কৃষক আর্থব্যবস্থা অংশে আপনারা জেনেছেন যে নৃবিজ্ঞানীদের অনেকেই কৃষকদের কর্মকান্ডকে একটা
স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। এই পদ্ধতিতে ভাবার একটা বিরাট সমস্যা আছে। প্রথমত মনে
রাখা দরকার আমরা যে অর্থে কৃষক বলে থাকি সারা পৃথিবীতে সেই রকম কৃষক নেই। শিল্পোন্নত বিশ্বে
কৃষকরা আর মোটেই সেরকম নন। দ্বিতীয়ত অন্যান্য অংশের কৃষকরা কোনভাবেই এক জায়গায় স্থির
নেই। আমাদের সতর্ক থাকা দরকার যে কৃষক সম্পর্কিত ভাবনা চিন্তায় অনেক সময়েই কৃষকদের
অপরিবর্তনশীল ধরে নেয়া হয়। ধরে নেয়া হয়েছে যে কৃষকদের মধ্যে তেমন কোন পরিবর্তন হচ্ছে না।
সে কারণেই এই আলোচনার শুরুতেই আমাদের বোঝা দরকার সারা পৃথিবীতে কৃষকদের জীবনে নানা
রকম পরিবর্তন হচ্ছে Ñ কখনো প্রযুক্তি আসার কারণে, কখনো সরকারী নীতিমালার কারণে, কখনো
আন্তর্জাতিক বাজারের চাপে। বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলন বুঝবার জন্য এই অঞ্চলের কৃষকদের
বৈশিষ্ট্য বোঝা দরকার। আর তাহলে এখানকার কৃষিজ সম্পর্কের ইতিহাস খানিকটা জানা দরকার।
ব্রিটিশরা এখানে আসবার আগে পর্যন্তএই অঞ্চলে জমির কোন ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। এর মানে
এই নয় যে তখন সমাজে সমতা ছিল। ক্রিস ফুলারের বক্তব্য হচ্ছে মোঘল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক
অধিকার সৃষ্টি এবং সেগুলোকে টিকিয়ে রাখা কৃষিজ ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। বিষয়গুলোকে তিনি
এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন : প্রাক-ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিল জমির
উপর নিয়নত্রণ। কিন্তু আসলে ঠিক তাও নয়। যেটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটি হচ্ছে জমিতে উৎপাদিত
শস্যাদির উপর নিয়ন্ত্রণ। রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল জমিতে বসবাসরত মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ। নির্দিষ্ট
কোন জমিতে উৎপাদিত শস্যের ভাগীদার ছিল একাধিক ব্যক্তি কিংবা সমষ্টি, শাসক হতে একেবারে
কৃষক পর্যায় পর্যন্ত। শস্য উৎপাদনের জন্যে কৃষকের শ্রম স্পষ্টতই অপরিহার্য। কেবল তাই নয়, সে
সময়ের ভারতবর্ষের জনসংখ্যা ছিল কম এবং সে তুলনায় জমি ছিল অত্যাধিক। নিয়মিত ফসলের হিস্যা
আদায় করার লক্ষ্যে কৃষককে জমিতে বসবাসরত রাখা ছিল শাসকবৃন্দের স্বার্থ। মোঘল সাম্রাজ্যের
রাজনৈতিক স্তরবিন্যস্তব্যবস্থা ছিল একটি বিশাল পিরামিডের মতন: পিরামিডের সর্বনিন্মে অবস্থিত ছিলেন
রায়ত বা কৃষক, তার উপর ছিলেন জমিদার, তার উপরে প্রধান কিংবা দলপতি, তারও উপর
মানসাবদার, তার উপর জায়গীরদার এবং আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার চ‚ড়ায় ছিলেন স্বয়ং মোঘল সম্রাট।
সম্রাট হতে জমিদার, প্রতিটি ব্যক্তি এবং সমষ্টি ততক্ষণই ক্ষমতাবান যতক্ষণ তিনি অধিবাসীদের নিয়ন্ত্রণ
করতে পারছেন এবং জমি হতে শস্যের ভাগ আদায় করতে পারছেন। শস্যের ভাগ আদায় করতে না
পারলে রাজনৈতিক স্তরবিন্যস্তব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে সিপাহীসালা, অথবা অস্ত্র, কোনটাই মজুদ রাখা
সম্ভব ছিল না যেটি কিনা মোঘল সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার প্রধান উপায় ছিল।
মোঘল সাম্রাজ্যের গ্রামগুলো ছিল দুই ধরনের : রায়তওয়ারী এবং জমিদারী। জমিদার শ্রেণী রায়ত কিংবা
কৃষক শ্রেণীর এক ধাপ উর্দ্ধে অবস্থিত; তাদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার ছিল কৃষকের উৎপাদিত
ফসলের একটি ভাগ। জমির মালিকানার অর্থ সে কালে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষমতা বোঝাত না, বোঝাত
জমিদারীতে বসবাসরত মানুষ এবং তাদের উৎপাদিত ফসলের হিস্যার উপর অধিকার। গ্রাম গড়ে উঠত
পাঠ - ৪
প্রাক-ব্রিটিশ ভারতের
রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার
কেন্দ্রে ছিল জমির উপর
নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু আসলে ঠিক তাও
নয়। যেটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটি
হচ্ছে জমিতে উৎপাদিত
শস্যাদির উপর নিয়ন্ত্রণ।
মোঘল সাম্রাজ্যের গ্রামগুলো
ছিল দুই ধরনের : রায়তওয়ারী
এবং জমিদারী। জমিদার শ্রেণী
রায়ত কিংবা কৃষক শ্রেণীর এক
ধাপ উর্দ্ধে অবস্থিত; তাদের
সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার
ছিল কৃষকের উৎপাদিত
ফসলের একটি ভাগ।
এভাবে : একটি জাতিবর্ণ কিংবা গোত্রের সদস্যগণ গ্রামের পুরনো অধিবাসীদের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা
করত, অথবা তারা কোন খালি জায়গাকে বাসযোগ্য করে তুলত। যদি প্রথমটা ঘটত তাহলে সৃষ্ট হ‘ত
জমিদারী গ্রাম। দ্বিতীয়টা ঘটলে সৃষ্ট হ‘ত রায়তওয়ারী গ্রাম যেহেতু তারা নিজেরাই রায়তী কিংবা কৃষক।
অর্থাৎ, রায়তওয়ারী গ্রাম হচ্ছে জমিদার-বিহীন গ্রাম। কালানুক্রমে সে গ্রামে যদি অন্য কোন গোত্রের
উদ্ভব ঘটত, এবং নতুন গোত্র পুরানদের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারত অথবা হেরে যেত,
তাহলে জমিদারী গ্রাম প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তৈরী হ‘ত। একেবারে প্রথমে না হলেও পরবর্তী কোন এক
পর্যায়ে, বিজয়ী গোত্র কিংবা জাতিবর্ণের অধিকার পরিণত হতে পারত জমিদারী অধিকারে। অধিকৃত
এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদারীর অধিকার বিজয়ী গোত্রের বিভিন্ন নেতৃত্বদানকারী সদস্যদের হাতে
ন্যস্তথাকত। জমিদারী অধিকার নিশ্চিত করবার জন্য বলপ্রয়োগ এবং শারীরিক / পেশী শক্তি ছিল
অপরিহার্য। ক্রিস ফুলার বলেন : দুটি বিষয় মনে রাখা জরুরী। প্রথমত, জমিদারের উৎপত্তি প্রায়
সবসময়ই হত কৃষক শ্রেণী হতে। একারণে তাদের মধ্যে কোন নিরঙ্কুশ পার্থক্য ছিল না। বরং ক্ষমতাকে
যদি আমরা লাগাতার হিসেবে ভাবি তাহলে বলা যায় যে এক পক্ষের ক্ষমতা ছিল কিছুটা বেশী, অপর
পক্ষের কিছুটা কম। দ্বিতীয়ত, স্থানিক পর্যায়ে অধিপতি শ্রেণী চক্রাকারভাবে পরিবর্তিত হ’তে
(পরৎপঁষধঃরড়হ ড়ভ বষরঃবং)।
বৃটিশ শাসন মোঘল কৃষি ব্যবস্থায় বড়-সড় রদবদল ঘটায়। ভারতবর্ষের যে কোন ভ‚খন্ড দখলের পর,
নতুন শাসকদের প্রথম কাজ ছিল জমির খাজনা আদায় করা কিন্তু সেটির জন্য প্রয়োজন ছির জমির
মালিক কে বা কারা সে ব্যাপার নিশ্চিত হওয়া। পূর্বতন খাজনা ব্যবস্থা বৃটিশদের বোধগম্যের বাইরে
ছিল। বৃটিশরা জমির মালিক খুঁজছিলেন কিন্তু তারা জমির মালিক বলতে যা বুঝতেন সে অর্থে কোন
মালিক ছিল না। পরে অবশ্য তারা মালিক পক্ষ “খুঁজে” বের করলেন এবং তাদের সঙ্গে একটি
“মীমাংসা”য় পৌঁছালেন ঠিকই কারণ তাদের লক্ষ্য ছিল একটি স্থায়ী জমির-মালিক শ্রেণী সৃষ্টি করা যারা
হবেন বৃটিশ ক্ষমতার নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক মিত্র। বৃটিশ রাজস্ব ব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিল ব্যক্তি মালিকানার
ধারণা। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ভারতবর্ষে কেবলমাত্র জমিতে ব্যক্তি মালিকানা সৃষ্টি করেনি, তারা
তাদের প্রবর্তিত রাজস্ব ব্যবস্থা সমগ্র ভারতবর্ষে প্রয়োগ করেছে। সেটিকে আইন দ্বারা, চ‚ড়ান্তভাবে বললে
বৃটিশ ক্ষমতা দ্বারা, রক্ষা করেছে। বৃটিশ শাসকদের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে পুরাতন অধিপতিশীল
শ্রেণী ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো, এবং একটি নতুন অধিপতিশীল শ্রেণী তৈরী হ’ল। নতুন এই আর্থ-রাজনৈতিক
ব্যবস্থার চালিকাশক্তি পূর্বের ব্যবস্থার মত বলপ্রয়োগ-ভিত্তিক ছিল না, উৎপাদিত ফসলে ভাগ বসানোর
ব্যাপারও ছিল না। নতুনটির কেন্দ্রে ছিল বাজার প্রতিযোগিতা। এটি সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার
ধারণা হতে গড়ে উঠেছিল। নতুন-সৃষ্ট ব্যবস্থায় উৎপাদিত ফসলের ভাগাভাগির পরিবর্তে গড়ে উঠে
একটি নতুন লক্ষ্য : বাজার ব্যবস্থা মোতাবেক জমি-সংগ্রহ।
উপরের আলোচনার বিষয়বস্তুকে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে সাধারণ কৃষকদের আন্দোলন ব্রিটিশ
আমলের আগে ছিল প্রধানত জমিদারদের বিপক্ষে। সেগুলির মূল লক্ষ্য ছিল নিজেদের জীবন যাপনের
জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সম্পদটুকু রাখা এবং নির্যাতন বন্ধ করা। ব্রিটিশ শাসনে এই পরিস্থিতিটা পুরো
পাল্টে যায়। কৃষক আন্দোলনের মূল লক্ষ্য এক থাকলেও কৃষকদের প্রতিপক্ষ অনেক বদলে যায়। আর
কৃষকদের উপর নির্যাতনের ধরনও অনেক জটিল হয়ে পড়ে। এখানে আমাদের কয়েকটি ব্যাপার খুবই
মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করবার প্রয়োজন আছে। ব্রিটিশ ভারতে প্রথম জমির মালিকানার ধরন আমূল
বদলে গেল। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তপ্রথা চালু করলেন। এর মাধ্যমে বাস্তবে
চিরস্থায়ী জমিদার তৈরি হ’ল। ফলে কৃষকদের পক্ষে কোন জমিদারকে উচ্ছেদ করবার বাস্তব কোন মানে
থাকল না। কারণ ইতোমধ্যেই কোর্ট কাচারী ও আইনের মাধ্যমে জমির উপর চিরস্থায়ী মালিকানাকে
প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। অর্থাৎ কোন জমিদারের শোষণে অতিষ্ট হয়ে তাঁকে হঠালেও সেই জমিদারের
আইনগত ওয়ারিশ পরবর্তী জমিদার হয়ে যাবে। উপরন্তু মোঘল ভারতে জমির উপর কৃষকদের যে হক
স্বীকৃত ছিল তাও আর রইল না। আরও কিছু মৌলিক বদল ঘটেছে। আগে বিভিন্ন অঞ্চল বা পরগণাতে
কার্যত বিভিন্ন রকম নিয়ম এবং ব্যবস্থা ছিল। সেটা চাষের চুক্তি বা ফসলের হিস্যা যাই হোক না কেন।
ব্রিটিশ আমলে সমগ্র ভারতের জন্য একটা অখন্ড আইনী ব্যবস্থা চালু হ’ল। ফলে কৃষকদের লড়াই বা
আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল খোদ আইনী ব্যবস্থার বিপক্ষে। এর অন্য কারণও আছে।
১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তপ্রথা চালু
করলেন। এর মাধ্যমে বাস্তবে
চিরস্থায়ী জমিদার তৈরি হ’ল।
ফলে কৃষকদের পক্ষে কোন
জমিদারকে উচ্ছেদ করবার
বাস্তব কোন মানে থাকল না।
বৃটিশরা জমির মালিক
খুঁজছিলেন কিন্তু তারা জমির
মালিক বলতে যা বুঝতেন সে
অর্থে কোন মালিক ছিল না।
মোঘল যুগে আইনী কাঠামো ছিল কৃষি নিয়ে। সেগুলোর নাম ছিল বাদশাহী ফরমান। কিন্তু ব্রিটিশ
আমলে আইনের শক্তিমত্তা অনেক বেড়ে গেছিল নয়া পদ্ধতির বিচার কাঠামোর কারণে এবং একটা
অখন্ড ব্যবস্থা সমস্তভারতের জন্য কায়েম হয়েছিল বলে। তাছাড়া সেই আইনকে রক্ষা করার জন্য
শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী নিয়োগ হয়েছিল। এই নতুন ব্যবস্থাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগে সাধারণ
কৃষকদের সংগ্রাম পরিচালনা করতে হ’ত জমিদারদের বিরুদ্ধে এবং লড়াই হ’ত লাঠিয়ালদের বিপক্ষে।
ব্রিটিশ ভারতে তা বদলে গিয়ে হ’ল আইন এবং পুলিশের বিপক্ষে। অন্য ভাষায় বললে রাষ্ট্রের সাথে।
চিরস্থায়ী জমিদাররা যেহেতু ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থের অনুক‚ল ছিল তাই তাদের রক্ষা করবার জন্য
ব্রিটিশ রাজ এবং পুলিশ বাহিনী সর্বাত্মক চেষ্টা চালাত। কৃষক আন্দোলনের লিখিত ইতিহাস থেকে জানা
যায় এই সময়কালে একাধিক বড় মাপের কৃষক আন্দোলন হয়েছিল। এর মধ্যে এই শতকের তেভাগা
এবং তেলেঙ্গানা সংগ্রামের স্বতন্ত্র গুরুত্ব আছে। এখানে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এই শতকের
বিশের দশক থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে কমিউনিস্ট রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠা ঘটে। এর কার্যক্রম ছিল
সমগ্র ভারতবর্ষ ব্যাপী কৃষক ও নি¤œশ্রেণীর মানুষজনের আন্দোলনকে সংগঠিত করা। তাতে করে নানান
স্থানে বেড়ে ওঠা আন্দোলনগুলির মধ্যে একটা যোগসূত্র তৈরি হতে থাকল। যদিও কৃষক আন্দোলনের
চূড়ান্তবিজয় অর্জন হয়নি কিন্তু এই আন্দোলনগুলির বিরাট গুরুত্ব এই কারণে যে সেগুলি কৃষকদের
জীবনকে বদলে দেবার উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল। তেভাগা আন্দোলন বাংলা অঞ্চলেই মূলত বেড়ে
উঠেছিল। এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে সেই আন্দোলন এবং সা¤প্রতিক কালের দুটি আন্দোলন নিয়ে টীকা
দেয়া হচ্ছে।
তেভাগা আন্দোলন
তেভাগা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল প্রধানত বাংলা অঞ্চলে। এর স্থায়িত্ব ছিল ’৪০-এর দশকের শুরু হতে
মাঝামাঝি পর্যন্ত। এই আন্দোলন আপাতভাবে বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদার কিংবা জোতদারদের বিপক্ষে
গড়ে উঠেছিল। কিন্তু আবার চূড়ান্তবিচারে এই আন্দোলনের লড়াইকারী শক্তির বিপক্ষ ছিল ইংরেজ
শাসন ব্যবস্থা তথা রাষ্ট্র। বিভিন্ন অঞ্চলে তখন জমিদার শব্দটির পাশাপাশি জোতদার শব্দটি ব্যবহৃত
হ’ত। বিশেষভাবে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে জমির খন্ডকে জোত বলা হয়ে থাকে। জোতদার কথাটার
তাই মানে দাঁড়ায় যার অনেক পরিমাণে জমি আছে। অন্য ভাষায় জমিদার। আমাদের মনে রাখতে হবে
যে ইতোমধ্যেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিদাররা বংশ পরম্পরায় জমির মালিক হয়ে গেছে। ফলে
কৃষকদের জীবনের উপর আগের সময়ের তুলনায় আরো অনেক বেশি অত্যাচার নেমে এসেছিল। এই
পরিস্থিতিতে কৃষকদের প্রতিবাদের মূল বিষয় ছিল ফসলের হিস্যা। এখানে আর একটি পরিবর্তনের কথা
বলা প্রয়োজন। জমির মালিকানার বদলের পাশাপাশি লাভজনক শস্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু
হয়েছিল। এই সকল ঘটনার মধ্য দিয়ে সাধারণ কৃষকদের হাতে জমি ছিল খুব সামান্যই। ফলে বর্গাচাষ
পদ্ধতির প্রচলন ঘটে। বর্গাচাষ পদ্ধতির সাথে তেভাগা আন্দোলনের যোগাযোগ খুবই নিবিড়। তাই
তেভাগা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বর্গাচাষ ব্যবস্থা নিয়ে ধারণা থাকা দরকার।
এটা খুবই পরিষ্কার যে মালিকানার নিশ্চিত ব্যবস্থা না হলে বর্গাচাষ ব্যবস্থা পোক্ত হ’ত না। অর্থাৎ কাগজে
কলমে জমির মালিক দেখা দিল বলেই সেই মালিকের কাছ থেকে জমি বর্গা নেবার পরিস্থিতি তৈরি হ’ল।
বর্গাব্যবস্থা হচ্ছে কোন জমির মালিকের কাছ থেকে চুক্তিতে জমি নিয়ে সেই জমিতে চাষবাস করা।
এখানে চুক্তির প্রধান ব্যাপার হ’ল ফসলের হিসাব করা। তেভাগা আন্দোলনের আগে উৎপাদিত ফসলের
বড় অংশই জমির মালিক নিয়ে নিতেন। সেটার পরিমাণ ছিল মোটামুটি তিন ভাগের দুই ভাগ। এই
রকম পরিমাণে ফসল দিয়ে দিতে হ’ত বলে চাষীর অবস্থা দিন দিন নাজুক হতে থাকল। শরীরের
পরিশ্রম, হালের বলদ খাটিয়ে চাষী পেতেন সামান্য পরিমাণ ফসল। আর কোন পরিশ্রম না করেই জমির
মালিক বা জোতদার পেতে থাকলেন সিংহভাগ ফসল। বর্গাচাষীদের সকলেরই পূর্বসূরীরা ছিলেন রায়ত
কৃষক। আগে খাজনা দিতে হ’ত। নতুন ব্যবস্থায় সেটা জমির দাম বা ভাড়া হিসাবে দেয়া লাগল। আর
তাতে পরিমাণটাও আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছিল। অনেক ক্ষেত্রে বর্গার উপচুক্তিও হ’ত। অর্থাৎ
এক পরিবার বর্গা নিয়ে আরো দরিদ্র পরিবারকে সেই কাজ দিচ্ছে এবং লাভের ফসল রেখে দিচ্ছে। এই
মধ্যসত্ত¡ভোগী কৃষক শ্রেণীর কারণে চাষী কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে গেল। এর মধ্যে দুর্যোগ,
চিরস্থায়ী জমিদাররা যেহেতু
ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থের
অনুক‚ল ছিল তাই তাদের রক্ষা
করবার জন্য ব্রিটিশ রাজ এবং
পুলিশ বাহিনী সর্বাত্মক চেষ্টা
চালাত। কৃষক আন্দোলনের
লিখিত ইতিহাস থেকে জানা
যায় এই সময়কালে একাধিক
বড় মাপের কৃষক আন্দোলন
হয়েছিল।
খাতা কলমে প্রধান দাবী ছিল
ফসলের তিন হিস্যার দুইটা
দিতে হবে চাষীকে, যিনি
শারীরিক পরিশ্রম করে ফসল
উৎপাদন করে থাকেন। কিন্তু
এই সংগ্রাম ছিল আসলে জমির
মালিক বড়লোক শ্রেণীর এবং
রাষ্ট্রের নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে
রুখে দাঁড়ানো।
অনাবৃষ্টি, ফসল না হওয়ার মত প্রাকৃতিক আক্রমণ তো আছেই। এটা ঠিক যে বর্গাচাষীদের মধ্য থেকে
অনেক পরিবার পরবর্তীকালে শহুরে লেখাপড়া করা সুবিধা পাওয়া শ্রেণীতে এসেছে। কিন্তু সেটা সাধারণ
কোন অবস্থা নয়। সাধারণ কৃষকদের জীবন মৃত্যুতুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে কৃষকদের মধ্যে এই
জীবন বদলাবার দুর্দান্তআগ্রহ তৈরি হয়েছিল। এক সময়ে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষকরা বিদ্রোহ করতে
শুরু করেন। খাতা কলমে প্রধান দাবী ছিল ফসলের তিন হিস্যার দুইটা দিতে হবে চাষীকে, যিনি
শারীরিক পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করে থাকেন। কিন্তু এই সংগ্রাম ছিল আসলে জমির মালিক
বড়লোক শ্রেণীর এবং রাষ্ট্রের নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
কৃষকদের এই দাবী আদায়ের জন্য তাঁরা সংঘবদ্ধভাবে সভা-সমিতি এবং বিক্ষোভ করতে শুরু করলেন।
ধীরে ধীরে এই কর্মসূচী বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। অবশ্য
উত্তর বাংলাতে আন্দোলনটি বেগবান ছিল বলে লিখিত ইতিহাসে এই অঞ্চলের কথাই বেশি জানা যায়।
এই পদক্ষেপ নেয়ার সাথে সাথেই জমির মালিকরা একদিকে পুলিশ এবং অন্যদিকে ভাড়াটিয়া লাঠিয়াল
দিয়ে কৃষকদের উপর অত্যাচার শুরু করে দিল। অত্যাচার বলতে মারধোর, বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া,
খুন, গুম এবং ধর্ষণ। পুলিশ মারধোর করা ছাড়াও গ্রেফতার করে পুলিশী হেফাজতে নির্যাতন চালাতো
কৃষকদের উপর। জমির মালিকরা আরেকটা কাজ শুরু করেছিল। লাঠিয়াল গুÐা দিয়ে কৃষকদের
উৎপাদিত ফসল জমি থেকে কেটে নিয়ে আত্মসাৎ করত তারা। এর জবাবে কৃষকরাও দল বেঁধে
উৎপাদিত শস্য তুলে নিয়ে আসতেন নিজেদের ভান্ডারে। ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ ইত্যাদি শ্লোগান
জনপ্রিয় হয় তখন থেকেই। কৃষকদের উপর পুলিশী এবং গুণ্ডাবাহিনীর আক্রমণ এতটাই তীব্র হয়েছিল
যে বহু কৃষকের তখন দিনরাত পালিয়ে থাকবার দরকার পড়ত। বিশেষভাবে যাঁরা সংগঠক হিসেবে
পরিচিত ছিলেন। কৃষকরা তখন নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য পুলিশ ও জমির মালিকদের উপর
পাল্টা আক্রমণ শুরু করে দেয়। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশের বিরুদ্ধে কৃষকদের সাহসী লড়াইয়ের
গল্প এখনও ছড়িয়ে আছে। এর সব যদিও সংরক্ষণ করা হয়নি। একদিকে আধুনিক অস্ত্র নিয়ে পুলিশ,
অন্যদিকে কৃষকদের জীবন যাপনের দাবী ছাড়া আধুনিক অস্ত্র বলতে কিছু নেই। কৃষক শ্রেণীর মানুষজন
তখন নিজেদের ঢাল, সড়কি, বল- ম নিয়েই একাধিক যুদ্ধে পুলিশকে পরাস্তকরেছে। তেভাগা
আন্দোলনের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে নারীদের বা কিষাণীদের শক্তিশালী অংশগ্রহণ ছিল। বহু অঞ্চলে
পুরুষদের বেশির ভাগ পালিয়ে ছিলেন এবং পুলিশের সঙ্গে মূল লড়াই হয়েছে নারীদের। আর বাংলাভাষী
ছাড়া অন্য জাতির মানুষ এই আন্দোলনের বড় নির্মাতা ছিলেন: সাঁওতাল, হাজং, বা খাসিয়া। এই কৃষক
আন্দোলন দেখে একদিকে যেমন ব্রিটিশ শাসকরা ভীত হয়েছিল, অন্যদিকে ভীত হয়েছিল বাংলার জমি
মালিক শ্রেণী এবং উঠতি শহুরে শ্রেণী। কারণ কৃষকদের এই সংগ্রাম তাদের স্বার্থের বিপক্ষে ছিল
পরিষ্কারভাবে। তবে জমির মালিক শ্রেণী এবং উঠতি শহুরে শ্রেণীর অনেক সদস্যই কৃষকদের এই ন্যায্য
দাবীর স্বপক্ষে ছিলেন। শহরের রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তাঁরা কৃষকদের দাবী দাওয়াকে সমর্থন
দিতেন কেউ কেউ। এ ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করার কাজ করতেন
তাঁরা। এখানে প্রথমেই আসে সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কথা। এই দলের বাইরেও অনেক
সমাজতন্ত্রী কৃষকদের তেভাগা আন্দোলনকে সহায়তা করে গেছেন। তেভাগা আন্দোলনের কারণেই ইলা
মিত্রের মত নেত্রীর নাম উচ্চারিত হয়। কিন্তু নাম না জানা বহু কৃষক-কিষাণী পুলিশের বা লাঠিয়ালদের
হাতে প্রাণ দিয়েছেন। আর অন্য অনেকে কঠিন নির্যাতনের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন যাঁদের নাম
আমাদের জানার কোন সুযোগ হয়নি।
লিখিত ইতিহাসে এই আন্দোলনের নাম তেভাগা আন্দোলন। যদিও বিভিন্ন অঞ্চলে এর নাম বিভিন্ন
ছিল। যেমন এই আন্দোলন ছড়িয়েছিল বহু অঞ্চলে তেমনি এর ধরন, দাবী দাওয়া এবং নাম হয়েছিল
বিবিধ। কোথাও সাঁওতাল বিদ্রোহ, কোথাও হাজং বিদ্রোহ, কোথাও বা টংকা বিদ্রোহ। খাতা কলমে
তেভাগা লড়াইয়ে কৃষকরা জিতেছেন। বাংলা অঞ্চলে ফসলের ভাগের একটা বন্দোবস্তহয়। কৃষক
আন্দোলনের চাপে রাষ্ট্র সেই ব্যবস্থা নেয়। ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে খাস জমি বণ্টনের দাবীও জোরাল
হয় এই আন্দোলন থেকেই। কিন্তু জমির মালিকানা কিংবা কৃষকের দুর্দশা তাতে বদলায় না। পরবর্তী
চিত্র ১: অবিভক্ত বাংলায় তেভাগা আন্দোলনের মানচিত্র
জমির মালিক শ্রেণী এবং উঠতি
শহুরে শ্রেণীর অনেক সদস্যই
কৃষকদের এই ন্যায্য দাবীর
স্বপক্ষে ছিলেন। শহরের
রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে
তাঁরা কৃষকদের দাবী দাওয়াকে
সমর্থন দিতেন কেউ কেউ। এ
ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলের
কৃষকদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা
করার কাজ করতেন তাঁরা।
এখানে প্রথমেই আসে
সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির
কথা।
সূত্র: পিটার কাস্টার্স (১৯৯২) তেভাগা আন্দোলনে নারী [কৃষ্ণা নিয়োগী অনূদিত], ঢাকা: গণ সাহিত্য প্রকাশনী
কালে কৃষকদের দুর্দশা দেখে তা আমরা বুঝতে পারি। বাংলাদেশে ভূমিহীন চাষীর সংখ্যা দিন দিন
বাড়ছে। এ ছাড়া গ্রাম থেকে ঘর হারানো মানুষ শহরে চলে আসছেন। সেখানে কাজ নেই। শহরে নিতান্ত
অল্প মজুরির কাজ খুঁজছেন তাঁরা। সেটারও কোন নিশ্চিত ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থাই বলে দেয় কৃষকদের
অবস্থা। কিন্তু নিজেদের জীবনের বদল ঘটাবার জন্য উদ্যম ও লড়াই তাঁরা থামাননি।
’৯৫-এর সার আন্দোলন
আধুনিক রাষ্ট্রের আধুনিক ব্যবস্থায় কৃষকের উৎপাদনের অনেক কিছুই বাজারের সঙ্গে যুক্ত। কৃষি ক্ষেত্রে
নতুন প্রযুক্তি আসার কারণে জমির সঙ্গে কৃষকের সম্পর্ক বদলে গেছে। এখন সার, কিটনাশক, কৃত্রিম সেচ
ছাড়া জমিতে ফসল ফলানো যায় না। দীর্ঘ দিন ধরে জমি হতে দেশজ ফসলের বীজ সরিয়ে কৃত্রিম বীজ
চালু করার কারণেই এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। আর এই প্রচলনের জন্য রাষ্ট্র ভূমিকা পালন করেছে। এই
বদলগুলো ঘটানো হয়েছে উচ্চ ফলনের নামে। বীজ ও সার, কিটনাশক, সেচের সরঞ্জাম ইত্যাদির ব্যবসা
বিদেশী কোম্পানিগুলোর হাতে। তারা সর্বক্ষণই এর প্রচার চালিয়েছে এবং গরিব দেশের সরকারকে
এগুলো গ্রহণ করতে প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশ এরকম একটি দেশ। বাস্তবে ফসল বেশি হলেও
কৃষকের জীবনের যে পরিবর্তন ঘটেনি, বরং আরো নাজুক হয়েছে তা উপরের আলোচনাতেই দেখা যায়।
কিন্তু কৃষক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন অনেক কিছুর উপর। এরকম একটি দ্রব্য হচ্ছে সার। চাষের মৌসুমে
চাষীর এটা লাগবেই। ফলে সারের বাজারের সঙ্গে চাষীর জীবন ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। বিশেষভাবে
ছোট চাষী এবং বর্গাচাষীদের জন্য এটা একটা কঠিন পরিস্থিতি যেহেতু তাঁদের হাতে নগদ পয়সা থাকে
কম। আর সারের দাম বেশি হলে তাঁদের ক্ষতির পরিমাণও বেড়ে যায়। এই পরিস্থিতির সুযোগ প্রায়শই
সার ব্যবসায়ীরা নিয়ে থাকেন। তাঁরা চাষের মৌসুমে প্রয়োজনীয় সারের কৃত্রিম টানাটানি বাধিয়ে দেন
কখনো। এর মাধ্যমে সারের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। অথবা অন্য কোন কারণে চাষীদের অবস্থাকে আরো
দুর্দশাগ্রস্তবানিয়ে দেয়া যায়। বড় জমির মালিকদের এই সংকটে পড়ার কোন কারণই নেই। প্রথমত
তাঁদের উদ্বৃত্ত থাকে, দ্বিতীয়ত তাঁরা সাধারণত জমি বর্গা দিয়ে থাকেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই
প্রত্যক্ষভাবে সারের ব্যবসায়ী। ’৯৫ সালে এই রকম একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। ক্ষুদ্র এবং
বর্গাচাষীরা তাঁদের জমিতে চাষের মৌসুমে চাষ শুরু করতে পারছিলেন না। অথচ তাঁরা জানতেন যে
সারের মজুদ আছে। এই পর্যায়ে তাঁরা ন্যায্যমূল্যে সারের দাবীতে বিক্ষোভ শুরু করেন বিভিন্ন অঞ্চলে।
ক্রমশ এটা ছড়িয়ে পড়ে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর সহ বিভিন্ন অঞ্চলে। অনেক জায়গায়
কৃষকেরা সারের গুদাম হতে সার বের করবার চেষ্টাও করেন। তাঁদের এই আন্দোলন দমন করবার জন্য
চিরাচরিতভাবে পুলিশ মোতায়েন করে সরকার ও সার ব্যবসায়ীগণ। পত্র পত্রিকায় জানা যায় ১৫ থেকে
২০ জন চাষীকে গুলি করে মেরে ফেলে পুলিশ। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে কতজন চাষী মারা গেছেন সার চাইতে
গিয়ে তার সঠিক হিসাব পাওয়া মুশকিল।
’৯৮-এর ভূমিহীন আন্দোলন
আগের আন্দোলনটা যেমন প্রধানত বর্গাচাষীদের দ্বারা পরিচালিত একটা আন্দোলন ছিল, এই আন্দোলন
পরিচালিত হয়েছিল ভূমিহীন কৃষকদের দ্বারা। এটা সাতক্ষীরা অঞ্চলে সংঘটিত আন্দোলন। গত এক দেড়
দশকে উপক‚লীয় দক্ষিণ অঞ্চলে চিংড়ি চাষ করবার প্রবণতা বাড়ে। এই চাষ করে ধনী ব্যবসায়ীরা আরো
মুনাফা পেতে পারে। কারণ বিদেশে চিংড়ির ব্যাপক চাহিদা আছে। চিংড়ি চাষের জন্য সাধারণত নিচু জমি
বেছে নিতে হয় যেখানে ধান জন্মে। অনেক এলাকাতে বেশ কিছু জমি চিংড়ি ব্যবসায়ীরা উপযুক্ত মনে
করেছে যেগুলো আবার খাস জমি হিসেবে ভূমিহীনদের দেয়া হয়েছিল। এ সকল জমি দখল করবার জন্য
নানা রকম জোর জবরদস্তি, আইনী ফন্দি বের করেছিল চিংড়ি ব্যবসায়ীগণ। সাতক্ষীরাতে এভাবে প্রচুর
জমি দখল করতে গেছে ব্যবসায়ীরা। যে সকল ভূমিহীনরা সেই জমি ব্যবহার করছিলেন তাঁরা প্রতিরোধ
গড়ে তোলেন। এখানেও সম্মুখ সারিতে নারীরা ছিলেন। এই আন্দোলন দমন করবার জন্যও পুলিশ ও
ভাড়াটিয়া অস্ত্রধারীদের ব্যবহার করা হয়। পত্র-পত্রিকায় জাহেদা নামের একজন নারীর মৃত্যুর খবর আসে।
তিনি মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে। ব্যাপক নির্যাতনের খবর তেমন ভাবে জানতে পারেননি মানুষজন।
বেশ কয়েকজন শিশুকেও হত্যা করা হয় তখন।
কৃষকদের আন্দোলন একটা চলমান বিষয়। কেবল গুটিকতক আন্দোলনের খবর আমরা জানতে পাই।
কিন্তু নিরন্তর নিপীড়িত দশা থেকে মুক্তির জন্য কৃষকেরা নিত্যদিন লড়াই করে চলেছেন মালিক এবং
ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।
সারাংশ
বাংলা অঞ্চলের কৃষক-কিষাণী বিভিন্ন সময়কালে নানান অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।
তবে ব্রিটিশরা এখানে আসবার পরে সেটার অর্থ বদলে যায়। কারণ তার আগে পর্যন্তএই অঞ্চলে জমির
কোন ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। এমনকি রায়তওয়ারী গ্রামগুলোতে জমিদারী শাসনও ছিল না।
ব্রিটিশদের করা আইনে চিরস্থায়ী জমিদার সৃষ্টি হয়। এর বিরুদ্ধে কৃষকদের বিশাল আন্দোলন গড়ে ওঠে
তেভাগা আন্দোলন নামে। জীবন বাজি রেখে লড়ে তাঁরা সেই আন্দোলনের কিছু দাবি আদায় করেন। কিন্তু
কৃষক-কিষাণীর জীবনে খুব বড় বদল আসে না। সা¤প্রতিক কালেও নানা অঞ্চলে তাঁদের আন্দোলনসংগ্রাম-লড়াই চলছে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন -
১। মোঘল যুগে আইনী কাঠামো ছিল ------- নিয়ে।
ক. শিল্প খ. কৃষি
গ. আইন ঘ. বিচার কাঠামো
২। তেভাগা আন্দোলনের স্থায়িত্ব ছিল কত দিন?
ক. ‘৪০-এর দশকের শুরু হতে মাঝামাঝি পর্যন্ত
খ. ‘৫০-এর দশকের শুরু হতে মাঝামাঝি পর্যন্ত
গ. ‘৪০-এর দশকের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত
ঘ. ‘৫০-এর দশকের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত
৩। তেভাগা আন্দোলনের প্রধান দাবী কি ছিল?
ক. উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক দিতে হবে চাষীকে
খ. উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ দিতে হবে চাষীকে
গ. উৎপাদিত ফসলের চার ভাগের তিন ভাগ দিতে হবে চাষীকে
ঘ. উৎপাদিত ফসলের পাঁচ ভাগের চার ভাগ দিতে হবে চাষীকে
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। কৃষক কে?
২। তেভাগা আন্দোলনে কৃষকদের দাবী কী ছিল?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তবাংলার কৃষকদের জীবনে কী ফল বয়ে বনে এনেছিল?
২। ‘সার সংকটের ঘটনাবলী হতে বোঝা যায় রাষ্ট্রের শাসকবর্গ কৃষকদের বিপক্ষে’ Ñ আপনি কি তাই
মনে করেন? আপনার অবস্থান যুক্তি দিয়ে লিখুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত