পদ মর্যাদা সোপান বলতে কি বোঝায়?
মর্যাদা ভিত্তিক স্তর বিন্যাসের সঙ্গে শ্রেণীর সম্পর্ককিরূপ?

পদমর্যাদা সোপান - সাধারণত অ-ইউরোপীয় ও প্রাক পুঁজিবাদী সমাজের স্তর বিন্যাসের আলোচনায় পদ
সোপানিক সমাজের কথা উল্লেখ করা হয়। এ ধরনের সমাজে মর্যাদার ভিত্তিতে স্তর ভাগ করা হয়। মর্যাদা
গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত হয় তাদের বিশেষ ধরনের জীবন রীতি দ্বারা। সাধারণত প্রতিটি মর্যাদা গোষ্ঠী
তাদের সামাজিক যোগাযোগ নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন। মার্ক্স অর্থনৈতিক স্তর বিভাজনের উপর
জোর দেন। পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদনের উপায় ও সম্পদে মানুষের প্রবেশাধিকার নির্ণয় করে তাদের
সামাজিক স্তর। ম্যাক্স ওয়েবার অর্থনৈতিক সম্পতির বাইরে সামাজিক সম্মান (যড়হড়ঁৎ) প্রাপ্তির উপর
জোর দেন। তার মতে অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাজনের চেয়ে মর্যাদা ভিত্তিক পদ সোপান ভিন্ন। কারণ সম্পদ
অবধারিত ভাবে মর্যাদা অর্জনের গুণ নয়। তবে শেষ পর্যন্তঅর্থনৈতিক ক্ষমতা ও মর্যাদা একত্রে মিলে
যায়। আবার মর্যাদা ভিত্তিক স্তর বিন্যাসে কোন মর্যাদা গোষ্ঠী কর্তৃক সম্পদের পাহাড় জড়ো করে অন্য
গোষ্ঠীকে শোষণ করা হয় না। ম্যাক্স ওয়েবারের মতে প্রাক শিল্পযুগে কোন কোন গোষ্ঠী সামাজিক মর্যাদা
ও স্বতন্ত্রজীবনধারা ভোগ করেন। এবং সমাজে তাদের অবস্থান সম্পর্কে তারা সচেতন। সম্মানের প্রশ্নে
উচু-নীচু বিভক্ত গোষ্ঠী গুলিই মর্যাদা গোষ্ঠী।
উপমহাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বর্ণ প্রথা চালু আছে তা মর্যাদাভিত্তিক পদ সোপানের উদাহরণ।
পরবর্তী পাঠে বর্ণ প্রথা নিয়ে আলোচনা করা হবে। বর্তমান পাঠে বাঙ্গালী মুসলমান সমাজে মর্যাদা ভিত্তিক
স্তরবিন্যাস নিয়ে আলোচনা করা হলো।
বাঙ্গালী মুসলমান সমাজে পদমর্যাদা ভিত্তিক স্তর : ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট - অনেকের ধারণা মুসলমান
সমাজে কোন স্তর বিন্যাস নেই, কারণ ইসলাম ধর্ম সমতা ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শ প্রচার করে।
উপমহাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে চারটি পদমর্যাদা ভিত্তিক সামাজিক স্তর আছে। যেমন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,
বৈশ্য ও শুদ্র। এ স্তর বিন্যাস ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত এবং পবিত্র -অপবিত্র ধারণা দ্বারা প্রভাবিত।
মুসলমান সমাজে ঠিক এ ধরনের পদ মর্যাদা ভিত্তিক স্তর নেই। তবে মুসলমান সমাজে ভিন্ন ধরনের
সামাজিক মর্যাদার স্তর আছে। এ পদ মর্যাদার স্তর হিন্দু বর্ণ প্রথার মত নয়। ঔপনিবেশিক শাসনের পূর্ব
থেকে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে চারটি মর্যাদা ভিত্তিক স্তর ছিল বলে ধারণা করা হয়।এগুলি হচ্ছে
সৈয়দ, শেখ, মোঘল ও পাঠান। সৈয়দগণ দাবী করেন যে তারা হযরত মোহাম্মাদ (সঃ) এর বংশের এবং
শেখগণ হযরত আলী (রাঃ) এর বংশের উত্তরাধিকারী। উচ্চবংশীয় হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়ে শেখ উপাধি
ধারণ করেন বলেও বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। নি¤œবর্ণের হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়ে মোঘল ও পাঠান
স্তরভুক্ত হন। এই চারটি স্তরভুক্ত মর্যাদা গোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ ছিল এবং আন্তগোষ্ঠী বিয়েও
হতো। এই সঞ্চালনের ফলে স্তর বিন্যাস হিন্দুবর্ণ প্রথার ন্যায় অনমনীয় বিভক্তিকরণের রূপ লাভ করে নি।
মর্যাদা ভিত্তিক স্তরবিন্যাসে
একেকটি স্তরে একেকটি
মর্যাদাগোষ্ঠীর অবস্থান
থাকে। সম্মানের প্রশ্নে
উচু-নীচু বিভক্ত
গোষ্ঠীগুলোই মর্যাদা
গোষ্ঠী।
ঔপনিবেশিক শাসনের পূর্ব
থেকে উপমহাদেশের
মুসলমানদের মধ্যে চারটি
মর্যাদা ভিত্তিক স্তর ছিল
বলে ধারণা করা
হয়।এগুলি হচ্ছে সৈয়দ,
শেখ, মোঘল ও পাঠান।
মুসলমান সমাজে চারটি মর্যাদা স্তরে সামাজিক সচলতার প্রচলন ছিল। এদের মধ্যে শুচি-অশুচির ধারণা
কাজ করে নি। সামাজিক মর্যাদা বিভাজনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসনও ছিল না।
গবেষণা থেকে দেখা যায় যে উপমহাদেশের উপরোক্ত চারটি মর্যাদার স্তর বাংলা অঞ্চলে তেমন প্রভাব
ফেলেনি। ১৮৭২ ও ১৮৯১ সালের আদমশুমারীতে বাংলা অঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন পদবীধারী
ও পেশা বিভক্ত সামাজিক স্তরের উল্লেখ আছে। পদবীগুলির মধ্যে ছিল - গাজী, খান, মীর, মোঘল,
পাঠান, সরদার, সৈয়দ ও শেখ। পেশাদার দলগুলি ছিল- দরজী, ধোপা, ধুনিয়া, ফকির, হাজম, জোলা,
কুলু, কারিগর, চূনকার ও কাহারী। ১৯০১ সনের আদমশুমারীতে বাঙ্গালী মুসলমান সমাজের তিনটি স্তরের
উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলি হচ্ছে আশরাফ বা উচ্চ শ্রেণী, আতরাফ বা নি¤œশ্রেণী ও আজলাফ বা পতিত
শ্রেণী। এই তিন স্তরের মধ্যে আরো উপ স্তরের সন্ধান পাওয়া যায়। আশরাফদের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে
অবস্থান যথাক্রমে সৈয়দের পর শেখ, মোঘল ও পাঠানের। আতরাফ ও আরজাল স্তরে অন্তত পঞ্চাশটির
মত পেশাগত দল ছিল বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন। ১৯২১ সনের আদমশুমারীতে উল্লেখ করা হয়েছে
যে পেশাদার শ্রেণীর মধ্যে বেহারা, জোলা, কুলু, নিকারী বর্গ সমূহের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে
শুমারিতে উল্লেখ করা হয় যে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে পাঠান, সৈয়দ, ও শেখদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
উনিশ শতক পর্যন্তবাংলা অঞ্চলে মুসলমান সমাজে উচ্চ মর্যাদা ভুক্ত ছিলেন আশরাফগণ যারা প্রধানত:
আরব, ইরান ও আফগানিস্তান থেকে আসা মুসলমানদের উত্তরসূরী। এই মর্যাদা গোষ্ঠীর প্রধান বৈশিষ্ট ছিল
এই যে তারা কায়িক শ্রমে নিয়োজিত হওয়া থেকে বিরত থাকতেন এবং লাঙ্গল দিয়ে নিজেরা চাষাবাদ
করতেন না। এরা বিত্তবানও ছিলেন। যারা কায়িক শ্রম করেন এবং দরিদ্র তাদের প্রতি আশরাফ
মর্যাদাভুক্তদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নেতিবাচক। সমাজে অনেক ক্ষুদ্র পেশাজীবী ছিলেন যারা মূলত উত্তরাধিকার
সূত্রে পেশায় নিয়োজিত হতেন। তার মানে বাবার পেশা পুত্র গ্রহণ করতেন। হিন্দু সম্প্রদায়েও এই সব
পেশাজীবীদের মর্যাদা কম ছিল। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর মুসলমান সমাজেও এদের মর্যাদা পরিবর্তিত হয়
নি। এরা হচ্ছেন আতরাফ যেমন তাঁতী, জোলা, তেলী, নাপিত, দর্জি ধোপা ইত্যাদি। সর্বনি¤œস্তরে ছিলেন
আজলাফগণ তাদেরকে মনে করা হতো নোংরা। তারা নোংরা কাজ করতেন। যেমন মেথর, ময়লা
পরিষ্কারকারী, বেদিয়া ইত্যাদি। তাদের সঙ্গে আশরাফ ও আতরাফ স্তরের মানুষজন মেলামেশা করতেন
না।
ঔপনিবেশিক শাসনমালে পাশ্চাত্যের শিক্ষা ব্যবস্থার আলোকে উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করা
হয়। প্রশাসনিক কাঠামোকে ঢেলে সাজানো হয়। বৃটিশ শাসনের পূর্ব পর্যন্তউচ্চ মর্যাদাভুক্তগণ জমির সঙ্গে
যুক্ত থেকে এবং প্রশাসক হিসেবে সম্মানজনক অবস্থানে ছিলেন। কিন্তু বৃটিশ শাসনামলে মুসলমানগণ
রাজনৈতিক ক্ষমতা হারান। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমির সঙ্গে যুক্ত থেকেও তারা লাভবান হতে
অপারগ হন। অন্য দিকে বৃটিশদের চালু করা শিক্ষা, ব্যবসায় ও চাকুরীর সঙ্গে যুক্ত একটি ন‚তন মর্যাদার
স্তর সৃষ্টি হয়। তারা এই পরিবর্তিত অবস্থায় নিজেদের পেশা বদল করে সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন করতে
সক্ষম হন। তারা উচ্চ মর্যাদার প্রতীক হিসেবে নূতন নূতন পদবী গ্রহণ করেন। উচ্চ মর্যাদাশালীদের সঙ্গে
এই নতুন মর্যাদাশালীদের বৈবাহিক সম্পর্কপ্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে মুসলমানদের সামাজিক স্তর বিন্যাসে
রদবদল ঘটে। মুসলমানদের এই সামাজিক স্তরীকরণের পরিবর্তনশীলতার কারণেই সম্ভবত একটি প্রবাদের
জন্ম হয়, যা বর্তমানেও অর্থবহ। “গত বছর আমি ছিলাম জোলা, এবার হয়েছি শেখ; তবে সামনের বছর
যদি মূল্য বৃদ্ধি পায় আমি সৈয়দে পরিণত হব’’।
উপনিবেশ উত্তরকালে পাকিস্তান সরকার ১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করে যার ফলে বাংলাদেশ
থেকে হিন্দু জমিদার ও জোতদারগণ দেশ ত্যাগ করেন। উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুদের ভারতে চলে যাওয়ার কারণে
সে স্থানগুলি মুসলমান বড় জোতদারদের দ্বারা পূরণ হয়। উচ্চ শ্রেণীর জোতদার উচ্চ মর্যাদার অধিকারী
হন। তারা উচ্চ মর্যাদার পদবী গ্রহণ করেন। এতদ্ব্যতীত নূতন রাষ্ট্রে প্রশাসনিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রচুর
বাঙ্গালী মুলমানদের মধ্যে
তিনটি মর্যাদাভিত্তিক
স্তরের উল্লেখ পাওয়া যায়।
আশরাফ বা উচ্চ শ্রেণী,
আতরাফ বা নি¤œ শ্রেণী,
আজলাফ বা পতিত
শ্রেণী।
কর্মের সুযোগ সৃষ্টি হয়। চাকুরী, শিক্ষা, শহরে বসবাস বাঙ্গালী মুসলমানগণের জন্য মর্যাদা অর্জনের
পরিসর সম্প্রসারিত করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অবাঙ্গালীদের পাকিস্তান গমনের ফলে
পুনরায় একই ধরনের সুযোগ বৃদ্ধি পায়। পেশা ও অর্থনৈতিক অবস্থা বদলের সঙ্গে সঙ্গে মর্যাদা সূচক পদবী
বদল করা গ্রামাঞ্চলে পরিচিত পরিবেশে সহজ নয়। শহরে অভিবাসনের মাধ্যমে পদবী বদল করা
তুলনামূলকভাবে সহজ।
বাঙ্গালী মুসলমান সমাজে মর্যাদা ভিত্তিক স্তর বিন্যাসের ধরন
বাংলাদেশে মুসলমান সমাজে সাধারণত উচ্চবংশ, মধ্যবংশ ও নি¤œবংশ এই তিন ধরনের মর্যাদাভিত্তিক
স্তর নির্ণয় করা হয়ে থাকে। বংশ মর্যাদা মুসলিম স্তর বিন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বংশ মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত
অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি, আচার ব্যবহার , আদব কায়দা, জীবন-যাপন পদ্ধতি, শিক্ষা, পেশা এবং ধর্ম ও
সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলা ইত্যাদি। বংশ মর্যাদা এক প্রজন্মে অর্জন করা যায় না। কয়েক প্রজন্ম
একই ধরনের মর্যাদার অধিকারী হলেই বংশ মর্যাদা স্বীকৃত হয়। পূর্ব পুরুষের বংশমর্যাদাকে উৎস হিসেবে
ধরে নিয়ে গোষ্ঠীর সকলে মর্যাদাবান হতে পারেন। কিন্তু গোষ্ঠীর কেউ খুব দরিদ্র হয়ে গেলে গোষ্ঠীর অন্যান্য
বিত্তবান ও মর্যাদাবানদের সঙ্গে সর্বক্ষণ লেগে থেকে তারা মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে সমর্থ হন। একটি গোষ্ঠীও
বংশ মর্যাদা হারাতে পারে যদি সে গোষ্ঠীর জমিজমা ও সম্পদ কমে যায়। নতুন প্রজন্মও উচ্চবংশের ধারা
সৃষ্টি করতে পারে অর্থবিত্ত অর্জন, সম্মানজনক পেশাগ্রহণ ও জীবনযাত্রায় নৈতিকতা ও শালীনতা আনয়নের
মাধ্যমে। এ ধরনের নতুন বংশের মর্যাদা পুরাতন বংশের চেয়ে কম। নতুন ও পুরাতন বংশ মর্যাদার মধ্যে
পার্থক্য করা হয়। বংশধারা সৃষ্টির একটি উপায় হচ্ছে উচ্চবংশের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কস্থাপন। এতে
নি¤œবংশের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় কিন্তু উচ্চবংশের মর্যাদা হ্রাস পায়।
বংশ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন পদবী গ্রহণের রেওয়াজ আছে। নামের সঙ্গে
পদবীর ব্যবহার প্রতীকী গুরুত্ব বহন করে। পদবীটি ব্যক্তির মর্যাদার স্তর নির্দেশক। এসব পদবী
পৈত্রিকসূত্রে (ঢ়ধঃৎড়হুসরপ) প্রাপ্ত। যে পূর্ব পুরুষের সূত্র ধরে বংশ ও গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে তার পদবী
গোষ্ঠীভুক্ত সকলে ব্যবহার করেন। লক্ষণীয় যে বাংলাদেশে সকলের নামের সঙ্গে পদবী নেই। যে সকল
ব্যক্তির নামের সঙ্গে পদবী নেই তারা পদবীহীন বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন। তারা সাধারণ মুসলমান।
গ্রামাঞ্চলে তাদের মর্যাদা স্তর ‘গৃহস্থ’ হিসেবে ধরা হয়। উচ্চ মর্যাদাশীল ‘খান্দান’ দের নীচে তাদের স্থান।
নৃবিজ্ঞানীগণ বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে গবেষণা করে মুসলমানদের মর্যাদা ভিত্তিক স্তর চিহ্নিত করেছেন
(বারতোচি ১৯৯৫, আরেফিন ১৯৮৪)১ ।
এখানে কয়েকটি মর্যাদা নির্দেশক পদবী নিয়ে আলোচনা করা হলো।
উচ্চমর্যাদা : মোঘল আমলে যারা রাজস্ব সংগ্রহ করতেন তাদেরকে ‘মজুমদার’ পদবী দেয়া হতো। সেই
থেকে মজুমদার পদবীটি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ে জমি নিয়ন্ত্রণ ও হিসাব রক্ষণের পেশার সঙ্গে যুক্ত
হয়ে গেছে। মোঘল আমলে যারা জমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকতেন তাদেরকে ‘চৌধুরী’ পদবী দেয়া হয়।
চৌধুরী পদবীটিও হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ‘ভ‚ইয়া’ পদবীটিও মোঘল আমল
থেকে ভ‚মির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত। ‘মহিষান’ পদবীটি বৃহৎ এলাকার জমির মালিকের সঙ্গে যুক্ত। ধারণা
করা হয় যে মহিষানগণ গরুর ব্যবসা করতেন বলে তাদের বড় জমির প্রয়োজন হতো গরু চরানোর জন্য।

১ ইবৎঃড়পপর চবঃবৎ, “ঈড়সসঁহরঃু ঝঃৎঁপঃঁৎব ধহফ ঝড়পরধষ জধহশ রহ ঞড়ি ঠরষষধমবং রহ ইধহমষধফবংয”,
রহ ঞঘ গধফধহ (বফ) গঁংষরস ঈড়সসঁহরঃরবং ড়ভ ঝড়ঁঃয অংরধ, টচখ, উযধশধ, ১৯৯৫.
আরেফিন হেলালউদ্দীন খান, “বাংলাদেশের মুসলিম স্তরবিন্যাসের ধারা”, সমাজ নিরীক্ষণ, সংখ্যা ১৪, সমাজ নিরীক্ষণ
কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৪।
বংশ মর্যাদা মুসলিম স্তর
বিন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ
উপাদান।
মজুমদার, চৌধুরী,ইত্যাদি উচ্চ মর্যাদনির্দেশক পদবী।
‘কাজী’ পদবীটি অর্পন করা হতো স্থানীয় পর্যায়ে বিচারকদের উপর যারা প্রধানত বিবাহ রেজিষ্ট্রিকরণের
কাজ করতেন। ‘কেরানী’, ‘মুহুরী’ এই পদবীগুলি সরকারের রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের বেলা প্রযোজ্য
হতো। কিন্তু কেরানী ও মুহুরী পদবী নামের সঙ্গে ব্যবহৃত হয় না। তবে বাড়ী চিহ্নিত করার সময় যেমন,
‘কেরানী বাড়ী’, ‘মুহুরী বাড়ী’ ব্যবহৃত হয়। ‘খন্দকার’ পদবীটি ধর্মীয় নেতার উপাধি যারা পারস্য থেকে
ধর্ম প্রচারের জন্য উপমহাদেশে এসেছিলেন। পারস্য দেশে খন্দকারগণ ছেলেদের খৎনা দেবার কাজ
করতেন। এ কাজটি বাংলাদেশে নি¤œমর্যাদার। কিন্তু খন্দকারগণের ধর্ম প্রচারের কাজকে অধিক গুরুত্ব
প্রদান করে পদবীটি উচ্চ মর্যাদার পদবীতে পরিণত হয়েছে। ‘মওলানা’ পদবীটি তাদেরকে দেয়া হয় যারা
ধর্মীয় পড়াশোনা করেছেন, ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান রাখেন এবং মসজিদে নামাজ পড়ান। সাধারণ মৌলভীদের
থেকে মওলানার মর্যাদা উঁচু। ‘ফারায়জী’ পদবীটি দেয়া হয় তাদেরকে যারা ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইসলামের
সংস্কার ও শ্রেণী শোষণ বিরোধী ফারায়জী আন্দোলন করেছিলেন। সাধারণত নামের সঙ্গে এটি ব্যবহৃত
হয় না কিন্তু বাড়ী ও গোষ্ঠী চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
এধরনের আরো কয়েকটি পদবী হচ্ছে- জোয়ারদার, প্রামানিক, পাটোয়ারী, তালুকদার, খান, দেওয়ান
ইত্যাদি।
মধ্যম মর্যাদা : সাধারণত ‘শেখ’ উপাধীধারীগণ মধ্যবংশের মর্যাদাভুক্ত। যতদূর জানা যায় যাদের পূর্ব
পুরুষের পদবী ছিল না অথচ অর্থবিত্ত ও মর্যাদা অর্জন করেছেন তারা ঢালাও ভাবে শেখ উপাধী গ্রহণ
করেন। বর্তমান কালেও যাদের নামে পদবী নেই তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলে তারা নিজেদেরকে ‘শেখ’
বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। ‘ইমাম’ পদবীটি ধারণ করেন ধার্মিক ব্যক্তিগণ যারা মসজিদে নামাজ পড়ান
এবং ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলেন। ‘মাষ্টার’ পদবীটি সফল শিক্ষকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
পূর্ব পুরুষ শিক্ষকতায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে থাকলে পৈত্রিক সূত্রে অনেকে এ পদবীটি ব্যবহার
করেন। ‘মোল্লা’, ‘মৌলভী’ এ পদবীগুলি ধার্মিক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা ধর্ম বিষয়ে পড়াশোনা
করেছেন ও সমাজে ধর্ম চর্চা করেন। ‘কবিরাজ’ পদবীটি স্থানীয় ও লোকজ চিকিৎসায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের
সম্মানজনক পদবী। ‘বেপারী’ পদবীটি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত এবং পৈত্রিকসূত্রে ব্যবহার করা হয়।
নি¤œমর্যাদা : হিন্দু সম্প্রদায়ে ‘অপরিষ্কার’ (ফবভরষরহম) কাজের সঙ্গে জড়িত থাকায় অনেক মানুষকে
‘অপবিত্র’ (ঢ়ড়ষষঁঃরহম) বলে বিবেচনা করা হয়। হিন্দু স্তর বিন্যাসে তাদের স্থান নীচু। দেখা যায় যে তারা
নানা ধরনের কাজে দক্ষতা অর্জন করেন এবং সেবা (ংবৎারপব) প্রদান করেন। বাংলাদেশে এসব পেশায়
বহু হিন্দু এখনো নিয়োজিত আছেন। অনেক মুসলমানও এসব পেশা গ্রহণ করেছেন যাদেরকে মুসলিম স্তর
বিন্যাসে নি¤œবংশ ধরা হয়। পেশাদার এসব দলের মধ্যে আছেন- দরজী, ধোপা, ধুনিয়া, ফকির, হাজম,
জোলা, কুলু, কারিগর, চূনকার, কাহারী, নিকারী, তেলী, নাপিত, কসাই, বাড্ডি (চোখের শৈল্য
চিকিৎসক), জেলে, কামার, সূতার ইত্যাদি।
এ সকল পেশাদারী দলের সঙ্গে উচ্চ ও মধ্য বংশীয় দলের সামাজিক দূরত্ব অনেক বেশী।
অর্থনৈতিকভাবেও এসব পেশাদারীগণ দুর্বল। প্রতিদিন এসব পেশার মানুষজনের সঙ্গে উচ্চ ও মধ্য বংশের
মানুষজনের সেবা প্রদান ও গ্রহণের জন্য যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সামাজিকভাবে পেশাজীবীগণ
অধস্তন বলে বিবেচিত। তবে এই অধস্তনতা হিন্দু সমাজের কাঠামোগত উর্ধতন -অধস্তনের রূপ লাভ করে
নি। কারণ তারা বিচ্ছিন্ন ভাবে বিভিন্ন গ্রামে অন্যান্য স্তরের মানুষজনের সঙ্গে বসবাস করেন। পার্থক্য স্পষ্ট
হয়ে উঠে বৈবাহিক সম্পর্কের প্রশ্নে। উচ্চ ও মধ্য বংশীয়দের সঙ্গে নি¤œস্তরের পেশাজীবীদের বৈবাহিক
সম্পর্কধর্মীয় ভাবে নিষিদ্ধ না হলেও সামাজিক ভাবে নিষিদ্ধ। হিন্দু স্তর বিন্যাসের সঙ্গে পার্থক্য এই যে
মুসলমান সমাজে নিষিদ্ধ হলেও বৈবাহিক সম্পর্কহতে পারে। এমন বিয়ে হলে উঁচু বংশের ছেলে বা মেয়ে
সম্মান হারাবে এবং তার গোষ্ঠী মর্যাদাহীন হয়ে পড়বে। নি¤œস্তরের পেশাজীবিদের সঙ্গে উচ্চ ও মধ্য বংশের
মানুষজন একত্রে খাওয়া দাওয়া করা থেকেও বিরত থাকেন। পেশাজীবী দলের বৈবাহিক সম্পর্কনিজ
যাদের পূর্ব পুরুষের পদবী
ছিল না তারা অর্থবিত্ত ও
মর্যাদা অর্জনের পর
ঢালাওভাবে ‘শেখ’ উপাধি
ধারণ করেন।
অপরিস্কার কাজের সংগে
জড়িতদের নি¤œবংশ ধরা
হয়।
দলের সঙ্গে হয়। যেমন তাঁতীদের বিয়ে তাঁতীদের সঙ্গে, নাপিতের বিয়ে নাপিতের সঙ্গে ইত্যাদি। বলা
যায় নি¤œবংশের এইসব পেশাজীবী দলগুলি অন্ত:বিবাহ (বহফড়মধসু) রীতি অনুসরণ করে থাকেন।
উল্লেখ্য যে এসব পেশাধারীগণ শহরে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে
পারেন। এর সঙ্গে সঙ্গে তাদের সামাজিক মর্যাদাও পরিবর্তন করতে পারেন। যেমন শহরে লন্ড্রি (ধোপা),
সেলুন ও পারলার (নাপিত) এসব ব্যবসা লাভজনক। শহরের এসব ব্যবসায়ী উচ্চ বংশের সঙ্গে বৈবাহিক
সম্পর্কস্থাপন করে মর্যাদার স্তর উন্নীত করতে পারেন।
নি¤œতম মর্যাদা অচ্ছুৎ দল (ঁহঃড়ঁপযধনষবং) : মুসলিম স্তর বিন্যাসে ‘নোংরা’ বলে বিবেচিত কাজের
সঙ্গে যুক্তদের মর্যাদা নেই বললেই চলে। যেমন মেথর, ময়লা পরিষ্কারকারী, জুতা সেলাই ও পরিষ্কারকারী।
এই স্তরের মানুষজনের সেবা গ্রহণ করলেও উচ্চ ও মধ্য বংশের মানুষজন তাদের সঙ্গে ওঠাবসা, খাওয়া
দাওয়া, বিবাহ সর্বপ্রকার সম্পর্কস্থাপন থেকে বিরত থাকেন। অনেকে কোন কারণে তাদের সংম্পর্শে
আসলে গোসল করে পবিত্র হতে চান। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ থেকে মানব সম্পদ রপ্তানীর কর্মসূচীতে যে
সকল মানুষ বিদেশে যান তাদের অনেকেই বিদেশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন। বাংলাদেশ থেকে
যাওয়ার সময়ও পষবধহবৎ হিসেবে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। বিদেশে কাজ করে অর্থ উপার্জন করার পর
এইসব পষবধহবৎ দের পরিবার সম্পদ বৃদ্ধির কারণে মর্যাদা উন্নীত করতে সক্ষম হন।
মর্যাদার স্তর বিন্যাস ও শ্রেণী সম্পর্ক
বাংলাদেশে মুসলিম মর্যাদার স্তর ও শ্রেণীকে কখনো পৃথক মনে হতে পারে। যেমন বৈবাহিক সম্পর্ক
স্থাপনের সময় অনেক উচ্চ মর্যাদাশীল বংশ শ্রেণীগত অবস্থান মাঝারী হলেও মর্যাদার কারণে বৈবাহিক
সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। কিন্তু সাধারণভাবে এটি ধরে নেয়া হয় যে অর্থনৈতিকভাবে ধনী মানে
বংশগতভাবেও মর্যাদাশীল। দারিদ্র এবং অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় মর্যাদার চেয়ে অর্থনৈতিক অবস্থানকেই
বৈবাহিক সম্পর্কে অগ্রাধিকার দেবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। গ্রামবাসীরাও এধরনের মন্তব্য করে থাকেন
“আজকাল যার ধন দৌলতের অবস্থা ভালো তার বংশ মর্যাদাও ভালো” (বারভোচি ১৯৭০)২ ।
লক্ষণীয় যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও বংশ মর্যাদা মিলে সামাজিক অবস্থান সৃষ্টি হয়; কেবল সম্পদ অথবা কেবল
মর্যাদা নয়। ‘খান্দান’ বা উচ্চ মর্যাদা রক্ষার জন্য যা করতে হয় তার মধ্যে মর্যাদাশালীদের ভাষা, খাওয়া
দাওয়ার ধরন, অতিথি আপ্যায়নের ধরন, পোশাক, বাড়ীঘর ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। উচ্চ মর্যাদা মানে ‘ইজ্জত’
রক্ষা করা। ‘ইজ্জত’ এর সঙ্গে আর্থিক সামর্থ জড়িত। জাহাঙ্গীরের (১৯৭৯)৩ মতে ইজ্জত রক্ষার জন্য যা
করণীয় তা হচ্ছে- পরিবারের ‘খাওয়া পরা’র নিশ্চয়তা; পরিবারের নারীদের ‘পর্দা’ রক্ষা; বাইরের
অতিথিদের জন্য পৃথক ‘কাচারী ঘর’; বাড়ীর নারীদের গোসলের জন্য নিজস্ব পুকুর। সুতরাং ইজ্জত রক্ষার
জন্য অর্থের প্রয়োজন। ধনী শ্রেণী ইজ্জত রক্ষার জন্য এসব প্রতীকী ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। দরিদ্র শ্রেণীর
পরিবারে অতিথির জন্য পৃথক ঘর রাখা কিংবা নারীদের বাইরে যাওয়া বন্ধ করা সম্ভব নয়। সুতরাং
মর্যাদাশীল দরিদ্র পরিবারের ইজ্জত রক্ষা করাও সম্ভব নয়। তার অর্থ সম্মান ও মর্যাদা অর্জন ও রক্ষা করার
জন্য যে সকল দ্রব্য ও সেবা ক্রয়ের ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, তা ধনী শ্রেণীর আছে। এভাবে ‘মর্যাদা’ ও
‘বিত্ত’ একই শ্রেণীর হাতে পুঞ্জীভ‚ত হচ্ছে। আবার মর্যাদা অর্জনের জন্য সম্পদের বাইরে কিছু আচরণ বিধি

২ ইবৎঃড়পপর চবঃবৎ, ঊষঁংরাব ঠরষষধমবং: ঝড়পরধষ ঝঃৎঁপঃঁৎব ধহফ ঈড়সসঁহরঃু ঙৎমধহরুধঃরড়হ রহ
জঁৎধষ ঊধংঃ চধশরংঃধহ, ঁহঢ়ঁনষরংযবফ চয. উ. উরংংবৎঃধঃরড়হ, গরপযরমধহ ঝঃধঃব টহরাবৎংরঃু,
১৯৭০

ঔধযধহমরৎ ইক, উরভভবৎবহঃরধঃরড়হ, চড়ষধৎরুধঃরড়হ ধহফ ঈড়হভৎড়হঃধঃরড়হ রহ জঁৎধষ ইধহমষধফবংয,
ঈঝঝ, উযধশধ টহরাবৎংরঃু, ১৯৭৯.
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও বংশ
মর্যাদা মিলে সমাজিক
অবস্থান সৃষ্টি হয়।
ও আদব কায়দার ব্যাপার আছে। এসব আচার আচরণ ধনী শ্রেণীর পক্ষেই পালন করা সম্ভব। দরিদ্র
ক্ষেতমজুর বা শ্রমিক শ্রেণী এসব আচরণ বিধি পালন করে রুজি রোজগারের সংগ্রাম করতে সক্ষম হন না।
গ্রামাঞ্চলে কৃষক সমাজে মর্যাদার ভিত্তিতে সাধারণত তিনটি স্তর দেখা যায় ‘খান্দান’ ‘গৃহস্থ’ ও ‘কামলা’
(চৌধুরী ১৯৭৮)৪ । এসকল মর্যাদা স্তরের মধ্যে মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গী, আচার আচরণ, জীবন যাপন পদ্ধতি
পৃথক। আবার এ মর্যাদা দলগুলির জমির মালিকানা, সম্পদ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও পৃথক। খান্দানদের
বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা দীর্ঘকাল যাবত জমির মালিক এবং তারা ধনী কৃষক। তারা জমিতে নিজেরা কাজ
করেন না; চাষাবাদ তদারকী করেন। তারা জমি চাষ বর্গাদার কিংবা কামলাদের দিয়ে করান। তারাই
অধিক মাত্রায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করছেন এবং বিভিন্ন অ-কৃষি পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন। গৃহস্তরা
অল্প জমির মালিক এবং অল্প কিছুদিন পূর্বে জমির মালিক হয়েছেন। তারা নিজেরা জমিতে চাষাবাদ
করেন। কামলারা ভ‚মিহীন ক্ষেতমজুর। এই মর্যাদার স্তরের সঙ্গে গ্রামাঞ্চলের শ্রেণী পৃথকীকরণের মিল
আছে। ‘খান্দান’ মর্যাদার অধিকাংশ ধনী কৃষক। গৃহস্থগণ মাঝারী ও নি¤œশ্রেণীর কৃষক। কামলারা দরিদ্র
মজুরী শ্রমিক।
শহরাঞ্চলে মর্যাদার স্তর নির্ধারণে শিক্ষা ও চাকুরীর গুরুত্ব অনেক। গ্রামাঞ্চলে কৃষকের বেলা কে কত আগে
থেকে জমির মালিক তা মর্যাদার নির্দেশক। শহরে কে কত আগে থেকে শিক্ষিত ও উচ্চ বেতনের বা
সম্মানজনক চাকুরী করছেন তা মর্যাদা নিরূপণ করে থাকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মর্যাদার জন্য আরো
প্রয়োজনীয় হচ্ছে ভোগের অধিকার। বাজারে ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে কার কত বেশী সামর্থ আছে তা দিয়ে মর্যাদা
নির্ধারিত হয়। যেমন উচ্চ মর্যাদাশালীগণ বিলাসবহুল বাড়ী কিংবা এপার্টমেন্টে থাকেন, বেশী দামের
গাড়ীতে চড়েন, খাবার দাবার, পোশাক উচ্চমূল্যে ক্রয় করেন, ঘন ঘন বিদেশে যাতায়াত করেন, বিদেশে
বিয়ের বাজার করেন ইত্যাদি। শিক্ষার ক্ষেত্রেও দেখা যায় উচ্চ মর্যাদাশালীরা তাদের সন্তানদের প্রাইভেট
বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশী অর্থ ব্যয় করে পড়ান কিংবা বিদেশে পড়ান। তার মানে উচ্চবিত্তরাই উচ্চ মর্যাদার
অধিকারী হয়ে থাকেন। আবার তারাই মর্যাদার মাপকাঠি বিত্ত দ্বারা নির্ধারণ করেন।

৪ ঈযড়ফিঁৎু অ, অ ইধহমষধফবংয ঠরষষধমব. অ ংঃঁফু ড়ভ ঝড়পরধষ ঝঃৎধঃরভরপধঃরড়হ, ঈঝঝ, উযধশধ
টহরাবৎংরঃু, ১৯৭৮.
গ্রামাঞ্চলে কে কত আগে
থেকে জমির মালিক তা
মর্যাদার নির্দেশক। শহরে
কে কত আগে থেকে
শিক্ষিত ও উচ্চ বেতনের
চাকুরী করছেন তা
মর্যাদার নির্দেশক।
বাঙালী মুসলমানদের মর্যাদার স্তর বিন্যাস মুসলমানদের আশরাফ-আজলাফ বর্গকরণের মতাদর্শ দ্বারা
প্রভাবিত হয়েছে। সর্বোপরি ইসলাম ধর্মের সমতার মতাদর্শের প্রভাবে মর্যাদার স্তরগুলি ‘আনুভ‚মিক ঐক্য’
(যড়ৎরুড়হঃধষ ংড়ষরফধৎরঃু) স্থাপন করেছে। এই স্তরবিন্যাস উল্লম্ব(াবৎঃরপধষ) স্তরে পরিণত হতে পারে
নি যদিও আশরাফ ও আজলাফের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান বিদ্যমান। এ কারণে মুসলমান সমাজকে একটি
সমপ্রকৃতির (যড়সড়মবহড়ঁং) সমাজ বলে প্রতীয়মান হয়।
বাঙালী মুসলমানদের মর্যাদার স্তর বিন্যাসে হিন্দু বর্ণপ্রথার অনেক উপাদান বিদ্যমান। যেমন উঁচু-নীচু
প্রভেদ, অন্তঃবিবাহ এবং পেশাভিত্তিক শ্রেণী। তবু মুসলমানদের মর্যাদার স্তরগুলিকে হিন্দু বর্ণ প্রথার অনুরূপ
বলা যায় না। কারণ হিন্দু বর্ণ প্রথার প্রতিটি স্তর বৃত্তিমূলক পদ, ধর্মীয় অনুশাসনের সঙ্গে যুক্ত, শুচি-অশুচির
ধারণা প্রকট, উল্লম্ব আকারে স্তরীকৃত এবং স্তরগুলির মধ্যে প্রথাগত সঞ্চালন নেই। তবে বাস্তবে এই
বর্ণপ্রথার অনেক পরিবর্তন ঘটছে।
মুসলিম স্তর বিন্যাসের ভিত্তি হচ্ছে বংশ মর্যাদা বা শরাফতী। এ বংশ মর্যাদা অনেক ক্ষেত্রেই কাল্পনিক।
মুসলিম স্তর বিন্যাসে সচলতা লক্ষণীয়। সম্প্রদায় পর্যায়ে মর্যাদার স্তরসমূহে পার্থক্য রক্ষা করা হয়। তবে
অনেক ক্ষেত্রে তা নমনীয়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে উচ্চ মর্যাদাশীল ও ধনী শ্রেণীর মধ্যে যোগাযোগ ও বৈবাহিক
সম্পর্কপ্রতিষ্ঠিত হয়। উচ্চ মর্যাদাশীল পরিবার অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র হয়ে গেলে মর্যাদা হ্রাস পায় এবং
অনেকে মর্যাদার প্রতীক পদবী ছেড়ে দেন। অন্য দিকে অর্থবিত্ত ও সম্পত্তির মালিকানা লাভ করে অনেকে
উচ্চ মর্যাদাশীল বলে দাবী করেন এবং পদবী ধারণ করেন।
মুসলিম স্তর বিন্যাসে ধনসম্পদ ও জমির মালিকানা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। অর্থনৈতিক অবস্থা
পরিবর্তন করে মর্যাদার অবস্থান পরিবর্তন করা যায়।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক() চিহ্ন দিন।
১। পদমর্যাদা ভিত্তিতে স্তর গুলির পার্থক্য কি ভাবে বেশী বোঝা যায়?
ক. ব্যবসায়ের সম্পর্কদ্বারা
খ. বৈবাহিক সম্পর্কের ধরন দ্বারা
গ. শিক্ষা দ্বারা
ঘ. অর্থ ও সম্পদ দ্বারা
২। আশরাফগণ নিজেদেরকে কাদের উত্তরসূরী বলে মনে করেন?
ক. কৃষক সমাজ থেকে ধর্মান্তরিতদের
খ. ভারতীয় ব্যবসায়ী শ্রেণীর ধর্মান্তরিতদের
গ. ভারতীয় ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় থেকে ধর্মান্তরিতদের
ঘ. আরব-ইরান-আফগানিস্তান থেকে আসা মুসলমানদের
৩। বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে যাদের নামের শেষে পদবী নেই তারা কোন স্তরভ‚ক্ত?
ক. খান্দান
খ. গৃহস্ত
গ. আশরাফ
ঘ. আজলাফ
৪। বাঙ্গালী মুসলমানদের পদমর্যাদা ভিত্তিক স্তর বিন্যাসে কোনটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান?
ক. ধর্মীয় চর্চা
খ. শিক্ষা
গ. সম্পদের মালিকানা
ঘ. বংশ মর্যাদা
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। পদ মর্যাদা সোপান বলতে কি বোঝায়?
২। মর্যাদা ভিত্তিক স্তর বিন্যাসের সঙ্গে শ্রেণীর সম্পর্ককিরূপ?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। বাঙ্গালী মুসলমান সমাজের পদমর্যাদা ভিত্তিক স্তর কি হিন্দু বর্ণপ্রথা দ্বারা প্রভাবিত?
২। বাঙ্গালী মুসলমানদের পদমর্যাদা স্তর বিন্যাসের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]