ভূমি সংস্কারে কৃষি অর্থনীতির কোন কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত?
২। বাংলাদেশে ভূমি সংস্কারের গুরুত্ব কি?

ভ‚মি সংস্কার
ভ‚মির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ফলে যে উৎপাদন হয় সে সম্পর্কে পরিবর্তন আনয়নই ভ‚মি সংস্কার। অর্থাৎ
ভ‚মির সঙ্গে মানুষের, উৎপাদনী নানাবিধ শক্তির সঙ্গে মানুষের এবং উৎপাদক হিসেবে মানুষের সঙ্গে
মানুষের যে সকল সম্পর্কস্থাপিত হয়, ভ‚মি সংস্কার সেইসব সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটানোর পদক্ষেপ।
ভ‚মি সংস্কারের প্রশ্নে থর্ণার (১৯৫৬)১
নি¤েœ উপস্থাপিত বিষয়গুলির উপর গুরুত্ব প্রদান করেন যা
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
১। ভ‚মির মালিকানা ও তার বন্টন।
২। চাষাবাদের শর্ত। যেমন মালিককে দেয় খাজনা; রাজস্বের পরিমাণ ও পদ্ধতি; প্রকৃত চাষী ও জমির
মালিকের মধ্যে অবস্থিত মধ্য স্বত্ব ভোগীদের বৈশিষ্ট্য; প্রজা স্বত্বের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব ইত্যাদি।
৩। ভ‚মির একত্রীকরণ অথবা বিখন্ডীকরণ।
৪। চাষাবাদের সংগঠন। যেমন সমবায়, যৌথ খামার অথবা পারিবারিক খামার ইত্যাদি।
৫। জমির মালিকানা, উৎপাদিত পণ্যের অধিকার ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের ভ‚মিকা।
ভ‚মি সংস্কারের গুরুত্ব
বাংলাদেশে ভ‚মি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে সকল মহলে স্বীকৃত।
এ বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি যেমন হচ্ছে তেমনি সকল সরকার ভ‚মি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে মৌখিক
স্বীকারোক্তি প্রদান করে থাকেন। আংশিক ভাবে কিছু কিছু সংস্কারমূলক নীতিও প্রণীত হয়েছে। পুঁজিবাদী
ব্যবস্থায়ও ভ‚মি সংস্কার আবশ্যক। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটি আরো গুরুত্ব বহন করে থাকে। এর প্রধান
কারণ উৎপাদন বৃদ্ধি। দ্বিতীয় কারণ উৎপাদিত পণ্যের বন্টনে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশে কৃষি
উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে বিদ্যমান ভ‚মির মালিকানা ও ভ‚মির ব্যবহার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা জরুরী।
বাংলাদেশে জমির মালিকানায় যেমন অসমতা বিরাজ করছে তেমনি উৎপাদন সম্পর্কনির্যাতনমূলক হয়ে
উঠেছে। এই অসম ও নির্যাতনমূলক অবস্থায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে ও দারিদ্র বৃদ্ধি পাচ্ছে। বলা যায়
কৃষিতে এক ধরনের স্থবিরতা টিকে আছে যা ঔপনিবেশিক শাসনের ফলাফল। বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিদ্যমান
গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার জন্য তৎপর। কৃষি উৎপাদনে স্থবিরতার মধ্যে ধনী শ্রেণীর কাছে
জমির কেন্দ্রীভবন ঘটছে এবং প্ুঁজির পুঞ্জীভবন হচ্ছে। এর ফলে গ্রামীণ সমাজে শ্রেণী পৃথকীকরণ দ্রæত
ঘটছে এবং মেরুকরণ হচ্ছে। সর্বোপরি দারিদ্র চরম আকার ধারণ করেছে। এসকল কারণে কৃষি উৎপাদন
বৃদ্ধি করে শিল্পেৎপাদনের সঙ্গে সমন্বিত সংযোগ ঘটানো প্রয়োজন। তাহলে জমি থেকে ঝরে পড়া ভ‚মিহীন
কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের আয় উপার্জনের ব্যবস্থা হতে পারে। বর্তমান কৃষি কাঠামো উৎপাদন বৃদ্ধি ও
বন্টনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে বড় অন্তরায়। এ সকল কারণে ভ‚মি সংস্কারের বিষয়টিতে অগ্রাধিকার
দেয়া প্রয়োজন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মোঘল শাসনামলের পূর্বে দুই ধরনের গ্রামীণ ভ‚মি ব্যবস্থাপনার কথা জানা যায়। প্রথমত: এক ধরনের গ্রাম
ছিল যেখানে কৃষক নিজের শ্রম দিয়ে খোরাকীর জন্য চাষাবাদ করতেন। এ ধরনের রায়তী গ্রামের
কৃষকদের খাজনা দিতে হতো না। তবে জমিতে ব্যক্তি মালিকানা ছিল না। রায়তী গ্রামের বিশেষত্ব হচ্ছে
এই ধরনের গ্রামে জমিদারী শাসন ছিল না। দ্বিতীয়ত: এক ধরনের ভ‚মি ব্যবস্থাপনার কথা জানা যায় তাতে
কৃষকের চাষকৃত জমির উপর অধিকার ছিল কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। তাদেরকে রাজার জন্য

১ ঞযড়ৎহবৎ উধহরবষ, চবধংধহঃ ঊপড়হড়সু ধং ধ ঈধঃবমড়ৎু রহ ঊপড়হড়সরপ ঐরংঃড়ৎু” রহ ঞ. ঝযধহরহ
(বফ) চবধংধহঃং ধহফ চবধংধহঃ ঝড়পরবঃরবং, চবহমঁরহ ইড়ড়শং, ঐধৎসড়হফং ড়িৎঃয, ১৯৭৬.
বর্তমান কৃষি কাঠামো,
উৎপাদন বৃদ্ধি ও বন্টনে ন্যায়
বিচার প্রতিষ্ঠার পথে বড়
অন্তরায়। এ সকল কারণে ভূমি
সংস্কারের বিষয়টিতে
অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন।
কর প্রদান করতে হতো। প্রকৃত কৃষক ও রাজার মাঝে তিন ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী ছিল। এক, জমিদার
বা জায়গীরদার যারা রাজার পক্ষ থেকে কর সংগ্রহ করে রাজাকে প্রদান করতেন। দুই, গ্রাম প্রধান যিনি
গ্রাম পরিচালনার জন্য ফসলের অংশ সংগ্রহ করতেন। তিন, সরকারী কর্মচারী যারা বেতন হিসেবে ফসলের
অংশ সংগ্রহ করতেন। মোঘল শাসনামলে এ ব্যবস্থার কোন উল্লেখযোগ্য বদল ঘটেনি, যদিও ভ‚মি রাজস্ব
সংগ্রহের জন্য জমিদার ও জায়গীরদারদের উপর প্রশাসনিক চাপ বৃদ্ধি করা হয়।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভ‚মি ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আনা হয়। এর ফলে স্বাধীন কৃষকগণ জমিদারের
উপর নির্ভরশীল প্রজায় পরিণত হন। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বৃটিশ শাসকগণ ইংল্যান্ডের
অনুরূপ ভ‚মিব্যবস্থা বাংলায় প্রতিষ্ঠিত করে। জমিদারগণকে ভ‚মির মালিকানা প্রদান করা হয় এবং তাদেরকে
ভ‚মি হস্তান্তর করার ও বন্ধক দেয়ার অধিকার দেয়া হয়। জমিদারদের ভ‚মির মালিকানা চিরস্থায়ী এই অর্থে
যে তারা বংশপরম্পরায় ভ‚মির মালিক হতে পারবেন। এ অধিকারের বিনিময়ে জমিদারগণ প্রজাদের কাছ
থেকে রাজস্ব আদায় করে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ চিরস্থায়ীভাবে সরকারকে প্রদান করবেন। কৃষক
প্রজাদের সঙ্গে জমিদারদের সম্পর্কহয়ে যায় নিপীড়নমূলক। কারণ রাজস্ব আদায়ের জন্য জমিদারগণ
প্রজাদের উপর নির্যাতন করার, বল প্রয়োগ করার এমনকি তাদেরকে উচ্ছেদ করার অধিকার প্রাপ্ত ছিলেন।
জমিদার ও তার এজেন্টদের নির্মম অত্যাচার, রাজস্বের চাপ, ঋণের বোঝা ও তত্ত¡াবধানের অভাবে কৃষি
উৎপাদন ব্যাহত হয়। প্রায় প্রতি বৎসর দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তবে বৃটিশ শাসক গোষ্ঠী তাদের
সমর্থক একটি স্বার্থ গোষ্ঠী হিসেবে জমিদারগণের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসন সংহত করে।
জমিদারী ব্যবস্থায় বর্গাচাষীদের নিরাপত্তা ও করের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট না থাকায় তারা ক্ষতিগ্রস্তহয়। বিভিন্ন
অঞ্চলে বর্গাচাষীগণ চাষের শর্তাবলী সংস্কার করার জন্য দাবী জানাতে থাকেন। এই প্রেক্ষিতে বিভিন্ন
আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বর্গাচাষীদের ১২ বৎসর পর্যন্তজমি চাষের অধিকার প্রদান করা হয়। জমিদারদের
অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উত্থাপিত হওয়ায় ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী জমিদারী প্রথার
কার্যকারিতা নিয়ে পরীক্ষা চালায়। ১৯৪০ সালে ফ্লাউড কমিশন জমিদারী প্রথা বিলোপের জন্য সুপারিশ
করে। বর্গাচাষীদের তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালে একটি খসড়া আইনে ভাগচাষীদের
ফসলের দুই তৃতীয়াংশ অধিকার প্রদান করা হয়। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি।
পাকিস্তান রাষ্ট্র পতিষ্ঠার পর ১৯৫০ সালে পূর্ব বাংলার জমিদারী দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হয়। এই
আইনে জমিদারের মালিকানা বাতিল করে কৃষকের ভ‚মি মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। জমিদারের খাজনা
আদায়ের অধিকার বাতিল করে রাষ্ট্রের খাজনা আদায়ের অধিকার চালু হয়, যাতে কৃষকগণ সরাসরি রাষ্ট্রের
প্রজায় পরিণত হন। পরিবার প্রতি ১০০ বিঘা (৩৩.৩ একর) আবাদী জমি ও বসত ভিটার জন্য সর্বোচ্চ
১০ বিঘা জমি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। এর অতিরিক্ত জমি সরকারী মালিকানায় চলে যাবে বলে ঘোষিত
হয়। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভ‚মি কেবল তাদের নিজেদের মধ্যে হস্তান্তর করা যাবে। সকল হাট, বাজার,
জলমহাল সরকারী মালিকানায় চালে আসে। মাটির নীচের সম্পদে ব্যক্তি মালিকানা রহিত করা হয়। কোন
জমির বাৎসরিক ফসলের এক দশমাংশ খাজনা হিসেবে ধার্য করা হয়। জমি খন্ডিতকরণের উপর নিষেধাজ্ঞা
জারী হয় এইভাবে যে কোন জমি এত ক্ষুদ্র হতে পারবে না যার খাজনা এক টাকার কম হয়। সিলেট
অঞ্চলে নানকার নামে এক ধরনের ভ‚মিদাস ব্যবস্থা চালু ছিল যার ফলে কৃষককে মালিকের জমিতে বেগার
খাটতে হতো। এই আইনে তা বাতিল করা হয়। অর্থের বিনিময়ে জমি ভাড়া দেয়া বাতিল করা হয়।
বর্গাচাষকে মজুরী শ্রম দিয়ে চাষের সমতুল্য বিবেচনা করা হয়। ঔপনিবেশিক শাসনামলে বর্গাচাষীদের
ফসলের দুই তৃতীয়াংশ পাওয়ার যে দাবী উত্থাপিত হয়েছিল, ১৯৫০ এর আইনে সে বিষয়ে কোন কিছুর
উল্লেখ নেই। পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৬১ সালে ভ‚মির মালিকানা সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা থেকে বাড়িয়ে ৩৭৫
বিঘা করা হয়।
১৯৫০ সালের আইনের কেবল জমিদারী প্রথা বিলোপের বিষয়টি কার্যকর হয়। প্রথমে ১০০ বিঘা ও
পরবর্তীতে ৩৭৫ বিঘা পর্যন্তজমির মালিকানা স্থির করার ক্ষেত্রে প্রচুর প্রশাসনিক দুর্নীতি ও জোতদারদের
ঔপনিবেশিক শাসনামলে
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে
স্বাধীন কৃষকগণ জমিদারের
উপর নির্ভরশীল প্রজায়
পরিণত হন।
পাকিস্তান শাসনামলে
জমিদারী প্রথা বিলোপ হয়।
কৃষকগণ সরাসরি রাষ্ট্রের
প্রজায় পরিণত হন।
জালিয়াতি হওয়ায় এটি সঠিক ভাবে কার্যকর করা যায় নি। ১৯৪৭ সালে চাষাবাদকৃত মোট জমির কেবল
১% জমি উদ্বৃত্ত হিসেবে পাওয়া যায়। এই উদ্ধারকৃত জমির অধিকাংশ (৬০%) চাষাবাদ যোগ্য নয়।
উদ্ধারকৃত জমি ভ‚মিহীন পরিবার প্রতি ০.৩২ একর হিসেবে বন্টন করা হয়। সরকারী খাস জমি বন্টনের
ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়। ভারত থেকে আগত মুসলমান
উদ্বাস্তুদের জমি প্রদানের জন্য ময়মনসিংহে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা
হয়। খাস জমি পাওয়ার জন্য সরকারকে মোটা অঙ্কের অর্থ ‘সেলামী’ হিসেবে দিতে গ্রাহকগণ বাধ্য থাকেন।
আইনে যদিও উল্লেখ আছে যে কেবলমাত্র কৃষকগণই জমির মালিক হতে পারবেন, এতে অনুপস্থিত
ভ‚স্বামীদের জমি থেকে উৎখাত করা সম্ভব হয় নি। প্রকৃতপক্ষে জোতদারগণ জমিদারদের স্থলাভিষিক্ত হন
এবং তাদের অনুকরণে কায়িক শ্রম বর্জন করেন ও বর্গাচাষীদের সঙ্গে প্রজার ন্যায় আচরণ শুরু করেন।
জমি খন্ডিতকরণের উপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তাও কার্যত বাতিল করা হয়। সর্বোপরি উৎপাদন সম্পর্কে
কোন প্রকার পরিবর্তন আনতে এই ভ‚মি সংস্কার ব্যর্থ হওয়ায় উৎপাদন শক্তি উন্নীত হয় নি এবং কৃষি
উৎপাদনে স্থবিরতা বহাল থাকে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ভ‚মি সংস্কার পদক্ষেপ গৃহীত হয়। এই আইনে সকল বকেয়া
খাজনা সুদসহ মওকুফ করা হয় এবং ২৫ বিঘা পর্যন্তজমির মালিকদের খাজনা মওকুফ করা হয়। খাস
জমি কেবল ভ‚মিহীনদের মধ্যে সালামী ছাড়া বন্টনের সিদ্ধান্তগৃহীত হয়। নদীতে জেগে উঠা চর জমির
উপর নদীর পাড়ের মালিকদের অধিকার বিলোপ করে সকল চর এলাকার জমি সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনা
হয়। পূর্বে খাই খালাসী, বন্ধকী ঋণ কেবল ১৫ বৎসরের জন্য করার যে সিদ্ধান্তছিল তা শিথিল করে ৭
বৎসর করা হয়। মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ঋণ গ্রহীতা আবেদন করে ৭ বৎসরের পূর্বেও মহাজনের
কাছ থেকে জমি ছাড়ানোর সুযোগ করা হয়। পূর্বে হাট বাজার ইজারা দেওয়ার যে ব্যবস্থা ছিল তা বাতিল
করা হয়। এর পরিবর্তে ব্যবসায়ী ও সরকারী কর্মকর্তা সমন্বয়ে পরিচালনা কমিটির কাছে হাট বাজার
পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। ভ‚মি সংস্কার আইন বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় তা কার্যকর
করার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। সরকারের ভ‚মি রাজস্ব বিভাগ কর আদায়ে সর্বাধিক গাফলতি করেন
ও দুর্নীতির আশ্রয় নেন। ২৫ বিঘা পর্যন্তকর মওকুফ হওয়ায় ধনী কৃষকগণ কাগজপত্রে নাম বদল করে
কর ফাঁকি দেওয়ার ও মওকুফ পাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
১৯৮৩ সালে ভ‚মি সংস্কারের জন্য কমিটি গঠিত হয়, কিন্তু তা অকার্যকর হয়। ভ‚মি সংস্কারের উপর জনমত
গ্রহণের সিদ্ধান্তও কার্যকর হয় নি। ১৯৮১ সালে জমির আইল তুলে দেবার উদ্যোগ নেয়া হয় কিন্তু
পরবর্তীতে তা বাতিল হয়ে যায়। ১৯৮৪ সালে ভ‚মি সংস্কার আইন ও বিধিবলে খাস জমি পুনরুদ্ধার করে
ভ‚মিহীনদের মধ্যে বন্টনের ব্যবস্থা নেয়া হয়। এটি ছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে খাস জমিতে গুচ্ছগ্রাম প্রতিষ্ঠা
করে ভ‚মিহীন পরিবারকে পুনর্বাসিত করার কার্যক্রম।
প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশে ভ‚মি সংস্কারের ঐতিহাসিক পটভ‚মি থেকে দেখা যায় যে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কিছু উদ্যোগ
গ্রহণ করা হলেও স্বাধীনতার পর কোন উল্লেখযোগ্য সংস্কার নীতি গৃহীত হয় নি। পঞ্চাশের দশকে জমিদারী
প্রথা বিলোপের মাধ্যমে ভ‚মি থেকে বিচ্ছিন্ন অথচ ভ‚মি খাজনা আত্বসাৎকারী শ্রেণীকে উচ্ছেদ করা হয়।
একই উদ্দেশ্যে এই নীতিও গৃহীত হয় যে, ভ‚মি কেবল কৃষকের জন্য যারা নিজেরা চাষাবাদ করেন। কিন্তু
ধনী জোতদার যারা বর্গাচাষের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত ভোগ করেন ও অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়
করে সম্পদ বৃদ্ধি করেন, তাদেরকে ভ‚মি থেকে উৎখাত করা সম্ভব হয় নি। ভ‚মি মালিকদের ভ‚মির পরিমাণ
ঘোষণা দেয়ার জন্য প্রচুর সময় দেয়া হয়। প্রশাসনের ধীরগতির সুযোগ গ্রহণ করে ভ‚মি মালিকগণ জাল
কাগজপত্র তৈরী করার সুযোগ পান। অন্যদিকে ১৯৪৭ সালে তেভাগা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ভাগ
চাষের শর্ত পরিবর্তন করে ফসলের এক তৃতীয়াংশ জমির মালিককে ফসলের খাজনা দেবার যে সুপারিশ
করা হয়েছিল তা এখনো পর্যন্তআইনে পরিণত হয় নি। তার অর্থ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শাসক গোষ্ঠী
ধনী কৃষকের শ্রেণী স্বার্থ রক্ষায় যতটা আগ্রহী দরিদ্র কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে ততটা আগ্রহী নন। মাটির
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর
২৫ বিঘা পর্যন্তজমির
মালিকদের খাজনা মওকুফ
করা হয়।
নীচের সম্পদ যেমন খনিজ সম্পদের মালিকানা রাষ্ট্রের, এই নীতির কার্যকারিতা দেখা যায় গভীর নলকুপের
পানির মালিকানা সমবায়ের উপর ন্যস্তহওয়া থেকে। ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর জমি তাদের মালিকানায় রাখার
নীতি প্রণীত হলেও সরকার তা ভঙ্গ করেন। প্রথমত মুসলমান উদ্বাস্তুদের ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর জমিতে
পুনর্বাসন করা হয়। সিলেটের খাই খালাসীদের ভ‚মিদাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য আইন প্রণীত হলেও চা
বাগানের চা শ্রমিকদের শ্রমবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য আইন প্রণীত হয় নি।
ভ‚মি সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণবিষয়
গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাজমান উৎপাদন পদ্ধতি ও উৎপাদন সম্পর্কথেকে ভ‚মি সংস্কারের প্রশ্নে নি¤েœ
উপস্থাপিত বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত: জমির মালিকানার প্রশ্ন। পূর্বের দুটি পাঠের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে অসম বন্টন
ব্যবস্থার কারণে অল্প সংখ্যক ধনী শ্রেণীর হাতে মোট জমির অর্ধেকের বেশী কেন্দ্রীভ‚ত হয়ে আছে। শুধু
তাই নয়, ধনী শ্রেণীর হাতে উৎপাদনের উপকরণ ও অর্থেরও পুঞ্জীভবন থাকায় এবং উৎপাদন সম্পর্কে
নিপীড়নমূলক অবস্থা বিরাজ করায় জমি কেন্দ্রীভবনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জোতের মালিকগণ
দারিদ্র ও ক্ষমতাশালীদের দাপটের কারণে জমি হারাচ্ছেন। এতে জমির মালিকানার অসম অবস্থা মেরুকরণ
ঘটাচ্ছে। এই অবস্থা নিরসনের জন্য অনেকে ভ‚মি সংস্কার করে সিলিং ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনী শ্রেণীর হাত
থেকে জমি নিয়ে ভ‚মিহীনদের মধ্যে বিতরণের সুপারিশ করে থাকেন। সিলিং বা জমির উচ্চ সীমা বেধে
দিলেই কৃষি উৎপাদনে স্থবিরতার সমাধান হবে না। সিলিং বেধে জমি বন্টন করলে আরো অসংখ্য ক্ষুদ্র
জোতের সৃষ্টি হবে। আর দেখা যায় যে ক্ষুদ্র জোতে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ সম্ভব নয়। বড় আয়তনের
জোত গুলিতে ট্রাক্টর দিয়ে চাষ ও আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ সম্ভব। ফলে একটি সমাধান হতে পারে জমির
সিলিং না করে বড় জোত গুলিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এতে দরিদ্র কৃষকগণও
মজুরী শ্রমিক হিসেবে উপকৃত হবেন। আরেকটা সমাধান হতে পারে সিলিং বেধে জমির মালিককে
ক্ষতিপূরণ দিয়ে উদ্বৃত্ত জমি ভ‚মিহীনদের প্রদান করে ভ‚মিহীন সমবায় সমিতির মাধ্যমে চাষাবাদ করা।
এতে জমির খন্ডিতকরণ বন্ধ করা যাবে।
দ্বিতীয়ত: ভ‚মি মালিকানার একক ক্ষুদ্র হওয়ার প্রশ্ন। ক্ষুদ্রজোতের মালিকদের পুঁজির অভাবের দরূন কৃষি
উপকরণ সংগ্রহ করে ঠিকমত জমিতে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। স্বল্প আয়ের দরূন আধুনিক যন্ত্রপাতি
ব্যবহার করাও সহজ নয়। এক্ষেত্রে উৎপাদন শক্তির বৃদ্ধি ঘটে না। উৎপাদন ব্যাহত হয়। পুঁজিবাদী
ব্যবস্থার ভ‚মি সংস্কারের লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষুদ্র উৎপাদনের পরিবর্তে বৃহৎ উৎপাদন চালু করা। তাছাড়া ক্ষুদ্র জমি
মালিকদের জমি হারানোর প্রক্রিয়া জারি রেখে দরিদ্র কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নও সহজ নয়। ভ‚মি সংস্কারের
মাধ্যমে ক্ষুদ্র জোতগুলি একত্রিত করে সমবায় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করলে জমিতে অধিক উৎপাদনের অবস্থা
সৃষ্টি হয়। তাছাড়া দরিদ্র কৃষকদের উন্নত কৃষি উপকরণ ও সেচের ব্যবস্থাও সমবায়ের মাধ্যমে ব্যাংক ঋণ
গ্রহণ করে করা সম্ভব হতে পারে।
তৃতীয়ত: একই মালিকের জমি বিভিন্ন স্থানে বিস্তৃত থাকার প্রশ্ন। অনেক সময় দেখা যায় যে ধনী কৃষকের
প্রচুর জমি বিস্তৃত অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে থাকে। এমতাবস্থায় ধনী কৃষক বর্গাচাষের
ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এতে ধনী কৃষকের খাজনা আদায় হলেও উৎপাদন কম হয়। ভ‚মি সংস্কার করে জমি
একত্রীকরণ করা প্রয়োজন। ১৯৬১-৬২ সালে এরকম একটি উদ্যোগ গৃহীত হয় দিনাজপুরের দেবীগঞ্জে
(আলমগীর ১৯৮১)২ । ১৭৫ মাইল আয়তনে বিস্তৃত ২,৯৪,৫৭৬টি খন্ডিত ভ‚মি একত্রীকরণ প্রক্রিয়ায়
১,০৩,২০৯টি খন্ড জমিতে আনা হয়। এতে প্রায় ৪০০ একর বাড়তি জমি পাওয়া যায় যা পূর্বে জমির
আইল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কঅপরিবর্তিত থাকায় এবং ব্যবস্থাপনা দুর্বল
হওয়ায় এই উদ্যোগটি সাফল্য অর্জন করে নি।


অষধসমরৎ গক, “ঞড়ধিৎফং খড়হফ জবভড়ৎস রহ ইধহমষধফবংয “রহ অষধসমরৎ গক (বফ) খধহফ
জবভড়ৎসং রহ ইধহমষধফবংয, ঈঝঝ, উযধশধ টহরাবৎংরঃু, ১৯৮১.
ভ‚মি সংস্কারের একটি
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জমির
মালিকানা। অসম বন্টন
ব্যবস্থার ফলে অল্প সংখ্যাক
ধনী শ্রেণীর হাতে অধিক
জমি কেন্দ্রীভ‚ত হচ্ছে।
চতুর্থত: অনুপস্থিত ভ‚মি মালিক শ্রেণীর প্রশ্ন। ধনী শ্রেণীর কৃষকগণ উচ্চমর্যাদার প্রতীক হিসেবে নিজেরা
জমিতে কায়িক শ্রম নিয়োগ করেন না। অধিকাংশ ধনী শ্রেণীর জমির মালিক বর্গাচাষ করেন অথবা মজুরী
শ্রমিক নিয়োগ করে চাষাবাদ তত্ত¡াবধান করেন। এতে দেখা যায় যে ধনী শ্রেণীর হাতে বিপুল পরিমাণ জমি
পুঞ্জীভ‚ত থাকায় বিপুল পরিমাণ জমিতে উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। কারণ বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কে দরিদ্র
বর্গাচাষীকে চাষাবাদের জন্য সকল ব্যয়ভার বহন করতে হয়। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য অতিরিক্ত
উৎপাদন ব্যয় ও উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ সম্ভব হয় না। অন্য দিকে ধনী কৃষক খাজনা ব্যতীত কোন ব্যয় না
করে অর্ধেক ফসল পেয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। এটি তাদের অনুপার্জিত আয়। ধনী কৃষকগণের জমির উৎপাদনের
দিকে মনোযোগী হতে দেখা যায় না। কারণ ঋণের ব্যবসা, মহাজনী, বাজারে নানাবিধ ব্যবসা, প্রশাসনের
সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে কৃষি উপকরণের ব্যবসা ও ঠিকাদারী ইত্যাদিতে তাদের প্রচুর মুনাফা আসে।
কৃষির উদ্বৃত্ত ও মুনাফা তারা আরো জমি ক্রয় করার জন্য ব্যয় করতে আগ্রহী হন। এই শ্রেণীর অনেকে
আবার গ্রামেও থাকেন না। তারা শহরে বসবাস করেন। এই ধনী শ্রেণী যারা জমির উৎপাদনে নিজেরা
অংশগ্রহণ করেন না তারা কৃষিতে উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার জন্য দায়ী। ভ‚মি সংস্কারের লক্ষ্য হতে পারে
অনুপস্থিত ভ‚মি মালিকদের উচ্ছেদ করা। ধনী শ্রেণীর জমি মালিকগণের মধ্যে যারা নিজেরা চাষাবাদ
করবেন অথবা মজুরী শ্রমিক নিয়োগ করে চাষাবাদ করবেন এবং নিজেরা তত্ত¡াবধান করবেন কেবল তাদের
হাতেই জমির মালিকানা থাকতে পারে। তাদেরকে কৃষি উৎপাদনে বাধ্য করা হলে উৎপাদন শক্তির পূর্ণ
ব্যবহার নিশ্চিত হবে। অনুপস্থিত ভ‚মি মালিকগণের মধ্যে যারা নিজেরা চাষাবাদ করতে চাইবেন না তাদের
জমি গ্রহণ করে সরকার ভ‚মিহীনদের সমবায়ের মাধ্যমে চাষাবাদের ব্যবস্থা করতে পারে।
পঞ্চমত: উৎপাদন সম্পর্কের বর্গাচাষ সমস্যা। বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কে বর্গাচাষ অনুৎপাদনশীল। কারণ
বর্গাচাষের প্রচলিত শর্তানুযায়ী ফসলের অর্ধেক জমির মালিককে প্রদান করায় বর্গাচাষীর লাভ হয় না।
তাছাড়া মালিক বীজ, সার, সেচ ইত্যাদির ব্যয় বহন না করায় বর্গাচাষীর উপর অর্থনৈতিক ব্যয়ের চাপ
অত্যধিক। ব্যয়ভার বহন করার পর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল হানি হলে বর্গাচাষী মারাত্বক দুরবস্থায়
পড়েন। মালিক পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের কোন ব্যবস্থা নেই। উপরন্তু বর্গাচাষের মাধ্যমে ধনীকৃষকগণ
বর্গাচাষীর উপর অর্থনীতি বহিভর্‚ত রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করেন। ভ‚মি সংস্কারের উদ্দেশ্য হতে পারে
বর্গাচাষের শর্তাবলী সংস্কার করে তেভাগা আন্দোলনের দাবী অনুযায়ী ফসল খাজনা এক তৃতীয়াংশ করা।
ভ‚মির মালিককে উৎপাদন ব্যয়ে অংশীদার হওয়ার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। অন্য দিকে বর্গাচাষ
অলাভজনক হওয়ায় এবং এর মাধ্যমে ধনী শ্রেণীর নির্যাতন নিপীড়ন অব্যাহত থাকায় এই ব্যবস্থার বিলুপ্তি
ঘটানো যেতে পারে। ক্ষতিপূরণ প্রদানের পর বর্গাচাষের বিলুপ্তি ঘটিয়ে জমি মালিককে চাষাবাদ করতে
বাধ্য করা যেতে পারে। অথবা বর্গাচাষীদের সমবায় গঠন করে জমি চাষাবাদের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
ষষ্ঠত: মজুরী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরীর প্রশ্ন। বিদ্যমান ব্যবস্থায় ধনী কৃষকগণ একচেটিয়াভাবে নিæ মজুরী
প্রদান করে শ্রম শোষণ করেন। ভ‚মি সংস্কারের মাধ্যমে জমির মালিকানা ও উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তিত
হলে উৎপাদনী শক্তি বৃদ্ধি পাবে। ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বহাল রেখে মজুরী
শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরী বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। ভ‚মি সংস্কারের মাধ্যমে মজুরী শ্রমিকদের নিæতম মজুরী
আইনত নির্ধারণ করে দেয়া আবশ্যক। অ-কৃষিখাতে কর্মসংস্থানের জন্য গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান
গড়ে তোলা দরকার। কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে শিল্পের সংযোগ ঘটলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি
কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
সপ্তমত: কৃষি উপকরণ ও মূলধনের প্রশ্ন। বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কে ধনী শ্রেণী ঋণের ব্যবসা ও প্রশাসনের
যোগসাজশে কৃষি উপকরণ আত্বসাৎ করার মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার করেন। ভ‚মি সংস্কারের লক্ষ্য হতে
পারে পুঁজি, বীজ, সার, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচের পানি ইত্যাদি প্রাপ্তিতে ভ‚মিহীন সমবায়গুলিকে
অগ্রাধিকার প্রদান করা। এ ব্যাপারে সরকারী প্রশাসন ও ব্যাংকের কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয়
আইন করা যেতে পারে। অন্য দিকে ভ‚মিহীন সমবায় গুলির রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এবং
যোগাযোগ স্থাপনে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কর্মসূচী গ্রহণের প্রয়োজন আছে।
ভ‚মি সংস্কারের একটি
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুপস্থিত
ভ‚মি মালিক শ্রেণীর উৎখাত।
ভ‚মি সংস্কারের মাধ্যমেবর্গাচাষের শর্ত পরিবতবর্গাচাষীর পক্ষে আইনপ্রয়োজন।
অষ্টমত: বাজার বিকাশের প্রশ্ন। বর্তমানে দেখা যায় যে বাজারের উপর ধনী শ্রেণীর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ
প্রতিষ্ঠিত। মধ্যস্বত্বভোগী ও ফড়িয়াদের জন্য দরিদ্র কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত
হন। অধিকাংশ সময় অল্প মূল্যে দরিদ্র কৃষকগণ গ্রামের ভিতরেই ধনী কৃষকগণের কাছে ফসল বিক্রি করে
দেন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিকে অবাধ ও নিশ্চিত করতে হলে বাজার ব্যবস্থা উন্নত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে
বাজারে দরিদ্র কৃষকদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা দরকার। উৎপাদিত পণ্যের মূল্য হাসিল হলেই কৃষক
অধিক উৎপাদনের জন্য উৎপাদনী শক্তি প্রয়োগ করতে উৎসাহিত হবেন। ভ‚মি সংস্কারের লক্ষ্য হতে পারে
প্রয়োজনীয় অবকাঠামো যেমন রাস্তা, যানবাহন ইত্যাদি উন্নত করা। মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের উৎখাত
করা প্রয়োজন।
নবমত: খাস জমির প্রশ্ন। রাষ্ট্র অনেক জমির মালিক যা অব্যবহৃত আছে। অনেকে মনে করেন এসব খাস
জমিতে ভ‚মিহীনদের পুনর্বাসন করলেই ভুমিহীনদের সমস্যা নিরসন হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডে জমি বিতরণ
করলে খন্ডিত জমির অনুৎপাদনশীলতার প্রশ্ন থেকেই যাবে। ভ‚মি সংস্কারের লক্ষ্য হতে পারে ভ‚মিহীন
সমবায় গঠন করে খাস জমি বরাদ্দ করা। সেই সঙ্গে ভ‚মিহীন সমবায়কে সহজ শর্তে কৃষি উপকরণ ও পুঁজি
সরবরাহ করা। রাষ্ট্রের মালিকানায় অনেক হাওর ও জলমহাল আছে। এগুলিতে পূর্বে ভ‚মিহীন দরিদ্র
কৃষকগণ বিনামূল্যে মাছ সংগ্রহ করতে পারতেন। কিন্তু ইজারা দেওয়ার ব্যবস্থা করায় এসবের উপর ধনী
কৃষকদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভ‚মি সংস্কারের লক্ষ্য হতে পারে এইসব রাষ্ট্রীয় সম্পদে ভ‚মিহীনদের
অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। বনাঞ্চলও রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আছে। বনাঞ্চলের উপর অর্থনৈতিকভাবে বহু মানুষ
নির্ভরশীল। বনের প্রাকৃতিক উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে বনে বসবাসকারী মানুষের সুসমন্বয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
বনের সঙ্গে সম্পর্কপ্রতিষ্ঠা করে যে সকল মানুষ বেঁচে থাকেন তাদের উৎখাত করার পরিবর্তে ভ‚মি
সংস্কারের মাধ্যমে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। বর্তমানে সামাজিক বনায়নের নামে ও বনের
বাণিজ্যিকীকরণের নামে বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ভ‚মি সংস্কারের লক্ষ্য হতে পারে বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ
রক্ষা করা।
সারাংশ
ভ‚মি সংস্কারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণহচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রশ্ন। ভ‚মি সংস্কারে উৎপাদনের উপায় ও
উৎপাদন সম্পর্কদুটোকে সার্বিকভাবে বিবেচনা করতে হবে। অধিকাংশ সময় ছোট ছোট পরিবর্তন আনা
হয়। মূল সমস্যায় আলোকপাত করা হয় না। কৃষি উৎপাদনের আমূল পরিবর্তন ভ‚মি সংস্কারের লক্ষ্য
হওয়া বাঞ্ছনীয়। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। প্রশাসনিক কাঠামোকে পরিবর্তন করে গণমুখী
করা আবশ্যক। ক্ষমতাশালী শাসক গোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
এ কারণে বাংলাদেশের কোন সরকারকে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা
যায় নি। বাংলাদেশে ভ‚মিহীনদের মধ্যে জমি বন্টনের চেয়েও বড় প্রয়োজন, যে প্রক্রিয়ায় কৃষক ভ‚মিহীন
হন সে প্রক্রিয়া বন্ধ করা। ভ‚মি সংস্কারের মূল লক্ষ্য তাই হওয়া উচিত।
খাসজমি, জলমহাল ও
বনাঞ্চলে দরিদ্র মানুষের
অধিকার প্রতিষ্ঠা করা
প্রয়োজন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন -
১। কত সালে তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে জমির মালিককে এক তৃতীয়াংশ ফসলের খাজনা
দেবার সুপারিশ করা হয়?
ক. ১৯৪০ সালে
খ. ১৯৪৭ সালে
গ. ১৯৪৩ সালে
ঘ. ১৯৫০ সালে
২। পাকিস্তানী শাসনামলে একজন জমির মালিক আইনত সর্বোচ্চ কত জমির মালিক হতে পারতেন?
ক. ১০০ বিঘা
খ. ২৫ বিঘা
গ. ৩৭৫ বিঘা
ঘ. ৩০০ বিঘা
৩। বাংলাদেশে কত বিঘা পর্যন্তজমির খাজনা মওকুফ করা হয়?
ক. ১০০ বিঘা
খ. ৩০ বিঘা
গ. ২৫ বিঘা
ঘ. ৭৫ বিঘা
৪। বাংলাদেশে কোথায় জমির আইল তুলে দিয়ে জমি একত্রীকরণের উদ্যোগ গৃহীত হয়?
ক. কুমিল্লার কোতোয়ালীতে
খ. ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়
গ. রাজশাহীর পুটিয়ায়
ঘ. দিনাজপুরের দেবীগঞ্জে
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ভ‚মি সংস্কারে কৃষি অর্থনীতির কোন কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত?
২। বাংলাদেশে ভ‚মি সংস্কারের গুরুত্ব কি?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। পাকিস্তানী শাসনামলে ও বাংলাদেশে ভ‚মি সংস্কারের কি কি পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে? এসব
সংস্কারের সীমাবদ্ধতা কি?
২। ভ‚মি সংস্কারের মাধ্যমে কিভাবে কৃষি অর্থনীতির সার্বিক সংস্কার সাধন করা যায়? আলোচনা
করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]