পাহাড়পুরের অবস্থান ও উৎপত্তি পাহাড়পুরের গুরুত্বপূর্ণ প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে

মুখ্য শব্দ পাহাড়পুর, প্রতœসামগ্রী, সোমপুর বিহার, ¯œানঘাট, মন্দির, সত্যপিরের ভিটা।
বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতœতাত্তি¡ক দর্শনীয় স্থানের নাম পাহাড়পুর। বৌদ্ধ সংস্কৃতির উৎকর্ষের নিদর্শন
হিসেবে পাহাড়পুরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এটি জাতিসংঘের ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব সাংস্কৃতিক
ঐতিহ্যের অংশ। ভারতবর্ষে এতবড় বৌদ্ধ বিহার এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। উৎপত্তিগত দিক থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলের এ
সভ্যতা ময়নামতির সমসাময়িক। নি¤েœ পাহাড়পুরের প্রতœতাত্তি¡ক পরিচিতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
অবস্থান: বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে অবিস্থত নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলায় পাহাড়পুরের অবস্থান। নওগাঁ জেলাসদর
থেকে পাহাড়পুরের দূরত্ব ৩৪ কিলোমিটার। নওগাঁ এবং জয়পুরহাট থেকে পাকা সড়কে পাহাড়পুর যাতায়াত করা যায়।
জামালগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে পাহাড়পুরের দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার।
উৎপত্তি ও নামকরণ: পাল রাজত্বের প্রথম ভাগে ৮ম শতকের শেষভাগে পাহাড়পুরের বিখ্যাত মন্দির ও বিহার নির্মিত
হয়েছিল বলে জানা যায়। ৮ম ও ৯ম শতাব্দীতে পালবংশের দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাজা ধর্মপাল ও তাঁর পুত্র দেবপালদের সময়ে
বাংলাদেশে বহু বৌদ্ধবিহার ও মন্দির নির্মিত হয়। পাহাড়পুরের বৌদ্ধ ও হিন্দুসভ্যতা ৮ম থেকে ১৩শ শতক পর্যন্ত স্থায়ী
ছিল বলে অনুমান করা হয়। পাহাড়পুরের প্রধান মন্দির ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে সেই ইটের স্তূপের উপর ধূলাবালি ও মাটি
ইত্যাদি জমে কালক্রমে এক উঁচু পাহাড়ের সৃষ্টি হয়। সমতল ভ‚মি থেকে পাহাড়ের মত উঁচু হওয়ার কারণেই এ এলাকার
নামকরণ হয়েছে পাহাড়পুর।
ব্রিটিশ নাগরিক বুকানন হ্যামিল্টন ১৮০৭ এবং ১৮১২ সালে পূর্ব ভারতে প্রতœতাত্তি¡ক জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
তিনিই প্রথম পাহাড়পুরের প্রতœনিদর্শনের তথ্য প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে ওয়েস্টম্যাকট পাহাড়পুর পরিদর্শন করেন। ১৮৭৯
সালে স্যার আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম পাহাড়পুরে প্রতœতাত্তি¡ক খননকার্য পরিচালনা করেন। ১৯২৩ সালে রাজশাহীর বরেন্দ্র
অনুসন্ধান সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শরৎ কুমার রায়ের অর্থ সাহায্যে প্রতœতত্ত¡ বিভাগের সহযোগিতায় পাহাড়পুরের মূল
খননকাজ শুরু হয়। ভান্ডারকরের নেতৃত্বে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির কিছু গবেষক, প্রতœতত্ত¡বিদ
রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২৫-২৬ সালে খননকার্য পরিচালনা করেন। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৩-৩৪ সাল পর্যন্ত কে.
এন. দীক্ষিত পাহাড়পুরে খননকাজ চালান।
পাহাড়পুরের প্রধান প্রধান প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন: পাহাড়পুর মহাবিহারের আয়তন প্রায় ২৭ একর। বর্গাকৃতির আঙ্গিনার
প্রতিটি দিকের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় তিনশ গজ। মূল বিহারটি চারদিক থেকেই উঁচু প্রাচীরে ঘেরা। প্রতিটি প্রাচীরের গায়ে
ভিক্ষুগণের বসবাসের জন্য ছোট ছোট কক্ষ নির্মিত হয়েছিল। মোট ১১৭ টি কক্ষের প্রতিটির সাথেই চওড়া বারান্দা
পরিলক্ষিত হয়। পাহাড়পুরে প্রধান যেসব স্থাপনা আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে:
ক. সোমপুর বিহার: উপমহাদেশে আবিস্কৃত বিহারগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ হচ্ছে সোমপুর বিহার। উত্তর-দক্ষিণে ২৮১ মিটার
এবং পূর্ব-পশ্চিমে ২৮০ মিটার দৈর্ঘ্য। চতুর্দিকে ১৭৭টি বাসোপযোগী কক্ষ, বিস্তৃত প্রবেশপথ, অসংখ্য নিবেদন-স্তূপ, ছোট
ছোট মন্দির রয়েছে। উঁচু ঢিবিতে অবস্থিত মন্দিরের আয়তন ১০৯ মিটার বাই ৯৬ মিটার।
খ) ক. ¯œানঘাট: সোমপুর বিহারের বাইরের দেওয়াল থেকে ৪৯ মিটার দিক্ষণ-পূর্ব দিকে ¯œানঘাট অবস্থিত। ৪ মিটার প্রশস্ত
ঘাটটি ১২.৫ মিটার ঢালু। ¯œানঘাটের সিঁড়ি চুনাপাথরে বাঁধানো। রাজা মহীদলের কন্য সন্ধ্যাবতী এ ঘাটে ¯œান করতেন
বলে লোককথা প্রচলিত আছে।
গ. গন্ধেশ্বরী মন্দির: ¯œানঘাট থেকে প্রায় ১২ মিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত মন্দিরটি গন্ধেশ্বরী মন্দির নামে পরিচিত। এ
মন্দিরের ভিতরে একটি ছোট হলঘর এবং একটি ছোট কক্ষে পূজার স্থান নির্ধারিত ছিল।
ঘ. সত্যপির ভিটা: পাহাড়পুর বিহারের সীমানা প্রাচীরের ১২২ মিটার পূর্বে এ ভিটার অবস্থান। সন্ধ্যাবতীর গর্ভে ঐশ্বরিক
উপায়ে সত্যপিরের জন্ম বিষয়ে লোককাহিনী প্রচলিত আছে। সত্যপিরের নামানুসারে এ ভিটার নামকরণ হয়েছে। এর
আগে এটি তারামন্দির নামে প্রসিদ্ধ ছিল বলে জানা যায়।
পাহাড়পুরে প্রাপ্ত প্রতœসামগ্রী: প্রধান মন্দিরের চতুর্দিকে বেষ্টন করে হিন্দু দেবদেবীর ৬৩টি প্রস্তরমূর্তি রয়েছে। ধারণা করা
হয়, কোনো প্রাচীন মন্দির থেকে মূর্তিগুলো সংগ্রহ করে প্রধান মন্দিরের শোভা বর্ধন করা হয়েছে। পাহাড়পুরে ২৮০০টি
পোড়ামাটির ফলকচিত্র (টেরাকোটা) পাওয়া গেছে। এসব টেরাকোটায় শিব, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, গণেশ, সূর্য, বোধিসত্ত¡া, পদ্মপাণি,
মঞ্জশ্রী, তারা প্রভৃতি দেবদেবীর মূর্তি স্থান পেয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জীবজন্তু, ফুল-ফল, গাছপালা, সন্তানসহ জননী, স্ত্রীপুরুষ যোদ্ধা, রথারোহী তীরন্দাজ, পূজারত ব্রাহ্মণ, লাঙল-কাঁধে কৃষক ও বাদ্যযন্ত্র এসব ফলকের মূল উপজীব্য। খননের
ফলে মুসলমান যুগের অসংখ্য মুদ্রা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পাল স¤্রাট এবং বাগদাদের খলিফা হারুন-অর-রশিদের
সময়ের রৌপ্যমুদ্রাও রয়েছে। এছাড়া এখানে মাটির পাত্র, তৈজসপত্র, গেরস্থালি সামগ্রী, হাতিয়ার, গহনা, সিলমোহর,
তা¤্রলিপি ও শিলালিপি ইত্যাদি পাওয়া গেছে।
পাহাড়পুরের প্রতœসম্পদের মধ্যে তাম্রশাসন ও শিলালিপি উল্লেখযোগ্য। বিহারের বারান্দার উত্তর-পূর্ব কোণে প্রাপ্ত ১৫৯
গুপ্তাব্দের (৪৭৯ খ্রি.) তাম্রশাসনটি সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। পাহাড়পুরে প্রাপ্ত মূর্তির মধ্যে দন্ডায়মান বুদ্ধ, দন্ডায়মান উলঙ্গ
জৈনমূর্তি, রাজাসনে উপবিষ্ট ব্রোঞ্জের কুবের ও গণেশমূর্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৩শ শতাব্দের শুরুতে ইখতিয়ার
উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির উত্তরবঙ্গ দখলের সময়ে পাহাড়পুর বিহার ধ্বংস হয় বলে মনে করা হয়। এর সাথে
পৃষ্ঠপোষকতা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবও দায়ী। এ সমৃদ্ধ সভ্যতাটির আবিষ্কার এতদঞ্চলের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়
রচনা করেছে। সবশেষে বলা যায় যে, পাহাড়পুরের সভ্যতাটি একাধারে বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার নিদর্শন বহন করছে, যা
বাংলার সমাজ-ইতিহাসের তাৎপর্যময় নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়।
পাহাড়পুরে প্রাপ্ত নিদর্শনসমূহের গুরুত্ব: বাংলাদেশের প্রধান চারটি প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনের মধ্যে পাহাড়পুর অন্যতম। পাহাড়পুরে
বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার নিদর্শনসমূহের সমাজ-ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। পোড়ামাটির ফলক-চিত্রের রাজকীয় শিল্পবোধের বদলে
লোকমানসের চরিত্র অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। বাগদাদের খলিফা হারুন-অর-রশিদের একটি রৌপ্যমুদ্রা এ অঞ্চলের সাথে আরবের
বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রমাণ দেয়। পাহাড়পুরের ছোট ছোট কুঠুরিসমূহ বৌদ্ধভিক্ষুদের বসবাসের দৃষ্টান্ত হাজির করে। পাহাড়পুরে
আবিষ্কৃত প্রতœসম্পদগুলো সেসময়ের মানুষের শিল্পবোধ সম্পর্কে ধারণা দেয়।
সারসংক্ষেপ
বৃহত্তর বাংলা জনপদের আলোচিত প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনের নাম পাহাড়পুর। প্রতœতাত্তি¡ক খননকাজের মাধ্যমে আবিষ্কৃত সোমপুর
বিহার, সত্যপিরের ভিটা, ¯œানঘাট, মন্দির প্রভৃতি তৎকালীন বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির পরিচায়ক। এখানে প্রাপ্ত অন্যান প্রতœসামগ্রী
থেকে তৎকালীন সমাজ জীবন এবং অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন-৩.১
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন
১। ১৮০৭ এবং ১৮১২ সালে পূর্ব ভারতে প্রতœতাত্তি¡ক জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেন কে?
ক) স্যার আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম খ) ব্রিটিশ নাগরিক বুকানন হ্যামিল্টন
গ) শরৎ কুমার রায় ঘ) রাখাল দাস
২। পাহাড়পুরের বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির বিকাশের আনুমানিক সময়কাল কত?
ক) ৫ম থেকে ৮ম খ্রি. পূ. খ) ৭ম থেকে দ্বাদশ শতক
গ) ৯ম থেকে একাদশ শতক ঘ) ১০ম থেকে পঞ্চদশ শতক

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]