বয়সভিত্তিক সংগঠন কী বৈষম্যমূলক?
বিভিন্ন সমাজে বয়সভিত্তিক সংগঠনের গুরুত্ব বর্ণনা করুন।


 সামাজিক কাজকর্মের পরিচালনায় বয়স ভিত্তিক সংগঠনের গুরুত্ব ছিল
 আধুনিক সমাজে ভিন্ন প্রক্রিয়ায় বয়সের বিভাজন কাজ করে
বলা হয়ে থাকে বয়সের ভিত্তিতে বিভাজন পৃথিবীর সকল জাতিতে এবং সকল কালে বজায় আছে।
অর্থাৎ সমাজের মানুষের মধ্যে সকল সমাজেই বয়সের ভাগ আছে। সাধারণভাবে এই ভাগ হচ্ছে: অপ্রাপ্ত
বয়স্ক, বয়স্ক এবং বয়োবৃদ্ধ। কিন্তু সকল জাতি আর সকল কালে এই বিভাজনের মানে কোনমতেই এক
নয়। সাধারণভাবে নৃবিজ্ঞানের আলাপ-আলোচনায় অ-ইউরোপীয় সমাজের বয়স বিভাজন বেশি করে
এসেছে। প্রধানত আফ্রিকা, আমেরিকার আদিবাসী জাতিসমূহ নিয়ে মনোযোগ দেয়া হয়েছে। অনেক
জাতির মধ্যে বয়সের ভিত্তিতে বিভাজন লক্ষ্য করা গেছে। একে বলা হয় বয়স বর্গ (ধমব মৎধফব)। এক
একটি বর্গে সকল সদস্যরা একটি বয়স সীমার মধ্যে হয়ে থাকেন। এই বর্গে ঢুকতে পারাটা প্রায়
ক্ষেত্রেই কোন বিশেষ প্রক্রিয়ার ব্যাপার নয়। কোন একজন একটা নির্দিষ্ট বয়সে উত্তীর্ণ হওয়ার মানে
তিনি আপনা আপনিই সেই বয়সের নির্দিষ্ট বর্গের সদস্য হয়ে যাবেন। যেমন : পূর্ব আফ্রিকার তিরিকি
জাতির মধ্যে। তবে এসব ক্ষেত্রে কোন কোন জাতির মধ্যে নির্দিষ্ট আচার অনুষ্ঠানের রেওয়াজ আছে।
যেমন: উত্তর-আমেরিকার অনেক আদিবাসী জাতিসমূহের মধ্যে কোন কিশোর তার বয়স বর্গে ঢুকতে
চাইলে অবশ্যই কিছু প্রথা মেনে নিতে হবে। তার নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হবে, আর নাচ-গানে অংশ
নিতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ মন উল্লেখ পাওয়া যায় যে নির্দিষ্ট বয়স বর্গে প্রবেশ করবার জন্য
প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে বেশ খরচ হয়। ফলে সমাজের কোন কোন সদস্যের পক্ষে সেখানে
আনুষ্ঠানিকভাবে ঢোকা সম্ভব হয় না।
নির্দিষ্ট বয়স বর্গে ঢুকবার জন্য কতকগুলি ব্যক্তিগত অর্জন থাকতে পারে। সেটা জৈবিক হতে পারে Ñ
যেমন সাবালগ হওয়া, আবার সামাজিক হতে পারে Ñ যেমন বিয়ে করা, বা বাচ্চা জন্মানো। বয়স বর্গের
সদস্যদের অনেক কিছুই এক রকম হতে পারে, তাঁদের কাজ-কর্ম এক ধরনের হতে পারে, পরস্পরের
মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক থাকতে পারে, এমনকি একই ধরনের উদ্যম ও আকাক্সক্ষা থাকতে পারে Ñ
কিন্তু একই বর্গের সদস্যদের বয়স আক্ষরিক অর্থে এক নয়, একটা সীমার মধ্যে তাঁদের বয়স। বয়স বর্গ
(ধমব মৎধফব)-এর পাশাপাশি আরেকটি ধারণা নৃবিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয়েছে। সেটা হচ্ছে বয়স সেট
(ধমব ংবঃ)। বয়স সেট বলতে বোঝানো হয়ে থাকে এমন একটা সামাজিক সংগঠন যেখানে একদল
মানুষ সম-বয়সের এবং একই লিঙ্গের হয়ে থাকেন এবং সারা জীবন কিংবা জীবনের একটা বড় সময়
একই সঙ্গে অতিবাহন করেন। যেমন: পূর্ব আফ্রিকার তিরিকিদের মধ্যে একটা বয়স বর্গের সেই সব
সদস্য যাঁরা ১৫ বছরের মত একত্রে কাটিয়েছেন তাঁদেরকে একটা বয়স সেটে গণ্য করা হয়। অনেকেই
এটাকে বয়স বর্গের একটা অংশ হিসেবে দেখেছেন। কারণ বয়স সেটের সদস্যরা সকলে একই বয়স
বর্গের হয়ে থাকেন। তবে একটা সাধারণ পার্থক্য হচ্ছে বয়স সেট সাধারণত একই লিঙ্গের সদস্যদের
দ্বারা গঠিত। আর এর সদস্যরা পরস্পরের খুব ঘনিষ্ট থেকে যান সারা জীবন বা জীবনের বড় একটা
সময়। তবে কোন কোন নৃবিজ্ঞানীর মতে এই ধরনের বয়স সেট বয়স বর্গের তুলনায় ক্ষমতার বিচারে
স্বতন্ত্র। অনেক সমাজেই সিদ্ধান্তগ্রহণ এবং নেতৃত্ব দেবার ব্যাপারে এই ধরনের বয়স সেট হস্তক্ষেপ
করতে পারে। কোন কোন সমাজে বয়স সেট জ্ঞাতি সম্পর্কের বাইরে পর্যন্তবি¯তৃত হতে পারে। এই
ব্যাপারটা সাধারণ বয়স বর্গের থেকে একেবারেই ভিন্ন। বয়স বর্গের ব্যাপারটা ধীরে ধীরে শিথিল হতে
থাকে যখন এর সদস্যরা বয়স্ক হতে থাকেন।
কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ধরনের আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সাধারণত এক বর্গের সদস্যরা
অন্য বর্গে প্রবেশ করেন। বয়স্কবর্গের লোকজন সাধারণত স্পষ্টভাবেই নিজেদের আলাদা মনে করে
অনেক জাতির মধ্যে বয়সের
ভিত্তিতে বিভাজন লক্ষ্য করা
গেছে। একে বলা হয় বয়স বর্গ
(ধমব মৎধফব)।
বয়স সেট ... এমন একটা
সামাজিক সংগঠন যেখানে
একদল মানুষ সম-বয়সের এবং
একই লিঙ্গের হয়ে থাকেন এবং
সারা জীবন কিংবা জীবনের
একটা বড় সময় একই সঙ্গে
অতিবাহন করেন।
থাকেন, এবং একই সঙ্গে তাঁরা কিছু দায়িত্বও বোধ করে থাকেন তাঁদের ‘কনিষ্ঠ’দের প্রতি Ñ কিন্তু এর
মানে এই নয় যে বয়স্করা কিংবা বয়োকনিষ্ঠরা কেউ কারো বর্গের চেয়ে ‘ভাল’ বা ‘মন্দ’। নৃবিজ্ঞানীরা যে
সকল সমাজকে সরল সমাজ বলেছেন সেখানকার বয়স বিভাজন সম্পর্কে এই রকম ব্যাখ্যাই অধিকাংশ
নৃবিজ্ঞানীরা দিয়েছেন। তাঁদের ব্যাখ্যা থেকে এটা অনুমান করা যায় যে, কোন একটা বয়সের বর্গকে
ভাল বা মন্দ ভাবা আধুনিক কালের এবং আধুনিক সমাজে সৃষ্টি হয়েছে। অ-ইউরোপীয় সমাজে এই
বর্গগুলো দিয়ে সমাজের কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য ভাগাভাগি করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু এতে কোন বর্গকে
খাটো করে দেখা হয়নি। তবে কোথাও কোথাও বয়স ভিত্তিক দলের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক এবং সামরিক
দায়-দায়িত্ব দেয়া থাকে। যেমন: পূর্ব আফ্রিকার কারিমোজোং, মাসাই এবং নান্দী জাতি। এখানে দুই
একটা সমাজের উদাহরণ ধরে বয়স ভিত্তিক বিভাজনের চর্চা দেখা যেতে পারে।
আফ্রিকার সমাজে বয়স ভিত্তিক বিভাজন
নৃবিজ্ঞানীদের মতে আফ্রিকাই বয়স ভিত্তিক বিভাজনের সবচেয়ে ভাল উদাহরণ। এখানেই নানাবিধ
ধরনে বয়সের সংঘ ধরা পড়েছে নৃবিজ্ঞানীদের কাছে। ই. ই. ইভান্স প্রিচার্ড নুয়ের সমাজের বয়স
বিভাজন নিয়ে আলোচনা করেছেন (১৯৪০)। প্রিচার্ডের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সমস্তসাহারার দক্ষিণে
অবস্থিত পূর্ব আফ্রিকার নুয়ের সমাজে যে কোন পুরুষের সঙ্গে অন্য সকল পুরুষের অবস্থানের তুলনা
চলে। আর সেই তুলনাটা চলে বয়োজ্যেষ্ঠতা, সমবয়স এবং বয়োকনিষ্ঠতা দিয়ে। এভাবেই নুয়ের
সমাজের একদম ভিত্তির ব্যাপার এটা। নতুন বর্গে অভিষেক ঘটানো কোন কাগজে-কলমে লেখাপড়ার
ব্যাপার নয়। একজন ছেলে তাঁর বাবার কাছ থেকে কিংবা চাচার কাছ থেকে যদি কোন অস্ত্র লাভ
করেন, তাহলে এর মধ্য দিয়ে তিনি যোদ্ধাতে পরিণত হন। তাঁকে যদি একটা ষাঁড় দেয়া হয় তিনি
রাখাল বা পশুচারক হয়ে যান। এভাবে তিনি বয়স্ক পুরুষ হবার স্বীকৃতি পেলেন। একবার যখন তিনি এই
কাজে অভিষিক্ত হলেন, সারা জীবনই সেই বয়স বর্গের সদস্য হয়ে রইলেন। তাঁর এই নতুন মর্যাদার
কারণে তিনি কোন প্রশাসনিক কিংবা রাজনৈতিক-সামরিক কর্তৃত্ব পেলেন না, কিন্তু স্বীকৃতি পেলেন।
কেবল একটা নিষেধাজ্ঞা থাকতে পারে যে, তিনি দুধ দোয়াতে পারবেন না। এ ছাড়া তিনি ঘর-
গেরস্তালির কাজে অংশ নেবেন কতটা তাও খুবই শিথিলভাবে বলা থাকে। অন্তত তাঁর বিয়ে অব্দি। কিছু
নীতিমালা অবশ্যই থাকে। যেমন: কোন পুরুষ তাঁর সমবয়সী দলের কোন সদস্যের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে
করতে পারবেন না, কোন সম্পর্ক রাখাও সম্ভব নয়। যেহেতু মেয়েটি তাঁর ‘মেয়েতুল্য’। পুরুষ হয়ে ওঠার
সাথে সাথেই কারো আচার-আচরণ এবং খাবার দাবারের কিছু নির্দিষ্ট পরিবর্তন হবে। এটা তাঁকে কোন
সুযোগ দেবার জন্য নয়, নিয়ম।
বিস্তারিত বয়স বিভাজনের প্রসঙ্গে পূর্ব নাইজেরিয়ার আফিকপো ইবো-দের কথা বলা যায়। সেখানে
প্রত্যেকটা আফিকপো গ্রামে পুরুষদের একটা সংগঠন দেখা গেছে Ñ ওগো। সকল বয়োপ্রাপ্ত পুরুষরা
সমাজের সকল ধর্মীয়, নৈতিক এবং মনোরঞ্জনের অনুষ্ঠানের দায়-দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। একই সঙ্গে
তাঁরা গ্রামবাসীর আচার-আচরণের নীতিমালাও বানিয়ে থাকেন। এই সমাজে বয়স সেটও বেশ গুরুত্বপূর্ণ
সংগঠন। একই গ্রামে মোটামুটি তিন বছরের ব্যবধানে যাঁরা জন্মেছেন তাঁদের নিয়ে এই সেট গঠিত।
নারী এবং পুরুষদের সেট আলাদা, তবে পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করে থাকেন। এই সেটগুলোর
একেবারে স্বতন্ত্র দায়িত্ব পড়ে যখন কোন ভোজ বা উৎসব দেখা দেয়। বয়স বর্গ হচ্ছে এই ধরনের বয়স
সেটের একটা সম্মিলিত রূপ। এর অনেকগুলি সামাজিক-অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব আছে। পারস্পরিক
সহযোগিতা এবং জবাবদিহিতার সম্পর্ক রয়েছে এই বয়স বর্গের সদস্যদের। বয়স সেট সাধারণভাবে
গ্রামের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, আর বয়স বর্গ গ্রামের এবং অনেক গ্রামের মধ্যকার সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে
ওঠে। নারীদের বয়স সেটগুলোকে পুরুষদের তুলনায় দুর্বল বলে মনে করেছেন গবেষক নৃবিজ্ঞানীরা।
কিশোরী মেয়েদের সমবয়সী দল আছে। তবে সাধারণত বিয়ের পর বিবাহিত মেয়েদের সমবয়সী সংঘই
তৎপর। ১৯৪০ সাল থেকে সেখানে গ্রাম উন্নয়ন সংগঠন এবং গ্রামীণ ইউনিয়নও গড়ে উঠেছে।
নুয়ের সমাজের ... একজন
ছেলে তাঁর বাবার কাছ থেকে
কিংবা চাচার কাছ থেকে যদি
কোন অস্ত্র লাভ করেন, তাহলে
এর মধ্য দিয়ে তিনি যোদ্ধাতে
পরিণত হন। তাঁকে যদি একটা
ষাঁড় দেয়া হয় তিনি রাখাল বা
পশুচারক হয়ে যান।
আফিকপো ইবোদের মধ্যে ...
সকল বয়োপ্রাপ্ত পুরুষরা
সমাজের সকল ধর্মীয়, নৈতিক
এবং মনোরঞ্জনের অনুষ্ঠানের
দায়-দায়িত্ব নিয়ে থাকেন।
কারিমোজোং-দের বয়স সেট থেকে দেখা যায় এখানে জ্ঞাতি সম্পর্কের ঊর্ধ্বে কাজ করে এই সংঘ। এরা
উগাÐার একটা জাতি। এখানে এক একটা প্রজন্মে ৫টি করে বয়স সেট থাকে। পুরুষদের প্রজন্মের এই
৫টি বয়স সেট তৈরি হয়ে গেলেই তাঁরা তাঁদের বয়োজ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্তাদের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে
নেয় এই প্রজন্ম বা বয়স বর্গ। এভাবে একটি প্রজন্ম যাঁরা প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলেন. বিচার কাজ
পরিচালনা করতেন Ñ তাঁরা কার্যত অবসরপ্রাপ্ত হয়ে গেলেন। এই সমাজে বয়স সেটের রাজনৈতিক
কর্তৃত্ব স্বীকৃত। ব্রাজিলের শাভান্তেজাতির মধ্যে আবার একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর ছেলেদেরকে
‘আইবুড়োদের ঘরে’ (নধপযবষড়ৎ যঁঃ) পাঠানো হয়ে থাকে। এখানে বছর পাঁচেক কাটানোর পর তাঁরা
‘যুবক’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারেন। ওই বাসস্থানে থাকতে থাকতেই শিখতে হবে কিভাবে অস্ত্র
বানাতে হয়, কিংবা শিকার করতে হয়। এ রকম উদাহরণ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া সম্ভব নৃবিজ্ঞানের
গবেষণা থেকে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন সমাজ ও জাতিতে বয়সের ভিত্তিতে বিভাজন দেখা যায়, একটা
সমাজ থেকে আরেকটা একেবারেই ভিন্ন।
নৃবিজ্ঞানের এই সব গবেষণা লক্ষ্য করলে দেখা যায় বয়স ভিত্তিক বিভাজনের বেলায় নামকরণ নিয়ে
নানা বিভ্রান্তিআছে। বয়স সেট এবং বয়স বর্গ বলতে কি বোঝানো হয়েছে তা সবক্ষেত্রে পরিষ্কার হয়নি,
একটার সঙ্গে অন্যটার পার্থক্যও বোঝা কঠিন হয়। কোন কোন লেখায় বয়স ভিত্তিক বিভাজন না বলে
বয়স ভিত্তিক সংগঠন হিসেবে বলা হয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপার খুব স্পষ্ট। এই সব সমাজে ইউরোপীয়
শাসন আসবার পর কি ধরনের বদল ঘটেছে তা নিয়ে তেমন একটা আলোচনা খুব কম নৃবিজ্ঞানী
করেছেন। বিশেষত যাঁরা বয়স ভিত্তিক সংগঠন নিয়ে গবেষণা করেছেন। ইউরোপের শাসনে সমাজের
সর্বত্র বদলেছে। ফলে অনুমান করা যায় বয়স ভিত্তিক সংগঠন কিংবা বিভাজনের মধ্যেও মৌলিক বদল
এসেছে। এ ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট করেছেন আরেক নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ। তিনি সুদানের ডিংকা
সমাজের উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বুঝিয়েছেন। এই সমাজে গবেষণা করেন আরেক নৃবিজ্ঞানী
লিয়েনহার্ট। লিয়েনহার্টের কাজ ধরে তালাল আসাদ বিশে- ষণ করেছেন কিভাবে ডিংকা সমাজের
বয়সের বিভাজনে ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণা প্রবেশ করেছে। উপনিবেশ স্থাপনার আগে অর্থাৎ ডিংকা
সমাজে বৃটিশ শাসন চালু হবার আগে এক বয়স বর্গ থেকে অন্যটায় উত্তরণ ছিল ‘পাকা হয়ে ওঠা’। এর
জন্য তাঁরা একটা শব্দ ব্যবহার করতেন Ñ ‘লো তোয়েং’। এর সামাজিক মানে ছিল অভিজ্ঞতা অর্জন
করা, জ্ঞানী হয়ে ওঠা ইত্যাদি। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্য দিয়ে সমাজের মধ্যকার ধ্যান-ধারণায়
এমন পরিবর্তন ঘটেছে যে বয়স বর্গের গুরুত্ব একেবারেই আগের মত থাকল না। আর ওই শব্দটার
মানে বদলে গিয়ে দাঁড়াল ‘প্রগতিশীল হয়ে ওঠা/আধুনিক হয়ে ওঠা’। বয়সের দিক থেকে বুর্জুগ হয়ে
ওঠার আর কোন মানে থাকল না ওই সমাজে।
বাংলাদেশের বয়স ভিত্তিক বিভাজনের আচার-অনুষ্ঠান
বয়সের কোন একটা পর্যায়ে সামাজিক রীতিনীতি কিংবা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির দু’চারটি উদাহরণ
আমাদের সমাজ থেকেও দেয়া সম্ভব। একটা হচ্ছে উপনয়ন প্রক্রিয়া। সাধারণত বাংলা অঞ্চলের হিন্দু
ব্রাহ্মণদের মধ্যে এর প্রচলন দেখা যায়, তবে কাছাকাছি ধরনের নিয়ম অন্যান্য অঞ্চলের ব্রাহ্মণদের
মধ্যেও রয়েছে। ব্রাহ্মণ পুরুষ সন্তান একটা নির্দিষ্ট বয়সে আসবার পর তাঁকে নিয়ে উপনয়ন অনুষ্ঠান
হয়। এর চলতি নাম হচ্ছে ‘পৈতে পরানো’। এই অনুষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজন ও অন্যান্যরা আসেন। তবে
সকলেই সাধারণত নিজ বর্ণ থেকে আসেন। এর নাম যাই হোক না কেন Ñ সামাজিকভাবে এর মানে
হচ্ছে পুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই ব্রাহ্মণ ‘বালক’ অন্য স্তরে উন্নীত হন। এর
অন্য মানেও আছে। যে সব ব্রাহ্মণ পূজা-অর্চণা করেন তাঁদের এই পৈতে প্রয়োজন পড়ে। ফলে এই
আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির আগে কোন ব্রাহ্মণ পূজার মত কোন দায়িত্ব নিতে পারেন না।
আরেকটা উদাহরণ দেয়া যায়। বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে কিছু লোকদেবীর আরাধনা প্রচলিত ছিল। এর
অনেকাংশই বিশেষভাবে নিæবর্গীয় এবং নারীকেন্দ্রিক। যেমন: ভাদু দেবী। এই সব আরাধনার কিছু কিছু
এই সব সমাজে ইউরোপীয়
শাসন আসবার পর কি ধরনের
বদল ঘটেছে তা নিয়ে তেমন
একটা আলোচনা খুব কম
নৃবিজ্ঞানী করেছেন। বিশেষত
যাঁরা বয়স ভিত্তিক সংগঠন নিয়ে
গবেষণা করেছেন।
‘পৈতে পরানো’..র আব্রাহ্মণ পূজার মত কোননিতে পারেন না।
নারীর শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। দক্ষিণাঞ্চলে এই রকম একটা দেবীর আরাধনার নজির
ছিল নারীদের ঋতুস্রাব শুরু হলে। সাধারণভাবে গেরস্তহিন্দু ঘরের মেয়েরা বয়োপ্রাপ্ত হলে লোকদেবীর
আরাধনা করা ছাড়াও পাড়া-পড়শিকে খাওয়ানো হ’ত। একই সাথে শুভাকাক্সক্ষীরা উপহার দিতেন এই
‘নতুন’ নারীকে। এই ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানের মূল মানে ছিল নারীর ‘যৌবন প্রাপ্তি’কে সম্মান
দেখানো। ক্রমশ এই ধরনের প্রচলন কমে আসছে সমাজে।

নগর সমাজে বয়সের বিভাজন ও বৈষম্য
শহরাঞ্চলে বয়সের বিভাজন ঘটে থাকে আইনের মাধ্যমে। প্রচলিতভাবে একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্তনারী
বা পুরুষ উভয়েই শিশু হিসেবে গণ্য হয়ে থাকেন। এই মুহূর্তে জাতিসংঘের মানদন্ড অনুযায়ী বয়সের
সীমারেখাটি হচ্ছে ১৮ বছর। এই বয়সের পর কতকগুলি অধিকার স্বীকৃতি পায়। যেমন: ভোট দেয়ার
অধিকার, কোন কিছু কেনার অধিকার ইত্যাদি। পশ্চিমা সমাজে এই বয়স হবার আরও কিছু সামাজিক
মানে আছে। এই বয়সের পর আশা করা হয় সন্তানেরা বাবা-মার কাছ থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র জীবন
যাপন করবেন। তাছাড়া এই বয়সের পর যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলা আইনত দন্ডনীয় নয়। কিশোরকিশোরী বয়স থেকে ‘যুবক-যুবতী’ হয়ে ওঠার মত নগর সমাজে প্রৌঢ়/বৃদ্ধ হয়ে ওঠার ব্যাপারটাও
গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণভাবে পুরুষদের মধ্যে একটা সময়ে চাকুরি বা কাজ থেকে অবসর নেবার চর্চা আছে।
আশা করা হয় এই সময়ে তিনি বিশ্রাম নেবেন এবং তাঁর পুত্র সন্তানেরা ব্যবসা সামলাবেন কিংবা চাকুরি
করে রোজগার করবেন। নারীদের গেরস্তালি কাজ থেকে অবসর নেয়ার সুযোগ থাকে না। পাশাপাশি
লক্ষ্য করার মত কিছু ব্যাপার আছে। হাসি-ঠাট্টা এবং আলাপ-আলোচনার মধ্যেও বয়সের বিভাজন ধরা
পড়ে। যেমন: ‘এখন তো তুমি দাদা হয়েছ, তোমার কি এখন এসব মানায়?’
সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে বয়সের ভিত্তিতে কোন ভেদাভেদ বা বৈষম্য আধুনিক সমাজে নেই।
একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে এই ধারণাটা ভ্রান্ত। পরিবারে প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ আলাপআলোচনায় অল্প বয়সীদের কখনোই অংশ নিতে দেয়া হয় না। তাঁদের মতামত কিংবা ভাবনা-চিন্তাকে
হাল্কাভাবে নেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে খাবার-দাবার কিংবা আসবাবপত্র ব্যবহারের বেলায়ও বঞ্চিত হয়ে
থাকেন পরিবারের অল্প বয়সী সদস্যরা। এসব ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থাও পুরুষদের তুলনায় নিæমুখী।
বাংলা ভাষায় সর্বনামের বেলায় দেখা যায় নিæ শ্রেণীর মানুষের জন্য ‘তুমি’ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
পাশাপাশি অল্প বয়সীদের বেলায়ও তা করা হয়। বয়স ১৮ হওয়া মানেই এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে
পারা নয়। প্রায়শই কাউকে ঘায়েল করার জন্য বলা হয় ‘তুমি তো আমার হাঁটুর বয়সী।’
বৈষম্যের এই চিত্র কেবল এখানেই সীমিত নয়। চাকুরি কিংবা পেশাগত সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে একটা
শব্দ প্রায়ই ব্যবহার করা হয়ে থাকে Ñ অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতা ছাড়া কোন নিয়োগকর্তাই বর্তমান নগর
সমাজে চাকুরি দিতে চান না। কিন্তু অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ-সুবিধা সকলের একরকম না। বৈষম্য
এখানেই। পেশাদার জগতে সাধারণত অভিজ্ঞতার কথা গর্বের সঙ্গে বলা হয়েও থাকে। এটা আধুনিক
সমাজের একটা বৈশিষ্ট্য। শুধু তাই নয় যে কোন সামাজিক প্রসঙ্গে মতামত দেয়া বা আলাপ-আলোচনার
জন্য বয়স্ক এবং পুরুষদের বাড়তি গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। এখানে কোন তরুণ-তরুণী বা কিশোরকিশোরীর তীক্ষè বিশে- ষণ থাকলেও তা চাপা পড়ে যায়। প্রচার মাধ্যমের যে সমস্তকাজকে চিন্তাশীল
ভাবা হয়ে থাকে তার প্রায় একচেটিয়া কর্তৃত্ব তুলনামূলকভাবে বয়স্ক পুরুষদের হাতে। তা সে
টেলিভিশনই হোক আর পত্রিকার রাজনীতি-অর্থনীতি পাতাই হোক। বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাতে
গুরুত্ব দিয়ে কিশোর-কিশোরীর ছবি ছাপা হয় কেবল মাধ্যমিক এবং উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল
বের হলে। সেখানেও তাঁদের সাফল্যের সঙ্গে অনিবার্যভাবে তাঁদের বাবা-মার ভূমিকার কৃতিত্ব দেয়া
হতে থাকে। এগুলো কেবল কিছু উদাহরণ বয়স ভেদে বৈষম্যকে বোঝার জন্য।
চার মাধ্যমের যে সমস্ত
ক চিন্তাশীল ভাবা হয়ে
ক তার প্রায় একচেটিয়া
তুলনামূলকভাবে বয়স্ক
পুরুষদের হাতে।
অল্প বয়সীদের ... মতামত
কিংবা ভাবনা-চিন্তাকে
হাল্কাভাবে নেয়া হয়।
আধুনিক সমাজে বয়সের দিক থেকে অল্প বয়সীরাই যে কেবল বৈষম্যের শিকার তা নয়। এখানে বৃদ্ধরাও
বৈষম্যের শিকার। সমাজের ঘটনাবলী তলিয়ে দেখলেই সেটা বোঝা যায়। বয়সে যাঁরা অনেক প্রবীণ
তাঁদেরকে প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদেরকে বোঝা মনে করা হয়। প্রবীণদের নিয়ে
হাসি-ঠাট্টা করার সামাজিক প্রবণতা আছে। কেউ কেউ বলে থাকেন প্রবীণেরা যদি অনেক সম্পত্তিবান
হন তাহলে এই পরিস্থিতি তৈরি হয় না। সেক্ষেত্রে সম্পত্তির ওজনে মানুষের মর্যাদা মাপা হচ্ছে। নারীরা
এই পরিস্থিতিতে আরও করুণ অবস্থার মুখোমুখি হয়ে থাকেন। কারণ সামাজিকভাবে নারীর সম্পত্তির
নজির কম। শহুরে বহু মধ্যবিত্ত পরিবারে অবসরপ্রাপ্ত এই মানুষজন নানাবিধ অবজ্ঞা আর চাপের মধ্যে
থাকেন। সেই হিসেবে চিন্তা করলে দেখা যায় এই সমাজে গ্রহণযোগ্যতা আছে কেবল একটা নির্দিষ্ট
বয়সের এবং অবশ্যই নির্দিষ্ট আর্থিক স্বচ্ছলতার পুরুষদের। কারণ তাঁরাই কেবল সমাজে অন্য শ্রেণীর,
অন্য লিঙ্গের এবং অন্য বয়সের মানুষদের অবস্থান ঠিক করে দিতে পারেন। তাঁদের কথার মূল্যায়ন
করতে পারেন, সঠিক-বেঠিক নির্ধারণ করতে পারেন, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এটা
নিশ্চিতভাবেই বৈষম্য।
সারাংশ
বিশেষত ইউরোপের বাইরের সমাজে বয়স একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বয়সের ভিত্তিতে সমাজের
মানুষজনের মধ্যে ভাগ করা হয়। প্রায় ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট একটা বয়সের সদস্যদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব-কর্তব্য
থাকে। বয়স্ক মানুষজনের প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি থাকে এবং তাঁরা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ
সিদ্ধান্তসমূহ নিয়ে থাকেন। তবে সেক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্যকে খেয়াল রাখা দরকার। সাধারণভাবে
মনে করা হয় যে,শহুরে সমাজে বয়সের ভিত্তিতে মান-মর্যাদার ভেদবিচার নেই। কিন্তু এই ধারণা সঠিক
নয়। বরং, এই সমাজে পেশাগত মর্যাদার ক্ষেত্রে অল্প বয়সীদের গুরুত্ব কম দেয়া হয়। একই সঙ্গে বয়স্ক
অবসরপ্রাপ্তদের নানারকম অবহেলার শিকার হতে হয়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন -
১। বয়স ভিত্তিক বিভাজন -এর উদাহরন হিসেবে নৃবিজ্ঞানীরা কোন অঞ্চলকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ
করেছেন?
ক. এশিয়া খ. ইউরোপ
বয়সে যাঁরা অনেক প্রবীণ
তাঁদেরকে প্রায়ই উপেক্ষা করা
হয়, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদেরকে
বোঝা মনে করা হয়।
গ. আফ্রিকা ঘ. ল্যাটিন আমেরিকা
২। নৃবিজ্ঞানী ই. ই. ইভান্স প্রিচার্ড কোন সমাজের বয়স বিভাজন নিয়ে আলোচনা করেছেন?
ক. নুয়ের খ. নায়ার
গ. টোডো ঘ. আফিকপো ইবো
৩। ‘লো-তোয়েং’ - শব্দটি কোন সমাজে প্রচলিত?
ক. কারিমোজোং খ. শাভান্তে
গ. ডিংকা ঘ. নান্দী
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। বয়স বর্গ(ধমব মৎধফব) বলতে কী বোঝানো হয়ে থাকে?
২। বয়সভিত্তিক সংগঠন কী বৈষম্যমূলক?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। বিভিন্ন সমাজে বয়সভিত্তিক সংগঠনের গুরুত্ব বর্ণনা করুন।
২। সাধারণভাবে অনেকেই বলে থাকেন আধুনিক সমাজে বয়সের ভেদাভেদ নেই। আপনার কি মনে
হয়?

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]