জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের চারটি তাত্তি¡ক পূর্বানুমান সংক্ষেপে তুলে ধরুন।
বংশবৃত্তান্তবা কুলুজি পদ্ধতি কী?


এই পাঠটি জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের শেষ ইউনিটের শেষ পাঠ। আমরা এখন জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের মূল প্রসঙ্গে
ফিরে আসব: জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা কি? যে সংজ্ঞা এবং পূর্বানুমানের ভিত্তিতে প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে জ্ঞাতিত্ব
বিষয়ক গবেষণা কাজ পরিচালিত হয়েছে, জ্ঞাতি তত্ত¡ দাঁড় করান হয়েছে, জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন একটি
বিশেষজ্ঞ জ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে, সেগুলো কি পর্যাপ্ত? সা¤প্রতিক কালের জ্ঞাতিত্ব
অধ্যয়নরত বেশ কিছু নৃবিজ্ঞানী মনে করেন, এগুলো পর্যাপ্ত নয়। জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন ধাক্কা খেয়েছে নতুন
প্রজনন প্রযুক্তির (হবি ৎবঢ়ৎড়ফঁপঃরাব ঃবপযহড়ষড়মু) কারণে। কিন্তু প্রযুক্তিগত আবিষ্কার,
উদাহরণস্বরূপ Ñ টেস্ট টিউবে সন্তান প্রসব, এবং আরও নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং প্রসার,
কেবলমাত্র একটি দিক। জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ইতিহাস ঘেঁটে এই অধ্যয়ন সম্পর্কে মৌলিক কিছু জিজ্ঞাসা
উত্থাপন করেছেন হাল আমলের নৃবিজ্ঞানীরা। জিজ্ঞাসাগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে পাশ্চাত্য-অপাশ্চাত্যের
অসম সম্পর্ক, পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্য, পাশ্চাত্যীয় সমাজের ধ্যান-ধারণা বাকী বিশ্বের মানদন্ড
হয়ে উঠা, এবং খোদ নৃবিজ্ঞানের ভূমিকা। এ সকল কারণে, অনেকে মনে করেন জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নে
সংকট দেখা দিয়েছে এবং এই সংকট “জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন”র অস্তিত্বকে প্রশ্নসাপেক্ষ করে তুলেছে।
ভবিষ্যতে নৃবিজ্ঞানের একটি বিশেষজ্ঞ জ্ঞান হিসেবে এটি আদৌ টিকে থাকতে পারবে কিনা, সে
ব্যাপারে তাঁরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আবার অনেক নৃবিজ্ঞানী আছেন যাঁরা বিষয়টিকে একেবারে
ভিন্ন চোখে দেখেন। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, এই ধাক্কাগুলো জরুরী ছিল, এই জিজ্ঞাসাগুলোকে
অন্তর্ভুক্ত করে জ্ঞাতিত্বের বিষয়বস্তুকে পুনর্গঠিত করা উচিত। এর ফল, আগামীতে, অর্থবহ জ্ঞাতিত্ব
অধ্যয়ন এবং নৃবৈজ্ঞানিক অনুশীলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা এবং পূর্বানুমান প্রশ্নের সম্মুখীন
নৃবিজ্ঞানে এপর্যন্তঅনুশীলিত জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন চারটি পূর্বানুমানের উপর ভর করেছে। প্রথম তিনটি হ’ল
:
পূর্বানুমান ১: আদিম সমাজে জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে একটি মূলনীতি, সামাজিক জীবন জ্ঞাতি বন্ধন দ্বারা
সংগঠিত। নৃবিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন, অধিকাংশ আদিম সমাজে বংশীয় দল জ্ঞাতি বন্ধনকে সংগঠিত
করে। পক্ষান্তরে, পাশ্চাত্য সমাজে অপরাপর প্রতিষ্ঠান আছে (যেমন কর্মক্ষেত্র, রাষ্ট্র) যেগুলো সামাজিক
জীবনের সাংগঠনিক মূলনীতি হিসেবে কাজ করে। আদিম সমাজের জ্ঞাতি ভিত্তিক দলের কাঠামো
বুঝতে নৃবিজ্ঞানীরা ‘বহির্বিবাহ’ এবং ‘বিনিময়’-এর ধারণার সাহায্য নিয়েছেন। তাঁদের মতে, বিয়ে একটি
বিনিময় ব্যবস্থা এবং বহির্বিবাহের মাধ্যমে একটি বংশীয় দল অপর একটি বংশীয় দলের সাথে বিয়ের
সম্পর্ক স্থাপন করে। এই সম্পর্ক স্থাপন, জ্ঞাতিভিত্তিক দলের পুনর্জন্ম নিশ্চিত করে।
পূর্বানুমান ২: আদিম সমাজে জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র পরিসর। বহু নৃবিজ্ঞানী (এবং মজার ব্যাপার
হ’ল, তাঁরা বিরুদ্ধ তাত্তি¡ক দৃষ্টিভঙ্গির) মার্কিনী নৃবিজ্ঞানী নেপোলিয়ান শ্যানো’র সাথে একমত হবেন
যে, জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে আদিম সামাজিক কাঠামোর “প্রাণ”। নৃবিজ্ঞানীরা যেহেতু ধরে নিয়েছিলেন যে,
প্রতিটি আদিম সমাজে জ্ঞাতিত্ব নামক নির্দিষ্ট কিছু আছে, এবং এটি সকল আদিম সমাজের সাংগঠনিক
অনেকে মনে করেন জ্ঞাতিত্ব
অধ্যয়নে সংকট দেখা দিয়েছে
এবং এই সংকট “জ্ঞাতিত্ব
অধ্যয়ন”র অস্তিত্বকে
প্রশ্নসাপেক্ষ করে তুলেছে।
পূর্বানুমান ১: আদিম সমাজে
জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে একটি মূলনীতি,
সামাজিক জীবন জ্ঞাতি বন্ধন
দ্বারা সংগঠিত।
পূর্বানুমান ২: আদিম সমাজে
জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র
পরিসর।
মূলনীতি, সে কারণে নৃবিজ্ঞানীদের মতে, বাস্তবিক অর্থে, প্রতিটি সমাজে জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র
পরিসর (ফরংঃরহপঃ ফড়সধরহ)। এভাবে দেখার কারণে, কিছু নৃবিজ্ঞানীর মনে হয়েছে যে, আদিম
সমাজের অপর তিনটি ক্ষেত্র: রাজনীতি, অর্থনীতি এবং ধর্ম, গড়ে উঠে জ্ঞাতিত্ব বন্ধনের সাপেক্ষে।
নৃবিজ্ঞানীদের সৃষ্ট এধরনের যুক্তি এবং ধ্যান-ধারণা, জ্ঞাতিত্বকে গড়ে তুলেছে আদিম সমাজের একটি
কেন্দ্রীয় এবং “স্বতন্ত্র” পরিসর হিসেবে।
পূর্বানুমান ৩: জ্ঞাতিত্ব মূলত কি? এই প্রশ্নের উত্তরে নৃবিজ্ঞানীরা বলেন, জ্ঞাতিত্বের মূলে রয়েছে,
মানুষের প্রজনন। প্রজনন হচ্ছে জৈবিক এবং প্রাকৃতিক। প্রজনন হচ্ছে একটি সর্বজনীন সত্য: প্রতিটি
সমাজে পেটে বাচ্চা আসা, মানুষের জন্ম গ্রহণ, বেড়ে ওঠা, এবং মৃত্যু, এগুলো ঘটে থাকে। শুধু ঘটে
বললে চলবে না, একই প্রক্রিয়ায় ঘটে। এই বিষয়গুলো কেবলমাত্র সকল সমাজের জন্য সত্য নয়,
একইভাবে সত্য। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, প্রজন্মের জৈবিকতা হচ্ছে জীববিজ্ঞানীদের “ক্ষেত্র”। জৈবিকতার
সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক নির্মাণ হচ্ছে নৃবিজ্ঞানীদের কর্মক্ষেত্র (তাঁদের "ভরবষফ")। কিন্তু, প্রজনন
যেহেতু মূলত জৈবিক, সে কারণে জৈবিকতা হচ্ছে মুখ্য (ঢ়ৎরসধৎু) এবং এর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক
নির্মাণ গৌণ (ংবপড়হফধৎু)।
বিগত কয়েক দশকে নৃবিজ্ঞানে একটি মৌলিক বদল ঘটেছে, এই বদল অন্যান্য জ্ঞানকান্ডেও দেখা
গেছে। বদলটি তত্ত¡ এবং জ্ঞানতত্ত¡ (বঢ়রংঃবসড়ষড়মু), দুটোকেই কেন্দ্র করে ঘটেছে। জটিল প্রসঙ্গে না
ঢুকে, সহজভাবে বললে, এই বদলের কারণে মূলত দুই ধরনের পুনর্বিবেচনা করা চলে। এক, জ্ঞাতিত্ব
অধ্যয়ন যে সকল বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে যেমন, জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, পরিবার গঠন ইত্যাদি,
এসব বিষয়কে নতুন প্রত্যয়নের সাহায্যে পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। এর কিছু নমুনা আপনি এ পর্যন্ত
উপস্থাপিত পাঠ সমূহে পেয়েছেন (উদাহরণস্বরূপ, ডেভিডফ এবং হল্, হিলারি স্ট্যান্ডিং, এবং রায়না
র‌্যাপের লিঙ্গ ও শ্রেণীর অন্তর্প্রবিষ্টতা সম্পর্কিত আলোচনা)। দুই, আরও মৌলিক বিষয় প্রসঙ্গ হিসেবে
দেখা দিয়েছে। সেগুলো হল: জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের মূলনীতি, মূলনীতি গড়ে উঠার ইতিহাস, মূলনীতি এবং
পাশ্চাত্য-কেন্দ্রিকতা, মাঠ-গবেষণা পদ্ধতি, পদ্ধতি ও উৎপাদিত জ্ঞানের সম্পর্ক ইত্যাদি।
জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নে কিছু বদল ধীরে ধীরে ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশক থেকে শুরু হতে থাকে। প্রথম
একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন ইংরেজ নৃবিজ্ঞানী জ্যাক গুডি। তিনি প্রস্তাব করেন যে, জ্ঞাতি দলকে
কাঠামো হিসেবে না দেখে এটিকে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা উচিত। তাঁর বিবেচনায়, গৃহস্থালী গঠন
একটি কাঠামো নয়, এটি একটি বিকাশমান প্রক্রিয়া। কিছুদিন পর, জ্যাক গুডি, এডমান্ড লীচ এবং
আরও কিছূ নৃবিজ্ঞানী জ্ঞাতিত্বকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার প্রবণতার সমালোচনা দাঁড় করান। অজাচারের
আলোচনা প্রসঙ্গে গুডি বলেন, অজাচারকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে, এটিকে স্থাপন করা উচিত বিষমকামী
(যবঃবৎড়ংবীঁধষ) সম্পর্কের সামগ্রিক পরিসরে যেখানে অজাচার অন্যান্য যৌন অপরাধের (যেমন
ব্যভিচার, অবিবাহিত নারী-পুরুষের যৌন মিলন ইত্যাদি) মধ্যে একটি। একই ধারার পরামর্শ নৃবিজ্ঞানী
রিভিয়ের বিয়ে প্রসঙ্গে দেন। তাঁর মতে, বিয়েকে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে স্থাপন করা উচিত। তিনি মনে
করেন, বিয়েকে দেখা উচিত সমাজে নারী ও পুরুষের সামগ্রিক সম্পর্কের একটি দিক হিসেবে। বিয়ে
হচ্ছে, তাঁর দৃষ্টিতে বিদ্যমান লিঙ্গীয় সম্পর্কের একটি ফলাফল মাত্র।
বৃহত্তর প্রেক্ষিতে স্থাপন করার এই উদীয়মান ধারা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে লীচের শ্রীলংকার কাজের
কারণে। গুডি এবং রিভিয়ের যেখানে অজাচার এবং বিয়েকে সামগ্রিক লিঙ্গীয় সম্পর্কে স্থাপন করার
প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন, সেখানে লীচের বক্তব্য ছিল আরও দ্বিধাহীন। তিনি
বলেন, “ভূমি এবং সম্পত্তির বাইরে জ্ঞাতিত্ব ব্যবস্থার ভিন্ন কোন অস্তিত্ব নেই”। পরবর্তীকালে, একই
ধরনের বিশ্লেষণ ফরাসী কাঠামোবাদী মার্ক্সবাদী যেমন ইম্যানুয়েল টেরে, ক্লদ মেয়াসুর কাজের সাহায্যে
আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে। টেরে এবং মেয়াসু জ্ঞাতিত্বকে দেখেন রাজনৈতিক অর্থনীতির একটি অংশ
হিসেবে। নারীবাদী নৃবিজ্ঞানীদের কাজের জোয়ার আরম্ভ হয় ১৯৬০-এর শেষ এবং ১৯৭০-এর প্রথম
দিকে। এটি এখনও চলমান। নারীবাদীরা জ্ঞাতিত্বকে বৃহত্তর লিঙ্গীয় সম্পর্কের বাইরে দেখতে রাজি নন;
সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা লিঙ্গীয় সম্পর্কের সাথে যুক্ত করেছেন শ্রেণীগত সম্পর্ক (উদাহরণস্বরূপ রায়না
র‌্যাপ, হিলারী স্ট্যান্ডিং)। কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী অবস্থ্ান থেকে লিঙ্গ, শ্রেণী এবং নরবর্ণ Ñ বৈষম্যের এই তিন
পূর্বানুমান ৩: জ্ঞাতিত্বের মূলে
রয়েছে, মানুষের প্রজনন।
প্রজনন হচ্ছে জৈবিক এবং
প্রাকৃতিক।
প্রধান মূলনীতির অন্তর্প্রবিষ্টতা অনুসন্ধান করা প্রয়োজনীয়। জ্ঞাতিত্বের স্বতন্ত্র এবং বিচ্ছিন্ন অবস্থা নিয়ে
তাত্তি¡ক অসন্তোষের সুরাহা লীচ একভাবে করেছিলেন। ফরাসী কাঠামোবাদী মার্ক্সবাদী মেয়াসু এবং টেরে
করেছিলেন আরেকভাবে। তাত্তি¡ক এই অসন্তোষকে আরও উচ্চতর জায়গায় ঠেলে দিলেন মার্কিন
নৃবিজ্ঞানী ডেভিড শ্নাইডার। তিনি বলেন, জ্ঞাতিত্বকে স্থাপন করতে হবে সামগ্রিক “সংস্কৃতির”
প্রেক্ষিতে। শ্নাইডারের দৃষ্টিতে এটি জরুরী কারণ তা না হলে আমাদের পক্ষে সংস্কৃতির সামগ্রিক বিন্যাস
বোঝা সম্ভব হবে না।
“কাঠামো”র পরিবর্তে জ্ঞাতিত্বকে সমাজ জীবনের একটি “প্রক্রিয়া” হিসেবে বিবেচনা করার কারণে
নতুন ধরনের গবেষণা কাজ ও লেখালেখি আরম্ভ হয়। পুরোনো দৃষ্টিতে গবেষণার বিষয় হত পরিবারের
কাঠামো এবং এটির ভূমিকা। নতুন দৃষ্টিতে ভিন্ন ধরনের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হল: পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়া,
এ প্রক্রিয়ায় পরিবার ও জ্ঞাতি দল বাদে আর কোন কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠান যুক্ত, সামাজিক প্রতিষ্ঠান
কি উপায়ে পুনরুৎপাদনকে সংগঠিত করে ইত্যাদি। পূর্বে নৃবিজ্ঞানীরা যেখানে অর্থনীতিকে প্রত্যয়ন
করতেন একটি “ব্যবস্থা” হিসেবে, নতুন ধারণায়নের ফলে নৃবিজ্ঞানীরা এটিকে দেখা আরম্ভ করলেন
একটি প্রক্রিয়া হিসেবে (উদাহরণস্বরূপ, হিলারি স্ট্যান্ডিং)। প্রথাগত নৃবৈজ্ঞানিক কাজে সচরাচর
এধরনের জিজ্ঞাসা দেখা যেত: অমুক সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জ্ঞাতি এবং বংশীয় দলের ভূমিকা
কি? উৎপাদন এবং বিনিময় প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে নতুন ধারার কাজে নৃবিজ্ঞানীরা জিজ্ঞাসা তোলেন
জ্ঞাতি ও বংশীয় দল, এবং অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান, কিভাবে এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত। কোন একটি
সমাজের “জ্ঞাতি ব্যবস্থা”র প্রতি মনোনিবেশ করার পরিবর্তে নতুন ধারার কাজে রত নৃবিজ্ঞানীরা
জ্ঞাতিত্বকে তাদের কাজে অন্তর্ভুক্ত করছেন। ধরুন, যিনি কৃষিক্ষেত্রে পুঁজিবাদী রূপান্তর নিয়ে কাজ
করছেন, তিনি জ্ঞাতি বন্ধন কিভাবে এই রূপান্তরের ফলে পরিবর্তিত হচ্ছে সেটির উপর গুরুত্ব আরোপ
করছেন।
জ্ঞাতিত্বকে সামাজিক জীবনের অংশ হিসেবে দেখার কারণে খোদ জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের চেহারা বদলে
গেছে। পঞ্চাশ ষাট বছর পূর্বের জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের বই শুধুমাত্র জ্ঞাতিত্বের চার্ট, ডায়াগ্রাম, ছকে
পরিপূর্ণ থাকত (“জ্ঞাতি বীজগণিত”)। সা¤প্রতিককালের জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়ন যেহেতু টেকনিকেল না
(নিয়ম-ব্যবস্থা, পদাবলী ব্যবস্থা) সে কারণে বইগুলো হয় আরও আলোচনা-ভিত্তিক।
জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা এবং পূর্বানুমান : পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণা?
জ্ঞাতিত্বের তাত্তি¡ক পূর্বানুমান প্রসঙ্গে যে আলোচনা পূর্বের অংশে ছিল, সেটি ছিল প্রধানত জ্ঞাতিত্ব
অধ্যয়নের প্রত্যয় নিয়ে (“কাঠামো” বনাম “প্রক্রিয়া”, “স্বতন্ত্র পরিসর” বনাম “সমগ্র”)। এখন আরেকটি
কেন্দ্রীয় পূর্বানুমান প্রসঙ্গে আলোচনা করা হবে; এই পূর্বানুমান নিয়ে যে সমালোচনা উঠেছে সেটি
জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ভিত্তিকে মৌলিকভাবে ধাক্কা দিয়েছে।
পূর্বানুমান ৪: রক্তের সম্পর্ক মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করে: রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়রা এক দলে, যাঁরা
রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় নন তাঁরা অন্য দলে। প্রজনন হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক সত্য। প্রজননের প্রাকৃতিক
সত্যতা প্রকাশের ভাষা হচ্ছে: আমরা “একই” রক্তের, “ওর আপন চাচা”. “আমার নিজের মা”। একটি
শিশু জন্মগ্রহণ করার পরপরই কিংবা আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, শিশুটি গর্ভে আসার মুহূর্ত থেকেই তার
“আসল” আত্মীয় কারা তা স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। শিশুটি পালক হলেও, “আসল” বাবা, মা, ভাই,
বোনের ধারণা কার্যকরী যেহেতু, রক্ত সম্পর্ক হচ্ছে জ্ঞাতিত্বের ভিত্তি, এবং সেটি “আসল”। জ্ঞাতিত্ব
হচ্ছে রক্তে অংশীদারিত্বের ব্যাপার; কারা একই রক্তের তা গর্ভধারণের মুহূর্ত থেকে প্রতিষ্ঠিত; প্রতিষ্ঠিত
এই সত্যটি অপরিবর্তনীয় (আমার “আসল” বাবা চিরদিনের জন্য আমার “আসল” বাবা)। জ্ঞাতি তত্ত¡
এসব পূর্বানুমানের উপর দাঁড়িয়ে। নৃবিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন যে, এই ধারণাগুলো সকল সমাজের
জন্য, সকল মানুষের জন্য সত্য। আরও ধরে নিয়েছিলেন যে, যেহেতু এগুলি প্রাকৃতিক সত্য (এর কোন
নড়চড় নেই), সে কারণে বিভিন্ন সমাজে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক নির্মাণগুলোকে এই সত্য সাপেক্ষে
বিচার বিশ্লেষণ করা হবে।
পর্বানুমান ৪ : জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে
রক্তে অংশীদারিত্বের ব্যাপার;
কারা একই রক্তের তা
গর্ভধারণের মুহূর্ত থেকে
প্রতিষ্ঠিত; প্রতিষ্ঠিত এই সত্যটি
অপরিবর্তনীয়।
সত্য-অসত্যের এই ধারণা নৃবিজ্ঞানে ছিল মজ্জাগত। এবং এগুলো প্রোথিত ছিল বৃহত্তর একটি
পরিকাঠামোতে : আদিম সমাজ হচ্ছে অযৌক্তিক, অনুভূতিপ্রবণ, ঐতিহ্যবাহী, ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন।
পক্ষান্তরে পাশ্চাত্য সমাজ হচ্ছে যুক্তি নির্ভর, আলোকময় (বহষরমযঃবহবফ), বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর।
হাল আমলের নৃবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই কারণে নৃবিজ্ঞানে প্রায় শ’ খানেক বছর ধরে বিবর্তনবাদের
“পিতৃত্ব সম্বন্ধে অজ্ঞতা”র ধারণা শক্তিমত্তা অর্জন করে। মর্গান এবং আরও বহু নৃবিজ্ঞানীরা ধরে
নিয়েছিলেন যে, আদিম সমাজে পিতৃ পরিচয় জানা ছিল না। কেবল মাত্র মায়ের পরিচয় নিশ্চিত ছিল
যেহেতু তিনি গর্ভধারিণী এবং প্রসবকারী। বিবর্তনবাদীদের বক্তব্য ছিল, বিবর্তনের একটি বিশেষ পর্যায়ে
সন্তান প্রজননে পিতার শরীরী ভূমিকা সম্বন্ধে জ্ঞান তৈরী হয়। এই ব্যাখ্যার তীব্র সমালোচনা প্রথমে
তোলেন লীচ, ১৯৬৮ সালের একটি প্রবন্ধে। খ্রিস্টীয় ধর্মে “কুমারী মাতা”র ঘটনার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি
বলেন, সন্তান প্রজননে পিতার ভূমিকার অস্বীকৃতিকে নৃবিজ্ঞানীদের “অজ্ঞানতা” হিসেবে দেখা উচিত
নয়। বরং, তাঁদের প্রশ্ন করতে পারা উচিত কেন বিশেষ বিশেষ সমাজে এই তথ্যটি গুরুত্বহীন অথবা
অপ্রাসঙ্গিক।
সা¤প্রতিক নৃবিজ্ঞানীদের বিবেচনায়, এই কেন্দ্রীয় তাত্তি¡ক পূর্বানুমান হচ্ছে পাশ্চাত্যীয়। নৃবিজ্ঞানী
মেইগস ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, জনপ্রিয় মার্কিন দৃষ্টিতে গর্ভধারণের মুহূর্ত হতে
জ্ঞাতিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে “আসল” জ্ঞাতি কে তা পূর্ব-নির্দিষ্ট হয়ে পড়ে।
“আপন” বাবা শব্দের ব্যবহার থেকে বোঝা যায় যে এই মতাদর্শে জৈবিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন
সংস্কৃতিতে বংশবৃত্তান্তবা কুলুজীর ব্যাপারে রয়েছে মুগ্ধতা এবং অধিক আগ্রহ। মেইগস লেখেন, মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের বইয়ের দোকানগুলোতে বর্তমানে অন্তত ৫০টি নিজ কুলুজি তৈরী করার গাইড বই পাওয়া
যাবে। পালিত সন্তানদের “নিজ”র বাবা-মা সন্ধান করার যে সা¤প্রতিক ঘটনাগুলো, তা মেইগসের
মতে, “আসল” জ্ঞাতি বন্ধন যে জন্ম হতে নির্ধারিত, এই ধারণার শক্তিমত্তা প্রমাণ করে। এই মতাদর্শ
মতে, জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে রক্তে অংশীদারিত্বের ব্যাপার। একই রক্ত হওয়ার সূত্রে যে বন্ধন তা, মার্কিন
মতাদর্শে, অপরিবর্তনীয় এবং চিরকালের জন্য।
মার্কিন মতাদর্শ পাশ্চাত্যীয় মতাদর্শের অংশ। কিছূ নৃবিজ্ঞানী মনে করেন যে, পাশ্চাত্যীয় স্বাভাবিকত্বের
ধারণা জ্ঞাতিত্বের ধারণায়নকে প্রভাবিত করেছে। জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের মাঠ গবেষণা পদ্ধতি এই
মতাদর্শকে ধারণ করে। এবং, এই গবেষণা পদ্ধতির অনুসরণ, অপাশ্চাত্য সমাজের জ্ঞাতি সম্পর্কের
বিবিধতাকে কেবলমাত্র অস্বীকার করেনি, পাশ্চাত্যীয় ধ্যান-ধারণা কে অপাশ্চাত্য সমাজে আরোপন
করছে।
জ্ঞাতিত্ব অনুসন্ধান পদ্ধতি: জ্ঞাতি বন্ধন অনুসন্ধানের বংশবৃত্তান্তবা কুলুজি পদ্ধতি (মবহবধষড়মরপধষ
সবঃযড়ফ) নৃবিজ্ঞানী রিভার্স উদ্ভূত। তিনি এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন ১৮৯৮-১৮৯৯ সালের টরেস
স্ট্রেইটস অভিযানে। পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নবিজ্ঞানের মত একটি নির্ভুল জ্ঞান হিসেবে জাতিতত্ত¡কে
(প্রথম দিকে নৃবিজ্ঞান এই নামে পরিচিত ছিল) প্রতিষ্ঠিত করা এই পদ্ধতির লক্ষ্য ছিল। নৃবিজ্ঞানী
বুকে’র মতে, এই পদ্ধতি ইংরেজ সংস্কৃতির ধ্যান-ধারণাকে অন্তর্ভুূক্ত করে দাঁড় করানো হয়। রির্ভাস তাঁর
নোটস এ্যান্ড কোওয়েরিজ ইন এ্যান্থ্রোপলজি বইয়ের চতুর্থ সংস্করণে (১৯১২) এই পদ্ধতির বর্ণনা দেন।
এটিতে কুলুজি অনুসন্ধানরত মাঠ গবেষককে গবেষণার প্রতিটি ধাপের ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়।
গবেষককে প্রথম যে নির্দেশ দেয়া হয় তা হ’ল, তথ্যদাতাকে জিজ্ঞেস করতে হবে তিনি যে নারীর গর্ভ
হতে জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁর নাম। দ্বিতীয়ত, তথ্যদাতাকে জিজ্ঞেস করতে হবে, তাঁর জৈবিক পিতার
নাম। একই পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষকের জেনে নিতে হবে তথ্যদাতার ভাই ও বোনের নাম, তাঁর
বাবা ও মার ভাই ও বোনদের নাম-ধাম, বয়স ইত্যাদি। এগুলো টুকে নেয়ার পর গবেষক তথ্যদাতার
কাছ থেকে জানতে চাইবেন তিনি তার জৈবিক পিতা ও মাতাকে, ভাই ও বোনদের, কিভাবে সম্বোধন
করেন। এই তথ্যগুলিও টুকে রাখতে নির্দেশ দেয়া হয় গবেষককে। রিভার্স গবেষককে দেশীয় জ্ঞাতি
পদ জেনে নিতে উৎসাহ প্রদান করেন ঠিকই কিন্তু সতর্ক করেন যাতে সকল তথ্য (পাশ্চাত্যীয়
জ্ঞাতিত্তে¡র ধারণার উপর ভিত্তি করে) জোগাড় করার পর সে প্রচেষ্টা চালানো হয়।
এস এস এইচ এল
ইউনিট - ৪ পৃষ্ঠা-১৪২
রিভার্সের কুলুজি পদ্ধতি আলোচনা প্রসঙ্গে নৃবিজ্ঞানী বারনার্ড এবং গুড বলেন, বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান
উৎপাদন করা ছিল বংশবৃত্তান্ত বা কুলুজি পদ্ধতির উদ্দেশ্য। রিভার্স (এবং পরবর্তী প্রজন্মের
নৃবিজ্ঞানীগণ) গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তথ্যের মানসম্পন্ন লিপিকরণের উপর, মাঠ গবেষককে নির্দেশ
দিয়েছিলেন যাতে তিনি ভুল-ভাল তথ্য বাদ দেন, সাক্ষাতকারে প্রাপ্ত তথ্যকে সত্যায়িত করেন, এবং
বিভিন্ন তথ্যদাতাদের বক্তব্য জড়ো করে একটি সমন্বিত চিত্র দাঁড় করান। বুকে উল্লেখ করেন, কুলুজি
পদ্ধতি অনুসারীদের প্রতি নির্দেশ ছিল, সংগৃহীত তথ্য যাতে তুলনাযোগ্য হয়। তুলনা তখনই করা
সম্ভব, বুকের মতে, যখন স্থানিক ভাষাকে একটি মানসম্পন্ন বৈশ্বিক প্রকাশভঙ্গিতে অনুবাদ করা হয়।
বুকে এই পদ্ধতির তীক্ষè সমালোচনা করে বলেন: মা যেহেতু বিশ্বের সকল সমাজে সন্তান প্রসব করেন,
কোন না কোন ব্যক্তি যেহেতু সকল সমাজে বাবা হিসেবে চিহ্নিত হন, সে কারণে সকল সমাজের
মানুষের কুলুজি যোগাড় করা, তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, পাশ্চাত্য সমাজে পিতা,
মাতা এবং সন্তানদের মধ্যকার সম্পর্ককে যে ধরনের গুরুত্ব দেয়া হয়, ঠিক একই ধরনের গুরুত্ব
অপাশ্চাত্য সমাজেও দেয়া হয়। বুকে আরও বলেন, জ্ঞাতি বন্ধনের তথ্য এই পদ্ধতিতে যোগাড় করার
ফলে পাশ্চাত্য সমাজের জ্ঞাতিত্বের ধারণা (রক্ত, বংশ, কুল) অপাশ্চাত্য সমাজে আরোপিত হয়। এই
আলোচনা প্রসঙ্গে নৃবিজ্ঞানী লাডি¯- াভ হলি মার্গারেট মীডের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। মার্গারেট মীড
সামোয়া দ্বীপে মাঠ গবেষণা করার সময় লক্ষ্য করেন যে, রিভার্সের কুলুজি পদ্ধতি অনুসরণ করলে
সামোয়া দ্বীপবাসীরা এক ধরনের তথ্য দেন। মীড তাদের প্ররোচিত না করলে তারা তাদের পারস্পরিক
সম্পর্ককে খুব ভিন্নভাবে তুলে ধরেন।
এ কারণে হলি অভিমত প্রকাশ করেন যে, বংশবৃত্তান্তপদ্ধতি জ্ঞাতিত্বের সম্পর্ক অনুসন্ধানে বংশ বা
কুলকেই গুরুত্ব দেয়। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে জ্ঞাতিত্ব কি তা জানার পরিবর্তে, জ্ঞাতিত্ব কি হওয়া
উচিত সেটি জানা যায়।
ইয়াপ্ সমাজে জ্ঞাতিত্ব: মার্কিন নৃবিজ্ঞানী ডেভিড শ্নাইডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ক্যারোলায়না দ্বীপে
ইয়াপ্ নামক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে কাজ করেছেন। ইয়াপ্রা কেবলমাত্র আচার-অনুষ্ঠান পালনের
সময় জ্ঞাতি সম্বোধন ব্যবহার করেন। এ বাদে, বাকী সময়ে তারা একে অপরকে নাম ধরে ডাকেন,
এমন কি বাবা, মাকেও। কিন্তু একজন ইয়াপ্-এর কাছে যদি জানতে চাওয়া হয় যে নারী তাকে গর্ভে
ধারণ করেছে, অথবা যে পুরুষ তার জনক, তাদের কি নামে সে সম্বোধন করে, তখন সেই ইয়াপট্
িউত্তর দেবেন, সিটিনিঙ্গেন এবং সিটামাঙ্গেন। তিনি আরও বলবেন যে, যারা ওর সিটিনিঙ্গেন এবং
সিটামাঙ্গেন ও নিজে তাদের ফাক। শুধুমাত্র তার বাবা নয়, তার বাবার ভাইয়েরা এবং তাদের চাচাত
ভাইয়েরাও তার সিটামাঙ্গেন। সিটিনিঙ্গেন-এর ক্ষেত্রেও তাই। শ্নাইডার বলেন, এ ধরনের রীতি বহু
সমাজে প্রচলিত, ইয়াপ্দের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ জিনিস দেখা যায়। পদ দুটি কেবলমাত্র যারা জীবিত
তাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় এবং একজনের শুধুমাত্র একজন সিটিনিঙ্গেন এবং সিটামাঙ্গেন থাকতে পারে,
তার বেশি নয়। পিতা বেঁচে থাকলে শুধু তিনি হন সিটামাঙ্গেন, তার মৃত্যুর পর তার ভাই অথবা চাচাত
ভাইদের থেকে একজন হন সেই মানুষটির সিটামাঙ্গেন। মায়ের বেলাতেও একই নিয়ম কাজ করে।
ইয়াপ্দের কাছে সিটামাঙ্গেন এবং ফাক বোঝায় নির্ভরশীলতা এবং কর্তৃত্বের সর্ম্পক। বাল্যকালে
ফাকদের লালন পালন করার দায়িত্ব সিটিনিঙ্গেন-এর; ফাক যখন বড় হয় তার দায়িত্ব হচ্ছে
সিটামাঙ্গেন-এর দেখাশোনা করা। সাধারণত, একজন নারীর স্বামী হচ্ছে তার সন্তানের সিটামাঙ্গেন,
এবং সন্তানেরা হচ্ছে তার ফাক। নারীর স্বামীটি যখন বুড়ো এবং অথর্ব হয়ে যান, তখন তার ফাক হয়ে
যায় তার সিটামাঙ্গেন। এই সিটামাঙ্গেন-ফাক সম্পর্ক অন্যদের মধ্যেও গড়ে উঠতে পারে। যদি নারীর
স্বামীর দেখাশোনা তার পুত্র না করে তাহলে সেই দায়িত্ব অন্য কোন পুরুষের পক্ষে পালন করা সম্ভব।
তিনি তখন হয়ে যান বুড়োটির ফাক। এমন যদি ঘটে, তাহলে নারীর পুত্র সন্তান তাদের
বাড়ি/ঘর/ভূমি/সংসারে (ঃধনরহধঁ) তার অধিকার হারায়। অধিকার পান তিনি যিনি বৃদ্ধের দেখাশোনা
করেন, অবশ্য তার মৃত্যুর পরে।
শ্নাইডার বলেন, সিটিনিঙ্গেন এবং সিটামাঙ্গেন স্পষ্টতই কোন দশাকে (ংঃধঃব) বোঝায় না। বরং,
এগুলো ভূমিকা পালনের স্মারক। স্বাভাবিক অবস্থায়, একজন বিবাহিত নারী তার গর্ভজাত সন্তানের
বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান উৎপাদন
করা ছিল বংশবৃত্তান্তবা কুলুজি
পদ্ধতির উদ্দেশ্য।
পাশ্চাত্য ধারণায় জ্ঞাতিবাংশ বলতে বোঝায় র্িিীি
সিটিনিঙ্গেন। কিন্তু যদি তার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে তাহলে তিনি চলে যান তার নিজের, সিটিনিঙ্গেন এবং
সিটামাঙ্গেন-এর কাছে এবং তাকে আর তার সন্তানের সিটিনিঙ্গেন হিসেবে দেখা হয় না। সন্তানদের বাবা
যদি আবার বিয়ে করেন তাহলে তার নতুন স্ত্রী হন সন্তানদের সিটিনিঙ্গেন। যদি তিনি বিয়ে না করেন
তাহলে স্বামীর বোন হন ভাইয়ের সন্তানদের সিটিনিঙ্গেন। শ্নাইডারের বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে যে,
সিটামাঙ্গেন-ফাক, সিটিনিঙ্গেন-ফাক সম্পর্কে দশার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ক্রিয়াকর্ম। এই
সম্পর্ক গঠনের ভিত্তি হচ্ছে একজন ফাক তার সিটামাঙ্গেনএর জন্য কি করে এবং একজন সিটামাঙ্গেন
তার ফাক-এর জন্য কি করে, সেটা। ইয়াপ্ ধারণাকে শ্নাইডার পাশ্চাত্য ধারণার সাথে তুলনা করে
বলেন, পাশ্চাত্য ধারণায় জ্ঞাতিত্ব এবং বংশ বলতে বোঝায় কিছু অন্তর্নিহিত গুণাবলী। এবং এই অর্থে
ইয়াপ্ ধারণা পাশ্চাত্য ধারণার বিপরীত কারণ ইয়াপ্রা গুরুত্ব দেন ক্রিয়ার উপর, দশার উপর না। তিনি
আরও বলেন, কুলুজি বা বংশবৃত্তান্তপদ্ধতি অনুসরণ করে নৃবিজ্ঞানীরা পাশ্চাত্যীয় ধারণা অন্য সকল
মানুষের উপর আরোপন করেছেন। তাঁরা ধরে নিয়েছেন যে, জ্ঞাতিত্বের মূলে রয়েছে প্রজনন প্রক্রিয়া,
যা কিনা রক্তসূত্রীয় বন্ধনের সূত্রপাত ঘটায় এবং এটি সমভাবে বিশ্বের সকল সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সারাংশ
জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে নৃবিজ্ঞানের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। এই কেন্দ্রিকতা প্রতিষ্ঠিত হয় নৃবিজ্ঞানের শুরু থেকে।
সা¤প্রতিককালের নৃবিজ্ঞানীদের অভিমত হচ্ছে, “আদিম” এবং “সভ্য” হিসেবে বিশ্বের সকল সমাজের
দ্বিবিভাজন এই কেন্দ্রিকতার কারণ। বিংশ শতকের শেষ ভাগে জ্ঞাতিত্বের কিছু কেন্দ্রীয় মূলনীতি যথা,
(ক) জ্ঞাতিত্ব আদিম সমাজের সামাজিক জীবনকে সংগঠিত করে (খ) জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র
পরিসর এবং (গ) জ্ঞাতিত্বের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষের প্রজনন। প্রজনন হচ্ছে জৈবিক এবং প্রাকৃতিক
প্রপঞ্চ Ñ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। নতুন ধারণায়নের প্রেক্ষিতে জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নে খুব ভিন্ন ঢংয়ের গবেষণা
কাজ ও লেখালেখি তৈরি হয়। আরও সা¤প্রতিককালে, ১৯৯০-এর দশকে, পাশ্চাত্য-অপাশ্চাত্যের
অসম সম্পর্ক এবং পাশ্চাত্য বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্য এই দুইটি প্রসঙ্গ জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ক্ষেত্রকে আরও
মৌলিকভাবে নাড়া দেয়। এতে জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ভিত্তিপ্রস্তর ধাক্কা খায়। নতুন তাত্তি¡ক উদ্ভাবনের
আলোকে নৃবিজ্ঞানীরা যুক্তি হাজির করেন যে, জ্ঞাতিত্বের সর্বজনীন সংজ্ঞা: জ্ঞাতিত্ব হচ্ছে রক্তে
অংশীদারিত্বের ব্যাপার, কারা একই রক্তের তা গর্ভধারণের মুহূর্ত থেকে প্রতিষ্ঠিত Ñ এই সত্যটি
আসলে সর্বজনীন নয়, এটি পাশ্চাত্যীয়। নৃবিজ্ঞানীরা তাঁদের কর্মকান্ডের মাধ্যমে এই ধারণা অপাশ্চাত্য
সমাজে আরোপ করে। এই সমালোচনা জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের পাটাতনে আঘাত হানে। আঘাতে নতুন
মাত্রা যুক্ত করে নতুন প্রজনন প্রযুক্তি। অনেকে মনে করেন, জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের ভবিষ্যত নেই।
পক্ষান্তরে, কিছু নৃবিজ্ঞানীর ধারণা, জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের জ্ঞানের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরী ছিল এবং
বর্তমানে যে ধরনের তাত্তি¡ক পুনর্মূল্যায়ন চলছে সেগুলো আগামীতে অর্থবহ এবং প্রাসঙ্গিক কাজের জন্ম
দেবে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন -
১। নিচের কোন নৃবিজ্ঞানী প্রস্তাব করেন যে, জ্ঞাতি দলকে কাঠামো হিসেবে না দেখে এটিকে একটি
প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা উচিত।
ক. জ্যাক গুডি খ. এইচ.আর রিভার্স
গ. ফার্ডিনান্দ সস্যুঘ ঘ. উপরের কেউ নন
২। জ্ঞাতি বন্ধন অনুসন্ধানে বংশবৃত্তান্তবা কুলুজি পদ্ধতিটি কে আবিস্কার করেন?
ক. এইচ.আর. রিভার্স খ. ভিক্টর টার্নার
গ. মার্গারেট মীড ঘ. মেরী ওগলাস
৩। নিচের কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠী কেবলমাত্র আচার-অনুষ্ঠান পালনের সময় জ্ঞাতি সম্বোধন
ব্যবহার করেন?
ক. ইয়াপ্ খ. টিভ
গ. দবু ঘ. টোডো
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। জ্ঞাতিত্ব অধ্যয়নের চারটি তাত্তি¡ক পূর্বানুমান সংক্ষেপে তুলে ধরুন।
২। বংশবৃত্তান্তবা কুলুজি পদ্ধতি কী?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা এবং পূর্বানুমান কি কি ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, তা আলোচনা করুন।
২। সা¤প্রতিককালের নৃবিজ্ঞানীরা বলছেন, জ্ঞাতিত্বের সংজ্ঞা পাশ্চাত্যীয়। ইয়াপ্ সমাজে জ্ঞাতিত্বের যে
ধারণা তার সাথে তুলনা করে এই পাশ্চাত্যীয় ভিত্তি স্পষ্ট করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]