নরবর্ণ কী?
বর্ণবাদ কী? বর্ণবাদ ও বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদ কী সম্পর্কিত?


নৃবিজ্ঞানের বিভিন্ন সংজ্ঞার মধ্যে এটিও একটি: নৃবিজ্ঞান হচ্ছে “নরবর্ণ এবং সংস্কৃতির বিজ্ঞান”
(ধহঃযৎড়ঢ়ড়ষড়মু রং ঃযব ংপরবহপব ড়ভ ৎধপব ধহফ পঁষঃঁৎব)। ইদানিং কালে অবশ্য এই সংজ্ঞা খুব
একটা দেখা যায় না। নরবর্ণের (ৎধপব) ভিত্তিতে পৃথিবীর মানুষজনের বর্গীকরণ আরম্ভ করেন
ইউরোপীয়রা। এর সূত্রপাত ঘটে চৌদ্দ শতকে, যখন থেকে ইউরোপীয় শক্তির বিশ্বব্যাপী স¤প্রসারণ
শুরু। এই পাঠের প্রথম অংশে রয়েছে এর আলোচনা। দ্বিতীয় অংশে, বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদ কি, এবং
নৃবিজ্ঞানী বোয়াস কি যুক্তিতে এর বিরোধিতা করেন, তা আলোচিত হবে। ড্যানিয়েল ময়নিহান-এর
কাজ হচ্ছে বর্ণবাদী দৃষ্টিতে পরিবার নিয়ে লেখালেখির একটি নমুনা। এটির আলোচনা আছে এই পাঠের
তৃতীয় অংশে, এবং এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গরা কেন গরিব, এ বিষয়ে ময়নিহানের বর্ণবাদী
যুক্তি সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। এই অংশে আরো রয়েছে ক্যারল স্ট্যাক-এর কাজ হতে মার্কিনী
কৃষ্ণাঙ্গদের পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে কেস স্টাডি। স্ট্যাকের কাজ ময়নিহানের যুক্তি খÐনের একটি
শক্তিশালী, বাস্তবসম্মত উত্তর হিসেবে বিবেচিত।
নরবর্ণের ভিত্তিতে বর্গীকরণ
নরবর্ণ প্রসঙ্গে ধারণা গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই একটি বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট হতে হবে, তা হ’ল, এটি
হচ্ছে একটি পরিকাঠামো। পরিকাঠামোর অর্থ কি? একটি চিত্র বা ছবিকে যেমন বাঁধাই করা হয় ফ্রেমের
সাহায্যে, ঠিক একইভাবে বিশ্বের মানুষজনকে বাঁধাই করা হয় নরবর্ণের ধারণার সাহায্যে। এই ধারণা
মানুষকে বিভিন্ন ভাবে আলাদা করে, আবার একত্রীভূত করে, এদের নির্দিষ্ট স্থানে সন্নিবেশিত করে।
এই বিভাজনের ফলাফল হচ্ছে পরিকাঠামো (ছবির বাঁধাই) যা আমাদের মজ্জাগত হয়; এবং আমাদের
দৃষ্টি ও অনুভূতি-উপলব্দিকে দিক্-নির্দেশনা দান করে। উদাহরণ দিই, কেন আপনি বা আমি কালো
মানুষ দেখলে “নিগ্রো” বলি? কেন অন্য কিছু Ñ যেমন ধরুন, “খুব সুন্দর দেখতে, মনে হয় চেহারাটা
একদম খোদাই করা” কিংবা “দেখলেই ঈর্ষা হয়, মনে হয় ঈশ্বর যদি আমাকে ওভাবে গড়তেন” অথবা
“চোখ দুটো দেখলে মনে হয় সারা বিশ্বের মায়া ওতে লুকানো” Ñ প্রায় কখনোই মাথায় আসে না। কেন
কণ্ঠে একটু আধটু তাচ্ছিল্যের ভাব থাকে? এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবলে বুঝবেন কেন ইদানিং কালে
নৃবিজ্ঞানীরা “পরিকাঠামো” শব্দটি ব্যবহার করছেন যা অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবিক ধারণা। বাস্তবিক এই যে,
ব্যক্তির মাথায় এগুলো গেঁথে থাকে।
পরিকাঠামো সৃষ্টির ইতিহাস আমাদের জানতে হবে: কোন্ বিশেষ প্রেক্ষিতে এটি একটি পরিকাঠামো
হিসেবে দাঁড়ায়, এই পরিকাঠামো কি উপায়ে শক্তিমত্তা অর্জন করে, এই পরিকাঠামো সৃষ্টির সাথে
বৈষম্যের কোন সম্পর্ক ছিল বা আছে কিনা ইত্যাদি। পরিকাঠামো হিসেবে দেখার বিষয়টি যে সকল
নৃবিজ্ঞানীরা জরুরী মনে করছেন, তাঁরা বলছেন, নরবর্ণকে যদি পরিকাঠামো হিসেবে না দেখি তাহলে
যে বর্গ (পধঃবমড়ৎু)-গুলো এই পরিকাঠামো দ্বারা সৃষ্ট, সেগুলোকে মনে হবে স্বতঃসিদ্ধ, প্রকৃতি-প্রদত্ত।
মনে হবে “আসলেই তো, মানুষের চামড়া’র রঙ তো হয় কালো অথবা সাদা, নাক হয় খাড়া অথবা
চ্যাপ্টা, চুল হয় কোঁকড়া অথবা সোজা” ইত্যাদি ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, নরবর্ণগত
পাঠ - ৫
নরবর্ণের (ৎধপব) ভিত্তিতে
পৃথিবীর মানুষজনের বর্গীকরণ
আরম্ভ করেন ইউরোপীয়রা। এর
সূত্রপাত ঘটে চৌদ্দ শতকে,
যখন থেকে ইউরোপীয় শক্তির
বিশ্বব্যাপী স¤প্রসারণ শুরু।
কেন আপনি বা আমি কালো
মানুষ দেখলে “নিগ্রো” বলি?
কেন অন্য কিছু Ñ যেমন ধরুন,
“খুব সুন্দর দেখতে, মনে হয়
চেহারাটা একদম খোদাই করা”
কিংবা “দেখলেই ঈর্ষা হয়, মনে
হয় ঈশ্বর যদি আমাকে ওভাবে
গড়তেন” অথবা “চোখ দুটো
দেখলে মনে হয় সারা বিশ্বের
মায়া ওতে লুকানো” Ñ প্রায়
কখনোই মাথায় আসে না।
বিভাজন ঐতিহাসিকভাবে গড়ে উঠেছে এবং বিষয়টি “কালো চোখ”, “খর্বকায়” Ñ এত সহজ, সরল
কিছু নয়। এ ধরনের সরলীকৃত চিত্রকে ভেদ করার লক্ষ্যে নৃবিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা দাঁড়
করাচ্ছেন যা বিশ্লেষণের রাস্তা তৈরি করে। প্রথমত, নৃবিজ্ঞানীদের অভিমত হল: যে কোন জনগোষ্ঠীর
সকল মানুষের গায়ের রঙ, দৈর্ঘ্য কিংবা চেহারা-সুরত ও শারীরিক আকার-আকৃতি একইরকম নয়।
একথা বিশ্বের সব জনগোষ্ঠীর জন্য সত্য। কিন্তু এসত্তে¡ও পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বা জাতিসত্তা সম্পর্কে
কিছূ গৎবাঁধা ধারনা (ংঃবৎবড়ঃুঢ়ব) তৈরি হয়েছে যা কিনা সেই জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যকার ভিন্নতাকে
অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কোন একটি শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে করে তোলে সমগ্র জাতির
সাধারণ চিহ্ন বা স্মারক (“চীনা চোখ”, “চ্যাপ্টা নাক”)।
নরবর্ণ বলতে সাধারণভাবে আমরা বুঝে থাকি শুধুমাত্র মুখাকৃতি এবং শারীরিক বৈশিষ্টাবলী। যেমন কিনা
উপরে উল্লেখিত। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে ইউরোপে জন্মানো নরবর্ণের ধারণা কেবলমাত্র তা নয়। নরবর্ণের
ধারণায় শারীরিক বৈশিষ্টাবলীর সাথে মিশ্রিত হয়ে আছে বুদ্ধি, সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ ইত্যাদি। নরবর্ণের
প্রধান পাঁচটি বর্গ তৈরি করা হয় যথা ককেশীয়, মঙ্গোলীয়, ইথিওপীয়, আমেরিকান এবং মালয়। সকল বর্গ
সমমর্যাদার না, এগুলো স্তরায়িত। এই স্তরায়নে ককেশীয়রা Ñ ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা’র জনসমষ্টি, যারা
“শ্বেতাঙ্গ” হিসেবে পরিচিত Ñ সর্বোত্তম হিসেবে বিবেচিত।
পনের হতে সতের শতক, এ সময়কালে, ইউরোপীয় দেশের নৌ-অভিযানের মধ্য দিয়ে মানুষের মুখাকৃতি ও
শারীরিক উপস্থিতির বিশ্বব্যাপী বৈচিত্র্য উন্মোচিত হতে থাকে। মানুষের মুখাকৃতি ও শারীরিক বৈচিত্র্যের এই
বিশালতা ১৪৯২ সালে কলম্বাসের আমেরিকা “আবিষ্কার”-এর আগে ধরা পড়েনি। পনের শতকের সাগরপথের এই অভিযান যুক্ত করে নতুন ও পুরাতন পৃথিবীকে। আরো পরবর্তী সময়কালের নৌ-সফর, পৃথিবী
নামক গ্রহে মানুষের মুখাকৃতি ও শারীরিক বৈচিত্র্যের চিত্রকে সামগ্রিকতা দান করে। যেমন, সতের শতকের
প্যাসিফিক দ্বীপপুঞ্জে পাঠানো একাধিক অনুসন্ধানী সফর। সাগর পথের অভিবাসন এবং ইউরোপ ও আফ্রিকার
সাব-সাহারা অঞ্চলের মানুষজনের জোরপূর্বক স্থানান্তরের ফলে, এমনধরনের স¤প্রদায় ঘনিষ্ঠ নৈকট্যে আসে,
যারা পূর্বে প্রতিবেশী ছিল না। ভৌগোলিক বিষয়টি এই আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দেখা গেছে,
কোন একটি ভৌগোলিক অঞ্চলে ভিন্ন-ভিন্ন জাতি বা বর্ণের মানুষজন বসবাস করলেও তাদের মধ্যকার
শারীরিক গঠনের ভিন্নতা ক্রমান্বিক। শারীরিক গঠনের এই ক্রমান্বিকতা ইউরোপীয় অভিযানের কারণে উল্টে
যায় এবং ইউরোপে বিদ্যমান খ্রিস্টীয়-প্রধান মানুষ অ-ইউরোপীয় অঞ্চলের মানুষজনের মুখাকৃতির বৈচিত্র্যে,
ধাক্কা খায়। এই বৈচিত্র্যকে বোঝার জন্য, সামাল দেয়ার জন্য, “নরবর্ণ” নামক ধারণা জন্মায়। মাথায় রাখা
জরুরী যে, মানুষের মুখাকৃতি ও শারীরিক উপস্থিতির বৈচিত্র্য বাস্তব, কিন্তু পাঁচ-ধরনের নরবর্ণের যে ছাঁচ বা
পরিকাঠামো সৃষ্টি করা হ’ল তা এই বৈচিত্র্যের জটিলতাকে বুঝতে সাহায্য করে না। এই ছাঁচ কেবল শ্বেতাঙ্গ
ইউরোপীয়দের একটি নরবর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিতই করে না। উপরন্তু তাদের, বিশ্বের আর সকল নরবর্ণের
তুলনায়, সকল ক্ষেত্রে Ñ বুদ্ধি-বিবেচনা, যুক্তিক্ষমতা, সৌন্দর্য, দৈহিক শক্তি ইত্যাদি Ñ উৎকৃষ্ট হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত করে। এভাবেই সৃষ্ট হয় নরবর্ণের ধারণা, এবং ঘটে বর্ণবাদের উত্থান।
চৌদ্দ শতক, এবং তার পরবর্তী শতকের, ঘটনাবলী বিশ্বকে নরবর্ণে বিভাজিত করে তোলে। ইউরোপীয়
অভিযানের পূর্বে, জাতিভিত্তিক উৎকর্ষের ধারণা যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মাঝে বিদ্যমান ছিল না, তা নয়।
প্রাচীন গ্রীকদের ধারণা ছিল মেডিটেরেনিয়ান অঞ্চলের অন্য সকল জনগোষ্ঠী বর্বর, কেবলমাত্র তারা
নিজেরা “সভ্য”। কিন্তু, তারা সভ্যতার সাথে শারীরিক গঠন এবং সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা যুক্ত করেনি।
নীল উপত্যকার কৃষ্ণকায় নুবিয়ানরা গ্রীকদের দৃষ্টিতে ছিল সভ্য। পক্ষান্তরে, উত্তরের শ্বেতাঙ্গ
ইউরোপবাসীরা তাদের দৃষ্টিতে ছিল বর্বর। দক্ষিণ এশীয় জাতিবর্ণ (পধংঃব)-ভিত্তিক সমাজে, জাতিবর্ণ
স্তরায়িত। অনেকটা নরবর্ণের মতনই। নিচু জাতের যারা, তারা বস্তুগত ও রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার।
কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভিন্নতা বিদ্যমান। চামড়ার রঙ জাতিবর্ণের ভিত্তি নয়। ঘন রঙের উচ্চবর্ণ যেমন রয়েছে,
ঠিক তেমনি হালকা রঙের নিচুবর্ণের অস্তিত্বও বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, মানুষের
পুনর্জন্ম ঘটে,এবং বহুবার। পুনর্জন্ম ঘটে একই আত্মার, কিন্তু সেই আত্মা একই জাতে জন্মগ্রহণ নাও
করতে পারে। যিনি কিনা ইহ-জন্মে শূদ্র, তিনি পরজন্মে ব্রাহ্মণ হিসেবে জন্মাতেও পারেন। কে
আগামীতে কোন জাতে জন্মগ্রহণ করবে তা নির্ভর করে তার কৃত কাজের উপর। নরবর্ণের বিশ্বকরণের
পূর্বে, দাসত্বের ক্ষেত্রেও একই জিনিস দেখা গেছে। বহু অঞ্চলে দাস এবং প্রভু, এদের শারীরিক গঠন
নরবর্ণ বলতে সাধারণভাবে
আমরা বুঝে থাকি শুধুমাত্র
মুখাকৃতি এবং শারীরিক
বৈশিষ্টাবলী। যেমন কিনা উপরে
উল্লেখিত। কিন্তু
ঐতিহাসিকভাবে ইউরোপে
জন্মানো নরবর্ণের ধারণা
কেবলমাত্র তা নয়। নরবর্ণের
ধারণায় শারীরিক বৈশিষ্টাবলীর
সাথে মিশ্রিত হয়ে আছে বুদ্ধি,
সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ
ইত্যাদি।
মাথায় রাখা জরুরী যে, মানুষের
মুখাকৃতি ও শারীরিক উপস্থিতির
বৈচিত্র্য বাস্তব, কিন্তু পাঁচ-ধরনের
নরবর্ণের যে ছাঁচ বা
পরিকাঠামো সৃষ্টি করা হ’ল তা
এই বৈচিত্র্যের জটিলতাকে
বুঝতে সাহায্য করে না।
বা মুখাকৃতির কোন ভিন্নতা ছিল না। দেখা গেছে যে, দাসত্ব যে কোন স¤প্রদায়ের ভাগ্যে ঘটেছে।
আবার এও দেখা গেছে যে, দাসের সন্তানেরা কয়েক প্রজন্ম পরে, প্রভু জাতির সাথে মিশে গেছে।
চৌদ্দ শতক পরবর্তী ইউরোপ-প্রবর্তিত নরবর্ণ ব্যবস্থা দক্ষিণ এশীয় জাতিভিত্তিক বিভাজন, অথবা দাস
এবং প্রভু ব্যবস্থা হতে খুব ভিন্ন। পূর্বতন ব্যবস্থাগুলোর সাথে তুলনা করলে মৌলিক ফারাক চোখে পড়ে।
নরবর্ণ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী, এটা সার্বিক মানবজাতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নরবর্ণের পরিকাঠামোতে আছে অল্প
কিছু বর্গ, সাধারণত শুধুমাত্র পাঁচটি। এই পাঁচটি মূল বর্গের সাথে যুক্ত হয়ে থাকে কিছু উপ-বর্গ, এবং
মিশ্র-বর্গ (পিতা, মাতা যদি ভিন্ন নরবর্ণের হয়ে থাকেন তাহলে তাদের সন্তানদের মিশ্রবর্গ হিসেবে
বিবেচনা করা হয়)। নরবর্ণের পরিকাঠামো অসমতাকে শক্তিশালী করে, সর্বব্যাপৃত করে। এই অসমতা
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক; ক্ষেত্র বিশেষে আইনগত। নরবর্ণীয় বিভাজনের ফলে দেখা
দেয় বর্ণবাদ। নৃবিজ্ঞানী রজার স্যানজেক-এর ভাষায় বর্ণবাদ হল: সাংস্কৃতিক এবং মতাদর্শিক। বর্ণবাদ
মানুষের আত্ম-উপলব্ধি এবং অপরের প্রতি উপলব্ধিকে নরবর্ণীয় চিন্তার ভিত্তিতে আকৃতি দান করে
(“নাহ্, আমি দেখতে সুন্দর না। আমার চোখগুলা চীনা-চীনা” কিংবা “টল ফিগার...... দেখতে একদম
বিদেশীদের মতন”)। বর্ণবাদ প্রাতিষ্ঠানিক। অর্থাৎ, এটি এক প্রজন্ম হতে আরেক প্রজন্মে প্রবাহিত হয়।
বর্ণবাদ এক ব্যক্তির সাথে আরেক ব্যক্তির আচরণ এবং আরও বৃহৎ পরিসরে সামাজিক আচরণকে
প্রভাবিত করে, নির্ধারণ করে।
বর্ণবাদ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে: যেমন দৈনন্দিন জীবনে, তেমনি জ্ঞানচর্চায়। বৃহত্তর রাজনৈতিক
পরিসরেও বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখা গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা এর সবচাইতে ভাল
উদাহরণ। কিছু নৃবিজ্ঞানী মনে করেন, বর্তমান বিশ্বে আছে বহু ধরনের বর্ণবাদ: স্থানিক বর্ণবাদ
(“কালো মেয়ে ঘরে আনব না”), জাতিরাষ্ট্র-ভিত্তিক বর্ণবাদ (“দেশ পরিচালনার মত বুদ্ধি ও দক্ষতা
পাহাড়িদের নেই”) এবং অঞ্চল-ভিত্তিক বর্ণবাদ (“খেলাধুলা আর গান বাজনা আফ্রিকানরা ভাল পারে,
অন্যসব বিষয়ে তারা পিছিয়ে”)। তাঁরা মনে করেন, এক এক জায়গার সংস্কৃতি এক এক ধরনের
বর্ণবাদকে গঠন করেছে। আবার কিছু নৃবিজ্ঞানী মনে করেন, স্থানিক পর্যায়ের বর্ণবাদ (“পাহাড়িদের
নাক চ্যাপ্টা”) ১৪ শতক হতে গঠিত বিশ্বব্যাপী বর্ণবাদের অংশ, তারই স্থানিক প্রতিবিম্ব। দৃষ্টিভঙ্গি দুটি
ভিন্ন হলেও বড়সড় মিলের জায়গা আছে। শ্বেতাঙ্গ বর্ণ সবসবময় কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণ হতে উৎকৃষ্ট হিসেবে
বিবেচিত হয়েছে। অপর সকল বর্ণ (“বাদামী”, “চকলেটি”, “হলদে জাতি”) এই দুই বর্ণের মাঝামাঝি
স্তরে স্থান পেয়েছে।
বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদ এবং ফ্রাঞ্জ বোয়াসের প্রতিরোধ
কিছু তত্ত¡ দাবি করে যে, বৈজ্ঞানিক উপায়ে নরবর্ণের উৎকৃষ্টতা এবং নিকৃষ্টতা প্রমাণ করা সম্ভব। এই তত্ত¡
সমষ্টিকে বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদ বলা হয়। এ ধরনের তত্তে¡র বক্তব্য হ’ল: নরবর্ণ অনুসারে মানুষের যোগ্যতা ভিন্ন।
নিচু নরবর্ণের, জাতিত্বের, শ্রেণীর মানুষজনের বুদ্ধি কম। এই তত্ত¡ অনুসারে, বুদ্ধির তারতম্য সামাজিক
অসমতার কারণ। বুদ্ধির এই তারতম্য প্রকৃতি-প্রদত্ত এবং সেই কারণে সামাজিক অসমতা অনিবার্য।
বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদ বিরোধীরা বলেন, এই তত্ত¡সমূহের ভিত্তি বৈজ্ঞানিক নয়, মতাদর্শিক। সামাজিক অসমতাকে
বৈধতা দানের লক্ষ্যে এই তত্ত¡গুলো তৈরি করা হয়েছে। অসমতা প্রকৃতি-প্রদত্ত নয়, বরং সামাজিক। বর্ণবাদী
মতাদর্শ হচ্ছে ক্ষমতা এবং টাকাপয়সার বৈষম্যকে যুক্তিসঙ্গত করে তোলার প্রচেষ্টা। ঊনবিংশ শতকের
শেষার্ধে এবং বিংশ শতকের প্রথমার্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ বিষয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক তৈরি হয়। এই বিতর্কে
বিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীরা অংশ নেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, হাল আমলের নয়া বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি
(জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, পুনরুৎপাদনমূলক প্রযুক্তি) কখনও কখনও, অতি সূ²ভাবে, পূর্বতন বর্ণবাদী এবং
শ্রেণীবাদী চিন্তাভাবনাকে শক্তি-সমর্থন যোগায়।
বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদের উৎপত্তি ঘটে ১৮ এবং ১৯ শতকে যখন জীববিজ্ঞান একটি বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকান্ড হিসেবে
গড়ে উঠে। বিবর্তনবাদী তত্তে¡র গঠন ও প্রসার অসমতার ধর্মীয় (খ্রিস্টীয়) ব্যাখ্যাকে কোণঠাসা করে। এই
প্রেক্ষিতে অসমতার প্রবক্তারা জীববিজ্ঞানের মতন নতুন বিজ্ঞানের শরণাপন্ন হন। তাঁরা প্রথমে প্রমাণ করার
চেষ্টা করেন যে, কৃষ্ণাঙ্গ এবং অন্যান্য নি¤œবর্ণের মানুষজনের মগজ (নৎধরহ) শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত
ছোট আকৃতির। বিংশ শতকের প্রথম দিকে এই তত্তে¡র অসারতা যখন প্রমাণিত হয় তখন তারা “বুদ্ধি
বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদ তত্তে¡র বক্তব্য
হ’ল: নরবর্ণ অনুসারে মানুষের
যোগ্যতা ভিন্ন। নিচু নরবর্ণের,
জাতিত্বের, শ্রেণীর মানুষজনের
বুদ্ধি কম। ... বুদ্ধির তারতম্য
সামাজিক অসমতার কারণ।
বুদ্ধির এই তারতম্য প্রকৃতিপ্রদত্ত এবং সেই কারণে
সামাজিক অসমতা অনিবার্য।
বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদ বিরোধীরা
বলেন, এই তত্ত¡সমূহের ভিত্তি
বৈজ্ঞানিক নয়, মতাদর্শিক।
চৌদ্দ শতক পরবর্তী ইউরোপপ্রবর্তিত নরবর্ণ ব্যবস্থা দক্ষিণ
এশীয় জাতিভিত্তিক বিভাজন,
অথবা দাস এবং প্রভু ব্যবস্থা
হতে খুব ভিন্ন। পূর্বতন
ব্যবস্থাগুলোর সাথে তুলনা
করলে মৌলিক ফারাক চোখে
পড়ে। নরবর্ণ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী,
এটা সার্বিক মানবজাতির
ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
পরীক্ষা” প্রণয়নে ব্যস্তহয়ে পড়েন। ইংরেজিতে একে বলা হয় ওহঃবষষরমবহপব ছঁড়ঃরবহঃ ঞবংঃ অথবা
সংক্ষেপে, আই কিউ পরীক্ষা। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে, আই কিউ পরীক্ষা পদ্ধতি সমালোচনার সম্মুখীন হয়।
সমালোচনা ছিল এরূপ: আই কিউ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে শ্বেতাঙ্গ শিশুদের জানাশোনা বিষয়ের উপর প্রাধান্য দেয়া
হয়। কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা বেড়ে ওঠার সময় যা যা শেখে, সেসব বিষয় প্রশ্নপত্রে উপেক্ষিত হয়। এ কারণে তারা
আই কিউ পরীক্ষায় ভাল নম্বর পায় না। প্রশ্নপত্রের পক্ষপাতিত্বকে আড়াল করে, আই কিউ পরীক্ষার প্রবক্তারা
কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতাকে দোষারোপ করেন। আই কিউ পরীক্ষা পদ্ধতি দাঁড় করিয়েছিলেন
প্রধানত মনোবিজ্ঞানীরা। ক্ষেত্রবিশেষে, বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদী এই দৃষ্টিভঙ্গিকে জেনেটিসিস্ট দৃষ্টিও বলা হয়ে
থাকে কারণ বক্তব্যের কেন্দ্রে রয়েছে জিন্স । বর্ণবাদী জেনেটিসিস্টদের বক্তব্য হ’ল, জেনেটিক কারণেই এই
বুদ্ধিবৃত্তিক তারতম্য। জেনেটিসিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি বাদে আরেকটি বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যার নাম
প্রতিবেশবাদী (বহারৎড়হসবহঃধষরংঃ)। প্রতিবেশবাদীদের বক্তব্য হচ্ছে: জেনেটিক কারণে নয়, প্রতিবেশের
কারণে Ñ ত্রট্টটিপূর্ণ সাংস্কৃতিক এবং পারিবারিক জীবনের কারণে Ñ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের বুদ্ধি কম। তাঁদের মতে,
কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের শিক্ষা এবং সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার উপর বিশেষ নজর রাখলে, বিশেষ ধরনের বাস্তবতা
গ্রহণ করলে, এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী এই পরিসরে নৃবিজ্ঞানী ফ্রাঞ্জ বোয়াস (১৮৫৮-১৯৪২) বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার
হন। তাঁর বক্তব্য ছিল: অসমতা জৈবিক নয়, এটা বরং সামাজিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী
সামাজিক কারণে অধস্তন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আফ্রিকানরা স্বতন্ত্রভাবে লৌহ-যুগ পর্যায়ে বিবর্তিত
হয়েছিলেন। ইউরোপীয়রা আফ্রিকায় পৌঁছে তাদের অধিক উন্নতির সম্ভাবনা বিনষ্ট করে দেয়। পরবর্তীতে,
তিনি খুলির মাপ নিয়ে গবেষণা করে প্রমাণ করেন যে, নিচু বর্ণের মানুষজনের খুলির মাপ সর্বকালের জন্য
অপরিবর্তিত থাকেনা। নতুন প্রতিবেশে নিচু হিসেবে বিবেচিত নরবর্ণের মানুষের খুলির মাপ বদলাতে পারে।
নাৎসীবাদ যেভাবে বিজ্ঞানের সহায়তায় আর্য-বর্ণের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশরত ছিল, বোয়াস তারও
সমালোচনা করেন। নরবর্ণ প্রসঙ্গে বোয়াসের বক্তব্য মার্কিনী নৃবিজ্ঞানে তাত্তি¡ক মাত্রা যোগ করে। বোয়াসের
উত্তরসূরীরা পরবর্তী কালে এই ধারায় কাজ করতে থাকেন এবং বর্ণবাদবিরোধী তাত্তি¡ক ধারা তৈরীতে অবদান
রাখেন।
১৯৬০ হতে ধীরে ধীরে নরবর্ণ প্রসঙ্গের উত্থাপনের ঢঙ পাল্টে যেতে থাকে। বোয়াস এবং তার উত্তরসূরীরা
সমালোচনা দাঁড় করিয়েছিলেন বর্ণবাদী স্তরায়নের বিরুদ্ধে। তাঁদের প্রধান বক্তব্য ছিল সামাজিক গ্ধঞ্ঝরায়নের
কারণ জৈবিক নয়, সামাজিক। সে অর্থে, তাঁরা যুক্তি দেখান, নরবর্ণকে জৈবিক বলার কোন অর্থ নেই, যেহেতু
নরবর্ণের কোন জৈবিক ভিত্তি নেই। পরবর্তী সময়ে, নৃবিজ্ঞানীদের মনোযোগ “নরবর্ণ” হতে “বর্ণবাদ” এ সরে
যায়। এই মনোযোগ এখনও অব্যাহত। এই ধারার নৃবিজ্ঞানীদের বক্তব্য হচ্ছে, নরবর্ণের কোন জৈবিক ভিত্তি
নেই, তা স্পষ্ট। কিন্তু বর্ণবাদ একটি শক্তিশালী পরিকাঠামো যা পৃথিবীর মানুষজনকে বিভিন্ন স্তরে (উঁচু, নিচু)
বিভক্ত করে। এ স্তরায়ন ও বিভাজন বিশ্বব্যাপী। এবং সেই কারণে “নরবর্ণ নেই”, এই বলে প্রসঙ্গটিকে উড়িয়ে
দেয়ার চাইতে, আরো বেশি জরুরী হচ্ছে এর শক্তিমত্তা অনুসন্ধানের কাজে মনোনিবেশ করা। এই উপলব্ধি
বিভিন্ন কাজের জন্ম দিয়েছে। কিছু কাজ মার্কিনী সমাজের স্ববিরোধিতা উদ্ঘাটনের উপর জোর দিচ্ছে:
মার্কিনী সমাজের একটি মূলনীতি হচ্ছে “সকল মানুষ সমান”, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় বর্ণবাদী বৈষম্য। এবং
সেটি সকল ক্ষেত্রে উপস্থিত Ñ শিক্ষা, চাকুরি, বসবাসের এলাকা ইত্যাদি। কিছু কাজ গুরুত্ব আরোপ করছে
বর্ণবাদী বিভাজন বর্তমানে যে নতুন নতুন রূপ লাভ করেছে (“আরব” বনাম “সভ্য”) তার উপর। আবার
কিছু নৃবিজ্ঞানী এই নতুন বর্গীকরণের সাথে পূর্বতন বর্গীকরণের ধারাবাহিকতা এবং বিভিন্নতা বিষয়ে গবেষণা
করছেন।
‘অত্যাচারিতকে দোষারোপ করা’র প্রবণতা এবং তার প্রত্যাখান
বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অত্যাচারিতকে তার দুরবস্থার জন্য দায়ী করা (ারপঃরসনষধসরহম)। ১৯৬০-এর দশকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বর্ণবাদী সঙ্কট ঘনীভূত হয় এবং বর্ণবাদ বিরোধী
আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে (এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং)। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিসংখ্যান অনুসারে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে দরিদ্রদের সংখ্যা অনেক বেশি,
এ বিষয়টির উপর বর্ণবাদ বিরোধীরা গুরুত্বারোপ করেন। শ্বেতাঙ্গ গরীবের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ গরিবের সংখ্যা
কেন বেশি, এ প্রশ্নের জবাবে কিছু মার্কিনীরা অভিনব ব্যাখ্যা দাঁড় করান। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন
সমাজবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল ময়নিহান।
বোয়াসের বক্তব্য ছিল: অসমতা
জৈবিক নয়, এটা বরং
সামাজিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী সামাজিক
কারণে অধস্তন।
ময়নিহানের মতে, নিগ্রো পরিবার রোগাক্রান্তএবং বিকারগ্রস্ত। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা জরুরী যে “নিগ্রো”
শব্দটি নেতিবাচক (যেমন “বাঙ্গাল” বা “গারো” শব্দটি নেতিবাচক) এবং ১৯৬০-৭০ এর দশকগুলোতে,
বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে, কৃষ্ণাঙ্গরা এই শব্দ প্রত্যাখ্যান করেন। এর পরিবর্তে তারা
“ব- ্যাক” (যার বাংলা দাঁড়ায় কৃষ্ণাঙ্গ) হিসেবে নিজেদের আত্ম ও সমষ্টিগত পরিচিতি দাঁড় করান।
ময়নিহান বলেন, বিকারগ্রস্তপারিবারিক জীবনের কারণেই কৃষ্ণাঙ্গরা দরিদ্র। তাদের পরিবারে পুরুষের
অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। অধিকাংশ পরিবারে দেখা যায় একাকী মায়ের সাথে বসবাস করছে তার শিশু সন্তান।
বেকার পুরুষেরা তাদের নিজ পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণে ব্যর্থ। আদর্শ পিতা-মাতার অভাবে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা ভাল
কিছু শেখে না। বড় হলে তাদের নিজের জীবনও তাদের পিতা মাতার জীবনের মত দারিদ্র্যে পর্যবসিত হয়।
লক্ষ্য করে দেখেন, এই ব্যাখ্যায় যারা প্রান্তিক এবং নিপীড়িত, তাদের দোষারোপ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে,
তারা নিজেরা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ দাসত্বের ইতিহাস নয়, বর্ণবাদী পরিকাঠামো এবং তার শক্তিমত্তা
নয়) তাদের দুরবস্থার জন্য দায়ী।
ময়নিহানের ভাবনাচিন্তার শক্তিশালী জবাব পাওয়া যায় নৃবিজ্ঞানী ক্যারল স্ট্যাকের কাজে। তিনি কৃষ্ণাঙ্গ
পরিবার নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁর গবেষণা ক্ষেত্র ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট শহরে বসবাসের একটি
সরকারী প্রকল্প। গরিব কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে গড়ে-উঠা নারীকেন্দ্রিক গৃহস্থালী এবং দারিদ্রের খুব ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন
তিনি। স্ট্যাক বলেন, কৃষ্ণাঙ্গরা বর্ণবাদী বৈষম্যের শিকার। বর্ণবাদের কারণে পুরুষেরা কাজ পায় না, তারা
বেকার থাকতে বাধ্য। সরকারী ভাতা ব্যবস্থাও পুরুষ সঙ্গীর সাথে বসবাসরত নারীর প্রতি বিদ্বেষ-প্রসূত।
দারিদ্র্যের এই প্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছে নারী-কেন্দ্রিকতা। স্ট্যাক এই নারী-কেন্দ্রিকতাকে বিকারগ্রস্ততার
লক্ষণ, বা “অযৌক্তিক” জীবন-যাপন পদ্ধতি মনে করেন না। তিনি বলেন, গৃহস্থালীর এই গঠন দারিদ্রের
প্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছে, এবং এটিকে দেখা উচিৎ দারিদ্র্য মোকাবেলার একটি কৌশল হিসেবে। নিচের কেস
স্টাডিতে তার ব্যাখ্যার বিবরণ সংক্ষিপ্ত আকারে দেয়া হয়েছে।
কেস স্টাডি: দারিদ্র্যকে মোকাবেলা করার একটি কৌশল হচ্ছে নারী-কেন্দ্রিক পরিবার১১
দারিদ্র্যের কারণে গৃহস্থালী গঠন সহজ নয়। চাকরির বাজার, সরকারের দেয়া কল্যাণ-ভাতার বিবিধ
নিয়মাবলী, এবং বস্তিস্থাপনের মধ্য দিয়ে গরিবদের পৃথক করে দেয়ার যে প্রকল্প Ñ এগুলো গরিব গৃহস্থালী
গঠনকে অস্থিতিশীল করে দেয়ার শর্ত হিসেবে কাজ করে। নিজে বেঁচে থাকার জন্য, এবং সন্তানদের বাঁচিয়ে
রাখার জন্য, যে টাকা-পয়সা প্রয়োজন তা গরিবদের নেই। সেকারণে তারা জীবন-সংগ্রামকে মোকাবেলা করে
সম্পদ ভাগভাগি করে, জীবন-যাপনের ঝুঁকিগুলোকে ভাগাভাগি করে। খাবার-দাবার, আসবাবপত্র, পোশাক,
যন্ত্রপাতি, সন্তান এবং নগদ টাকা Ñ এসব’ই এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তি, এক গৃহস্থালী থেকে আরেক
গৃহস্থালী, এর মধ্যে ঘুরতে থাকে। যে যখন যা পারে সেটা দেয়, এবং যখন যা লাগে, সেটা নেয়। সুনির্দিষ্ট
গৃহস্থালীর পরিবর্তে দেখা যায় “গৃহী জাল” (ফড়সবংঃরপ হবঃড়িৎশ)। এই গৃহী জাল হচ্ছে মানুষের দল। দলে
কে কখন থাকবে, তার বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই। এই দলগুলো সম্পদ জড়ো করে এবং সম্পদের ভাগাভাগি
করে পরস্পরকে সাহায্য করে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনা প্রয়োজন অনুসারে একত্রে বাস করে। নতুন
পরিস্থিতির উদ্ভব হলে, কেউ কেউ অন্যত্র চলে যায়। দারিদ্র্য এতোই প্রগাঢ় যে বেঁচে থাকার চাহিদা মেটানো
কঠিন। কঠিন দারিদ্র্য জন্ম দেয় গৃহী জালের। এই জালগুলো পরিবারের ধারণাকে ঘিরে গড়ে ওঠে।
পরিবার এবং গৃহস্থালী হচ্ছে নারী-কেন্দ্রিক। গরিব কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা, সম্পর্কে আত্মীয় বা বন্ধু, এমন নারীর
সাথে সীমিত সম্পদ এবং সন্তান লালন-পালনের দায়ভার ভাগাভাগি করেন। স্পষ্টতই, গরীব কৃষ্ণাঙ্গ সন্তান
শ্বেতাঙ্গ মধ্যবিত্ত সন্তানদের মতন বিচ্ছিন্ন অণু পরিবারে বেড়ে ওঠে না। অধিকাংশ গৃহস্থালী গঠিত হয় জৈবিক
মাকে কেন্দ্র করে। সন্তানদের দেখ-ভাল করা হচ্ছে গড়ে-ওঠা গৃহী জালগুলোর প্রধান লক্ষ্য। পুরুষদের সাথে
শিশুদের আবেগ-ভালবাসার দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক যদিও উৎসাহিত করা হয়, কিন্তু গড়ে ওঠা বৃহৎ পরিবারের
কেন্দ্রে থাকেন নারী। এই নারী-কেন্দ্রিক আকর সম্পাদন করে আর্থিক কাজ; এরা সম্পদের ভাগা-ভাগি করে
থাকেন। পুরুষরাও সন্তানদের লালন-পালন করেন। নারীদের মতনই, তারা যখন যা পারে তা দেয়। কিছু

১১ ঋৎধহপরং চরহব, "ঋধসরষু" রহ অষধহ ইধৎহধৎফ ধহফ ঔড়হধঃযধহ ঝঢ়বহপবৎ (বফং) ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ ড়ভ
ঝড়পরধষ ধহফ ঈঁষঃঁৎধষ অহঃযৎড়ঢ়ড়ষড়মু, খড়হফড়হ: জড়ঁঃষবফমব, ১৯৯৬, ঢ়ঢ়. ২২৩-২২৮.
স্ট্যাক বলেন, কৃষ্ণাঙ্গরা
বর্ণবাদী বৈষম্যের শিকার।
বর্ণবাদের কারণে পুরুষেরা কাজ
পায় না, তারা বেকার থাকতে
বাধ্য। সরকারী ভাতা ব্যবস্থাও
পুরুষ সঙ্গীর সাথে বসবাসরত
নারীর প্রতি বিদ্বেষ-প্রসূত।
দারিদ্র্যের এই প্রেক্ষিতে গড়ে
উঠেছে নারী-কেন্দ্রিকতা।
কিছু পুরুষ ভাগাভাগিতে অংশগ্রহণ করেন না, আবার অনেকে আছেন যারা একই সাথে বোনের ঘরে, মা
অথবা আন্টিকে, অথবা স্ত্রী কিংবা প্রেমিকার সংসারে কিছু কিছূ দিয়ে থাকেন। একটি নির্দিষ্ট ছাদের তলায়
থাকলেও, তারা হয়ত একাধিক সংসারের মানুষজনের খেয়াল রাখে।
পারিবারিক পর্যায়ে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার এ ধারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত প্রধান ধারার বিপরীত। প্রধান
ধারার প্রতিনিধিত্ব করে শ্বেতাঙ্গ পরিবার যেখানে রয়েছে দম্পতি-ভিত্তিক অণু পরিবার (বাবা-মা এবং তাদের
শিশু সন্তান)।
সারাংশ
নরবর্ণের ভিত্তিতে পৃথিবীর মানুষজনের বর্গীকরণ ইউরোপীয়রা আরম্ভ করেন। বর্গীকরণের সূত্রপাত এবং
ইউরোপীয় শক্তির বিশ্বব্যাপী স¤প্রসারণের সূত্রপাত একই সময়ে ঘটে। এই কারণে, নরবর্ণীয়
বর্গীকরণকে বৈজ্ঞানিক করে তোলার সকল প্রচেষ্টা (যেমন ধরুন আই কিউ পরীক্ষা), এবং সমাজ
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর সকল প্রচেষ্টা, সন্দেহের চোখে দেখা হয়। বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির একটি
প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অত্যাচারিতকে দোষারোপ করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক বিজ্ঞান চর্চায়,
বিশেষ করে ১৯৬০-১৯৭০’এর দশকগুলোতে, যখন বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলন শক্তিশালী হয়, তখন
একাধিক বিদ্যাজাগতিক কাজে কৃষ্ণাঙ্গদের দোষারোপ করা হয়। বলা হয়, তারা নিজেরাই তাদের
দুরবস্থার জন্য দায়ী। বর্তমানের নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থায়, নতুন নতুন ধরনের স্তরায়িত বর্গীকরণ করা হচ্ছে:
যেমন “জঙ্গী আরব” বনাম “সভ্য শেতাঙ্গ”। নৃবিজ্ঞানের একটি ধারার বিবেচনায় এটা নরবর্ণ-ভিত্তিক
বর্গীকরণের সা¤প্রতিকতম রূপ।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন -
১। নিচের কোন নৃবিজ্ঞানী বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন?
ক. ফ্রাঞ্জ বোয়াস খ. লুই ডুমো
গ. মেরী ডগলাস ঘ. মার্গারেট মীড
২। ১৯৬০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন কে?
ক. নেলসন ম্যান্ডেলা খ. মার্টিন লুথার কিং
গ. স্যার ডেসমন্ড টুটু ঘ. উপরের কেউই নন
৩। বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদের উৎপত্তি ঘটে কখন?
ক. ১৭ এবং ১৮ শতকে খ. ১৯ এবং ২০ শতকে
গ. ১৮ এবং ১৯ শতকে ঘ. উপরের কোনটিই নয়
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। নরবর্ণ কী?
২। বর্ণবাদ কী? বর্ণবাদ ও বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদ কী সম্পর্কিত?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কী? ড্যানিয়েল ময়নিহান কি এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করেন? আপনার উত্তরের
সপক্ষে যুক্তি দিন।
২। নারী-কেন্দ্রীক গৃহস্থালী গঠন বিকার-গ্রস্ততার লক্ষণ না। বরং এটি দারিদ্র্য মোকাবেলার একটি
কৌশল। কিসের প্রেক্ষিতে স্ট্যাক এই কথাগুলো বলছেন, এবং কি ভিত্তিতে তা আলোচনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]