প্রাক পুঁজিবাদী ও পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতি
কৃষক সমাজের রূপান্তরের প্রশ্নে লেনিন কৃষকদের শ্রেণী পৃথকীকরণ বা কৃষিতে পুঁজিবাদ বিকাশের বৈশিষ্ট্য
নির্ণয় করেন। প্রাক পুঁজিবাদী সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজে উত্তরণের ক্ষেত্রে লেনিন নি¤েœউপস্থাপিত
বৈশিষ্ট্যসমূহের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন (লেনিন-১৮৯৯)১
প্রাক পুঁজিবাদী গ্রামীণ সমাজের বৈশিষ্ট্য পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতি বিকাশের পর গ্রামীণ
সমাজের বৈশিষ্ট্য
১। সমরূপী কৃষক সম্প্রদায়
২। পারিবারিক সদস্যদের সহায়তায় গৃহস্থালীর
খাদ্যের জন্য উৎপাদন
৩। মৈত্রীমূলক কৃষক সম্প্রদায় ও সনাতন সংস্কৃতির
প্রতি আনুগত্য
৪। অর্থনীতি বহিভর্‚ত পদ্ধতিতে শোষণ, বেগার শ্রম,
বন্ধক, মহাজনী সুদ ও বণিকের মূলধনের প্রাধান্য
৫। অসংখ্য ক্ষুদে জোতে উৎপাদন
৬। গ্রামীণ সমাজে সামন্তদাসত্ব বন্ধন টিকে থাকে।
কৃষকগণ ভ‚স্বামীকে দ্রব্য খাজনা ও শ্রম খাজনা
প্রদান করেন।
১। শ্রেণী বিভক্ত কৃষক সমাজ
২। মজুরী শ্রমিকের সহায়তায় বাজারের জন্য
উৎপাদন
৩। শ্রেণী সংগ্রামে দীর্ন গ্রামীণ সমাজ ও চিরায়ত
কৃষক সংস্কৃতির অবসান
৪। উদ্বৃত্ত শ্রম আত্বসাৎ ও পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে
শোষণ, বন্ধক, মহাজনী সুদ ও বণিকের মূলধনের
বিলুপ্তি
৫। জমির মালিকানার পুঞ্জীভবন ও ক্ষুদে জোতের
বিলোপ সাধন করে বৃহদাকার পুঁজিবাদী খামারের
উদ্ভব
৬। শ্রেণী পৃথকীকরণ দাসত্ব বন্ধন দূর করে ও
পুঁজিবাদের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজার সৃষ্টি করে।
টাকায় খাজনা পরিশোধিত হয়।
কৃষক সমাজে অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্নে বিভিন্ন শ্রেণী বৈরী সামাজিক শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আবার
প্রতিটি শ্রেণী সম অর্থনৈতিক স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকে। এই প্রক্রিয়াকে শ্রেণী পৃথকীকরণ বলা হয়ে থাকে।
সাধারণত মার্ক্সসীয় সমাজতত্ব অনুসারে উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা ও উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে
শ্রেণী নির্ধারন করা হয়। বাংলাদেশে গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশ নিয়ে গবেষকগণ বিভিন্ন
মত পোষণ করেন। তবে মোটামুটিভাবে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে কয়েকটি শ্রেণীর অবস্থান স্পষ্ট হয়ে
উঠেছে এ বিষয়ে গবেষকগণ একমত পোষণ করেন।
বিভিন্ন শ্রেণীর কৃষক
বাংলাদেশের গ্রামে ধনী কৃষক, মাঝারী কৃষক, ক্ষুদ্র কৃষক ও মজুরী শ্রমিক শ্রেণীগুলির মধ্যে পৃথকীকরণ
ঘটছে। জমির মালিকানা বন্টন ব্যবস্থায় চরম অসমতা বিরাজ করায় সর্বাধিক পৃথকীকরণ ঘটে ধনী কৃষক
ও মজুরী শ্রমিকের মধ্যে। বলা যায় ধনী কৃষকগণ প্রবল প্রতাপশালী। মাঝারী কৃষকগণ নিজেদের জমি
নিজেরা চাষ করে মোটামুটি স্বচ্ছল। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকগণ অল্প জমি চাষ করে, বর্গাচাষ ও মজুরী শ্রমের
মাধ্যমে কোন রকমে প্রাণ ধারন করেন। ভ‚মিহীন মজুরী কৃষক জমি হারাবার পরও ক্ষেতমজুর হিসেবে
১ খবহরহ ঠও, উবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ ঈধঢ়রঃধষরংস রহ জঁংংরধ, ঈড়ষষবপঃবফ ডড়ৎশং, ১৮৯৯, াড়ষ. ৩,
চৎড়মৎবংং ঢ়ঁনষরংযবৎং, গড়ংপড়,ি ১৯৭২.
জমির মালিকানা বন্টন
য় চরম অসমতা বিরাজ
য় সর্বাধিক পৃথকীকরণ
ট ধনী কৃষক ও মজুরী
শ্রমিকের মধ্যে।
কৃষক সমাজে অর্থনৈতিক
স্বার্থের প্রশ্নে বিভিন্ন শ্রেণী
বৈরী সামাজিক শ্রেণীতে
বিভক্ত হয়ে পড়ে।
জমিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার সংগ্রামে লিপ্ত হন। বর্গাচাষ, বন্ধকী ঋণের ব্যবসা, আধুনিক কৃষি উপকরণের
ব্যবসা, দোকান, মজুতদারী, রাইসমিলের ন্যায় ছোট কারখানা, সরকারী পূর্ত কর্মসূচীতে ঠিকাদারী
ইত্যাদি নানা অর্থকরী বিনিয়োগে ধনী শ্রেণীর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বিত্তশালীগণ উৎপাদনের উদ্বৃত্ত
ও নগদ অর্থ প্রধানত জমি ক্রয়ে ও ঋণ ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেন। বিত্তশালীদের এই বিনিয়োগের ধরন
দরিদ্র শ্রেণীর জন্য অ-কৃষিখাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে না। উপরন্তু ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকগণ তাদের ক্ষুদ্র
জোত বিক্রয়ের জন্য ধনী কৃষকগণের লোভ ও চাপের মুখে পড়েন। এভাবে ধনী কৃষকগণের হাতে জমির
পুঞ্জীভবন ও ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের নিঃস্বকরণ ঘটে। সম্পদশালী ও সম্পদহীনের দুটি বৈরীদলে গ্রামীণ
সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে।
ধনী কৃষকগণের হাতে কৃষি উপকরণ ও প্রযুক্তিও কেন্দ্রীভ‚ত হচ্ছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ ভালো মানের গবাদী
পশু, সনাতন কৃষি যন্ত্রপাতি, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ইত্যাদির উপর তাদের
আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাণিজ্যিক শস্য যেমন আখ, পাট, তামাক ইত্যাদি ধনী কৃষকগণই বেশী চাষ
করেন। অন্যান্য কৃষকগণ পারিবারিক খাদ্যের যোগানের জন্য ধান চাষের উপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে
পড়েন। ধনী কৃষকগণ সেচের আওতাধীন জমি বর্গাচাষীদের কাছ থেকে ফেরত নিয়ে নিজেরা চাষাবাদ
করেন। এমনকি ক্ষুদ্র চাষীর উপর চাপ প্রয়োগ করে তাদের জমি বর্গাচাষের জন্য গ্রহণ করেন। এতে
বর্গাচাষীগণ ভ‚মিহীন হয়ে মজুরী শ্রমের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ক্ষেতমজুরদের পারিশ্রমিক নির্ধারণে
ধনী কৃষকগণ স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেন। শ্রমের বাজার সীমিত হওয়ায় ও ক্ষেতমজুরদের মধ্যে প্রতিযোগিতা
বৃদ্ধি পাওয়ায় মজুরী নিয়ে দর কষাকষির সুযোগ কম। বর্গাচাষে অসম বন্টন ব্যবস্থা ও চুক্তি বাতিল করা
এবং শ্রম আত্বসাৎ পরস্পর বিরোধী শ্রেণী স্বার্থ উন্মোচন করে। অস্বাভাবিক চড়া সুদে মহাজনী ঋণ প্রদান
ও জমি বন্ধক রেখে ঋণ পরিশোধে অসমর্থ প্রান্তিক কৃষককে জমি বিক্রয়ের জন্য চাপ দেওয়া ধনী কৃষকের
জমির মালিকানা বৃদ্ধির উপায়। আর এই নির্যাতনই শ্রেণী দ্ব›েদ্বর অন্যতম কারণ।
গ্রামীণ সামাজিক স্তরবিন্যাসে অর্থনৈতিকভাবে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ধনী শ্রেণী আবার উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বংশ
কৌলিন্যের অধিকারী। জমির মালিকানার সঙ্গে সামাজিক পদ মর্যাদা যুক্ত হয়ে সমাজে বিদ্যমান শ্রেণী
পৃথকীকরণকে বৈধতা দান করে। আত্বীয়তা, গোষ্ঠী সম্পর্কও উচুঁ বংশমর্যাদা ব্যবহার করে সম্পদশালী
শ্রেণী গ্রামীণ রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেন। দরিদ্র হওয়ার কারণে যারা নীচু মর্যাদার অধিকারী
তাদের কার্যকর পথ হচ্ছে বাড়ীর ‘মুরুব্বী’, পাড়ার ‘সর্দার’, গ্রামের ‘মাতব্বর’গণের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শণ।
ধনী শ্রেণী কর্তৃক স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, ইউনিয়ন পরিষদ, রাজনৈতিক দল শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান
ইত্যাদির সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা কাঠামো শক্তিশালী হয়ে উঠে। একই সঙ্গে
ধনী ও দরিদ্র কৃষকের মধ্যে আধিপত্যবাদী ও আনুগত্যের সম্পর্ক পাকাপোক্ত হয়। নৈর্ব্যক্তিক
(রসঢ়বৎংড়হধষ) বাজার ব্যবস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক (ভড়ৎসধষ) প্রশাসন ও গণতান্ত্রিক ইউনিয়ন পরিষদ নতুন
ধরনের মূল্যবোধের কথা বললেও এগুলিকে দরিদ্রদের পক্ষে পরিবর্তন সূচনা করতে দেখা যায় না। গ্রাম
পর্যায়ের ব্যক্তিক (ঢ়বৎংড়হধষ), মুখোমুখি (ভধপব ঃড় ভধপব) ও দাতা-গ্রহীতা (ঢ়ধঃৎড়হ-পষরবহঃ)-এর
সম্পর্ককে কেন্দ্র করে যে শ্রেণী পৃথকীকরণ ঘটে, উভয় (প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক) ক্ষমতা পরিসরে
তা বলবৎ থাকে। পূর্বে দাতা বা প্যাট্রন হিসেবে ক্ষমতা চর্চার জন্য তাদেরকে বর্গাচাষ, কর্মসংস্থান, আর্থিক
সাহায্য, খাদ্য বন্টন, সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে দেখা যেতো। ধীরে ধীরে দাতা-গ্রহীতার সম্পর্কে গুণগত
পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। উচ্চ শ্রেণী হিসেবে গ্রাম পর্যায়ে ক্ষমতা সুসংহত হওয়ায় এবং রাষ্ট্র পর্যন্তক্ষমতার
যোগাযোগ বিস্তৃত হওয়ায় ক্ষমতাশালী শ্রেণীকে পিতৃসুলভ (ঢ়ধঃবৎহধষরংঃরপ) ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা
যায় না। তবে পৃথকীকৃত শ্রেণীগুলির শোষক-শোষিতের সম্পর্কআড়াল করার জন্য দাতা-গ্রহীতার মতাদর্শ
বলবৎ থাকে।
শ্রেণীকরণ নিয়ে বিতর্ক
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে শ্রেণী বিভক্তিকরণ পর্যবেক্ষণ করে অনেক গবেষক যুক্তি প্রদান করেন যে কৃষি
অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিস্তার লাভ করছে। তাদের প্রধান যুক্তি হচ্ছে যে বাংলাদেশের কৃষকসমাজ
সমাজ বিজ্ঞানীদের অমনে করেন যে, কৃষি অর্থনীতিতে পুঁজিবাদীবিস্তার লাভ করছে।
গ্রামীণ সামাজিক স্তরবিন্যাসে
অর্থনৈতিকভাবে উচ্চ
ক্ষমতাসম্পন্ন ধনী শ্রেণী
আবার উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন
বংশ কৌলিন্যের অধিকারী।
শ্রেণী বিভেদহীন সমসত্তা বিশিষ্ট সমাজ নয়। লেনিনের শ্রেণী পৃথকীকরণ তত্তে¡র ন্যায় এখানে সচেতন
ভাবে ধনী কৃষক ও দরিদ্র সর্বহারা কৃষক দ্ব›দ্বমূলক অবস্থান গ্রহণ করেনি। কিন্তু কৃষক পারিবারিক খামারের
ধারণার ব্যাপক বদল ঘটেছে। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ রাষ্ট্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থা
প্রতিষ্ঠা করছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষক সমাজে ধনী শ্রেণী ও দরিদ্র শ্রেণী যথাক্রমে শোষক ও শোষিত
শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। এই দুটি শ্রেণী বিপরীতমুখী দ্ব›দ্বরত দলে পরিণত হচ্ছে। বোরহান উদ্দীন
খান জাহাঙ্গীরের (১৯৭৯)২ মতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কৃষি থেকে উৎপাদিত মূলধন দেশের বাইরে
পাচার না হয়ে গ্রামাঞ্চলে সৃষ্টি হয়ে সেখানেই আবর্তিত হচ্ছে। শ্রেণী প্রভেদ বৃদ্ধি পেয়ে ‘কুলাক’দের (ধনী
ও ক্ষমতাশালী কৃষক) হাতে যে ম‚লধন জমা হয়েছে তা তারা পুঁজিবাদী কৃষি খামারে বিনিয়োগ করছেন।
রাষ্ট্রীয় কৃষি নীতি ধনী শ্রেণীকে সহযোগিতা করছে পাওয়ার পাম্প, বীজ, সার, ঋণ প্রভৃতি কৃষি উপকরণ
সহজ শর্তে সরবরাহ করার মাধ্যমে। আতিউর রহমান (১৯৮৬)৩ এর মতে উৎপাদনের উপায়ের
মালিকানার ভিত্তিতে শ্রেণী বৈষম্য দ্রæতবেগে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি মনে করেন মজুরী শ্রমের ব্যাপক নিয়োগ
কৃষিতে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। তাছাড়া দরিদ্র ও ভ‚মিহীন কৃষকগণের সঙ্গে ধনী
কৃষকগণের উৎপাদনের সামাজিক সম্পর্কও বিনিময় ব্যবস্থা বিপরীতমুখী স্বার্থের ইঙ্গিত বহন করে।
জাহাঙ্গীরের মত তিনিও মনে করেন যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র শ্রমকে মূলধনের অধীনস্তকরার মাধ্যমে শ্রেণী
পৃথকীকরণকে ত্বরান্বিত করছে। গ্রামীণ পুঁজিবাদী শ্রেণীর বিকাশ রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল।
অনেক গবেষক যারা বাংলাদেশের কৃষক সমাজে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা বিকশিত হচ্ছে না বলে মনে
করেন তারাও একমত যে এখানে শ্রেণী পৃথকীকরণ দ্রæত ঘটছে। তাদের মতে বাংলাদেশের কৃষক সমাজে
ঔপনিবেশিক পদ্ধতি, প্রাক পুঁজিবাদী অথবা আধা সমান্ততান্ত্রিক পদ্ধতি বিরাজ করছে। বাংলাদেশের
গ্রামাঞ্চলে আত্বীয় সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে যে সমাজ সংগঠন ও পারিবারিক কৃষি খামার গড়ে উঠে তা
কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বংশ ও গোষ্ঠী আধিপত্য ও উৎপাদনের উপায়ের উপর
নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো গড়ে তোলে। আবু আব্দুল্লাহ (১৯৭৬)৪
যুক্তি প্রদর্শন করেন যে
ভ‚স্বামী-রাইয়ত, মহাজন-খাতক, পোষক- পোষ্য এধরনের সম্পর্কগুলি কৃষক শ্রেণী সম্পর্কের মধ্যেও
ক্রিয়াশীল থাকে। জেফ উড (১৯৭৮)৫ এর মতে কৃষি অর্থনীতিতে শ্রেণী প্রভেদ ক্রিয়াশীল হচ্ছে সুদযুক্ত
মূলধন ও মহাজনী ব্যবসার কারণে এবং মহাজনী ঋণই শ্রেণী দ্ব›েদ্বর প্রধান কারণ।
বিভিন্ন কৃষক সমীক্ষায় গ্রামীণ রাজনীতিতে বিত্তশালীদের ক্ষমতার লোভ, চক্রান্ত, হিংস্রতা ও এক কথায়
তাদের শ্রেণী চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে। বিত্তশালীগণ শ্রেণী, মর্যাদাভোগী দল ও বংশ ইত্যাদি বর্গে প্রবিষ্ট
হয়ে থাকায় একটি জটিল ক্ষমতা কাঠামো সৃষ্টি হয়। এই জটিলতা ব্যাখ্যা করে জাহাঙ্গীর (১৯৮১)৬
লিখেন যে গ্রামীণ ক্ষমতা চর্চায় সম্প্রদায় ও শ্রেণী কাঠামো এই পরস্পর বিরোধী কাঠামো দুটির ঐক্য
প্রতিষ্ঠিত হয়। অধস্তন বংশগুলি প্রবল বংশ দ্বারা শোষিত হয়। প্রবল বংশ গুলির স্বচ্ছল পরিবারগুলি একই
সঙ্গে নিজেদের এবং অধস্তন বংশগুলির অস্বচ্ছল পরিবার গুলিকে সম্প্রদায়ের নামে কাঠামোর ভেতর শোষণ
করে। এই শোষণ ক্রিয়াশীল থাকার কারণ কৃষি অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে গ্রামীণ সমাজে
মেরুকরণ ঘটছে। এই মেরুকরণের এক দিকে আছে ধনী কৃষক ও অন্য দিকে সর্বহারা কৃষক।
সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকে
মনে করেন যে, কৃষক
সমাজে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা
বিকশিত হচ্ছে না। তবে
এখানে শ্রেণী পৃথকীভবন
দ্রæত ঘটছে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে শ্রেণী পৃথকীকরণকে অনেক গবেষক ঔপনিবেশিক উৎপাদন পদ্ধতি
(পড়ষড়হরধষ সড়ফব ড়ভ ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ) দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে
ভ‚মিতে ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়, ভ‚মি একটি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হয় এবং ভ‚মি থেকে
ঔপনিবেশিক শাসকগণ বিপুল অর্থ রাজস্ব হিসেবে আত্বসাৎ করে। জমিতে ধান ব্যতীত বাণিজ্যিক শস্য
যেমন পাট, তুলা, নীল চাষ হয়। কৃষি থেকে উৎপাদিত মূলধন গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ না হয়ে
বিদেশে পাচার হয়ে যায়। গ্রামীণ শিল্প ধ্বংস করা হয়। এভাবে কৃষি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া মানুষের
বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ না থাকায় একটি নিঃস্বশ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাংলার
গ্রামগুলি কাঁচামালের যোগানকারী হিসেবে ইংল্যান্ডের পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু এই
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনুপ্রবেশ বাংলার গ্রামে বিরাজমান প্রাক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে পরিবর্তিত না করে
শিলীভ‚ত করে ফেলে। গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান অসম বন্টন ব্যবস্থা প্রকট আকার ধারণ করে। উপরন্তু
একটি নতুন ভ‚স্বামী মহাজন শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটায় ঋণের জালে দরিদ্র কৃষকদের বন্দী করে এই শ্রেণীটির
আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ঔপনিবেশিকতা বিরোধী আন্দোলন ও হিন্দু জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে
আন্দোলন ভিন্ন রাজনীতির ধারায় প্রবাহিত হওয়ায় গ্রামাঞ্চলের শ্রেণী পৃথকীকরণের বিষয়টি ঢাকা পড়ে
যায়।
পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরও গ্রামাঞ্চল থেকে উদ্বৃত্ত আত্বসাৎ করে দেশের বাইরে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার
করার ধারা অব্যাহত থাকে। পাকিস্তান সরকার পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে উন্নয়ন কার্যক্রম চালু করে এবং
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল থেকে পাটসহ অন্যান্য কৃষি পণ্যের উদ্বৃত্ত স্থানান্তর করে। অন্য দিকে জমিদারী প্রথা
উচ্ছেদের পর হিন্দু জমিদারদের স্থলাভিষিক্ত হয় মুসলমান জোতদার ও মহাজনগণ। গ্রামের কৃষক সমাজের
স্বার্থ রক্ষা করার জন্য কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। ফলে রাষ্ট্রীয় শোষণ ও স্থানীয় বিত্তশালীদের নির্যাতনের
চাপে পড়ে গ্রামাঞ্চলে পৃথকীকরণ তীব্র হয়ে উঠে। আর সাধারণ কৃষকগণ জমি থেকে নিজেদের খোরাকী
যোগাড় করতে না পেরে আত্বসংকোচনের নীতি গ্রহণ করে দারিদ্রের মধ্যে জীবন যাপন করেন। কিন্তু
পাকিস্তান শাসনামলেও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের রাজনীতি মুখ্য হয়ে উঠার ফলে গ্রামাঞ্চলে শ্রেণী শোষণের
বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গ্রামাঞ্চলের কৃষি উদ্বৃত্ত আর দেশের বাইরে স্থানান্তরিত হচ্ছে না কিন্তু দেশের
ভেতরে অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতার (রহঃবৎহধষ পড়ষড়হরধষরংস) অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের
প্রকৃতি পর নির্ভরশীলতার। বাংলাদেশ কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী দেশসমূহের প্রান্তিক
দেশ হিসেবে কাজ করে। সুতরাং বিদেশী সাহায্যপুষ্ট বাংলাদেশের সরকার বিদেশীদের নির্দেশনার
আলোকে অধিকাংশ সিদ্ধান্তগ্রহণ করে থাকে। গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কও একই ভাবে
পরিচালিত হচ্ছে যাতে গ্রামাঞ্চলের অবস্থান প্রান্তিক। সরকারী নানাবিধ নীতির মাধ্যমে গ্রামাঞ্চল বৃহত্তর
অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু শহর, আমলাতন্ত্র, পুঁজি, প্রবৃদ্ধি ও ভ‚স্বামীদের প্রতি
রাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্বের দরুন গ্রামাঞ্চল অর্থনৈতিক বন্টনে পিছিয়ে পড়ে। বাংলাদেশের প্রায় ৯০% মানুষ
গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন। ৮০% কর্মসংস্থান হয় কৃষিতে। রপ্তানীর ৯০% কৃষিপণ্য ও কাঁচামাল গ্রামে
উৎপাদিত হয়। কিন্তু দেখা যায় যে সরকারী ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে কেবল ১৫% এর মত কৃষির উন্নয়নের
জন্য দেয়া হয়। সরকারী ব্যয়ের সিংহ ভাগ বরাদ্দ থাকে এমন সব খাতে যাতে শহরগুলি উপকৃত হয়।
ব্যাংক গুলির কেবল ১১% এর মত কৃষি ঋণে বিনিয়োগ হয়। কৃষি খাতে ব্যক্তিগত বিনিয়োগের পরিমাণ
কেবল ১১% এর মত। এর অর্থ কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত স্থানান্তর হচ্ছে অথচ কৃষি উন্নয়নের জন্য
পুনর্বিনিয়োগ হচ্ছে না। স্বভাবতই গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর প্রভাব মারাত্বক নেতিবাচক।
শহর, আমলাতন্ত্র, পুঁপ্রিবৃদ্ধি, ভ‚-স্বামীদের প্রবাংলাদেশ রাষ্ট্রের
পক্ষপাতিত্বের দরুন ্রঅর্থনৈতিক বন্টনে পিপড়ে।
উদাহরণ স্বরূপ বাংলাদেশের কৃষকের হাঁড়ভাঙ্গা শ্রমের বিনিময়ে উৎপাদিত ফসল চালের শহরে স্থানান্তর
বিষয়টি দেখা যেতে পারে (জেনসেন ১৯৮৭)৭ । একটি গ্রামে যত চাল উৎপাদিত হয় তার প্রায় ষাট
ভাগের মত স্থানীয় বাজারে বিক্রয় হয়। বাকী চালের সিংহভাগ ধনী কৃষকগণ নিজেদের ভোগের জন্য
গুদামজাত করেন। যত চাল স্থানীয় বাজারে বিক্রিত হয় তার অধিকাংশ শহরে স্থানান্তরিত হয়। ধনী
কৃষকগণ চালের খুব সামান্য অংশ মজুরী হিসেবে প্রদান করেন যাতে ক্ষেতমজুরদের খোরাকী হয় না।
ফলে স্থানীয় বাজার থেকে চালের ক্রেতা ক্ষেতমজুর ও ক্ষুদ্র কৃষক যাদের খোরাকীর জন্য যথেষ্ট চাল
নিজেদের উৎপাদন থেকে আসে নি এবং মজুরী হিসেবে বন্টিত হয় নি। শহরের সঙ্গে বিনিময় সম্পর্ক
দেখলে স্পষ্ট হয় যে গ্রাম থেকে উৎপাদিত যত চাল শহরে আসে এর বিনিময়ে শহর থেকে গ্রামে কি
ধরনের পণ্য প্রেরিত হয়। শহরে শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদিত পণ্য ক্রয়ের জন্য গ্রামের দরিদ্র কৃষকের আর্থিক
সঙ্গতি নেই। তবে সরকার ভর্তুকীকৃত কৃষি উপকরণ গ্রামে প্রেরণ করেন। কিন্তু এতে গ্রামের সম্পদশালীগণ
উপকৃত হন। এতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে গ্রামাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ চাল উৎপাদিত হলেও এবং
বাংলাদেশ চাল রপ্তানীকারক দেশে পরিণত হলেও, বন্টন ব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে চালের উৎপাদক
দরিদ্রকৃষকগণকে অর্ধাহার ও অনাহারেই দিন কাটাতে হবে। কারণ চাল ক্রয়ের সামর্থ তাদের নেই।
রাষ্ট্রের ভ‚মিকা
বাংলাদেশে গ্রামীণ সমাজে শ্রেণী পৃথকীকরণের ফলে যে বিত্তশালী শ্রেণীটি উত্তরোত্তর ক্ষমতাবান হয়ে
দরিদ্র কৃষকদের প্রতি নির্যাতনমূলক ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে তাতে রাষ্ট্রের শাসক গোষ্ঠীর সমর্থন আছে।
উদাহরণস্বরূপ সরকারের কৃষি রাজস্বের নীতি উল্লেখযোগ্য। আইনত ২৫ বিঘার উর্ধে জমির মালিকদের
কৃষি রাজস্ব প্রদান করার কথা। কিন্তু ধনী শ্রেণীর মালিকগণ নানা উপায়ে জমির মালিকানা গোপন করে
থাকেন। দেখা যায় যে কৃষিতে যদিও উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হয় তথাপি এই খাত থেকে রাজস্ব আদায় ২% এর ন্যায়।
কৃষি খাত থেকে উৎপাদনের উদ্বৃত্তের উপর কর আরোপ করা হলে এই অর্থ গ্রামের সাধারণ কৃষকদের
উন্নয়নে ব্যয় করা সম্ভব হতো। তা না হওয়ায় ধনী কৃষকগণ তাদের উদ্বৃত্ত মহাজনী সুদ, ফড়িয়া, মজুতদারী
ইত্যাদি ব্যবসায় নিয়োজিত করে সহজে অধিক অর্থ উপার্জন করছেন। এসব ব্যবসা দরিদ্র বিরোধী এবং
এগুলি শ্রেণী পৃথকীকরণে সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
কৃষিতে প্রবৃদ্ধির জন্য সরকারী নীতি দরিদ্রদের প্রতিক‚লে কাজ করে এবং শ্রেণী পৃথকীকরণ বৃদ্ধি করে।
উদাহরণস্বরূপ সরকারের উচ্চফলনশীল বীজ (যরময ুরবষফরহম াধৎরবঃু) চাষের নীতি উল্লেখ করা যায়।
উফশী চাষের জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োজন হয় যা সরকার ভর্তুকী মূল্যে সরবরাহ করে।
কিন্তু প্রশাসনের যোগসাজশে ধনী শ্রেনীর কৃষকগণ এসব উপকরণ নিজেদের ব্যবহারের জন্য স্বল্প মূল্যে
লাভ করেন এবং এগুলির ব্যবসায়ে লিপ্ত হন। এই নীতির প্রভাবে ধনী কৃষকগণের দুই ভাবে লাভ হয়।
অন্য দিকে দরিদ্র কৃষকগণকে এসব উপকরণ কালোবাজার থেকে অধিক মূল্যে ক্রয় করতে হয়। আরও
লক্ষণীয় যে সেচের জন্য হস্তচালিত পাম্প ও শ্যালো মেশিন স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায় এবং এগুলি শ্রমঘন
হওয়ায় দরিদ্র শ্রেণীর বেশী উপকারে আসে। কিন্তু সরকার বেশী মূল্যবান পুঁজিঘন ডিপ-টিউবওয়েল
বসানোর নীতি গ্রহণ করেছে যাতে বৈদেশিক সাহায্য সংস্থার প্রভাব কাজ করেছে। এই সেচ ব্যবস্থা পুঁজিঘন
হওয়ায় সমবায় গঠন করা হয়, যার উপর ধনী শ্রেণীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারা “জল প্রভু”তে পরিণত
হন। সমবায়ের মাধ্যমে দরিদ্র কৃষকগণের জমিতে পানি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে তাদেরকে জমি বিক্রয়ে
বাধ্য করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এই নতুন কৃষি প্রযুক্তির ফলে ফসল বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং
কৃষিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়ায় ধনী কৃষকগণ তাদের নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি পরিবর্তন করেন। সেচের আওতায়
বর্গাচাষের জমি তারা ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের তত্ত¡াবধানে চাষের সিদ্ধান্তগ্রহণ করেন। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি
পায় বলে তারা কৃষি মজুরীর হার কমিয়ে দেন। এভাবে নতুন কৃষি প্রযুক্তির ফলে দরিদ্র কৃষকগণ ক্ষতিগ্রস্ত
হন। অন্য দিকে উৎপাদন বৃদ্ধি ও মজুরী কমে যাওয়ায় ধনী কৃষকগণ অতিরিক্ত লাভবান হন। নতুন প্রযুক্তি
৭
ঔধহংবহ ঊএ, জঁৎধষ ইধহমষধফবংয: ঈড়সঢ়বঃরঃরড়হ ভড়ৎ ঝপধৎপব জবংড়ঁৎপবং, টচখ, উযধশধ, ১৯৮৭.
গ্রামীণ সমাজে শ্রেণী
পৃথকীকরণের ফলে যে
বিত্তশালী শ্রেণীটি ক্ষমতাবান
হয়ে দরিদ্র কৃষকের প্রতি
নির্যাতনমূলক ভ‚মিকায়
অবতীর্ণহচ্ছে তাতে রাষ্ট্রের
শাসক গোষ্ঠীর সমর্থন আছে।
প্রয়োগের জন্য অধিক অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় দরিদ্র কৃষকগণ ঋণের জন্য ধনী কৃষকগণের উপর
নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তাছাড়া এই প্রযুক্তিতে পরিবেশ দূষিত হওয়ার কারণেও দরিদ্র কৃষকগণ ক্ষতিগ্রস্ত
হন। জানা যায় যে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের কারণে জমি ও পানি দূষিত হওয়ায় উদ্ভিদের জন্ম ও
মাছের প্রজনন নষ্ট হয়ে যায়। এইসব উদ্ভিদ ও মাছ দরিদ্র কৃষকগণ বিনা মূল্যে সংগ্রহ করতে পারতেন।
উচ্চ ফলনশীল বীজে ধানের গাছ উচ্চতায় বেটে হওয়ায় খড় পাওয়া যায় না। এইসব খড় দরিদ্র কৃষকগণের
ঘর নির্মাণের জন্য ও গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
সারাংশ
মার্ক্সসীয় সমাজতত্বে উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা ও উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে শ্রেণী নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে ধনী কৃষক, মাঝারী কৃষক, ক্ষুদ্র কৃষক ও মজুরী শ্রমিক শ্রেণীগুলির মধ্যে পৃথকীকরণ ঘটছে। সর্বাধিক
পৃথকীকরণ ঘটছে ধনী কৃষক ও মজুরী শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে। ভ‚মির মালিকানা ব্যবস্থা অসম এবং অল্প সংখ্যক ধনী
কৃষক অধিক জমির মালিক। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকগণ দারিদ্রের কারণে ক্ষুদ্র জোত ধরে রাখতে পারেন না। ধনী
কৃষকগণের হাতে জমির পুঞ্জীভবন ঘটে এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের নিঃস্বকরণ ঘটে। ধনী কৃষকগণের হাতে কৃষি
উপকরণ ও প্রযুক্তিও কেন্দ্রীভ‚ত হচ্ছে। ধনী কৃষকগণ তাদের উদ্বৃত্ত কৃষি উপকরণসহ নানাবিধ ব্যবসায় বিনিয়োগ
করেন। জমির মালিকানার সঙ্গে বড় গোষ্ঠী ও বংশ মর্যাদা যুক্ত হয়ে ধনী কৃষকগণের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
তারাই গ্রামীণ এলিট (ক্ষমতাশালী)। তারা গ্রামে সামাজিক রীতি নীতি বাস্তবায়ন করেন ও বিচার কার্য পরিচালনা
করেন। স্থানীয় প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদে গ্রামীণ এলিটগণই যোগাযোগ বৃদ্ধি করে ক্ষমতা চর্চা করেন। রাষ্ট্রীয়
ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে তাদের সম্পর্কপ্রতিষ্ঠিত হয়। তারা সহজেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পান। বিত্তশালী ও
ক্ষমতাশালী শ্রেণীটি দরিদ্র কৃষকের প্রতি নির্যাতনমূলক ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। বিভিন্ন কৃষক সমীক্ষায় গ্রামীণ
রাজনীতিতে বিত্তশালীদের ক্ষমতার লোভ, চক্রান্ত, হিংস্রতা অর্থাৎ তাদের শ্রেণী চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন -
১। কোন দুইটি শ্রেণীর মধ্যে সর্বাধিক পৃথকীকরণ ঘটে?
ক. ধনীকৃষক ও মাঝারী কৃষক
খ. মাঝারী কৃষক ও ক্ষুদ্র কৃষক
গ. ধনী কৃষক ও ক্ষুদ্র কৃষক
ঘ. ধনী কৃষক ও মজুরী শ্রমিক
২। বাণিজ্যিক শস্য কারা বেশী চাষ করেন?
ক. প্রান্তিক কৃষক
বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
সমকালীন বাংলাদেশ : সমাজ ও সংস্কৃতি পৃষ্ঠা-৬৫
খ. মাঝারী কৃষক
গ. ধনী কৃষক
ঘ. কৃষক সমবায় সমিতি
৩। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কৃষি থেকে উৎপাদিত মূলধন কোথায় জমা হচ্ছে?
ক. শিল্পপতিদের হাতে
খ. ধনী কৃষক বা কুলাকদের হাতে
গ. ভারতে চলে যাচ্ছে
ঘ. স্থানীয় প্রশাসকদের হাতে
৪। উচ্চ ফলনশীল বীজসহ নতুন কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় কিন্তু মজুরী
শ্রমিকদের লাভ হয় না কেন?
ক. ধনী কৃষকগণ নিজেরাই চাষাবাদ শুরু করেন
খ. ধনী কৃষকগণ মজুরীর হার কমিয়ে ফেলেন
গ. ধনী কৃষকগণ কম লোক নিয়োগ করেন
ঘ. মজুরী শ্রমিকগণ শহরে চলে আসেন
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের শ্রেণীগুলি চিহ্নিত করুন। কিভাবে শ্রেণী পৃথকীকরণ ঘটছে?
২। প্রাক পুঁজিবাদী ও পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য কি?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে শ্রেণী বিভক্তিকরণ নিয়ে সমাজ বিজ্ঞানীদের বিতর্কের প্রধান যুক্তিগুলি কি
কি? এ বিষয়ে আপনার মতামত লিখুন।
২। ঔপনিবেশিক উৎপাদন পদ্ধতি কি? বাংলাদেশে গ্রাম ও শহরের সম্পর্ককিভাবে শোষণমূলক?
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত