ্বের সকল সমাজের
জন্য প্রযোজ্য?
হাল-আমলের সমালোচকদের মতে, এঙ্গেলস মর্গানের নড়বড়ে পদ্ধতি গ্রহণ করে পরিবারের
পরিবর্তনের যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন তা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ-বিরুদ্ধ। মর্গানের পদ্ধতি গ্রহণ করার
ফলে তিনি প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সমরূপ করে ফেলেছেন। এটি
ঐতিহাসিক বস্তুবাদী পদ্ধতির লঙ্ঘন। মর্গানের কল্যাণে এঙ্গেলসের কাজে আরো কিছু তথ্যগত ভ্রান্তি
দেখা গেছে। নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যসূত্রে আমরা জানতে পারি যে, ব্যক্তিমালিকানা বিহীন
সমাজেও একপতিপতœী বিবাহের প্রচলন রয়েছে। আর কেনই বা জৈবিক পিতৃত্বের সম্পর্ক নিশ্চিত করা
আবশ্যিক হয়ে পড়বে সম্পদের আবির্ভাবের সাথে? এঙ্গেলসের বিরুদ্ধে সমালোচকদের প্রধান অভিযোগ
হ’ল, শ্রেণী এবং লিঙ্গীয় অসমতার গাঁথা একইসূত্রে গাঁথতে যেয়ে তিনি লিঙ্গীয় বৈষম্যের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য
উদঘাটনের রাস্তা কঠিন করে তুলেছেন। এতসব সমালোচনা এবং অভিযোগ সত্তে¡ও, নারীবাদীরা
এঙ্গেলসের তত্ত¡কে গুরুত্ব দেন। সেটির কারণ হচ্ছে, এঙ্গেলসের প্রধান বক্তব্য: নারী অধস্তনতা স্বাভাবিক
কিংবা প্রাকৃতিক কিংবা ঈশ্বর-প্রদত্ত নয়। এটি সামাজিক, এটি ঐতিহাসিক, এবং বদলযোগ্য।
সারাংশ
সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তনবাদী চিন্তা অনুসারে সমাজের গঠন হচ্ছে প্রাণীর মতন: এর আছে অঙ্গ-
প্রত্যঙ্গ। বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সরল আকৃতির সমাজ হয়ে ওঠে জটিল এবং পৃথকীকৃত। বিবর্তনবাদী
ভাবনাচিন্তা সামাজিক প্রতিষ্ঠান, আচার-অনুষ্ঠানের উদ্ভব খোঁজার প্রেরণা যোগায় কয়েক প্রজন্মের
নৃবিজ্ঞানীদের। উনবিংশ শতকের ইংল্যান্ডে পরিবারের আদি ধরন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। নৃবিজ্ঞানী
হিসেবে বর্তমানে যারা স্বীকৃত (যেমন আইনজীবী বাকোফেন, মর্গান প্রমুখ) তাঁরা এতে অংশগ্রহণ
করেন। তাঁরা পরিবারের উদ্ভবের অনুসন্ধান চালান। এদের মধ্যে মর্গানের তত্ত¡ বহুল পরিচিত। পরবর্তী
পর্যায়ে, এঙ্গেলস মর্গানের তত্তে¡র লুক্কায়িত বিষয়গুলোকে কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। উৎপাদন পদ্ধতি, শ্রমবিভাজন এবং লিঙ্গীয় বৈষম্য ঐতিহাসিক ভাবে আন্তঃসম্পর্কিত Ñ এই বক্তব্য স্পষ্ট করে তোলেন।
গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা সত্তে¡ও নারীবাদীরা এঙ্গেলসের কাছে ঋণী কারণ তিনি নারী অধস্ততার সামাজিক
কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা চালান।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন -
১। “যোগ্যতমের টিকে থাকা” - এই ধারাটির জন্ম দেন কে?
ক. ডারউইন খ. স্পেনসার
গ. ফ্রাইডরিক এঙ্গেলস ঘ. লুইস হেনরী মর্গান
২। বিবর্তনবাদী তত্তে¡ স্বর্নযুগ বলা হয় কোন সময়টিকে?
ক. উনবিংশ শতক খ. বিংশ শতক
গ. আঠারো শতক ঘ. উপরের কোনটিই নয়
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তন কী?
২। বিবর্তন এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ধারণা কিভাবে আন্তঃসম্পর্কিত তা সংক্ষেপে
আলোচনা করুন।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। সামাজিক ডারউইনিজম কী? এটি কিভাবে জৈবিক ডারউইনিজমের সাথে সম্পর্কিত?
২। এঙ্গেলসের মতে পরিবারের ইতিহাস আছে। সমালোচকদের দৃষ্টিতে, সমস্যা হচ্ছে এটি
বিবর্তনবাদী ইতিহাস। আলোচনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]